এই যে,তুমি শুভ্র না? তরুনি কন্ঠে আমার নাম শুনে পেছন ফিরে তাকালাম।কিন্তু পেছন ফিরতেই চমকে উঠলাম।ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম,
–তমা না?
–চিনেছ তাহলে?
–তোমাকে না চিনলে যে আমি নিজেকেই চিনব না! তা,রাজশাহীতে কেন?
–আমার বাসা তো এখানেই!
–এখানে মানে?আমাকে না বলেছিলে ‘দিনাজপুর ‘!
–ভুল ঠিকানা দিয়েছিলাম।ভেবেছ িলাম,আসল ঠিকানা দিলে যদি এখানে এসে উৎপাত করো!
–আজ তো দেখে ফেললাম।এরপর যদি উৎপাত করি!
–নাহ,করবে না!
–কিভাবে বুঝলে করব না?
–শুভ্র,কিশোর বয়সের প্রেম নিয়ে মাতামাতি করাটা কলেজ জীবনে খুবশোভা পায়।কিন্তু যে ছেলেটা এখন ব্যক্তিত্ববান একজন পুরুষ,সংসার জীবনের প্রবেশদ্বারে যে দাড়িয়ে,কিশোর বয়সের প্রেম নিয়ে মাতামাতি করাটা তার মানায় না!
–বড় আমি হয়েছি ঠিকই,কিন্তু মনটা এখনো কিশোরই আছে তমা! তমা কিছু বলল না।শুধু শুকনো একটু হাসল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
–তা,এখানে কেন?কোন কাজ আছে?
–হুম।একটু কাজ না থাকলে আসতাম না। তবে সমস্যা হলো,রাজশাহীর কিছুই চিনি না!
–শুভ্র,এখন কোন কাজ আছে?
–না।তেমন কোন কাজ নেই!
–তাহলে আমার সাথে যাবে?
–কোথায়?
–বাসায়!
–বাসয় গিয়ে কি করব?একটু পরেই তো চলে আসতে হবে।আমি তোমার মনের ভেতরে যেতে চাই তমা,যেখান থেকে কোনদিন বের হবো না!
–এটা কোনদিন সম্ভব না শুভ্র!
–কেন সম্ভব না?
–অনেক কারন আছে!
–সেসব কারনই কি মুখ্য?সেই কলেজে তোমাকে ভালোবেসেছি,আজ ৫ বছর ধরে আগের মতই ভালোবেসে আসছি,এটা কি এতটাই গৌন্য?
–তেমনটা না শুভ্র! আর কিছু বলতে পারলাম না।বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো।মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকলাম। তমা মৌনতা ভেঙ্গে বলল,
–একটা প্রশ্ন করব শুভ্র?
–করো না!
–আজ যদি আমার দেখা না পেতে,তাহলে কি করতে?
–কিছু না।যেমন পাচ বছর ধরে ভালোবেসে যাচ্ছি,সেভাবেই ভালোবেসে যেতাম!
–শুভ্র,চলো আমার সাথে!
–যাবো।তবে কিছু কথা এখনো বাকি তমা।বাকি কথাগুলো শেষ করে নেই!
–শুভ্র,কিছু কথা বাকিই থাক না!বাকি কথা না হয় জীবনের বাকি কোন সময়ে হবে!
–তোমার বাসায় গেলে যদি কেউ কিছু মনে করে?
–আরে নাহ।চলো…
–চলো তাহলে!
তমার সাথে একটা রিক্সায় উঠে বসলাম।তমার সাথে আমার পরিচয় কলেজে পড়ার সময়।কলেজের ক্লাস শেষে রোজ দেখতাম,একটা মেয়ে মাঠের একদিকে বসে থাকে।সাধারনত ক্লাসের পর সবাই বাসায় চলে যায়।কিন্তু ও যেত অনেক পরে। মাঠে বসে থাকা সেই বিশোরীকে দেখেই কেন জানি প্রেমে পরেছিলাম। সাধারনত কলেজে পা দেওয়ার বেশিরভাগ কিশোর কিশোরীর মনে মনে রং লাগে।কারো মনে রং খুবই অল্প সময় টিকে থাকে।কারো মনে রং থাকে সারা জীবন।কিশোর বয়সে তমার প্রেমের যে রং আমার মনে লেগেছিল,সে রং এখনো ফিকে হয় নি।সে রং মনের মনে থাকবে সারাজীবন! একদিন তমাকে কলেজের গেটের বাইরে বললাম,
–তোমার নাম কি?
–তমা!
–জানো তমা,আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি!
–ছি!
–ছি বললে কেন?
–তুমি সবার সামনে নোংরা কথা বলছ,তাই
–আমাকে ভালোবাসবে তমা?
–না।তুমি যাও এখান থেকে!
–তমা? আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তমা চলে গিয়েছিল সেদিন। এরপর তমাকে দেখলেই বলতাম,
–তোমাকে খুব ভালোবাসি তমা! তমা সবসময়ই উত্তর দিতো,
–ছি! প্রেমের কথা ওর কাছে নোংরা মনে হতো। এরপর একদিন বলেছিলাম,
–প্লিজ,আমাকে ভালোবাসে!
–আমি ভালোবাসা কি বুঝিই না এখনো!
–তুমি যদি আমাকে ভালো না বাসো,তাহলে আমি মরে যাব! আমার মরে যাওয়ার কথা শুনে সেদিনকিশোরী তমার চোখ দুটো আনন্দে চকচক করে উঠেছিল।মুচকি হেসে বলেছিল,
–মরে গেলে তো বিরক্ত করতে আসবে না! তাহলে মরেই যাও। খুব কেদেছিলাম সেদিন।এক মামা আমার থেকে ০৩ বছর সিনিয়র ছিলেন। উনি বলেছিলেন,’কয়েকদিন তমার সামনে যাস না।মেয়েদের স্বভাব অন্যরকম।এদের ধরতে গেলে পালাতে চায়,আর দুরে সরতে চাইলে কাছে আসতে চায়’ মামার উপদেশ শুনে তমার সামনে যাই নি কয়েকদিন।কিন্তু মামার থিওরি তমার ক্ষেত্রে খাটে নি।তমা আমার প্রেমে পরা তো দুরের কথা,আমার কথা চিন্তাও করে নি! তমার সাথে সর্বশেষবার দেখা হয়েছিল,কলেজের বিদায়ের দিনে। তেমন কোন কথা হয় নি।শুধু একবার বলেছিলাম,
–তমা,আই লাভ ইয়ু! তমা তাচ্ছিল্য ভরে হেসেছিল। বলেছিল,
–আমি ভালোবাসা কি সেটাই বুঝি না!!
আজ পাঁচ বছর পর তমার সাথে দেখা।একই রিক্সায় বসে ওদের বাসায় যাচ্ছি। কিন্তু তমার কোন পরিবর্তন হয় নি।তমা আমার ভালোবাসা এখনো বুঝলো না! কিছুক্ষনের মধ্যেই তমার বাসার সামনেএসে থামল রিক্সা।তমা নেমে বলল,
–শুভ্র,নেমে আসো। আমি নামলাম।তমাকে অনুসরন করে বসার ঘর পর্যন্ত এলাম।সোফাতে বসতেই একটা ছোট্ট বাচ্চাকে দেখলাম,একটু দুরে একজন মহিলার সাথে।জিজ্ঞেস করলাম,
–তমা,বাচ্চাটা কার? তমা বলল,
–সে অনেক কথা।দুপুর হয়েছে,কিছু খাও আগে।তারপর বলি। খাবার টেবিলে বসে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
–তমা,বাচ্চাটা…!
–ওটা আমার বাচ্চা!
–তোমার বিয়ে হয়েছে?
–হ্যা শুভ্র!
–তোমার হাজব্যান্ড কই?
–চলে গেছে আমাদের ছেড়ে!
–কোথায়!
–ওপারে! তমার কথা শুনে বুকে একটা ধাক্কা খেলাম। সামলেনিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
–একটা কথা বলব তমা?
–বলো
–তুমি আগের মতই আছো!
–তুমিও শুভ্র। নিঃশব্দে খেতে থাকলাম।ভাত,গরুর মাংস,আর চিংড়িমাছ!একটু পরে তমা জিজ্ঞেস করল,
–শুভ্র,এখনো কি কলেজের নাম্বারটাইআছে?
–হ্যা। কিন্তু তুমি তো আমার নাম্বার জানো না!
–জানি।কলেজের বিদায়ের দিনই এক বান্ধবীর কাছে নিয়েছিলম।কোনদিনফোন করি নি! খাওয়া শেষ করে আবার সোফায়বসলাম।তারপর আবার আলাপ,
–তমা,একটা কথা রাখবে!
–কি?
–আমাকে বিয়ে করবে?
–ছি,কি বলো শুভ্র।আমার বিয়ে হয়েছিল,বাচ্চা আছে।তুমি কেন আমাকে বিয়ে করবে?
–কারন,তোমাকে ভালোবাসি তমা!
–না,এটা সম্ভব না।তুমি কি চলে যাবে শুভ্র?
–হুমম।
–তাহলে যাও এখন! আসতে ইচ্ছা করছিল না।তারপরও উঠলাম,
–আমার জীবনে মনে রাখার মত কিছু দান করার জন্য ধন্যবাদ তমা!
–কি মনে রাখবে?
–মনে রাখব,যাকে
ভালোবেসেছিলাম,তার দেখা পেয়েছিলাম ০৫ বছর পর।আদর করেরে বাসায় এনে সে আমায় খাইয়েছিল। কিন্তু তার মনে ঢোকার দরজাটা এখনো বন্ধ। তার মনে প্রবেশাধিকার আমার নেই! চোখের কোনে দু ফোটা জল জমে গিয়েছিল।মুছে নিয়ে বাইরে বের হলাম।রাস্তায় এসে রিক্সায় উঠে বসলাম।তমা ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আমার চলে আসা দেখছে। তমার বাসা থেকে বেশ কিছুদুর দুরে এসেছি।তখন ফোনটা কেপে উঠল,দেখি একটা মেসেজ এসেছে, মেসেজটা ওপেন করলাম।দেখি লেখা,”আই লাভ ইয়ু শুভ্র” বুঝতে পারলাম,এটা তমা পাঠিয়েছে। দ্রুত রিক্সা ঘুরিয়ে তমার বাসার সামনে এলাম।গেট পার হতেই দেখি,তমা, একজন মহিলা, আর সেই বাচ্চাটা দাড়িয়ে, সোজা গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
–মেসেজটা তুমি দিয়েছ তমা?
–না
–সত্যিই দাও নি?
–না।
–ও আচ্ছা।ভুল করেছি বোধহয়। গেলাম তমা।ভালো থেকো। পেছন ফিরে চলে আসা শুরু করলাম। তখন তমার সাথে দাড়িয়ে থাকা মহিলা বলে উঠলেন,
–মেসেজটা তমা দিয়েছিল! আবার ঘুরে দাড়ালাম।জিজ্ঞেস করলাম,
–আপনি?
–ওর বড় বোন।আর এই বাচ্চাটা তমার না,আমার।ও মিথ্যে বলেছে তোমাকে।
–তার মানে?
–মানে ওকেই জিজ্ঞেস করো।আমি গেলাম। তমার আপু চলে গেলেন।আমি তমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
–সত্যিই আমাকে ভালোবাসো তমা?
–না!
–প্লিজ ভালোবাসো আমায়!
–ভালোবাসা কি তাই এখনো বুঝি না! বলেই হাসা শুরু করলো তমা।আমি দেখছি।ওর হাসিটা অন্যরকম সুন্দর। হাতটা আলতো করে ধরে বললাম,
–আই লাভ ইয়ু তমা! তমা তখনো হেসে চলেছে।হাসার ফাকে “লাভ ইয়ু ঠু” বলার সুযোগ পাচ্ছে না সে!!