বাবার পোস্টে তৌসিফ স্যারের ট্যাগ করতে দেখে আমার ভীষণ রাগ ধরছিল। তৌসিফ স্যার আমাদের কলেজের প্রোগ্রামিংয়ের স্যার। আমার এমনিতেই বাবার সাথে কোন স্যারের পরিচয় কিংবা মেলামেশা খুব একটা পছন্দ না। এর ফলে আমার অনেক গোপন কথা শত্রুপক্ষের কাছে পাচার হয়ে যায়।
আমি ফেসবুকের হোমপেজ স্ক্রল করছি আর রাগে ফুলছি। ঠিক তখনই আমার ফোনের স্ক্রিনে নিশাতের নামটা ভেসে উঠল। নিশাত ফোন দিয়েছে। এই মেয়ে কি নিশাচর প্রাণী নাকি ? এতো রাতে কি কেউ ফোন দেয় ? কোন কান্ড জ্ঞান নাই এই মেয়ের।
এমনিতেই আমার মাথা গরম হয়েছে আছে। হোক সেটা অহেতুক কারণ। তবুও কেন জানি আমার রাগ হচ্ছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। বোধহয় কাউকে খুন করতে পারলে এই রাগ কমবে। কিন্তু এই রাতে কাকেই বা খুন করা যায় ?
এইসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা করতে করতে ফোনটা কেটে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার নিশাতের ফোন এলো। আমি এবার কাল বিলম্ব না করে ফোনটা ধরে ফেললাম।
নিশাত: ফোন ধরতে এতো টাইম লাগে কেন ?
কি মেয়েরে বাবা !!! আমাকে এতো রাতে ফোন দেওয়ার জন্য আমার ওকে ঝাড়ি দেওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো ও আমাকেই ঝাড়ছে।
নিশাত: কিরে কথা বলছিস না কেন ?
আমি চুপ করে আছি। ইচ্ছে করেই। ওর কথা শুনতে ভালো লাগছে কেন জানি। খেয়াল করলাম আমার রাগটাও আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। এইটা সবসময় হয়। নিশাত যখনই আমার সাথে কথা বলে তখনই আমি দুনিয়াদারি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আমি জানি এখন ওর ঘুম আসছে না। আর সে জন্য ও সারারাত আমার সাথে কথা বলবে আর আমাকেও ঘুমাতে দিবে না।
নিশাত শাহরিয়ার। নাম এবং স্বভাব দুটোই ভিন্ন। একই ডিপার্টমেন্টের হওয়ার একে অপরকে চিনতাম ঠিকই কিন্তু কখনো আগ বাড়িয়ে কথা বলি নি। আমাকে দেখলে প্রথমে অনেকেই শান্ত এবং ভদ্র মনে করে। কিন্তু আমি যে কি তা একমাত্র আমি আর আমার উপরওয়ালায় ভালো জানেন।
সাধারণত আমি মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলি না। এর কোন বিশেষ কারণ নেই। এমনিতেই। ভালো লাগে না কথা বলতে। তবে আমার জীবনের প্রথম বন্ধুই ছিল এক মেয়ে। সে অবশ্য আমার থেকে কেবল এক বছরের সিনিয়র ছিল।
নিশাতের সাথে আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক আছে তা আমি প্রথমে জানতাম না। পরে জানলেও এ নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় নি।
তবে সেই বড় ভাই ছিল একেবারে শেষ বর্ষের আর আমরা প্রথম। ভাইয়ের সেমিস্টার শেষ হল। ভাইয়ের সাথে নিশাতের প্রেমও অসমাপ্ত থেকে গেল।
নিশাত তার প্রেমের চাকা চালানোর জন্য নতুন কাওকে খুঁজছিল। পেয়েও গেল। রুদ্র এমনিতেই মেয়েদের সাথে বেশ মেলামেশা করত। আর নিশাতের সাথে তার ভাবসাবও ভালোই ছিল। তাই রুদ্র রাজি হয়ে গেল। যদিও সে জানত নিশাত টাইম করার জন্যেই প্রেম করে। যদিও বা রুদ্র আর নিশাতের প্রেম সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিপূর্ণ পেত না। কারণটা না হয় নাই বললাম।
তবে নিশাত রুদ্রকে বেশি দিন স্থায়ী করে রাখতে পারে নি। সে দিন আমি ইলেকট্রনিক ল্যাবে প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড নিয়ে কাজ করছি। মাহি এসে আমার মনযোগে বাধা দিল।
,,,ওই,,,,
আমি রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ও খুব ভালো করেই জানে যে আমি কাজের সময় কোনো রূপ ডিস্টার্বেন্স পছন্দ করি না। তবুও এসে দিল আমার মনযোগ নষ্ট করে।
এই মেয়ের সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু বললার নেই। সাধারণত আধুনিক সমাজের স্কুল কলেজের মেয়েরা ছেলেদের সাথে অনেকটাই ফ্রি। তবে ও একটু আলাদা গোছের মেয়ে। ছেলেদের সাথে একেবারেই মেশে না। আরো ভালো করে বলতে গেলে ছেলেদের দিকে তাকাই পর্যন্ত না। কিন্তু আমার সাথে ও কিভাবে এতো ফ্রি বুঝি না।
মাহি নামটা যদিও বা ওর আসল নাম না। এটা ওর পরিবারের লোকজনেরা ডাকে। আমি তাদের পরিবারের কেউ নয়। আবার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও নয়। তবে ও আমাকে ওকে এই নামেই সম্বোধন করতে বলেছিল।
মাঝে মাঝে মনে হয় ও আমার দিকে অন্য নজরে দেখে। হতে পারে সেটা ভালোবাসা কিংবা অন্য কিছু। তবে আমি মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলি না। আর ওকে সে নজরে দেখিও না। ও দেখতে আহামরি না। মুখশ্রী শ্যামলা তবে কিঞ্চিৎ কালো। তবে কিছু কিছু মেয়েদের মায়া বলে একটা জিনিস আছে। আর ও যখন গোল গোল চশমা পরে তখন আমি ওকে চাশমিস পেত্নি বলে ডাকি।
মাহি বলল,
,,,তোকে নিশাত ডাকে।
নিশাত আমাকে কেন ডাকতে যাবে ? নিশাতকে আমি মনে মনে পছন্দ করি ঠিকই তবে কখনো প্রকাশ করি নি। ও আমার প্রথম ভালোবাসা নয়। যদিও বা এটা ভালোবাসা কিনা জানি না। আর তাছাড়া এর আগেও আমার একজনকে ভালো লেগেছিল। সেই ক্লাস সিক্স থেকে একেবারে ক্লাস টেন পর্যন্ত। মেয়েটার নাম নাবিলা। ওকেও সাহসের অভাবে আর সংশয়ের কারণে কোনদিন বলা হয় নি। ওর সাথে ভালোভাবে সক্ষতাটাও বেশ হুট করে হয়ে যায়। তাও আবার স্কুল লাইফের শেষের দিকে।
আমার অনেককেই দেখলে ভালো লাগে। কিন্তু ভালো লাগা আর বাসা তো ভিন্ন জিনিস। তাছাড়াও আমি বেশ চুপচাপ আর বোকা টাইপের। হয়তোবা। আমার নিজের বেশ অবাক লাগে যে আমার জীবনের প্রথম বন্ধুই মেয়ে। তাও আমার মধ্যে এতো সংশয়।
আমি নিশাতের কাছে যেতেই নিশাত টুকিটাকি কথাবার্তা বলতে লাগলো। এর আগেও কথা বলেছি তবে সেগুলো এতোটা দীর্ঘ ছিল না। আমার স্কুল লাইফের বান্ধবী তিথি আমার কলেজে একই ডিপার্টমেন্টে আর নিশাতের ভালো ফ্রেন্ড। একারণে নিশাতের সাথে আমার আলাপ আরো বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে আমার মনে লুকিয়ে থাকা ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণত হতে থাকল।
একটা জিনিস আমি আচ করতে পেরেছিলাম যে নিশাত আমার সাথে বন্ধুত্ব আর গভীর করতে চাই। আমি এটা জানতাম যে নিশাত এমনি এমনি আমার প্রতি এতো বন্ধুসুলভ আচরণ করছে না। তবে ও কি জন্য আমার সাথে যেচে পড়ে বন্ধুত্ব করতে এসেছে সেটা আরো পরে বুঝতে পারি। নিশাত এমনিতেই চঞ্চল স্বভাবের আর ছেলেদের সাথেও তার অগাধ মেলামেশা আছে। তবে ও এইটা আচ করতে পেরেছিল যে আমি ওকে পছন্দ করি। সে কারণে ও কেবল ওর মনোরঞ্জনের জন্যই আমাকে ওর সাথে রেখেছিল। মনোরঞ্জন কেন বললাম ? নিশাত আমাকে সব জায়গায় ওর সাথে নিয়ে যেত। আর ও এমন সব জায়গায় যেত যেখানে আমার মতো মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। ও যে বড় ঘরের ছিল তা নয়। আসলে সমাজে সবার সাথে মিশতে মিশতে আমরা সেই সমাজের চাল চলনে অভ্যস্থ হয়ে যায়। নিশাতের বেলাও ঠিক সেরকম। ও নিজের অবস্থান ভুলে গিয়েছিল। ও মেয়ে মানুষ। ওর রূপ সৌন্দর্য দেখে বড় ঘরে ওর বিয়ে হবে ঠিকই। কিন্তু আমার মতো ছেলেকে কোন রিকশাওয়ালাও মেয়ে দিতে চাইবে না। না চাওয়াটাই স্বাভাবিক। বাবা মাতো সন্তানের ভালো চাই। এইজন্য তারা মেয়ের জন্য বড় ঘর খুঁজে। কিন্তু মাঝে মাঝে তারা নিজেদের জালে নিজেরাই ফেসে যায়। অনেকে তো নিজ মেয়েকে হারাই। আসলে তাদের দোষ না। মানুষের কাছে গিরগিটির থেকেও বড় ক্ষমতা আছে রং বদলানোর। গিরগিটির ক্ষমতাটা তো বিধাতা দিয়েছেন। আর মানুষ সেই ক্ষমতা নিজেরাই অরজন করেছে। সুযোগ বুঝে আসল রূপ দেখায়।
নিশাতের সাথে আমার সম্পর্ক প্রেমে পরিণয় পাই। আমি কেন জানি নিজেও নিজের অবস্থানটা ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ওকে বলেছিলাম,
,,,চল আমাদের কথা বলেদি আমাদের বাসায়। তারাও আগাক আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।
নিশাত বেশ খানিকটা ধমকের সুরে,
,,,তোর এতো তারা কিসের সেটাই তো বুঝলাম না। এই সেমিস্টার পারলেই তো আমাদের ইন্টার্নি শুরু। তখন না হয় বলব।
আমি আর কিছু বললাম না। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি নিয়ে খুব একটা কঠিন কাজ না। আর নিশাত চাইলেই তার পরিবারকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে মানাতে পারবে আমি নিশ্চিত।
সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি আর নিশাত আর আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে একটা দোকানের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। ও বলল,
,,,এখানে আর কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব ?
,,,বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণই তো দেখছি না।
,,,হুম সেটাই তো।
আমি নিশাতের জামা বেশ খানিকটা ভিজে গেছে। নিশাতের শরীর অনেক অংশ দেখা যাচ্ছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা একটা টং দোকান। দোকানে বসে থাকা লোকগুলো নিশাতের দিকে কেমন জানি লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল। আমার ভালো লাগছিল না এসব। তাই আমি নিশাতকে টান দিয়ে সরিয়ে একটা বৃহৎ বটগাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম।
,,,কি রে এভাবে টেনে নিয়ে এলি কেন ?
,,,তোর জামা পুরো ভিজে গেছে।
নিশাত এবার নিজের দিকে লক্ষ্য করলো। সত্যিই তো। নিশাত বেশ খানিকটা লজ্জা পেল।
কলেজ থেকে সবাই কক্সবাজারে পিকনিকে এসেছি। রাতের বেলা যখন হোটেলে থাকতে যাব ঠিক তখনি বাঁধল বিপত্তি। আমার যেই রুমে থাকব সেই রুমের মধ্যে দিয়ে আরেকটা রুমে যেতে হবে। নিশাত নিজে থেকেই বলল ও আমার রুমের পাশের রুমটাই নেবে।
রাতে আমি যখনি ঘুমাচ্ছিলাম ঠিক তখনি আমার কানের কাছে কেমন যেন শব্দ হতে লাগলো। আমি চোখ খুলে দেখলাম যে নিশাত ঘুম মাখা চোখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। নিশাত এসেই আমার কোলের উপর উঠে এলো। সর্বনাশ। নিশাতের চোখ দেখে মনে হচ্ছে নেশা করেছে।।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। এবং সেটি যে ঠিক না তাও আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু সমস্যা হলো আমি এসব করার মতো মন মানসিকতায় নেই। তবে নিশাত যে নেশা করেছে এবং সে নেশার ঘোরে এসব করতে চাচ্ছে তাও বুঝতে পারছি। তবে ও তো ওই রকম মেয়ে নয়। বোধহয় ওর বান্ধবীরা মিলে ওকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে।
আমি বুঝতে পারছি না যে এই মূহুর্তে আমার ঠিক কি করা উচিত।
সকালবেলা,
আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার পাশে নিশাত ঘুমিয়ে আছে। নিশাতকে এই মুহূর্তে দেখতে পুরো বাচ্চাদের মতো লাগছে। কি রকম গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ইস,,, গালে একটা চুমু দিতে ইচ্ছে করছে। ধুর কি সব ভাবছি এগুলো !!!
কাল রাতের কথা মনে পড়ল। কাল রাতে নিশাতকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। নিশাত আমার সাথে ঘনিষ্ট হতে চাচ্ছিল এটা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। আর ও যে নেশার ঘরে ছিল তাও বুঝতে পারছিলাম। আমি চাইলেই এর সুযোগ নিতে পারতাম। কিন্তু আমার এসব করার কোন মুড ছিল না। নাহলে ধর্ষক আর আমার মধ্যে পার্থক্যই বা কি থাকত ?
বেশ বেলা করে নিশাতের ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙতেই যখন নিজেকে আমার ঘরের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করল তখন সে বেশ অবাক হয়েছিল। তারপরেই তার মধ্যে ভয় জেকে বসল। সে নিজের জামা কাপড়ের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সবই তো ঠিক আছে। তাহলে ? হটাৎ তার মনে পড়ল তার বান্ধবী অধরা তাকে জোর করে কিছুটা ভদকা খাইয়ে দিয়েছিল। সে খেতে চাইনি তবুও। তারপর কি হয়েছে তার স্পষ্ট মনে নেই। তবে যতদূর মনে পরে সে কাম নেশায় আমার দিকে এগিয়ে আসছিল।
আমি ওয়াসরুম থেকে বেরিয়েই দেখলাম নিশাত ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি যে নিশাত কালকের কোন কথায় মনে করতে পারছে না। স্বাভাবিক ! আমি নিজে থেকেই ওকে আশ্বাস দিয়ে বললাম,
,,, চিন্তা করার কারণ নেই কাল রাতে কিছুই হয় নি। তুমি নিজের রুমে গিয়ে চেঞ্জ হয়ে আসো।
নিশাত কিছুক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারপর কি মনে করে নিজের রুমে চলে গেল। আমি ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তখনি আমার মনে পড়ল আমি ওকে তুমি বলে ফেলেছি। আমার খানিকটা অবাক লাগলেও তেমন মাথা ঘামালাম না। তুমি বলা জেতেই পারে। এতে খারাপ কি ?
আর বেশ কিছুদিন কেটে গেল কক্সবাজারে। এ কটা দিন ও আমার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনি। হয়তো সেদিনের ঘটনা এখনো তার মনে লেগে আছে। হয়তো তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
যেদিন আমরা চলে যাব সেদিন বাসে ও আর আমি পাশাপাশি সিটে বসলাম। কেন জানি তখন আমার অদ্ভুদ অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। ঠিক তখনি নিশাত আমার হাত আঁকড়ে ধরল। আমার হার্টবিট আর বেড়ে গেল। আমি নিশাতের দিকে তাকালাম। নিশাত আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে আবার আমার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। আমার এই মুহূর্তে কেন জানি অদ্ভুদ শান্তি লাগছে।
নিশাত আবার বলল,
,,, কি রে, কোথায় হারিয়ে গেলি ? সেই তখন থেকে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছি।
,,, হ্যাঁ, বল শুনতেছি।
,,, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।
,,, হুম।
,,, ছেলে নাসাতে জব করে।
,,, এতো ভালো খবর।
,,, তোর একটুও কষ্ট হবে না।
,,, আগে হয়লে হয়তো হতো।
,,, আজ তোর জায়গায় আমার থাকার কথা ছিল তাই না।
,,, তোকে ওইভাবে দেখতে পারবো না বলেই আজ আমার এই অবস্থা।
,,, সরি।
,,, সরি কেন ?
,,, তোকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না। তোকে আমি বলেছিলাম যে সারাজীবন আমি তোর সাথে থাকব। কিন্তু পারলাম না।
,,, এটাই ভাগ্য। এটাই নিয়তি। কপালের লেখাকে খণ্ডন করা তো আর আমাদের কারো পক্ষে সম্ভব না তাই না।
,,, সেদিন কেন বাঁচাতে গেলি আমাকে ?
আমার চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। অসাড় পা দুটো যেন ব্যাথা করছে।
সেদিন যখন আমরা কক্সবাজার থেকে ফিরছিলাম তখন আমাদের বাস এক খাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। হটাৎ ওপর পাশ দিয়ে একটা মালবাহী ট্রাক ছুটন্ত অবস্থায় আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। ড্রাইভার জোরে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে ব্রেক করতে গেলে বাসটা পুরো খাদে পরে যায়। নিশাত বসে ছিল একেবারে জানালার কাছে। জানালার পাশ থেকে রড ভেঙে নিশাতের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলে আমি নিশাতকে সেফ করতে যায়। ঠিক তখনি একটা রড নিচু হয়ে আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে ঢুকে গিয়ে শিরা কেটে যায়। ওপর পা সিটের নিচে গিয়ে মারাত্মক ভাবে মচকে যায়। একেবারে পায়ের হাড় ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়।
তৎক্ষণাৎ এ্যাম্বুলেন্স এসে আমাদের বাসের আহতদের চিকিৎসা দিতে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু স্থানীয় হাসপাতালে আমার শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলেও আমার অবস্থা গুরুতর ছিল। আমাকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নিশাত সারা রাস্তা আমার সাথে ছিল আর কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো কেন করলি এরকম। আমি চোখের জল ফেলে মুচকি হেঁসে ওর চোখের জল মুছে দিচ্ছিলাম।
আমার পা দুটো মারাত্মক আঘাত পাওয়ায় আমার পায়ের চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছিল না। আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। আমার বাবার এতো সামর্থ্য নেই যে আমার চিকিৎসা করাবেন। তবুও বাবা মা দুজনে ধার দেনা করে আমার চিকিৎসা করতে চাইলেন। আমি বেশ রাগ করলাম। কারণ আমাদের এতো সামর্থ্য নেই যে এই ধার দেনা আবার শোধ করতে পারবো। তার উপর আবার আমার এই অবস্থা। এই অবস্থায় ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে যে চাকরি পাবো তা নিয়ে আমার শঙ্কার শেষ নেই। শেষে নিশাত আমাকে সাহায্য করতে এলে আমি ফিরিয়ে দেয়। তারপর আর কোন উপায় না পেয়ে আমার পা দুটো আর সক্ষম করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু এর পরেও আমার কোন দুঃখ ছিল না। কারণ নিশাত ঠিক ছিল। যদিও বা হালকা আঘাত পেয়েছিল তবে সেটা এতোটা গুরুতর না।
আমার আর ফাইনাল সেমিস্টার পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় নি। অন্য সবাই পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে গেল। নিশাত ও পরীক্ষা দিল। তার পরেই সবাই ইন্টার্নিতে গেল। আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হলো না। ফলে ইয়ার ড্রপ গেল। তারপর বেশ ঝড় ঝাপটা অতিক্রম করে তার পরের বছর পরীক্ষা দিলাম। পাশ করলাম। কিন্তু চাকরি পাওয়া তখন কষ্ট সাধ্য ছিল। আমি আগে থেকে আউটসোর্সিং করতাম। তাই করতে লাগ্লাম। বেশ কিছুটা সময় পার হলো। তবুও নিশাত আমার সাথে যোগাযোগ বজায় রাখত। দেখা করতে আসতো।
সে রাতের পর আমাকে নিশাত আর ফোন দেয় নি। কারণ তার বাবা আর যায়হোক কোন পঙ্গুর সাথে বিয়ে দিবেন না। আমারও আর বিয়ে করার মতো মন মানসিকতা ছিল না। বেশ কয়েকদিন পর শুনে ছিলাম নিশাতের বিয়ে হয়ে গেছে। বরের সাথে আমেরিকা চলে গেছে। আমি জাপানের ভিসা এপ্লাই করলাম। পেয়েও গেলাম। তারপর সোজা নতুন কিছুর খোঁজে জাপানে পাড়ি দিলাম।
৩ বছর পর,
আমি ছাঁদে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিলাম। ভাবছেন দাঁড়িয়ে আছি কি করে ? উন্নত প্রযুক্তির যুগে সব সম্ভব। যেখানে আমাদের দেশে একটু জ্বর হলেও মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মরতে হয়। শুনেছিলাম কোন তারকা নাকি ১২ বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। এতক্ষন আমি আমার ৩ বছর আগে ঘটে যাওয়া কাহিনীগুলো পরছিলাম। ও লিখে রেখেছিল একটা ডায়েরীতে। ডায়েরীটার কভারে লেখা ‘চুপকথা’। ভারী অদ্ভুত তো !
হটাৎ একজন আমাকে জড়িয়ে ধরল পিছন থেকে। প্রায় সে এই কাজটা করে। সে জানে আমার তাকে বদ্দ প্রয়োজন। আমার জাপানে আসার আগে সে আমার জন্য নিজ পরিবারের কথা না ভেবে জেদের বসে আমাকে বিয়ে করে। তারপর আমার সাথে জাপানে পাড়ি জমানোর পর আমার সুস্থতা থেকে শুরু আজ জাপানের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন করেছে সেই মানুষটা। একটা মেয়ে। নারী তো মায়ের জাত তাই না ? এই মায়ের জাতটা অর্থাৎ এই নারীটা আমাকে মায়ের মতো আগলে রেখে এ পর্যন্ত। আর ভবিষ্যতেও রাখবে যদি আমি তাকে ধোঁকা না দেয়। একে ধোঁকা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
এই সেই মেয়ে যে আমার সৌলমেট। মাহি। সেই শ্যম বর্ণের নারী। সেই চশমা পড়া মেয়েটা। যদিও বা এখন আর চশমা পরে না।
আমি তার দিকে ঘুরে বললাম,
,,, এইখানে কি করো ? বাবুর কষ্ট হবে। যাও ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো।
,,, বাবু তার পাপাকে খুঁজছিল তো।
আমি আলতো করে মাহির কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিলাম।
“নারীই শক্তি, নারীই বল,
নারী ছাড়া দুনিয়া অচল।”
___(সমাপ্ত)___