আমি মনে হয় পৃথিবীতে একমাত্র মেয়ে যে পুরোটা বাসররাত হাপুস নয়নে কেঁদে পার করলাম। আমার স্বামী আমাকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দিলো আর দুয়েকবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
আমি আমার বাবা-মার অষ্টম সন্তান। আমাকে নিয়ে কেউ আদিখ্যেতা করেনি বরং আমার জন্মের পর আমার মায়ের শরীরটা ভেঙে গিয়েছিল। তাই বেশ অল্প বয়সেই মফস্বল শহর থেকে পাকাপোক্তভাবে আমাকে আমার বড় বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। উনি আমাকে মানুষ করলেন। দুলাভাইয়ের বিশাল ব্যবসাপাতি তাছাড়া তিনি রাজনীতিও করতেন তাই অনেক মানুষই ওই বাড়িতে থাকত। সেই বাসায় বিশাল বিশাল পাতিলে রান্না হতো। প্রতিদিন যেন বনভোজন। আমার দিন প্রজাপতির ডানায় উড়ে চলছিল। বাড়িটা ছিল খানিকটা বাগানবাড়ির মতো। আমি ফুল কুড়াই, গান গাই। সেই বাড়িতেই দীপুভাইও থাকত। তবে অন্য সব আশ্রিত আর আমার মধ্যে তফাৎ ছিল, আমি তো কুটুম। আমাকে সবাই অনেক কদর করত।
দুলাভাই আর আপাকে আমি আমার বাবা-মাই ভাবতাম, তাদের কাছে সব কিছু আবদার করতাম। দীপুভাই ছিলেন দুলাভাইয়ের দূর সম্পর্কের ভাই। দুলাভাইয়ের ব্যবসায় টুকটাক কাজ করলেও বাড়ির লোকেরা তাকে সম্মান দিত না। আমার কেন যেন একটু মায়া হতো। খেয়াল করতাম বাসায় এতো কিছু রান্না বান্না হচ্ছে অথচ উনাকে হয়তো ভাতের সাথে শুধুই দুই টুকরো গোশত দেয়া হলো। আমি একটু খাওয়া পাঠিয়ে দিতাম। একবার একটা পাঞ্জাবিও কিনে দিলাম। কিন্তু এইসব ব্যাপার ওই বিশাল বাড়িতে কদিন আর চাপা থাকবে? আমার বড় বোন যখন টের পেলেন দীপু ভাই আর আমি চিঠি আদান প্রদান করেছি তিনি যেন লজ্জায় মরে গেলেন। উনি আর বাঁচবেন না! এই কলঙ্ক করতে আমাকে তিনি এতো স্নেহ করেছেন? আমিও হতবুদ্ধি। আমার বড় বোন ঘোষণা দিলেন আমাকে অতি সত্বর বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে। আর আমার হাত ধরে বললেন, আমি যেন তাকে ছোটো না করি। এই বাড়িতে তার শ্বশুরপক্ষের লোকজনও আছে, আমাকে তার সম্মান রাখতে হবে।
নিজের বাবা-মা যখন ছেলে মেয়েকে মানুষ করেন তখন অন্যরকম কিন্তু যাকে অন্য কেউ নিজের বাবা মায়ের মতো মানুষ করেন সে এক অদ্ভুত শৃঙ্খল। আমার উপায় নেই আমার বোনের উপর কিছু বলার। দুই মাস আমি কড়া পাহারায় ছিলাম তারপর আমাকে জাফরের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো। বিয়ের আগে একদিন আমি ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দূর থেকে জাফর আমাকে দেখেছিল। উনি বিয়ে করতে রাজি। শুনে আমার এমন রাগ হলো। আমি কী একটা পুতুল যে দূর থেকে দেখে মনে ধরল আর কিনে বাড়ি নিয়ে যাবে? আমিও পণ করলাম ওই লোকের বাপের নাম ভুলিয়ে দিব। আমার সব রাগ গিয়ে পড়ল জাফরের উপর। দূর থেকে একদিন আমাকে দেখানো হয়েছে আর অমনি সে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল!
বিয়ের দিনও আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজলাম কিন্তু না কেউ হয়তো দীপু ভাইকে দাওয়াতও দেয়নি। বিয়ের রাতে জাফর আমাকে বলল সে সারা জীবন আমার থাকবে। এসব কথা আমার একটুও ভালো লাগেনি। আগে বিয়ে হয়েছিল ওই লোকের, অসহ্য! বিয়ে বাড়িতে দুয়েকজন ফিসফিস করে বলল, বোন বোনের এমন সর্বনাশ করে!
বিয়ের অল্প কিছুদিন পর আমাকে আমার স্বামীর সাথে প্রবাসী হতে হলো। দিনগুলো ভালো লাগতো না। প্রবাসের কত চাকচিক্য কোনো কিছুই আমাকে টানত না। তারপরও যখন কিছু করার থাকে না মানুষ ওই পরিস্থিতিতেই বাঁচতে শিখে যায়। আমি মুখ গোমড়া করেই রাঁধি। যখন দেখি ঠান্ডায় বারান্দার টবে গাছগুলো মরে যাচ্ছে তাদের ঘরের ভিতর এনে রাখি। জাফর অবশ্য কাজ থেকে ফিরে আমাকে সব কাজে সাহায্য করতো। মাঝে মাঝে সে চমৎকার রান্নাও করতো। তার ঐসব গুণ আমার চোখে পড়তো না। মনের বিরুদ্ধে আমাকে কিছু করতে হলে আমার ভয়ানক রাগ উঠত।
তবে যাকে একদম অবহেলায় দূরে সরিয়ে দিচ্ছিলাম, সেই জাফর হঠাৎ আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলো যখন টের পেলাম তার আগের স্ত্রী আবার ফিরে আসতে চায়। জাফরের সাথে আমার প্রয়োজনের বাইরে তেমন কথা হতো না। তার আগের স্ত্রী কে, কোথায় কিছুই আমি কোনোদিন জানতে চাইনি। আমার কোনোদিন কৌতূহল হয়নি। কিন্তু এবার সেই মহিলা আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলো। আমি আসার ছয় মাসের মাথায় দিনের বেলা আমাকে একজন ফোন দিলো। গলাটা বেশ আদুরে।
– দিলরুবা বলছ?
– জি।
– আমি রেখা।
– চিনতে পারলাম না।
– আমি জাফরের প্রথম স্ত্রী। তোমার সাথে একটু কথা ছিল।
– জি বলেন।
– তুমি হাজার চেষ্টা করেও তার মন পাবে না। ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।
আমি একটু চমকালাম। উনি বলেই চললেন, আমি একটা ভুল করেছিলাম তাই সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার মানে এই না যে সে আমাকে ভুলে গেছে। ও রাগের বসে হুট করে তোমাকে বিয়ে করেছে। আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারি, তুমি ভুল লোককে বিয়ে করেছ। সে কোনোদিন তোমার হবে না। সে আমার কাছে ফিরে আসবে।
আমারতো খুশি হয়ে ফিরে আশা উচিৎ ছিল, জাফরকে তো আমি অবহেলা করে এসেছি কিন্তু আমার ভারী অপমান লাগল। আমি যে একজন মানুষের দখল পেয়েছি সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। যা পাওয়া হয় নাই মানুষ তার পিছনেই ছুটে। আমি এতো দিনে বুঝলাম, আমার সব কথা জেনেও কেন আমার স্বামী আমাকে বিয়ে করেছে।
এখানে বলে নিই আমি বেশ ভালো দেখতে। ঠিক যেমন মেয়েদের আমাদের দেশে অনেক কদর হয়। ফর্সা, টানা চোখ, লম্বা আবার ছিপছিপে গড়ন। রূপের একটু দেমাগ ছিল আমার। আমার ধারণা ছিল জাফর আমার রূপে মজে বিয়ে করেছে। কিন্তু এখনতো দেখছি আমি ভুল। আমি এই রেখাকে কী বলবো?
– আপনি ঠিক কি ভুল করেছিলেন?
– আমি অন্য একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। আসলে আমাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল। জাফর কষ্ট পেয়েছে, আমি ভুল বুঝতে পেরেছি, আমি ওকে ফিরে চাই। আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলাম।
জাফর সেদিন রাতে আসার পর আমি প্রথম তাকে একটু খেয়াল করলাম। আমার থেকে অন্তত দশ বছরের বড় সে। মাথায় চুল একটু কমে গেছে কিন্তু সে দেখতে বেশ সুপুরুষ। আমার প্রতি তার তেমন কোনো বাড়তি আগ্রহ নেই। যেন দুইজন মানুষ রুমমেটের মতো দায়িত্ব ভাগ করে সব কাজ করি। শুধু আমি তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছি তা নয়, সেও তো দিব্যি ভালোই মেনে নিয়েছে। তবে কি তার প্রথম স্ত্রী রেখা যা বলল তা সত্যি?
আমি কিছুক্ষণ কেঁদে ঘুমিয়ে গেলাম। অনেক রাতে আমার কেন যেন ঘুম ভেঙে গেল। আমি খেয়াল করলাম জানালার বাইরে তুষার পড়ছে। সে রাতটাও রহস্য ঘেরা। চাঁদের অর্ধেক রুপোলি আর অর্ধেক কালো। আমি যেন এক অদ্ভুত দোটানায় দুলছি। এরকম নিশ্চুপ রাতে দেয়াল ঘড়ির টিকটিক কানে লাগে। সেই ছোটোবেলার কথা মনে পড়ল, মায়ের কথা, বাবার কথা। মাকে তো তেমন কাছে পাইনি কোনোদিন। কোথাকার কোনো ছোট্ট শহরের আমি আজ দুনিয়ার কোথায় এসে পড়েছি। নিঃসঙ্গতার কষ্টে বুকটা হু হু করে উঠল। আমি চিন্তা করে দেখলাম জাফরকে যদি আমি হারাই আমি ভীষণ একা হয়ে যাব।
একই ছাদের নিচে দুজন মানুষ যখন থাকতে শুরু করে কেমন একটা মায়া তৈরি হয়ে যায়। মানুষটাকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে তার উপর এক নির্ভরতা চলে আসে। আমি তার পায়ের শব্দ চিনি আমি তার গায়ের গন্ধ চিনি।
আমি বিছানায় ফিরে এসে জাফরকে জড়িয়ে ধরলাম। আজ আমাদের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। আমি মন খারাপ করে বসে ছিলাম। জাফরেরও অনেক মন খারাপ ছিল। জাফর আমার কাছে এক কাপ কফি নিয়ে আসল। আমার প্রতি এই বাড়তি খেয়াল তার আছে। বাসায় থাকলে সংসারের সব কাজ দুজন এক সাথেই করি। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি।
– কী?
– তোমাকে ভারী সুন্দর লেগেছে আজকে।
– এ তো পুরনো কথা। এক ঝলক দেখেই তো বিয়ে করেছিলে।
খোঁটা দিতে আমি এখনো ছাড়ি না। খেয়াল করলাম সে একটু অস্থির। আরও কিছু কথা আছে তার মনে এটুকু বুঝতে পারলাম।
– এত ভূমিকা না করে আসল কথা বলো। মনে হচ্ছে অন্য কিছু বলতে চাচ্ছ। জাফর মৃদু হাসল।
– আমাদের জীবন শুরু হয়েছিল কোনো প্রত্যাশা ছাড়া কিন্তু আমাদের জীবন ভালোই কেটেছে।
– হুঁ, তারপর ?
– তবু একটা বিষয় তোমাকে না বললে মনে একটা কাঁটা থেকে যাবে। সে একটু সময় নিলো,
– বহু দিন আগে যেই রাতে আমাদের মিল হয়েছিল, সেদিন তুমি একটা ফোন কল পেয়েছিলে, ঠিক না? আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি কোনোদিন জাফরকে কিছু বলিনি।
– তুমি কীভাবে জানলে? জাফর একটু সময় নিলো।
– ফোনটা আমি আমার ভাবীকে দিয়ে করিয়েছিলাম। আমার প্রথম স্ত্রীর নাম রেখা হলেও ওই ফোন রেখা করেনি। আমি সত্যি অবাক হয়েছি।
– কেন?
– দেখ, আমাদের বিয়ের ছয়মাস হয়ে গিয়েছিল।
তোমার অন্য একজনকে পছন্দ ছিল আমি জানতাম। তোমার বড় বোন কিন্তু কোনো কিছু লুকায়নি আমার কাছ থেকে। আমি উনাকে এটাও বলেছিলাম মেয়েটার যাকে পছন্দ তার সাথেই বিয়ে দেন। উনার সাথে কথা বলে আমি বুঝেছিলাম ছেলেটা তেমন কিছু করে না। ওই ছেলের সাথে বিয়ে হলেও তুমি ভালো থাকতে না। সব কিছু জানি তাছাড়া আমার নিজেরও ভগ্ন হৃদয়। আমি তোমাকে সময় দিয়েছিলাম আমার সাথে সহজ হতে। কিন্তু তোমার কোনো আগ্রহ ছিল না আমার প্রতি। এক সময় আমি ভাবলাম তোমাকে দেশেই পাঠিয়ে দেই। কিন্তু তাতে তোমার জীবনটা খুব ভালো হতো এমন বলা যাবে না। অল্পদিন পাশাপাশি থেকেও তোমার প্রতি আমার মায়া জন্মেছিল। মনে হলো একবার অন্যভাবে একটি চেষ্টা করি। যাকে সহজে পাওয়া যায় তার দিকে মানুষের আগ্রহ থাকে না। যখন মানুষটাকে কেউ নিয়ে যেতে পারে এই ভয় মনে আসে তখন মনে হয় তার কদর হয়। আমি স্তব্ধ। জীবন তো আমার খারাপ কাটেনি, জাফর খুব মানিয়ে চলা মানুষ কিন্তু এতো ধোঁকা। রাগ লাগছে আবার কিছু বলতেও পারছি না।
আজকেও জানালার বাইরে তুষার পড়ছে। আমি ধীর পায়ে কিচেনে আসলাম আর এক কাপ কফি বানালাম। কফি নিয়ে জাফরকে দিলাম আর সাথে একটা কবিতা। প্রকৃতিরও অস্থিরতা আছে ধীরে ধীরে জমে ক্ষোভ, এক সময় শুরু হয় তান্ডব ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অগ্নুৎপাত। মানুষও জমিয়ে রাখে ব্যর্থতা তিলে তিলে সঞ্চয় করে হার, আনন্দের পসরা মেলে ধরে মন দিয়ে সাজায় কত বাসর। তারপরও থেকে যায় কিছু থেকে যায় কিছু না বলা শোক কিছু লুকিয়ে রাখা জল গভীরে বয়ে চলা পাড়ভাঙা নদী। তোমার ওই ক্ষুদ্র শোক সামান্য না পাওয়ার অস্থিরতা অগ্নুৎপাত ঘটাবে না বড় জোর জমাট বাঁধা শীতল কষ্টের তুষারপাত হবে।
কবিতা পড়ে কি জাফরের মনে হুল বিঁধল? কার কথা ভেবে লিখেছি? বিঁধুক। যখন আমাকে কেউ নিয়ে যেতে পারে এই ভয় মনে আসে তখন মনে হয় কদর হয়। এখন তো আর ছোটো মানুষ নেই আমি, তাই মুখ টিপে হাসছি আর কফি খাচ্ছি। যে কথাটা বলিনি তা হলো কবিতাটা আমি সে রাতেই লিখেছিলাম।