সেদিনের সেই ছোট্ট পিচ্চিটার কথার কাছে হার মেনে গেলাম। ছোট্ট একটা পিচ্চি, বলে কিনা- ভাইয়া, আমি বড় হলে আমাকে আমাকে বিয়ে করবে? আমিও দুষ্টুমি করে ওকে কোলে নিয়ে বলেছিলাম- “বড় হলে কেন রে? চলো তোমাকে এখনি বিয়ে করি। তোমার আম্মুকে বলো কাজী ডাকতে।” (আমি ছোটদের সাথে তুমি করে কথা বলি)
-ভাইয়া কাজী কি?
— কেন বিয়ে করবা আর কাজীকে চেনো না।
-না তো।
-বিয়ে করার কথা কোথা থেকে শিখেছো?
-কাল টিভিতে দেখেছিলাম, ছোট্ট দুটো মানুষের বিয়ে হচ্চিলো।
-ও এবার বুঝেছি, ছয় বছরের পিচ্চি মেয়ের মাথায় বিয়ের কথা আসলো কেমন করে।
অনেক বছর আগের কথা রাত্রির তখন বয়স ৬ বছর ছিলো। আমি তখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বি বি এ তে ভর্তি হওয়ার পরে খালার বাসায় বেড়াতে গেলাম। ক্লাস শুরু হবে প্রায় বিশদিন পর। তাইতো মা ছোট খালার বাসা থেকে বেড়িয়ে আসতে বললেন। আমার যেতে ইচ্ছে করছিলো না। কারণ সমবয়সী কেউ না থাকলে ঘুরে , আড্ডা দিয়ে মজা পাওয়া যায় না।
তার ওপর পিচ্চি খালাতো বোনটার জ্বালাতনি তো আছেই। সারাক্ষণ জ্বালাতন করবে। একবার বেড়াতে নিয়ে যাও , একবার এক্ষুণি বাজারে গিয়ে এ আনতে হবে , তা আনতে হবে, আবার ওর সাথে খেলাও করতে হবে। উফ! অসহ্য । ছোটদের জ্বালাতনি আমার একদম ভালো লাগে না। তারপরও গেলাম. . ২০ দিন বাসায় থাকতে ভাল লাগবে না। এডমিশনের কিছুদিন বাসার বাইরে থেকে কোচিং করে এখন আর বাসায় একটানা বেশিদিন থাকতে ভাল লাগে না। ঝিনাইদহে খালার বাসা। খালু ব্যবসা করে। তো যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে গেলো পিচ্চিটার জ্বালাতনি। কখনো ঘোড়া ঘোড়া খেলতে হবে, কখনো ও লুকোবে আর আমাকে খুজে বের করতে হবে , কখনো গল্প শোনাতে হবে। ধ্যাত, অসহ্য। বাচ্চাদের ঝামেলা আমার অসহ্য লাগে। সন্ধ্যায় ছাদে বসে আছি, ছোট্ট একটা রেডিও ছিলো খালার বাসায়, সেটাতে ছায়াছবির গান শুনছিলাম। হঠাৎ রাত্রি এসে বলে-
-ভাইয়া , আমি বড় হলে আমাকে বিয়ে করবে? ৬ বছরের পিচ্চি মেয়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে জিজ্ঞেস করলাম-
-বিয়ে করার কথা কোথা থেকে শিখেছো?
– কাল টিভিতে দেখেছিলাম, ছোট্ট দুটো মানুষের বিয়ে হচ্চিলো।
-ও এবার বুঝেছি, ছয় বছরের পিচ্চি মেয়ের মাথায় বিয়ের কথা আসলো কেমন করে। আমি হাসতে হাসতে বললাম-
-টিভিতে তো দুটো ছোট্ট মানুষের বিয়ে হচ্ছিলো, আমি তো বড় মানুষ। আমার বয়স কত জানো?
-না,
-২০ বছর আর মাত্র তোমার ৬ বছর,
তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে না, যাও। তুমি তোমার মত ছোট্ট কাউকে বিয়ে করো। রাত্রি দেখি অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলছে-
-না, আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।
তোমাকে বিয়ে করলে যখন বলবো তুমি আমাকে চকলেট কিনে দিবা, আমার সাথে সারাদিন খেলা করবা, গল্প শোনাবা আর ঘুরতে নিয়ে যাবা। আমি হাসি চেপে রেখে কড়া কন্ঠে বললাম-
-ওরে বাবারে, তোমাকে বিয়ে করলে তুমি এত জ্বালাতন করবা?
তাহলে তো তোমাকে মোটেও বিয়ে করা যাবে না। আমার কথা শুনে এবার পিচ্চিটা কান্না জুড়ে দিলো। কারণ আমি ওকে বিয়ে করতে না চাইলে যে ওর ভেবে রাখা অতগুলো প্রজেক্ট লস হয়ে যাবে। বিয়ে মানে ও ওগুলোই বোঝে। আমার হাত ধরে টেনে ছাদ থেকে নিচে নিয়ে আসলো। তারপর ওর আম্মুর কাছে বায়না ধরলো আমাকে বিয়ে করবে। ওর আম্মুকে আমাকে রাজি করাতে বলছে যেন আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। ওর কান্ড দেখে আমি আর খালা দুজনেই হাসছি। তারপর খালা রাত্রিকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমাকে বললো-
-মেহেদী, আমি আপাকে বলে রাখব যাতে রাত্রি বড় হলে তোদের বিয়ে দেয়। আমি পিচ্চিটাকে খেপাতে খালাকে বললাম-
-নাহ খালা, একে আমি বিয়ে করবো না। তোমার মেয়েকে বিয়ে করলে ও সারাদিন দুষ্টুমি করবে আর খেলা করতে চাইবে,একটুও বই পড়বে না তখন। রাত্রি আবার ওর আম্মুর কোলে গিয়ে মাকে বোঝাচ্ছে-
-আম্মু, বলো না ভাইয়াকে, আমি একটুও দুষ্টুমি করবো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম- সত্যি তো? ঠিকমত বই পড়বে, স্কুলে যাবে আর দুষ্টমি করবে না তো?
-না, দুষ্টুমি করবো না। তাহলে তুমিও বলো আমি বড় হলে বিয়ে করে আমাকে রিশার মত বড় বড় খেলনা কিনে দিবা?
-কে রিশা?
-ওর ফুফাতো বোন (খালা বললো)।
-হু দেবো. . . রাত্রিকে বললাম।
তারপর রাতে রাত্রি লক্ষী মেয়ের মত আমার কাছে পড়তে বসলো। শর্ত হচ্ছে কাল সকালে ওকে বিলে নৌকায় চড়াতে হবে। আর কথায় কথায় মেয়েটা নিজেকে আমার বউ বউ বলছে। অবশ্য নিজের বায়নাগুলো জোরালো ভাবে তুলে ধরতে। আমিও হ্যা বলছি আর শর্ত দিচ্ছি। দুষ্টুমি করলে কিন্তু তোমাকে কিচ্ছু দেবো না। কয়েকটা দিন খালার বাসায় ছিলাম। তারপর আবার বাসায় ফিরে এসে জিনিসপত্র নিয়ে ভার্সিটিতে গেলাম। হলে গণরুমে থাকতে হবে।
অবশ্য খালার বাসা ঝিনাইদহে বলে সেখানে থাকতে বলেছিলো,কিন্তু আমার কারোর বাসায় থাকার ইচ্ছা নেই। নিজের বাড়িতেও থাকতে ভালো লাগে না। আর শুনেছি, হলে না থাকলে নাকি স্টুডেন্ট লাইফের মজা পাওয়া যায় না। তবে প্রতি সপ্তাহে একবার খালার বাসায় ঘুরতে যেতাম। খালা বলতো- হলে কি খাস না খাস। এখানে তো থাকলি না তবে প্রতি বৃহঃবার আসিস। আবার শনিবার গিয়ে ক্লাস করতে পারবি। আমিও ভাবলাম তা ঠিক। হলের রান্না তেমন ভাল হয় না, আর নোংরা পরিবেশ। অন্তত সপ্তায় ১ দিন খালার হাতের রান্না খেলে মন্দ হবে না। খালুও অনেক ভালো। অনেক খোজ খবর নেয়। আর মাঝে মাঝে জোর করেই কিছু টাকা হাত খরচ হিসেবে দেয়। যদিও আমি নিতে চাইনি। কারণ আব্বুর পাঠানো টাকা দিয়েই ভালভাবে আমার চলে যায়। তবুও খালু জোর করেই কিছু টাকা মাঝে মাঝে দেয়। তো যে সপ্তায় খালার বাসায় ঘুরতে যেতাম না তার পরের বার গেলে আমার জন্য পিচ্চিটা ১৪৪ ধারা জারি করতো। এতটুকু বাচ্চা বড় মানুষের মত জেদ দেখিয়ে বলতো-
-তুমি আগের বার আসোনি কেন?(রাত্রি)
-কাজ ছিলো তাই আসতে পারি নি।(আমি)
-কালকে আমাকে অনেক খেলনা কিনে দিতে হবে। না হলে তুমি পচা।কথা বলবো না।
-আচ্ছা দিবো।
পরের দিন খালার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওকে নিয়ে বের হতাম। তারপর খালার বাসা থেকে একটু দূরে একটা শিশুপার্ক ছিলো সেখানে নিয়ে যেতাম। সেখান থেকে ফিরে পরে কিছু খেলনা কিনতাম, ওর জন্য আইসক্রিম,চিপস আর জুস কিনে বাসায় ফিরতাম। ওর আমাকে জ্বালাতন দেখে খালা আমাকে প্রায়ই বলতো-
-তুই কিছু মনে করিস না।
ছোট্ট মানুষ ও,আর সারাদিন বাসায় থাকে, খেলার মতও কেউ নেই, তাই তো তুই আসলে একটু বেশি জ্বালাতন করে। ওর বাবার ওকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার সময় হয় না, আর আমিও ঘরের কাজ গোছাতে গিয়ে সময় পাই না। ও আরেকটু বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।
-না ঠিক আছে।আমি কিছু মনে করিনি।
ছোট মানুষতো এমনই হয়।(আমি) এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিলো। আমি থার্ড ইয়ারে উঠলাম, আর ও ক্লাস থ্রি তে এখন আর ঘোড়া ঘোড়া , কানা মাছি খেলার জন্য জ্বালাতন করে না। কিন্তু ভূতের গল্প শোনার জন্য পাগল, আর আমি গেলে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। চিপস আর আইসক্রিম কিনে দিতে হবে। অবশ্য ওর জন্য পুরো খরচটাই খালার । এতে বরং আমারও কিছু থাকে। মানে আমি ফিরতি টাকা খালাকে দিতে গেলে বলে ওটা তুই রেখে দে।
আমি ফাইনাল ইয়ারে উঠলাম সেশন জটে পড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর লেগে যাচ্ছে শেষ হতে। রাত্রি এ বছর প্রাইমারী ছেড়ে সিক্সে ভর্তি হয়েছে। এখন আর ছোট নেই , আর জ্বালায় না। তবে এখন ওর সেই ছোট্ট ছোট্ট জ্বালাতনিগুলোকে খুব মিস করি। এখনও মাঝে মাঝে খালার বাসায় যায় । ওকে সেদিন পড়াই। অঙ্ক আর ইংরেজি দেখিয়ে দিই। আমি ওর ছোট বেলা থেকেই ওকে পিচ্চি বলে ডাকতাম। সেদিন পিচ্চি বলে ডাকায় বললো -ভাইয়া , দেখেন। আমি বড় হয়ে গেছি। পিচ্চি বলে ডাকলে লজ্জা করে। ভেবে দেখলাম তা ঠিক, আর পিচ্চি বলে ডাকাও ঠিক না। তবুও ঠাট্টা করে বললাম- বাব্বাহ!!!! দেখি আপনি কত বড় হয়ে গেছেন? তো আপনাকে কি বলে ডাকবো? আপু বলে? না রাত্রি বলে?কোনটা ডাকলে খুশি হবেন?
-নাম ধরে ডাকবে ভাইয়া, আমি তোমার ছোট,আপু বলে ডাকতে হবে না।
-বাহ , এত বুদ্ধি কোথা থেকে শিখেছো?
-নাহ,বেশি বেশি বলছো কিন্তু।
(সেই ছোট্ট থেকেই রাত্রি আমাকে তুমি করেই বলে)। আমার অনার্স শেষ হলো ই.বি তে মাস্টার্সও শেষ করলাম রেজাল্ট দিছে এবার বাসায় চলে যাবো। অবশ্য অনার্সের পর কয়েকটা জবের জন্য এ্যাপ্লাই করেছিলাম। মোটামুটি টাইপের পরীক্ষা হলেও সুবিধা হয়ে ওঠেনি তাতে। এবার বাসায় ফিরে জব প্রিপারেশন নিবো। অথবা ঢাকাতেও চলে যেতে পারি । আগে বাসায় যেয়ে নিই তারপর দেখা যাবে।
আমার বাসা খুলনায় । ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে আসার সময় খালার বাসায় গেলাম। আর আগের মত আসা হবে না। খারাপ লাগছে। ভার্সিটি লাইফের এই সাতটা বছর এই বাড়িটাই নিজের বাড়ি ছিলো। বাসায় যেতাম বড় কোন ছুটি পেলে। তাও আবার রাত্রির কান্নাকাটির জন্য তাড়াতাড়িই ফিরে আসতে হতো। খালা ফোন করে বলতো ওর নাকি কান্না থামছেই না। আমাকে আসতে বলছে। ওহ, বলাই হয়নি, নতুন মোবাইল কিনেছি। খালা আর খালুর কাছে বিদায় নিলাম। তারপর রাত্রির কাছে বিদায় নিতে গিয়ে দেখি ও কাঁদছে। বললাম- মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। এবার কিন্তু এইটে বৃত্তি ট্যালেন্টপুল পেতেই হবে। (ক্লাস ফাইভে সাধারণ বৃত্তি পেয়েছিলো।) রাত্রি কাদতে কাদতে বললো-
-তুমি চলে যাচ্ছো , আর বৃত্তি পাবো না।
-ধুর বোকা, মন দিয়ে পড়বা ।অনেক বড় হতে হবে।(আমি)
-তুমি থেকে যেতে পারো না?(রাত্রি)
-নাহ, তাই হয় নাকি?
পড়াশোনা শেষ করলাম,এবার চাকরি করতে হবে । বাড়ি ফিরে যেতে হবে তো। রাত্রি আরো জোরে জোরে কাদছে। ওর কান্না দেখে ওকে ছেড়ে যেতে আমারও খারাপ লাগছে। এই সাতটা বছর ওর সাথেই ছিলাম। কোলে পিঠে করেই মানুষ করেছি। তাইতো ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছে। ওরও খারাপ লাগছে। ছোটবেলা থেকে শুধু আমার সাথেই মিশেছে। আমি ছাড়া ওর আর কোন খেলার সাথীও ছিলো না। তাইতো আমার চলে যাওয়ার দিন এত কাদছে। ওকে অনেক বোঝালাম-আমি মাঝে মাঝেই আসবো। আপু তুমি আর কেদো না। তারপর খুলনার দিকে রওনা দিলাম। এতদিনের প্রিয় ক্যাম্পাস, বন্ধুরা , খালা-খালু আর ছোট্ট রাত্রিটাকে মিস করবো। ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম আমার চোখের কোণে পানি চলে এসেছে।
বাসায় ফিরে বেশিদিন ছিলাম না। খুলনা শহরে চলে আসি। তারপর জবের জন্য প্রিপারেশন নিতে থাকি। অবশ্য ভার্সিটিতে থাকতেই অল্প অল্প করে ব্যাংক আর বি সি এস এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। এবার পুরো দমে নেমে পড়তে হবে। রাতে খালু বাসায় ফিরলে রাত্রি প্রতিদিন ফোন দিতো। খালা খালু হয়তো ভাবতো আমি চলে আসায় ওর খারাপ লাগছে , তাই কিছু মনে করতো না। আমিও ওর খারাপ লাগছে ভেবে প্রতিদিন ফোন করার পরও কিছু বলতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারি আমি ওকে বোনের দৃষ্টিতে দেখলেও ও আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। কারণ ওকে আপু বলে ডাকলে বারণ করে শুধু রাত্রি নামেই ডাকতে বলতো। আর ক্লাস এইটে পড়া মেয়ে আস্তে আস্তে এমন ভাবে কথা বলা শুধু করে যেন আমি ওর বয়ফ্রেন্ড।
বিষয়টা ভালোর দিকে যাচেছ না দেখে আমি নিয়মিত কথা বলা বাদ দিতে চাইতাম। কিন্তু খালা-খালুর বড় আদরের মেয়ে, একটুখানি মন খারাপ করে বসে থাকলেই ফোন চলে আসতো আমার ফোনে, আর ছোটবেলা থেকেই ওর মন ভালো করার ওষুধ আমি। খালু খালাকে ফোন কিনে দিয়েছে। তাতে অবশ্য রাত্রিরই দখল বেশি। ওর ইচ্ছা মত যখন তখন আমাকে ফোন করে জ্বালাতে সুবিধা হতো। আমি না পারছি ওর পাগলামি সহ্য করতে না পারছি খালা খালুকে বিষয়টা নিজে বলতে। দ্বিধায় আছি। একদিন খালার বাসায় চলে গেলাম। তারপর রাত্রিকে নিয়ে বাইরে বের হলাম। উদ্দেশ্য ভালো করে বোঝানো। ও যা করছে তা ঠিক নয়। সেই শিশুপার্কে এসে ওকে জিজ্ঞেস করলাম ও এ পাগলামি কেন করছে।
-আমি তোমাকে ভালবাসি।(রাত্রি) আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম-
-তোমার বয়স কত?
-১৪.
-আমার বয়স কত জানো?
-না,কত?
-২৮..তোমার ডাবল।(একাডেমিক বয়স ২৬)
তুমি পড়াশোনা করো ,বড় হও ,দেখবে ভাল ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হবে। আর তা ছাড়া তোমাকে ছোটবেলা থেকে বোনের মতই মানুষ করেছি। তাই এটা হয় না।
-আমি অতশত বুঝি না।(রাত্রি)
-চুপ! (একটা ধমক দিলাম) ও কাঁদতে শুরু করলো। কাদতে কাদছে সেই ছয় বছরের পড়া স্মৃতির কথা বলছে আমাকে. .
-তোমার মনে আছে ? ছোট বেলায় তুমি বলেছিলে আমি বড় হলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে।
-তখন তো দুষ্টুমি করে একটা পিচ্চির সাথে বলেছিলাম। আজ তো তুমি সেই ছোট্ট পিচ্চি নেই। বড় হয়ে গেছে।
-তাহলে তোমার সমস্যা কোথায়? আমি কি দেখতে খুব খারাপ?
-আহ, তা নয়। তুমি আমার অনেক ছোট।
এখনো বাচ্চা একটা মেয়ে । আমার যার সাথে বিয়ে হবে সে আমার থেকে ৫/৬ বছরের ছোট হবে, ১৪ বছরের নয়।
-আর কয়টা বছর পরে তো আমি আরো বড় হবো, তখন ?
নাহ একে বোঝানো সম্ভব নয়। বয়সের দোষ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।
-কি হলো ? কিছু বলবে না?(রাত্রি)
-হু , তোমার মাথা আর আমার মুন্ডু চুপ করে বাসায় চলো।
আজ খালাকে বলবো‘ তোমার মেয়েকে শাসন করো।’ আবার রাত্রি কাঁদা শুরু করলো। নাহ, বিষয়টা সিরিয়াসলি না নিলে আরো খারাপের দিকেই যাবে। খালাকে আলাদা ডেকে বিষয়টা বললাম। খালা আগেই এরকম কিছু একটা আচ করেছিলো। ওর প্রতিদিন আমার কাছে ফোন করা দেখে। তবে শিউর ছিলো না। কারণ আমার কাছেই মেয়েটা ছোটবেলা থেকে মানুষ হয়েছে। তাই হয়তো এমনিতেই পরাণ টানছে। কিন্তু আমার কাছ থেকে শোনার পর খালা ওকে বকাঝকা করতে লাগলো। আমি খালাকে বললাম বেশি বকতে হবে না। ওকে বোঝান, আর এটা ওর বয়সের দোষ । কিছুদিন পর হয়তো ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু এতে ওর লেখাপড়া খারাপ হয়ে গেলে তো সমস্যা।
তারপর রাত্রিকে বললাম ভাল করে পড়, বড় হও তারপর দেখা যাবে। ওর শুধু একটাই কথা-তাহলে আই লাভ ইউ বলো। আমি ওকে কিছু না বলেই খুলনায় চলে আসি। মিথ্যে আশ্বাস দেওয়া ঠিক হবে না। নাহ, সে বছর রাত্রি এইটে বৃত্তি পায় নি , বরং রেজাল্ট খুব খারাপ হয়ে গিয়ে ছিলো। ওর সারাদিন কাজ ছিলো আমাকে ফোন করা আর আমি ও ফোন দিলে ফোন অফ করে রাখতাম। খালার নাম্বার বলে ব্লাক লিস্টেও রাখতে পারতাম না। পাগলিটা কেন যে বুঝতেছে না, এটা হয় না। আমাদের এজ ডিফারেন্সটা ১৪ বছরের । আর তাছাড়া আমি ওকে ছোট বোনের মতই দেখেছি। কোলে নিয়েছি, আদর করেছি তাই ওকে বোন ছাড়া অন্য দৃষ্টিতে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব না। ওর রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর খালা নিজেই আমাকে বললো-ও তো কারোর কথা শুনছে না।পড়ছেও না । তুই কিছু একটা কর।
-আমি কি করবো?
-জানিনা, তবে এভাবে চলতে থাকলে রাত্রি এস এস সি তে ফেল করবে। আর ওর পড়া শোনাও শেষ হয়ে যাবে।
-আচ্ছা খালা,আমি দেখছি কি করা যায়।
তারপর সময় করে খালার বাসায় গেলাম খালাকে আর রাত্রিকে ডাকলাম আর রাত্রিকে বললাম (বাধ্য হয়েই রাত্রির সাথে একটা মিথ্যে অভিনয় করতে হচ্ছে)
-ঠিক আছে, তোমাকে বিয়ে করবো। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে ভাল করে পড়ালেখা করবে। আর আমাকে বেশি ফোনে জ্বালাবে না। আমার তোমার জন্য পড়ার খুব ক্ষতি হচ্ছে। তুমি এভাবে সারাদিন ফোনে জ্বালালে আমি কিন্তু কোন চাকরিই পাবো না। বল রাজি?
–রাজি, তবে প্রতিদিন আমার সাথে একটু হলেও কথা বলবা। আর আমাকে ভালবাসবা। তুমি রাজি?(রাত্রি)
-হ্যা,আমি কিন্তু খালার কাছে থেকে প্রতিদিন খবর নিবো তুমি ঠিকমত স্কুলে যাচ্ছো কি না, পড়ছো কি না। যদি অনিয়ম দেখি তবে কিন্তু আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। মনে থাকবে?
-থাকবে।
তারপর রাত্রি ভদ্র মেয়ের মত পড়াশোনা করতে লাগলো। আর আমিও মিথ্যে বয়ফ্রেন্ড সেজে ওর জ্বালাতনি থেকে মুক্তি পেলাম। প্রতিদিন ওর সাথে সকালে , রাতে কথা বলতে হতো। যেন আমরা সত্যি সত্যিই প্রেম করছি। মেয়েটা আমাকে বউ বলে ডাকতে বলতো। আমি না ডাকলে নাকি বই পড়বে না। আমিও ওকে সন্তুষ্ট করতে বউ বলেই ডাকতে হতো। ভাবলে হাসি পেতো যাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করলাম তাকে এভাবে বউ বলে ডাকছি। কিন্তু কি করবো? করার কিছুই নেই।
দুবছরের মধ্যেই আমি একটা সরকারি চাকরি পেয়ে গেলাম। রাত্রি তখন এস এস সি পরিক্ষা দিয়েছে।আমাদের মাঝে প্রেম চলছে। যদিও আমার ওর এইচ এস সি পর্যন্ত অভিনয় করে যাওয়ার ইচ্ছা। কারণ ততদিনে ওর আবেগটা কেটে যেতে পারে। আর নতুন কেউ ওর জীবনে আসলে আমি সহজেই সরে যেতে পারবো। চাকরি পেয়েছি, খুলনাতেই একটা ব্যাংকে জব করছি। নিজের ছোট বোনটা এ বছর খুলনা বি এল কলেজ থেকে অনার্স শেষ করবে। ওকে ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিতে হবে। নিজেদের পুরোনো বাড়িটা ভেঙে নতুন বাড়ি বানাতে হবে। আমার ওপর অনেক দ্বায়িত্ব। আরো দু বছর কেটে গেলো ছোট বোনের বিয়ে দিলাম। নতুন বাড়ি বানানোর কাজে হাত দিয়েছি নিজে বিয়ে করার সময় পাইনি । আমার বয়স ৩৩ আর ওদিকে পাগলি মেয়েটা ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে ভালোই রেজাল্ট কিন্তু সমস্যা হলো কোথাও এডমিশন পরীক্ষা দেবে না।
কোথাও চান্স হয়ে গেলে নাকি ও আমার কাছে থেকে দূরে সরে যাবে। তাইতো শুধু খুলনা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন ফর্ম তুলেছিলো, আমি খুলনায় থাকি বলে। কিন্তু ওর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়নি। তাও খুলনা ছেড়ে যাবে না। তাই তো বি এল কলেজে ভর্তি হয়েছে। আমার সাথে প্রায়ই দেখা করতে আসে। দৌলতপুরেই থাকে। কিন্তু আমি এখন আর আগের মত ওর সাথে অভিনয় করি না। আর কতদিন? কাজের চাপের কথা বলে এড়িয়ে যাই। তাও মেয়েটা আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। ও তখন ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে আমার বাসা থেকে বিয়ের জন্য মা চাপ দিতে থাকে। বয়স ৩৪ হয়ে গেছে। আর দেরি করলে ভাল মেয়ে পাওয়া যাবে না। ওর সাথে দেখা করলাম বি এল কলেজ ক্যাম্পাসে। রাত্রিকে বললাম –দেখো, আমাকে ভুলে যাও। আমার বিয়ের জন্য বাসায় মেয়ে দেখতে বলেছি। তোমার সাথে সম্ভব না। তোমাকে আমি কখনো ওই দৃষ্টিতে দেখিনি।
-তাহলে এ কয় বছর আমার সাথে প্র্রেম করলে কেন?
-প্রেম? আমি প্রেম করিনি।
তুমি কথা শুনতে না,পড়তে না , তাই তোমাকেপড়ানোর জন্য এ অভিনয়।(আমি) রাত্রি কাদতে কাদতে বলছে. . .
-আমি তোমাকে ছাড়া বাচবো না।
-পাগলামি করো না ,রাত্রি।
-তুমি কি সিরিয়াসলি বলছো?
-হু।
ট্রেন আসার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো। বি এল কলেজের গেটের সামনেই রেল লাইন। রাত্রি কাদতে কাদতে ক্যাম্পাস থেকে এক দৌড় দিয়ে রেললাইনের দিকে যাচ্ছে। আমি পিছন থেকে ওর দিকেই দৌড়াচ্ছি –যেও না । থামো,যেও না । কিন্তু ও এক দৌড়ে রেল লাইনে ট্রেন আসার দিকেই দৌড়াচ্ছে। আমিও ওকে আটকালাম।
-থাক, আর মরতে হবে না,চলো। না ,আমি যাবো না।আমি বেচে থাকবো না।
-না,তোমাকে বেচে থাকতে হবে। আমার জন্য।(আমি)
-তুমি মিথ্যা বলছো,
-না , সত্যি বলছি,চলো আজই বিয়ে করবো।
পাঠকরা কি ভাবছেন? হঠাৎ আমার এত বছরে ভাবনা পাল্টে গেল কেন? না পাল্টে উপায় আছে? আমার জন্যে ওকে তো মরতে দিতে পারি না। তাই বাধ্য হয়েই ওকে বউ বলে গ্রহণ করতে হবে। কারণ এখন আটকাতে পারলেও পরে আবার ও আত্মহত্যা করতে পারে। খালাকে ফোন দিলাম. . .
-খালা তোমার মনে আছে ১৪ বছর আগে ছয় বছরের এক পিচ্ছি বড় হলে তাকে বিয়ে করতে বলেছিলো?
-হ্যা,থাকবে না কেন?
-দোয়া করো খালা, আজ তারা বিয়ে করতে যাচ্ছে।
আর খালুকেও দোয়া করতে বলো। বিয়ের পর বাসা থেকে ঘুরে বেড়াতে আসবো। ফোনটা কেটে দিয়ে দেখি পাগলিটা এখনো কাদছে। ওর কিছু বন্ধুকে ফোন করে কলেজ থেকে নিয়ে আসলো। কারণ এখনি কাজী অফিস থেকে বিয়ে করবো। সাক্ষী লাগবে। তারপর বিয়ে করে ফেললাম আমার বাসায়ও জানিয়ে দিলাম কারোর অমত নেই। তারপর ও আর আমি খুলনাতেই আছি। আসলে না চাইলেও কিছু কিছু পরিস্থিতি আমাদের মেনে নিতে হয়। সেদিন রাত্রিকে না বিয়ে করলে সে হয়তো আত্মহত্যা করতো। ছোটবেলা থেকে যার ভাল থাকার ওষুধ আমি তাকে এভাবে মরতে দেই কি করে। বিয়ের প্রথম প্রথম একটু লজ্জা করতো আমার। কিন্তু এখন আর করে না। এখন আর মনেই হয় না ও আমার থেকে অনেক জুনিয়র ,ওকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। বরং ওই নিজে হেসে বলে:- আমাদের বাবু যখন বড় হবে তখন তুমি গর্ব করে বলতে পারবা,তোদের আম্মুকেও আমি তোদের মত কোলে করে মানুষ করেছি।
হা. . . হা . . .হা. . . মেয়েটা এখন পাগলি রয়ে গেছে। তবে এখন ভালই লাগে ওর পাগলামি। আর ওকে এখন আমিও খুব ভালবাসি। কি করবো? বিয়ে যখন করেছি তখন ওকে ভালবাসবো নয় তো কাকে? যখন অফিসে থাকি তখন ওকে দেখতে খুব ইচ্ছা করে । এখন মনে হয় সারাদিন ওকে পাশে বসিয়ে রাখতে পারতাম। যে আমি ওর ভালবাসাকে এত অবহেলা করেছি, সেই আমিই আজ ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। অবশ্য নিজের বউয়ের প্রেমেই হাবুডুবু খাওয়াই ভালো। মানুষ বদলে যায়, পরিস্থিতি ,সময় মানুষকে বদলে দেয়। তাই তো সেদিনের সেই ছোট্ট পিচ্চিটাকে আজ কত সুন্দরভাবে আমার জীবনে জড়িয়ে নিয়েছি এবং সুখেই আছি। রাত্রি আমার নিজের হাতেই গড়ে তোলা সোনার প্রতিমা, যাকে আমি ছাড়া আর কেউ কখনো ছুয়ে দেখেনি।