বাসর ঘরে অন্তরাকে স্পর্শ করতেই এমনভাবে ছিঁটকে সরে গেলো মনে হলো কেউ ওকে কারেন্টের শক দিয়েছে। আমার দিকে কেমন যেন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কাচুমাচু হয়ে বসে রইলো বিছানার একটা কোনায়। তখন আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। অন্তরার এমন করার কারণ কি? আমাকে কি তার বাঘ বা ভাল্লুক মনে হচ্ছে? নাকি কোনো বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো মনে হচ্ছে? লাগে যেনো আমি তার ইজ্জত লুটেপুটে নিতে এসেছি এমন ভাবভঙ্গি করছে। অন্তরা কি ভুলে গেলো, আজই আমি ওকে ইসলামের সকল নিয়ম মেনে ২০ লক্ষ টাকা দেনমহর দিয়ে তিনবার কবুল বলে বিয়ে করেছি! আমার বিয়ে করা বউ সে তার উপর অবশ্যই আমার সব অধিকার রয়েছে তাহলে এমন করার মানে কি??
নিজেকে নিজের কাছেই আজ আজব প্রাণী মনে হচ্ছে। অন্তরা কেমন দৃষ্টিতে যেনো তাকিয়ে আছে। আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিয়ে বলে আজই ক্লিন সেভ করেছি। যথেষ্ট সুদর্শন আমি, সুঠাম দেহের অধিকারী। নিয়মিত জিমে যাই আকর্ষনীয় বডি। বলতে গেলে সকল মেয়ের সপ্নপুরুষ ছিলাম আমি। কিন্তু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদে কখনো প্রেম ভালোবাসা করার সুযোগ হয়ে উঠেনি। প্রচন্ড পরিমাণে রোমান্টিক একটা ছেলে আমি। সমস্ত ভালোবাসা, অনুভূতি বউয়ের জন্য জমিয়ে রেখে ছিলাম। আর দুর্ভাগ্যবশত আজ ভাগ্যের এই পরিহাস। আয়নায় নিজেকে ভালোভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে নিলাম নাহ আমাকে অপছন্দ করার মতো কিছু নেই। তাহলে অন্তরার এমন করার কারণটা কি? উম্মম..বয়ফ্রেন্ড? ওহ মাই গড! আমি তারাতারি বিছানার কাছে গিয়ে অন্তরাকে প্রশ্ন করলাম,
_ তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?
অন্তরা কোনো জবাব দিলো না। মেঝের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিচে তাকিয়ে আছে। আমার থেকেও ওই মেঝের কারুকার্য এতো পছন্দ হলো! স্ট্রেঞ্জ রাগে দুঃখে প্রচন্ড অভিমান হলো অন্তরার প্রতি। তবুও আবার বললাম,
_ লুক এট মি..আমার দিকে তাকাও অন্তরা। আমাকে কি তোমার কোনো কারণে অপছন্দ? বা তোমার এই বিয়েতে মত ছিলনা? তোমার কি অন্য কারো সঙ্গে? আই মিন ইউ হেভ এ বয়ফ্রেন্ড?? অন্তরা না সূচক মাথা নাড়লো দু’দিকে।
_ তাহলে তোমার প্রবলেমটা কোথায়? আন্সার মি অন্তরা। চুপ করে থেকো না।
_ আমি ঘুমাবো। দয়া করে লাইট অফ করে দিবেন আমার আবার লাইট জ্বলে থাকলে ঘুম আসেনা।
কিহহ্! আজ আমাদের বাসর রাত আর সে বলছে ঘুমাবে? কীভাবে সম্ভব, আমার প্রচন্ড ইগোতে বাঁধলো। কি যে হলো আমার তখন, আমি হঠাৎ অন্তরাকে বিছানায় চেপে ধরলাম। নিজের পুরুষত্ব ফলাতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। অন্তরার গলা, ঘারে এলোপাথাড়ি চুমু খেতে লাগলাম। ঠোট জোরা আঁকড়ে ধরতেই লক্ষ্য করলাম। অন্তরা ভীষণ পরিমাণে কাঁপছে। আমি অন্তরাকে ছেরে দিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। অন্তরা এখনো চোখ বন্ধ করে কাঁপছে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হলো একটু আগের ঘটনার জন্য। মৃদু কন্ঠে বললাম,
_ সরি অন্তরা। আসলে
সে কি অন্তরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ওর গালে আলতো করে হাত রাখতেই টের পেলাম জ্বর এসেছে। শরীর প্রচন্ড গরম। মনে হয় ভয়ে এমনটা হয়েছে। নিজেই নিজেকে বললাম, ছিঃ হিমেল ছিঃ এইটা তুই কীভাবে পারলি?
সেই রাতে সারারাত জেগে অন্তরার কপালে জলপট্টি দিলাম। সারারাত মেয়েটা জ্বরের ঘোরে ছিল। হাড় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছিলো। আমি কিছুতেই ভেবে পেলাম না এমন করার কারণটা কি। আমি তার স্বামী, তাকে আমি স্পর্শ করবো এটাই স্বাভাবিক। ভোর রাতের দিকে অন্তরার জ্বরটা কমে গেলো। ঘুমিয়েছে মেয়েটা। কি নিষ্পাপ লাগছে, প্রচন্ড মায়া মুখপানে মেয়েটার। আমি অন্তরার পাশেই শুয়ে পড়লাম। সারারাত জেগে থাকার কারণে আর বিয়ের ধকলে প্রচন্ড ক্লান্ত ছিলাম। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেলাম।
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো অনেক বেলা করে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটা আমার এক হাত আকঁড়ে ধরে বাচ্চাদের মতো করে ঘুমাচ্ছে। নিজের অজান্তেই ওর গালটা স্পর্শ করতে গেলেই মনে পড়ে গেলো গতকাল রাতের ঘটনা। চট করেই উঠে বসলাম বিছানায়। অন্তরার বুকের থেজে শাড়ির আঁচল অনেকটা সরে গিয়েছে। পায়ের দিকে অনেকটা কাপড় উঠে রয়েছে। চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। চাদর দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিলাম। ওর এই সৌন্দর্য দেখার অধিকার আমার নেই। ভাবতেই বুকের ভেতরটায় চিন চিনে ব্যঁথা অনুভব করলাম।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে একটা টি-শার্ট পড়ে নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম নাস্তা আনার জন্য। বাসায় ফিরে দেখলাম অন্তরা এখনো ঘুমুচ্ছে। ডাকলাম না ওকে আর আমার খাওয়ার ইচ্ছেটুকুও নেই। তৈরি হয়ে নিলাম শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য। জানতে হবে আমাকে তারা কেনো অন্তরার অমতে বিয়ে দিয়েছে। আর এমনই যদি হয়ে থাকে তাহলে এই সম্পর্ক কে বেশি দূর নিয়ে যাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই। আসার পথে উকিলের কাছে গিয়ে ডিভোর্সের সমস্ত কিছু ব্যবস্থা করে আসবো শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বিছানায় চোখ গেলো, অন্তরা উঠে বসেছে।
_ এখন কেমন লাগছে তোমার?
_ জ্বি ভালো।
_ গতকাল রাতের জন্য সরি। অন্তরা কিছু বললো না চুপচাপ বসে রইলো। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। বেড়নোর আগে শুধু বললাম,
_ টেবিলে নাস্তা রাখা আছে খেয়ে নিও। আর বিছানার সাইড টেবিলের ড্রয়ারে ঔষধ আছে খেয়ে নিও কষ্ট করে।
মনে মনে বললাম, ভেবোনা তোমাকে আমি মুক্তি দিয়ে দিবো। আমার ভালোবাসার খাঁচায় যেহেতু তুমি বন্ধি হতে চাওনা তাহলে এটাই হোক…মুক্ত করে দিবো তোমায়।
বসে আছি শ্বশুর হাসনাদ সাহেবের মুখোমুখি। শাশুরি রেহেনা বেগম একটু আগেই একগাদা নাস্তা রেখে গিয়েছে। তার চোখে মুখেও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক। বিয়ের পরের দিনই মেয়ের জামাই মেয়েকে ছাড়া কথা নেই বার্তা নেই এসে হাজির। তিনি আমার সাথে সামান্য কুশল বিনিময় করে চলে গিয়েছে। শ্বশুর মশাইও মাথা নিচু করে বসে আছে। মনে হচ্ছে কোনো বড়সরো অপরাধ করে ফেলেছে। আমার চোখে চোখ মেলাতে পারছেন না তিনি। পুরো হলরুমটা ঘিরে নিস্তব্ধ নিরবতা বিরাজ করছে। নিরবতা ভেঙ্গে আমিই প্রথমে মুখ খুললাম। বললাম,
_ বাবা আমার কিছু জানার আছে।
_ আমি জানি তুমি কি জানতে চাইছো।
_ আপনি জানেন মানে! আপনি কি জানেন অন্তরার এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ??
_ হ্যাঁ…বাবা হিমেল আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি সেটা আমি জানি।
কিন্তু মেয়েকে সুখি দেখতে চাওয়াটা যদি একটা বাবার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমি বলবো হ্যাঁ আমি অপরাধি।
শ্বশুর মশাই এইসব কি বলছে? অন্যায়! অপরাধ! কি হয়েছিল?? কিছুই বুঝতে পারছি না সবটা যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম,
_ বাবা আপনি কীসের অন্যায়ের কথা বলছেন? প্লিজ আমাকে সবকিছু খুলে বলুন। গতকাল রাত থেকেই মাথাটা হ্যাং হয়ে আছে।
_ তোমার জানার অধিকার আছে। আমি তোমাকে সব বলবো আজ। বিয়ের আগে আমি ভয়ে বলতে পারিনি যদি সব শুনে তুমি আমার মেয়েটাকে বিয়ে না করো। আমার মেয়েটাকে কোনো ভরসাযোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম। আর তোমাকে যেদিন হাসপাতালে দেখলাম সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম সেই ভরসাযোগ্য পাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ হতে পারবেনা। এইসব কথা এখন কেনো বলছেন তিনি? কি এমন সত্য তিনি আমার থেকে লুকিয়েছেন!!
_ আমি সেদিন বুকের ব্যঁথায় রাস্তায় বসে পড়েছিলাম চোখে ঘোর অন্ধকার দেখছিলাম মনে হচ্ছিলো সেদিনই বুঝি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবো। তখন চোখের সামনে শুধু বারবার মেয়েটার মুখ ভেসে উঠছিল, বারবার মনে হচ্ছিলো আমার কিছু হয়েগেলে মেয়েটার কি হবে।সেদিন সবাই ভির জমিয়ে আমাকে দেখছিল কিন্তু কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। হঠাৎ তুমি এলে সেদিন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে। আমাকে তারাতারি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে। সেদিন আমার কাছে তোমাকে দেবদূত মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, আল্লাহ আমার কথা শুনেছে। আমার প্রার্থনা কবুল করেছে।
_ হ্যাঁ…সেদিন আপনার ছোটখাটো একটা স্ট্রোকের মতো হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল অতিরিক্ত টেনশন থেকেই এমনটা হয়েছে।
_ সেদিনই ঠিক করে ফেললাম তোমার সাথেই মেয়েটার বিয়ে দিবো। অন্তরার যোগ্য পাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ হতে পারবেনা। তাই তোমার সব খোঁজ খবর নিলাম। জানলাম তোমার কেউ নেই, এক দূরসম্পর্কীয় চাচির কাছে মানুষ হয়েছো, তিনিও বছর খানেক হয়েছে পরকাল গমন করেছে। ভালো সরকারি চাকরি করছো তুমি। তোমার ব্যপারে সবকিছু জেনে মনে হলো, আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিয়েই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো।
মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথাগুলো আবার। সেদিনই অন্তরার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। হাসপাতালে বাবার অসুস্থতার কথা শুনে ছুটে এসেছিল অন্তরা। অঝোরে কাঁদছিল, অন্তরার কান্না মাখা মুখটা দেখে আমার বুকে কেমন যেনো একটা চিন চিনে ব্যঁথা অনুভব করছিলাম। সেদিনই বোধহয় আমি অন্তরার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর যখন শ্বশুর মশাই একদিন আমার অফিসে আসলেন, বিয়ের প্রস্তাব দিলেন তার মেয়ের জন্য। আমি সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। আমার এই ছন্নছাড়া জীবনে যেনো এক ফালি রোদ এসে উঁকি দিয়েছিল। সেদিনই একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলাম, বউকে নিয়ে তো আর ম্যাসে উঠতে পারবো না। খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ছিলাম সবকিছু অন্তরার জন্য। ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসলাম। শ্বশুর মশাইর কথা শুনে এটুকু বুঝতে পারলাম তিনি খুব অসহায়বোধ করছেন। শ্বশুর মশাইকে আসস্থ করে বললাম,
_ বাবা আপনি বেশি প্রেশার নিবেন না। আপনি এমনিতেই হার্টের রোগী আপনার জন্য অতিরিক্ত টেনশন ক্ষতিকর। আপনি সম্পূর্ণ নির্ভয়ে আমাকে সবটা খুলে বলতে পারেন। শ্বশুর মশাই মাথা নিচু করে ফেললো। নিচু গলায় বললেন,
_ আমার মেয়েটা ধর্ষিতা।
কথাটা শুনে আমার শিরদার বেয়ে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। কানে বারবার শ্বশুর মশাইর বলা শেষ কথাটা বাজতে লাগলো। শ্বশুর মশাই আবার বলতে লাগলেন,
_ ওই লম্পটগুলো আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে…
তিনি আর কিছুই বলতে পারলেন না হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে সে। শাশুরি মাকেও দেখলাম দরজার আড়ালে নিরবে কাঁদছেন। আমার ঠিক এই মুহূর্তে কি করা উচিৎ বুঝতে পারছিনা। কি বলে শান্তনা দিবো? শ্বশুর মশাই কাঁদতে কাঁদতে আবার বলতে লাগলেন,
_ আমার মেয়েটা লেখাপড়ায় অনেক ভালো ছিল।
সারাক্ষন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ওর পুরো পৃথিবী জুরে ছিলাম শুধু আমরা। মেয়েটা ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। ভার্সিটিরই কিছু ছেলেপুলে ওকে বিরক্ত করছিল বেশ কদিন যাবৎ। অন্তরা আমাকে কখনো সে কথা জানায়নি ভেবেছিল ঠিক হয়ে যাবে সব। একদিন হঠাৎ মেয়েটা ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরলো না। বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো। মেয়েটার ফেরার কোনো নাম নেই। আমার স্ত্রী আমাকে ফোন করে জানাতেই আমি ছুটে আসলাম অফিস থেকে। সব জায়গায় খোঁজ করলাম কোথাও পেলাম না। তারপর মেয়েটা ফিরে এলো বিধ্বস্ত অবস্থায়। সেদিন অন্তরা বাড়ি ফিরেছিল ঠিকই কিন্তু আমার হাসি খুশি মেয়েটাকে ওরা খুন করেছিল। তারপর ওখান থেকে বাড়ি-ঘর বিক্রি করে দিয়ে চলে আসলাম এখানে। সেদিনের পর আমার মেয়েটা আর হাসেনি, আমার সাথে মন খুলে কথা বলেনি, পড়াশোনা ছেড়ে দিলো। ঘর অন্ধকার করে বসে থাকতো সর্বক্ষন। কোনো মানুষের সামনে যেতেই ভয় পেতো। এভাবেই বছরখানেক কেটে গেলো। স্বাভাবিক হলেও এখনো পুরোপুরি ভাবে স্বাভাবিক হতে পারেনি।
_ আপনি ওদের নামে কোনো কেস করেননি?
_ কি হতো কেস করে? ওদের অনেক ক্ষমতা টাকা দিয়ে সব ধামাচাপা দিয়ে দিত।
অন্তরার উপর দিয়ে এতো ঝড় বয়ে গেছে! এতো অত্যাচার সহ্য করেছে মেয়েটা। আর আমি! আমি কাল রাতে শুধু শুধু অন্তরাকে ভুল বুঝেছিলাম। খুব খারাপ লাগছে। গতকাল রাতে আমি যা করতে যাচ্ছিলাম!! তাহলে ওদের মাঝে আর আমার মাঝে তফাৎটা কি থাকতো?? খুব অনুতপ্ত হলাম। আমি একটা কথা বলেই চলে আসলাম,
_ বাবা আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার আগের সেই অন্তরাকে আমি আপনার কাছে ফিরিয়ে দিবো। বাড়ি ফেরার পথে অন্তরার জন্য বেলি ফুলের মালা নিয়ে নিলাম। নিজ হাতে ওর খোপায় পড়িয়ে দিবো। অন্তরার ভয় আমাকে ভাঙ্গাতেই হবে। ওকে বোঝাতে হবে সব স্পর্শ এক না। কিছু স্পর্শ পবিত্র হয়, সেই স্পর্শ থাকে ভালোবাসার, শুধুই ভালোবাসার দুইবার কলিংবেল বাজাতেই অন্তরা দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম আমার সামনে কোনো স্বর্গের অপ্সরী দাঁড়িয়ে আছে। লাল শাড়িতে, খোলা চুলে অন্তরাকে অপূর্ব লাগছে। আমি মৃদু হেসে হাতে থাকা বেলি ফুলের মালাটা অন্তরার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। বললাম,
_ তোমার জন্য…
অন্তরা কিছু বললো না। ও নির্লিপ্ত হয়ে আছে। আমিও কিছু বললাম না দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে গেলাম।
তারপর থেকেই লেগে রইলাম অন্তরার পিছনে। ওকে বোঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। ওকে বোঝাতে হবে আমি ওর হাজবেন্ড। আমাদের মাঝে যেই সম্পর্কটা রয়েছে সেটা একটা পবিত্র সম্পর্ক। আমরা দুজন পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ।
প্রথম প্রথম অন্তরা আমাকে খুব ভয় পেতো। আমি ওর কাছে গেলে, পাশাপাশি বসলে কিংবা ওর হাতটা ধরলেও ও প্রচন্ড পরিমানে ভয় পেতো, অস্বাভাবিক আচরণ করতো। এইতো সেদিন সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে দেখি অন্তরা ভেজা চুল মুচছে। আকাশি রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। চুল গুলো একপাশ করে মোছার কারণে ফর্সা পিঠ উন্মক্ত হয়েছিল। অনেক স্নিগ্ধ লাগছিল ওকে। আমি উঠে গিয়ে পিছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছিলাম। মুখ গুজে দিয়েছিলাম ওর ভেজা চুলে। অন্তরা কেঁপে উঠেছিল কিছুটা কিন্তু আমি ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলেছিলাম,
_ তোমার ভেজা চুলের গন্ধে আমি মিশে থাকতে চাই অন্তরা। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলাম ফ্রেস হতে।
এভাবেই চলছিল দিন। আমি হাল ছেড়ে দেইনি চালিয়ে যাচ্ছিলাম চেষ্টা। এই যেমন প্রতিদিন ওকে দিয়েই গলার টাই বাঁধাতাম। অফিসে যাওয়ার আগে ওর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়ে যেতাম। আর রোজ বাসায় ফেরার পথে বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসতাম। কিন্তু কখনো বেলি ফুলের মালা খোঁপায় পড়ার জন্য জোর করতাম না। অন্তরাও পড়তো না। মাঝে মাঝে ঘুরতে যেতাম। আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে লাগলো। অন্তরা আগের মতো আর আমাকে ভয় পেতো না। এইতো সেদিন অন্তরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিল। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্তরা বললো,
_ আপনার মুভি দেখা শেষ?
আমি অন্তরার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলাম। অন্তরা কিছুই বললো না। ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে আমার এমন হঠাৎ হঠাৎ স্পর্শ করায়। অন্তরা মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আমি বললাম,
_ উহু…শেষ না।
_ তাহলে?
_ ভাবলাম মুভি দেখার থেকে বরং আমার বউটাকে একটু সময় দেই। আমার বউটা নিশ্চই বোরিং ফিল করছিল?
অন্তরা কথা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললো,
_ দেখুন আজ কত সুন্দর চাঁদ উঠেছে।
_ কোন চাঁদটা দেখবো? ঘরের চাঁদটা নাকি বাইরের চাঁদটা?
_ রাত হয়েছে অনেক। ডিনার করবেন না?
_ কথা এড়িয়ে যাচ্ছো অন্তরা? নাকি লজ্জা পাচ্ছো?
_ কোনোটাই না, আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি আপনি আসুন। অন্তরা আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছিলো। আমি ওর হাত ধরে আটকিয়ে বললাম,
_ পালাচ্ছো? আমার থেকে এতো সহজে পালাতে পারবেনা তুমি। তুমি চাইলেও তুমি আমার তুমি না চাইলেও তুমিআমার অন্তরা। সারাজীবন আটকে রেখে দিবো আমার মনের খাঁচায়।
_ রাখেনতো আপনার ডায়ালগ। খেতে আসুন।
সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার বউটা লজ্জা পেতেও জানে। লজ্জা পেলে অন্তরাকে ভীষণ সুন্দর লাগে। এতোদিন এমনভাবে থাকতো মনে হতো কোনো জড়বস্তু। এভাবেই ধীরে ধীরে নিজ সত্তায় ফিরে আসছিলো অন্তরা। একদিন আমার চেষ্টা সার্থক হলো। অন্তরা নিজ থেকে আমার কাছে ধরা দিলো। ওকে আমি বোঝাতে পেরেছিলাম সব স্পর্শ এক না। কিছু স্পর্শ ভালোবাসার। সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি অন্তরা খুব সুন্দর করে সেজেছে। আজ আর খোলা চুলে নয় খোঁপা করেছে। অন্তরা এগিয়ে এসে বললো,
_ দিন পড়িয়ে দিনআমিও পরম যত্নে বেলি ফুলের মালা অন্তরার খোঁপায় পড়িয়ে দিলাম। অন্তরা আমাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে নিলেই আমি ওকে বুকে টেনে নিলাম। অন্তরা বললো,
_ আমি অপবিত্র, আমাকে ওরা অপবিত্র করে দিয়েছে। আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছুই নেই…
_ চুপ করো অন্তরা। তুমি অপবিত্র নও তুমি ফুলের মতো পবিত্র। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার ভালোবাসায় আমি সিক্ত হতে চাই…
_ তাহলে দূরে কেনো? আপনার স্পর্শে আমাকে পবিত্র করে দিন আমি দু’হাত বাড়িয়ে অন্তরাকে বুকে টেনে নিলাম। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমার বাহুডোরে। দুজনের চোখেই পানি। কিন্তু এই চোখের পানি দুঃখের নয় খুশির। আমি অন্তরাকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বললাম,
_ আজ তোমাকে এক অন্যরকম ভালোবাসার স্পর্শ অনুভব করাবো..