চৈত্রের দুপুর। প্রকাণ্ড শিরিষ গাছের ছায়া এসে পড়েছে টুসীদের বারান্দায়।সেই ছায়ার নিচে বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে একটা গল্প লেখার চেষ্টা চানিয়ে যাচ্ছে সে।দুটো লাইন লিখে;আবার কাটে।বিষয়টাযেন মনঃপুত হয় না তার।এখনো স্থির করতে পারছে না কিভাবে শুরু করবে।শুধু একটার পর একটা কাগজ নষ্ট করে যাচ্ছে।
‘আচ্ছা,ছাগলটাকে নিয়ে লিখলে কেমন হয়?’মনে মনে ভাবছে সে।ওর কথা মনে পড়তেই মুখটা লাজে রাঙ্গা হয়ে ওঠে।
‘ছাগলটা কি আমার মনের কথা বোঝে না?নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে?’এটা ভেবে পরক্ষ্ণণেই আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
‘ওর যা মাথা,কখনোই বুঝবে না!আচ্ছা,আমি ওকে কিভাবে বলব?ছাগল,আমি সারাজীবন তোর কাঁঠালপাতার স্পন্সর হতে চাই?হা হা হা!’ হাসতে থাকে টুসী।
ছাগলটার নাম অয়ন।টুসীর সাথেই পড়ে।এইচ।এস।সি। দিয়েছে দুজনে এবার।সেই পিচ্চিবেলা থেকে বন্ধুত্ব তাদের।একসাথে পড়েছে,খেলেছে,পা হাড় চষেছে। ক্লাসের পড়া আর খেলনা শেয়ার করতে করতে কখন যে মনের সব কথা শেয়ার করতে শুরু করেছে জানে না এদের কেউই।
সেই ছোটবেলা থেকেই পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে নতুন প্রজাতির গাছ খুঁজে বের করা টুসীর নেশা।তাদের এলাকায় কোন গাছের কি নাম,কি তাদের গুন সব মুখস্থ বলে দিতে পারে সে।বনজংগলে একা একা ঘোরা মায়ের কঠোর নিষেধ।কিন্তু কে শোনে কার কথা!অয়ন যদি কখনো বলে, ‘আন্টি দেখে ফেললে?’ সে অকপটে উত্তর দেয়, ‘দেখলে দেখবে!আমি কি আর একা ঘুরছি নাকি?তোকে দেহরক্ষক রেখেছি কি করতে?’
অত্যন্ত খাঁটি কথা।সে তো আর একা যাচ্ছে না।আর কিছু বলতে পারে না অয়ন।মেয়েটির সব কথা সে মেনে নেয় চোখ বুজে।
এদের বন্ধুত্বটা কিভাবে হল সেটিও ভাববার বিষয়।দুজনসম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের।টুসী চঞ্চলমতি,অস্থির মনা।সারাক্ষণ শুধু পটর পটর করবে।আর সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়বে নতুন কোনো গাছের সন্ধানে।অপরদিকে অয়ন শান্তশিষ্ট,চুপচ াপ ধরনের।যত কম কথা বলতে পারে,ততই যেন তার শান্তি।হ্যাঁ,না বলে প্রশ্নের জবাব শেষ করতে পারলেই সে পালিয়ে বাঁচে।তার প্রধান কাজ হল টুসীর সাথে সাথে ঘোরা আর তার কথা মনযোগ দিয়ে শোনা।শুনতে হয় কারন টুসীর ধারনা যে তার কোনো কথাই শোনে না।তাই কথা বলতে বলতে হঠাত প্রশ্ন করে বসে, ‘এতক্ষণ কি বলেছি বল।’ঠিকমত জবাব দিতে না পারলে খুব রেগে যায় সে।একবার তো এক সপ্তাহ কথা বলেনি।তখন কি যেকষ্ট হয়েছিল!তাই সে টুসীর প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শোনে।
২
‘পাগলীটা এমন কেন?’ভাবছে অয়ন।‘সেদিন বলা নেই,কওয়া নেই হঠাত বৃষ্টি নামল আকাশ ভেঙ্গে।সেই সাথে তুমুল বজ্রপাত।এই সময়ে মেয়েটা কিনা ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা মাঠের দিকে ছুটে গেল।একটা মানুষ বৃষ্টি এত ভালোবাসতে পারে!নিজের কোনো খেয়াল নেই!যদি কিছু হয়ে যেত!’
৩
টুসী এখন গল্প লেখার কথা বেমালুম ভুলে গেছে।তার অয়নের কথা ভাবতেই বেশি ভালো লাগছে।সেদিন মুভি দেখার সময় কি কাণ্ডটাই না হয়েছিল!সে চাইছিল অয়ন তার হাতটা ধরুক।কিন্তু গাধাটা এমন ফ্যালফ্যাল করে পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিল!তখন টুসী ইচ্ছে করেই তার হাতটা অয়নের হাতের খুব কাছে রাখল।কিন্তু উনার খবর নাই!নিবিষ্টমনে মুভি দেখেই যাচ্ছেন!এত্ত রাগ হল!ইচ্ছে করছিল একটা একটা করে গাধাটার চুল ছিঁড়তে।হঠাত একটা হাতের স্পর্শ তার শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বইয়ে দিয়ে গেল।অয়ন তার হাত ধরার চেষ্টা করছে।সে আড়চোখে দেখল বেচারা সংকোচ বোধ করছে।যদি টুসী রাগ করে!একটু ছুঁয়েই হাত সরিয়ে ফেলল অয়ন।
‘ধুর গাধা!আমি কি হাতটা সরিয়ে ফেলতাম নাকি!ছাগল একটা!’মনে মনে বলল টুসী।এরপর অয়নের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবে তাকে।
‘স্যরি। এত্তবড় ভুল আমার কি করে হয়ে গেল আমি নিজেই জানি না।হঠাত করে তোর হাতটা আমার হাতে এসে লাগাতে আমার কেন জানি তোর হাতটা ধরতে ইচ্ছে করল।তুই রাগ করিস নি তো?’ভয় পাওয়া গলায় বলছিল অয়ন।
সেই মুহূরতে একটু রাগ দেখিয়েছিল টুসী।কিন্তু মনে মনে তো সে খুশিই হয়েছিল।
৪
অয়ন বুঝতে পারছে না কিভাবে সে তার মনের কথা বলবে।টুসীকে তার বেশ ভয় লাগে।ও যেরকম মেয়ে,কখনো কারো প্রেমে পড়বে বলে মনে হয় না।পাছে বন্ধুত্বটাই না নষ্ট হয়ে যায়।
আজ সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে তার।
৫
রাতে টুসী তার মা-বাবার সাথে খেতে বসেছে।বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই সে চিমসে গেল।এত রেগে আছে কেন?এম্নিতেই বাবাকে বেশ ভয় পায় সে।এখন তো প্রাণটাইবের হয়ে হাতে চলে আসতে চাইছে।
খাবার টেবিলে কেউ কোনো কথা বলল না।রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় রাদিত সাহেব তার মেয়েকে ডাকলেন।
‘তোমাকে একটা ইম্পরট্যান্ট কথা বলার জন্য ডেকেছি।বস।’
‘জ্বী,আব্বু।’
‘তোমার ওই বন্ধুটার নাম কি যেন?সবসময় তোমার পেছন পেছন ঘুরঘুর করে?’
‘অয়ন।’
‘ওর সাথে তোমার মেলামেশা আমার পছন্দ না।’
টুসী চুপ করে রইল।
‘রুনুর কথা মনে আছে?’
‘জ্বী।’
টুসীর সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল ওর ফুফাতো বোন রুনু।তার ভালোবাসার মানুষটিকে পরিবার মেনে নেয়নি দেখে গোপনে বিয়ে করে তারা।সেইদিন থেকে এই পরিবারের সাথে তার সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন বাবা।
‘যদি কখনো শুনি কোনো ছেলের সাথে তোমার সম্পর্ক আছে তাহলে তোমাকে আমি ত্যাজ্য করব।এলাকায় তোমার বাবার একটা স্ট্যাটাস আছে।তোমার কারণে যেন সেটিতে কোনো দাগ না লাগে।মানুষ মুখিয়ে আছে এই পরিবারের সুনামে কলঙ্ক লেপে দিতে।তাই সবসময় সাবধানে থাকবে।’
টুসী মাথা নিচু করে সব শুনে গেল।
‘এখন যাও।’
রুমে এসে লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করল টুসী।একসাথে অনেকগুলো ভাবনা তার মাথায় চেপে বসেছে।কিছুক্ষণ এরকম থাকার পর একসময় মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল।এই সময় তার বোধ শক্তিও কাজ করছিলনা।অতীত বর্তমান ভবিষ্যত যেন এক মুহূর্তে লয় পেয়ে গিয়েছিল।কয়েক সেকেন্ড বাদেই তার বাঁ চোখ উপচে বন্ধ পাতার কোণ দিয়ে একটা অবাধ্য জলের ধারা গড়িয়ে গেল কানের দিকে।সে মোছার চেষ্টা করল না।
৬
আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে।একটা জিনিস এত্ত সুন্দর,এত্ত সুন্দর কিভাবে হয়?ভূতের মত হা করে তাকিয়ে আছে অয়ন।সে ঠিক করেছে প্রতি কৃষ্ণপক্ষের রাতে টুসীর হাত ধরে চাঁদ দেখবে।জোতস্নাস্ নান করবে।আর টুসীর কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনবে।
ঘড়ি টিকটিক করে উঠল।আর মাত্র আধা ঘন্টা সময় হাতে আছে।ঠিক ১২টা বাজলেই টুসীকে ফোন করবে সে।বলে দেবে তার ভালোবাসার কথা।ঘুম ভেঙ্গে এসব শুনে মেয়েটা কি চমকানোটাই না চমকাবে।এই প্রথমবার অস্থির হতে দেখা যায় স্থিরমনা ছেলেটিকে।
৭
টুসী জেগেই ছিল।বালিশে মুখ গুঁজে আছে সে।একটু ভালো করে লক্ষ করলেই দেখা যাবে সে কাদঁছে।নিশ্চুপে ।শুধু জল গড়িয়ে পরছে তার গাল বেয়ে।এমন সময় মোবাইলের ভাইব্রেশনটা বেজে উঠল।স্ক্রিন না দেখেই ফোনটা রিসিভ করল সে।
ওপাশ থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ বেজে উঠল, ‘হ্যালো,টুসী?’
সে কোনো জবাব দেয় না।কন্ঠটা চিনতে অসুবিধে হয়না তার।
‘কি সুন্দর জোতস্না হয়েছে দেখেছিস?দাঁড়া একটা গান শুনাই তোকে। ’ওপাশের মানুষটি তাকে কথা বলার সুযোগ দেয় না।যেন আজ শুধু তারই কথা বলার দিন।
গিটার বাজিয়ে গান শুরু হয়…যখন নিঝুম রাতে…সবকিছু চুপ…নিষ্প্রাণ নগরীতে ঝিঁঝিঁরাও ঘুম…আমি চাঁদের আলো হয়ে…তোমার কালো ঘরে জেগে রই সারা নিশি…এতটা ভালবাসি…….. .টুসী,তোকে খুব ভালোবাসি রে।’
আবেগ জড়ানো কন্ঠটা চিনতে অসুবিধা হয় না তার।কিন্তু পুরো সময়টাতেই মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না।কেউ যেনআঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে তার মুখটা।শুধু দুচোখ বেয়ে জল গড়ায়।ফোনটা কেটে দেয় টুসী।সে চায়না অয়ন তার কান্না শুনুক।
‘হ্যালো…টুসী. ..হ্যালো…ফোনট া কেটে দিল কেন?’ধাক্কা লাগে অয়নের বুকে।‘কিছু হয় নি তো আবার?নাকি ফোনটা অন্য কেউ ধরেছিল?’ টুসীর বাবার কথা মনে হতেই আতংকে জমে যায় সে।প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর ভয়ে বুকটা চিরে যেতে চায়।এত কষ্ট হচ্ছে কেন?লোনা পানির ধারা নারী-পুরুষ মানে না।
৮
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।এরই মধ্যে টুসী তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছে।তার চোখফেটে জল নামছে।নামুক।প্র তিটা মেয়েই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চোখের পানি ফেলে।
বি.দ্র.-গল্পের উপসংহারটা আমি পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।ভাবুন না আপনারা আপনাদের ইচ্ছামত!আশাবাদী হলে ধরে নিন সে সমাজের,পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করে ভালোবাসার টানে ছুটে গেছে।আর আমার মত নিরাশাবাদী হলে সমাজের কাছে তাকে মাথা নুইয়ে ভালোবাসার কাছে হেরে যেতে দিন।