মোহনা ভেবেই রেখেছিলো রুমটা অগোছালো হবে। কিন্তু যতোখানি ভেবেছিলো রুমটার অবস্থা তার থেকেও খারাপ। মশারি এখনো টাঙানো রয়েছে। মশারির উপর গামছা ঝুলছে। বিছানার চাদর একপাশে মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। বিছানার নিচ থেকে হাত পাখাটা উঁকি দিচ্ছে। লাল রঙের দুটো স্যান্ডেল বিছানার দুপাশে পড়ে আছে। চেয়ারের উপর শার্ট প্যান্টের স্তূপ দেখা যাচ্ছে। মোহনা এক নজরে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো।
সামিউল ঘরে ঢুকেই শার্টটা পাল্টে মোহনার দিকে তাকিয়ে বললো “দেরি হয়ে গেলো। আসছি আমি।”
সামিউল অফিসে চলে যাওয়ার পরে মোহনা ঘর গোছানোর কাজে লেগে পড়লো। ময়লা ফেলার ঝুড়ি আর তোষকের নিচ থেকে ছাব্বিশটা খালি সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। ঘর গোছানো শেষ করে চেয়ারের উপর স্তূপ করে রাখা কাপড় গুলো ধুয়ে বারান্দার তারে শুকাতে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আড়াইটা বেঁজে গেছে। এখন আর রান্না করতে ইচ্ছা করছেনা তার। রান্নাঘরে রান্না করার মতো কিছু আছে কি নেই তাও জানা নেই। অনেক কাজ করেছে সে। বিয়ের আগে বাসায় এতো কাজ একসাথে কখনো করেনি সে। আজ অবশ্য কাজ করতে বিরক্ত লাগেনি তার। বরং ভালোই লাগছিলো। নিজের সংসার বলে কথা। বিয়ের পরে এই প্রথম তার নিজেকে নিজের কাছে বাড়ির কত্রী বলে মনে হচ্ছে। মোহনা গোসল সেরে বাসা থেকে সাথে করে নিয়ে আসা পরোটা আর মিষ্টি খেয়ে নিলো।
পাশের ঘরটা এখনো দেখা হয়নি। মোহনা দরজা খুলে পাশের ঘরে ঢুকতেই বেশ অবাক হলো। পাশাপাশি তিনটা বুকশেল্ফ ভর্তি বই। জানালার পাশে চেয়ার টেবিল। টেবিলের উপর কয়েকটা বই ছড়িয়ে আছে। কাঁচের মগে অনেকগুলো কলম রাখা। প্রত্যেকটা কলম ভিন্ন ভিন্ন। কাঁচের এ্যাঁশট্রেতে কয়েকটি সিগারেটের অবশিষ্ট। মোহনা চেয়ারে বসে একটা বই হাতে তুলে নিলো। বইয়ের ভেতর থেকে একটা ছবি নিচে পড়লো। মোহনা ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলো ছবির মেয়েটা সে। সামিউলের মা যেদিন তাকে দেখতে গিয়েছিলেন ছবিটা তিনি নিয়ে এসেছিলেন ছেলেকে দেখাবেন বলে। সামিউল মোহনার ছবি দেখে পছন্দ করলেও মোহনা বিয়েতে রাজি হয়েছিলো অন্য কারনে। মোহনা শুনেছিলো সামিউল একজন লেখক। সামিউলের ছোট বোন সুমাইয়া মোহনাকে দেখতে এসে তাকে আড়ালে ডেকে সামিউলের লেখা দুটি বই দিয়ে বলেছিলোঃ
“আমার ভাইয়ার লেখা বই।”
মোহনা অবাক হয়ে সুমাইয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিলোঃ “আচ্ছা তুমি কি যেই মেয়েকেই দেখতে যাও তাদের তোমার ভাইয়ার লেখা বই দাও?” সুমাইয়া মোহনার কথা শুনে হেসে বলেছিলো “সবাইকে দেইনা। যাকে আমার পছন্দ হয় তাকে দেই। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে তাই দিলাম।” “এর আগে কয়জনকে দিয়েছো?” “দুইজন কে” “আচ্ছা তাদের সাথে বিয়ে হলোনা কেন?” “তারা ভাইয়াকে পছন্দ করেনি।” “ও… আচ্ছা আমাকে তোমার পছন্দ হলো কেন?” “আপনি অনেক সুন্দর তাই। আপনার হাসিটা অনেক বেশি কিউট।” “আচ্ছা আমি যদি তোমার ভাইয়াকে পছন্দ না করি। তাহলে এর পরে কোন মেয়েকে দেখে যদি তোমার পছন্দ হয়। তুমি কি তাকেও তোমার ভাইয়ার বই গিফ্ট করবে?”
“আমার কাছে ভাইয়ার আর কোন বই নেই। আপনি ভাইয়াকে পছন্দ না করলে বইগুলো আমাকে ফেরত দিয়েন।” মোহনা সুমাইয়ার কথা শুনে বেশ শব্দ করে হেসেছিলো। আগের দুজন সামিউলকে কেন পছন্দ করেনি তা মোহনা জানেনা। কিন্তু সামিউলের লেখা পড়ে আর প্রথম দেখার পরে মোহনার বেশ পছন্দ হয়েছিলো। যেদিন সামিউলের সাথে তার প্রথম দেখা হয় সামিউল লজ্জায় ঠিক মতো কথাই বলতে পারছিলোনা। মোহনার দিকে ঠিক মতো তাকাচ্ছিলোনা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। মোহনা বেশ অবাক হয়েছে এটা দেখে যে বইয়ের পাতায় প্রেম আর রোমান্টিকতা নিয়ে শত বাক্য লেখা মানুষটা এতোখানি লাজুক। এমনকি বিয়ের এক সপ্তাহ পরেও সামিউল তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সংকোচ করে।
সামিউল বাসায় ফিরে দেখে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মোহনা পুরো বাসার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। এমনকি সিলিং ফ্যানে জমে থাকা ধূলো ময়লা পর্যন্ত পরিষ্কার করে রেখেছে। সন্ধ্যায় দুজনে একসাথে নাস্তা করার পরে সামিউল বাজারের ব্যাগ নিয়ে বের হলো। বাসায় ফেরার সময় সামিউলের কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো। আচ্ছা বাসায় ফিরে সে কি করবে। ত্রিশ বছরের জীবনে সে কখনো একা কোন মেয়ের সাথে থাকেনি। আচ্ছা রাতের খাবারের পরে সে কি মোহনার সাথে বসে গল্প করবে। কি গল্প করবে। স্বামী স্ত্রী কি গল্প করে। তারা কি তার লেখা বইয়ের চরিত্রগুলোর মতো রোমান্টিক গল্প করবে। কিছু রোমান্টিক মুহূর্ত কাটাবে একসাথে। কিন্তু মোহনার সামনে গেলে তার কেমন যেন অনুভব হয়। মোহনার চোখের দিকে তাকাতেই কেমন যেন লজ্জা করে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সামিউল বাসায় ফিরলো।
মোহনা তার দিকে তাকিয়ে বললো “এতোক্ষন সময় লাগে বাজার করতে।” সামিউল লক্ষ্য করলো মোহনা খুব দ্রুত তার সাথে মানিয়ে নিচ্ছে বা নেয়ার চেষ্টা করছে। এটা ভালো। সামিউল বিছানার উপর বসে টিভির রিমোটটা হাতে নিতেই মোহনা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বললো “তুমি তো টমেটো আনতে ভুলে গেছো।”
মোহনার কথা শুনে সামিউল রিমোট রেখে টমেটো আনার জন্য বের হচ্ছিলোনা। মোহনা ডেকে বললো “লেখক সাহেব কই চললেন? থাক এখন আর যেতে হবেনা।” সামিউল রোবটের মতো ফিরে এসে বিছানায় বসলো। মোহনা সামিউলের আচরনে অবাক হচ্ছে সাথে সাথে বেশ মজাও পাচ্ছে। রাতের খাওয়া শেষ করে দুজনে বসে টিভিতে হিন্দি সিনেমা দেখছে। কেউ কোন কথা বলছেনা। সিনেমায় নায়ক নায়িকার একটা অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখাতেই সামিউল টিভি বন্ধ করে দিলো। মোহনার দিকে না তাকিয়েই বললো “অনেক রাত হয়েছে। কাল সকালে অফিসে যেতে হবে।” লাইট অফ করে বিছানার দুপাশে দুজনে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষন পরে মোহনা তার কোমড়ে সামিউলের হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। মোহনা দু হাতে দুটো শাড়ি নিয়ে সামিউলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মোহনা সামিউলের দিকে তাকিয়ে বললোঃ
–এই কোন শাড়িটা পড়বো বলো না। বুঝতে পারছিনা কোন পড়বো। কোনটা বেশি মানাবে?
সামিউল শাড়ি দুটোর দিকে তাকিয়ে বললোঃ
-সবুজ শাড়িটা পড়ো।
–আমিও ভাবছিলাম সবুজ শাড়িটা পড়বো। কিন্তু এটার ম্যাচিং ব্লাউজটা তো ভুলে বাসায় রেখে এসেছি। এখন কি করি বলো তো।
-তাহলে মেরুন রঙেরটাই পড়ো।
–তুমি না বললে সবুজটা বেশি মানাবে।
-হুম বলেছি…
–তাহলে এখন কেন মেরুনটা পড়তে বলছো?
-একটা পড়লেই হলো। তুমি যেটা পড়ো সেটাতেই তোমাকে ভালো মানায়।
স্বামীর মুখে প্রশংসা শুনে মোহনা মৃদু হাসলো। শেষ মেষ সামিউলের পছন্দ মতো সবুজ শাড়িটাই পড়ে বের হলো। যদিও ম্যাচিং ব্লাউজ ছিলোনা। তবুও মোহনাকে সুন্দর মানিয়েছে। আজ ছুটির দিন তাই সামিউল বললো বাইরে কোথাও খেতে যাবে। মোহনা বলেছিলো “কি দরকার বাইরে খেয়ে টাকা নষ্ট করার।” যদিও তার ইচ্ছে করছিলো বাইরে যাওয়ার।
সামিউল বললো “খাওয়াটা তো বড় কথা না। সারাদিন বাসায় থাকো। বাইরে তো তেমন বের হওনা। এই সুযোগে বাইরে থেকে ঘুড়েও আসলে।”
বাসা থেকে বের হয়ে একটু সামনে এসেই মোহনা বললো “এই একটু দাঁড়াও, আসছি আমি।”
মোহনা বাসায় এসে পায়ে পায়েলটা পড়ে নিলো। গতকাল অফিস থেকে ফেরার সময় সামিউল নিয়ে এসেছিলো। সামিউল যদি তার বইয়ের নায়কের মতো হতো তাহলে ঠিক মোহনাকে বলতো “এই তোমার পা টা দেখি”। তারপর নিজ হাতে পড়িয়ে দিতো। কিন্তু সে কিনে এনে টেবিলের উপর রেখেছিলো। মোহনার এতে কোন আপত্তি নেই। আদিখ্যেতার চেয়ে বড় হলো ভালোবাসা। সামিউল ভালোবেসে এনেছে এতেই মোহনা খুশি।
সামিউলের ইচ্ছা করছে মোহনার হাতটা ধরতে। আবার সংকোচ ও হচ্ছে। রাস্তায় এতো মানুষ। কেউ দেখলে কি ভাববে। মোহনা রিকশায় চড়ার পর থেকেই অনর্গল কথা বলছে। সামিউল মোহনার দিকে তাকিয়ে ভাবছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা হয়তো সে।
সামিউলের পকেটে ফোনটা বাঁজছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আশরাফুল ভাইয়ের ফোন। আশরাফুল ভাই একজন প্রকাশক যিনি তার প্রথম বইটা প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম বইটা খুব একটা বিক্রি না হওয়ায় তিনি দ্বিতীয় বইটা ছাপাতে চাননি। তিনি ভুল ছিলেন না সামিউলের দ্বিতীয় বইটাও তেমন বিক্রি হয়নি। তবে আশরাফুল ভাই ফোন করে বলেছিলেন “হতাশ হবেন না। বইটা আমি পড়েছি। ভালোই লিখেছেন। নতুন কোন পান্ডুলিপি থাকলে দিন পড়ে দেখি।”
সামিউল ফোনটা রিসিভ করলোঃ
-হ্যালো ভাই আসসালামুআলাইকুম।
–ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি ব্যাপার কোথায় হারিয়ে গেছেন। শুনলাম বিয়ে করেছেন। তো একদিন ভাবিকে নিয়ে আসুন।
-জ্বি ভাই যাবো।
–যে জন্য ফোন করা। আপনাকে বলেছিলাম নতুন পান্ডুলিপি পাঠাতে। তার কি হলো?
-এখনো শেষ করতে পারিনি। শেষ করে পাঠাবো।
–তাড়াতাড়ি করুন মশাই। এতো বড় বিশ্রাম নিলে হবে?
-জ্বি শেষ করে জানাবো।
দুজনে দুপুরের খাওয়া শেষে চিড়িয়াখানায় গেলো। বাঁদরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বাদাম খাওয়ানোর সময় একটা বাঁদরের বাচ্চা সামিউলকে দেখে ভেংচি কাটছিলো। মোহনা তা দেখে হাসতে হাসতে চোখ থেকে পানি বের করে ফেলেছে। এমন অবস্থা হয়েছে বেচারি আর হাসতেই পারছেনা। সামিউল যতো বলছে চলো এখান থেকে মোহনা সেখন থেকে এক পা নড়তে নারাজ। সামিউল চলে যাচ্ছিলো মোহনা তার হাত ধরে আটকে রেখেছে।
বাসায় ফেরার পর থেকে সামিউল লক্ষ্য করলো গত একমাস ধরে সে একটা শব্দও লিখেনি। এমনকি পাশের রুমেই যায়নি। কোন বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ পর্যন্ত বুলায়নি। নতুন সংসার নিয়ে এতোখানি ব্যস্ত ছিলো যে তার শুরু করা লেখাটাকে শেষ করার কথা ভুলেই গেছে। সত্যি বলতে মোহনার ভালোবাসা আর মোহনার প্রতি প্রবল আকর্ষন সামিউলকে ভুলিয়ে রেখেছে।
অথচ বিয়ের আগে অফিস থেকে এসেই ফ্লাক্স ভর্তি চা নিয়ে লিখতে বসতো। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বই পড়তো। কতো রাত এভাবেই নির্ঘুম কাটতো তার সে হিসেব নেই। রাতে খাওয়া শেষ করে সামিউল পাশের রুমে গিয়ে বসলো। মোহনা এসে সামিউলকে ডাকলো “ঘুমাবেনা তুমি?”।
সামিউল বললো “তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি দেরিতে ঘুমাবো।”
মোহনা শোয়ার ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলো তার। অন্ধকারের মধ্যে বিছানায় হাত বাড়িয়ে দেখলো সামিউল নেই। মোহনা লাইট অন করে ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে তিনটা বাঁজে। পাশে রুমে আলো জ্বলছে। তারমানে সামিউল এখনো লিখছে। মোহনা পাশের রুমের দরজা খুলে দেখলো সামিউল কলম হাতে চুপচাপ বসে আছে। তার অন্যহাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ঘরটায় ঢুকতেই সিগারেটের গন্ধে মোহনার গা গুলাতে লাগলো। মোহনা সামিউলের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বললো “এখনো লিখছো। কতো রাত হয়েছে সে খেয়াল আছে তোমার। কাল তো আবার অফিস আছে। চলো ঘুমাতে চলো। বাকিটুকু নাহয় পরে লিখবে।”
সামিউল বললো “আমি লিখতে পারছিনা মোহনা। অনেকক্ষন ধরে বসে আছি কিন্তু লিখতে পারছিনা। মাথাটা শূণ্য মনে হচ্ছে।”
মোহনা সামিউলের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে এ্যাঁশট্রেতে নিভিয়ে বললো “অনেকদিন পরে লিখতে বসেছো তাই হয়তো এমন হচ্ছে। ঠিক হয়ে যাবে আসো।”
সামিউল কথা না বাড়িয়ে মোহনার সাথে এসে শুয়ে পড়লো। তার ঘুম আসছেনা। মাথার মধ্যে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। সে লিখতে পারছেনা। সামিউল বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। মোহনা বললো “কি হলো, ঘুম আসছেনা। আচ্ছা আমি চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি। তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
কয়েকদিন ধরে সামিউল চেষ্টা করেও কিছু লিখতে পারছেনা। দু পৃষ্ঠা লিখার পরে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। কাগজগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে ময়লা ফেলার ঝুড়ি ভরছে শুধু। অফিসের কাজে মন বসছেনা একদম। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। এক অজানা ভয় সামিউলের মনে বাসা বেঁধেছে। তার মনে হচ্ছে সে লিখতে ভুলে গেছে। বাসায় ফিরেই সামিউল বিছানার উপর ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেললো। শার্টটা খুলে চেয়ারের উপর রাখলো। পাশের রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো।
সামিউল সাদা পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন ভাবার পরে চার লাইন লিখলো। তারপর কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দিলো। বুকশেল্ফ থেকে বই নিয়ে পড়তে শুরু করলো।
কিছুদিন ধরে মোহনা সামিউলের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে। সামিউল বাসা ফিরেই পাশের ঘরে চলে যায়। দরজা লক করে দেয়। ডাকাডাকি করলেও কোন সাড়া দেয়না। শেষ রাতে ঘুমাতে আসে। তখন তার শরীর থেকে সিগারেটের তীব্র গন্ধ আসে। গতকাল রাতে তো ও ঘরেই ঘুমিয়েছিলো। সামিউলের এমন পরিবর্তনে মোহনা খুব বেশি অবাক হচ্ছিলো। মানুষটা দুদিন রাতে খায়নি। মোহনা কিছু বলতে গেলেই বিরক্ত হচ্ছে। মোহনার এখন কি করা উচিত সে বুঝতে পারছেনা। মোহনা টেবিলে রাতের খাবার বেড়ে সামিউলকে ডাকতে গেলো। কয়েকবার দরজায় নক করার পরে সামিউল খুব রাগী গলায় বললো “এখান থেকে যাও তো প্লিজ। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।” বিয়ের পরে এই প্রথম সামিউল মোহনার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করলো। মোহনা বাথরুমে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন কাঁদলো। রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়লো।
আজ সামিউলের ছুটির দিন। মোহনা সামিউলকে কিছুদিন আগেই বলে রেখেছিলো পাশাপাশি শহরে থাকে অথচ অনেকদিন বাবার বাসায় যায়না। বাসার কথা খুব মনে পড়ে তার। সামিউল বলেছিলো এবারের ছুটিতে যাবে। মোহনা সামিউলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বলবে কি বলবেনা সেটা ভাবছে। সামিউল বললোঃ
-কিছু বলবে?
–তুমি বলেছিলে এবারের ছুটিতে বাবার বাসায় যাবো।
-দেখ মোহনা আমি একটু ব্যস্ত আছি। প্লিজ মন খারাপ করোনা। আমরা পরের ছুটিতে যাবো।
সামিউলের কথা শুনে মোহনার কান্না পাচ্ছিলো। সে সামিউলের সামনে কাঁদতে চায়না। তাই রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। সামিউল পাশের ঘরে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। সামিউল ভার্টিসি পড়ুয়া প্রজ্ঞা আর ওয়াসিফকে নিয়ে লিখছে। কিভাবে দুই বন্ধু ধীরে ধীরে একে অন্যের প্রেমে পড়ে। এসময় সামিউলের মাথায় শুধু তাদের দুজনের কথাই ঘুরছে। অথচ মোহনা যে তার এমন আচরনে কষ্ট পাচ্ছে সেদিকে তার বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই। সে দিনরাত লিখছে। অফিসে গেলে শুধু মনে হয় কখন বাসায় ফিরে লিখবে। কখন লেখাটা শেষ করবে।
সামিউল বাসা ফিরে দেখলো মোহনার মা এসেছেন। সামিউল দুমিনিট কথা বলেই পাশের রুমে চলে গেলো। মোহনার মা মোহনাকে বললো “কিরে আমি না জানিয়ে আসায় কি জামাই রাগ করেছে নাকি?” মায়ের কথা শুনে মোহনা অবাক হয়ে বললো “না তো। তুমি এভাবে বলছো কেন। ও কি তোমাকে কিছু বলেছে?”
“না কিছু বলেনি তবে এসেই ও ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ঠিক মতো কথা পর্যন্ত বললোনা।” “না মা আসলে ওর অফিসে একটু সমস্যা হয়েছে তো তাই ও একটু টেনশনে আছে।”
মোহনার বড় ভাই রাতে এসে মা কে নিয়ে গেলেন। মোহনার খুব রাগ হচ্ছে সামিউলের উপর। কি শুরু করেছে সে। সবকিছুর একটা সীমা আছে। মোহনা কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর পরে সামিউল দরজা খুললো। মোহনা বললোঃ
–তোমার সমস্যাটা কি বলবে প্লিজ।
-কিসের সমস্যা?
–তুমি জানোনা কি সমস্যা? কিছুদিন ধরে কি শুরু করেছো তুমি।
-কেন আমি কি করলাম। দেখ মোহনা বিরক্ত করোনা। ভালো লাগছেনা কথা বলতে।
–কি ভালো লাগছেনা? আমার কথা নাকি আমাকে। সারাদিন ও ঘরে কি করো?
-লিখছি।
–লিখছো ঠিক আছে। তারমানে এটা না যে লিখলে বাকি দুনিয়া ভুলে যেতে হবে। তুমি আমাকে সময় দিচ্ছোনা। সময় মতো খাচ্ছোনা। সময় মতো ঘুমাচ্ছোনা। একের পর এক সিগারেট খাচ্ছো। নিজেকে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছো? তুমি খুব বড় লেখক? বড় লেখকরাও তো নিজের জীবনের বাকি কাজগুলো ঠিক মতো করে।
-হ্যাঁ তারা করে। কিন্তু আমি পারিনা। হ্যাঁ আমি বড় লেখক নই। তবে আমি যেভাবে লিখি সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়।
–তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার কথা বলার অধিকার রয়েছে।
-হ্যাঁ রয়েছে। তবে কেউ আমার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে সেটা মাথায় নিয়ে লিখতে পারিনা। কোন প্রকার দ্বায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে লিখতে পারিনা।
–খালি কলসি বাঁজে বেশি। দু টাকার লেখকের ভাব বেশি।
সামিউলের কথা বলতে ইচ্ছা করছিলোনা। সে বাসা থেকে বের হয়ে আসলো।
সামিউল বাসা থেকে বের হবার কিছুক্ষন পরে মোহনার খারাপ লাগা শুরু হলো। রাগের মাথায় সামিউলকে অনেক কথা শুনিয়েছে সে। তার মনে হচ্ছে কথাগুলো বলা একদম উচিত হয়নি। সামিউল হয়তো কষ্ট পেয়েছে। আসলে এতোদিনের জমানো রাগের কারনে কি বলতে কি বলেছে নিজেও বুঝতে পারেনি। কিন্তু এসব সেও আর নিতে পারছিলোনা।
সামিউল বাসা ফিরে মোহনার সাথে কোন কথা বললোনা। তার মাথায় প্রজ্ঞা আর ওয়াসিফ ঘুড়ছে। প্রজ্ঞা বা ওয়াসিফ কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলতে পারছেনা। বলতে চাচ্ছেনা। প্রজ্ঞা আর ওয়াসিফের মাঝে সবচেয়ে বড় বাঁধা হলো তাদের ধর্ম। কিন্তু তাদের গল্পটা কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে বুঝতে পারছেনা সামিউল। তার কেন যেন মনে হচ্ছে মোহনা ঠিক বলেছে। খালি কলসি বাঁজে বেশি। সে একটা খালি কলসি। সামিউল অনেকক্ষন বসে থাকার পরে সব কলমগুলো জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেললো। কাগজগুলো ছিঁড়ে ময়লা ফেলার ঝুঁড়িতে ফেলে দিলো। সে লিখতে পারছেনা। সামিউল যখন বাসা থেকে বের হয়েছে তখন মোহনা ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মাঝরাতে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো মোহনার। মোহনা ঘুম থেকে জেগে সামিউলকে খুঁজলো কিন্তু বাসায় কোথাও পেলেনা। বাইরের দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “কে?”
দরজার ওপাশ থেকে সামিউল বললো “দরজা খোলো।”
মোহনা দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো দরজা বাইরে থেকে আটকানো। সামিউল বের হবার সময় দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে গেছে। মোহনা বললো “দরজার বাইরে থেকে বন্ধ করা।”
সামিউলে বাইরে থেকে দরজা খুলতেই মোহনা বাজে গন্ধ পেলো। মোহনা খুব বেশি অবাক হয়ে বললো “তুমি নেশা করেছো? ছিঃ”
মোহনা চেয়ারে বসে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে খুব সকাল সকাল বাবার বাসায় চলে গেলো। সে যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিলো সামিউল অচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে ছিলো।
নেশা করার কারনে সামিউলের হেলুসিনেশন হচ্ছে। চোখ খুলেই সে দেখতে পেলো চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশে ছোট বড় তারা মিটমিট করে জ্বলছে। আবারো কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
দশ দিন হতে চললো মোহনা বাবার বাসায় আছে। এই দশদিনে সামিউল যোগাযোগ করার কোন চেষ্টা করেনি। মোহনাও নিজ থেকে ফোন করেনি। মোহনা একাকিত্বে সেই সামিউলকে খুব বেশি মিস করে যেই মানুষটা তার চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা পেতো। অফিস থেকে ফেরার সময় তার জন্য বুক পকেটে কিছু নিয়ে আসতো। রিকশায় বসে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আচ্ছা সেই মানুষটা কি বদলে গেছে। মোহনা কি কখনো সেই মানুষটাকে ফিরে পাবেনা। এ জীবনে কি পুরোনো সেই সামিউলকে কখনো সে ফিরে পাবে যাকে সে খুব বেশি ভালোবাসে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মোহনার চোখ ভিজে আসে।
সামিউল কয়েকদিন ধরে অফিস যাচ্ছেনা। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়িতে তাকে বেশ অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সামিউলের কষ্ট হচ্ছে প্রজ্ঞা আর ওয়াসিফের জন্য। প্রজ্ঞার বিয়ে হয়েছে অমিত নামের এক ভদ্রলোকের সাথে। ওয়াসিফ এখনো বিয়ে করেনি। দুজনে মাঝে মাঝে কফি শপে দেখা করে। প্রজ্ঞার খুব বেশি ইচ্ছে করে ওয়াসিফের হাতটা একটু ধরতে। প্রজ্ঞা ওয়াসিফের দিকে হাত বাড়াতেই তার হাতের শাখা আর চুড়ির শব্দে হাত থেমে যায়। ওয়াসিফের হাত ধরতে পারেনা আর। প্রজ্ঞা চেষ্টা করে অমিতকে ভালোবাসতে কিন্তু পারেনা। তার পুরোটা জুড়েই যে ওয়াসিফের বসবাস। প্রজ্ঞা আর ওয়াসিফ জানে তারা কখনো এক হতে পারবেনা। তবুও মাঝে মাঝে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেখা করে দুজনে। কেউ কাউকে স্পর্শ করেনা শুধু দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের চোখেই না পাওয়ার বেদনা আবার একই সাথে ভালোবাসার তৃষ্ণা। সামিউল তার উপন্যাস শেষ করার আগে লিখলোঃ
প্রজ্ঞা ছলছলে চোখ নিয়ে ওয়াসিফের দিকে তাকিয়ে বললো “জানি তুমি আমার হবেনা তবুও ভালোবাসার তৃষ্ণা নিয়ে আমি বারবার তোমার কাছে ফিরে আসবো। জানি তৃষ্ণার জল তুমি। তুমি পেয়ালা ভরে ভালোবাসার জল এগিয়ে দিলেও আমি পান করতে পারবোনা। এ তৃষ্ণা মিটবার নয়। তোমার তৃষ্ণায় একজন হারিয়ে যাবো। যদি সেখানে ভালোবাসার হয় মূল্যায়ন সেদিন আমি পান করবো তোমার ভালোবাসার জল। তার আগে নয়।”
সামিউল তার উপন্যাসের নাম দিয়েছে তৃষ্ণা।
আশরাফুল ভাইকে সামিউল তার লেখা তৃতীয় উপন্যাস তৃষ্ণার পান্ডুলিপি দিয়ে এসেছে। অসুস্থ্যতার অযুহাত দেখিয়ে চাকরিটা বাঁচিয়েছে সে। কিন্তু অফিস শেষ করে বাসায় ফিরে শূণ্যতা অনুভব করে সে। পুরো বাসা খালি খালি মনে হয় তার কাছে। মোহনার অনুপস্থিতি তাকে খুব করে পোঁড়ায়।
সুমাইয়া একটু আগে এসে মোহনার হাতে সামিউলের লেখা নতুন বইটা দিয়ে গেছে। বইয়ের নাম তৃষ্ণা। মোহনা অবাক হলো বইটা সামিউল উৎসর্গ করেছে তাকে। সামিউল বইয়ের পৃষ্ঠায় একটা লাইন লিখেছে “মোহনা আমি তৃষ্ণার্ত। ফিরে এসো তৃষ্ণার জল হয়ে।”
মোহনা বইটা বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। অন্য শহরে একই সময় সামিউলের চোখটা ভিজে এসেছে মোহনার জন্য।
ঘরে ঢুকতেই মোহনার প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। মোহনার অনুপস্থিতে ঘরটা ঠিক আগের মতো অগোছালো করে রেখেছে সামিউল। মোহনা ঘরে ঢুকেই বললো “ইশ কি অবস্থা করেছো বাসার। আমি কিন্তু এসব পরিষ্কার করতে পারবোনা। সব তোমাকেই পরিষ্কার করতে হবে।”
সামিউল কোন কথা বলেনি। মোহনাকে বাহুডোরে শক্ত করে ধরে রেখেছে।।