-আরে না! ধুর ছাড়োতো বর! ও আর কি বলবে কিছু জানলেই তো বলবে! ওতো সারাদিন বই নিয়েই ব্যস্ত, তুমি চলে আসো। আমি ওই নপুংসকটার জন্য ভ্যালেন্টাইন ডে এর মতো এতো সুন্দর একটা দিন নষ্ট করতে চাইনা। তুমি কিছুক্ষণ পর ইকো পার্কে চলে এসো জান। সেখান থেকে আমরা ডেটে যাবো।
রাত দশটা হবে, রিক্সা চালাচ্ছিলাম আর সিটে বসা মেয়েটির ফোনালাপ শুনছিলাম। ওপাশ থেকে কি বলছিল তার কিছু শুনতে পাইনি অবশ্য কিন্তু উপরের কথাগুলো যাত্রী মেয়েটির ছিলো। তবে কথা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটি বিবাহিতা হয়তো বরের নজর এড়িয়ে তার প্রাক্তনের সাথে কথা বলতে চাইছে নয়তো পরকিয়া। কিন্তু এসব মেয়েদের কিসে কম পড়ে! এভাবে স্বামীকে ঠকানোর মানে কি! এদের দেখলেই আমার ইচ্ছে হয় জোরে চিৎকার করে বলি চু*মারানি বাংলাদেশে না থেকে ওয়াশিংটন কিংবা টোকিওতে চলে গেলেই তো পারিস। ইচ্ছে করছিল তখনি নামিয়ে দেই মেয়েটাকে।
তবুও কলঙ্ক মুক্ত থাকুক বাবার রিক্সাটা। কিন্তু কি করার বাবা যে কখনওই যাত্রীর সাথে এমন আচরণ করতেন না। আমারও উচিৎ মেয়েটাকে গন্তব্য পৌঁছে দেয়া। বাবার দেওয়া শিক্ষা আমার সবচাইতে সেরা বিদ্যা। ছোটবেলায় বাবা বিয়ে করেছিলেন পতিতালয়ের এক দরিদ্র মেয়েকে। তখন মাত্র পনেরো টাকার বিনিময়ে দেহ ব্যবসা করে মা তাদের পরিবার চালাতেন। বাবা যখন তাকে বিয়ে করেছিলেন তারপর থেকে তিনি সেখানে আর যেতেননা। তখন দেহ দিতো অভাবে আর এখন স্বেচ্ছায় দেহ দেয়। বাবা সব জেনেই বিয়ে করেছিলেন কারণ মা তো নিজে থেকে যায়নি। অভাবের তাগিদে গিয়েছিলেন। বিয়ের পর মা আর যায়নি। তবুও সমাজের কানাঘুষো যেন কমবার নয়! বাবাকে দেখলেও লোকে ছিঃছিঃ করে বলতো বিয়ে করার জন্য আর ভালো মেয়ে পেলোনা! সমাজের নিন্দা সইতে না পেরে মা আমার জন্মের ছয় বছর পরে আত্মহত্যা করেছিলেন।
সেদিন সেই ছোটো আমি যতটুকু বুঝতাম তাতেই দেখেছিলাম বাবা মাকে অনেক বেশি ভালোবাসতো আর মাও বাবাকে। সেদিন মায়ের লাশের সামনে সবাইকে চিৎকার করে বলছিলেন এবার তোমরা খুশিতো? চলে গিয়েছে তোমাদের সব নিন্দা থেকে অনেক দূরে। এবার তোমাদের নিন্দা কমবে তো? তারপর বাবা আমাকে নিয়ে সব নিন্দার নিশ্চুপ জবাব দিয়ে অনেক দূরে চলে এসেছিলেন। যেখানে লোকে আমায় আর পতিতার পোলা বলতোনা। সেখানে বাবা রিক্সা চালিয়ে বাপ বেটার সংসার চালাতেন আর আমায় লেখাপড়া শেখাতেন। আর এখনকার সমাজে স্বেচ্ছায় দেহ দিয়ে আড়ালে ঠকিয়ে যায় তার স্বামীটিকে। কিছুদিন আগেকার ঘটনাতো সবাই নিজ চোখেই দেখেছে। ডাঃ মিতুর স্বামীর তরফ থেকে কি ঘাটতি ছিলো! শুধু শুধু ওই বেচারাকে কেন প্রাণ দিতে হয়েছিলো!
গন্তব্য আসার পর মেয়েটা আমাকে বিশ টাকা বেশি দিতে চাইলে আমি বলছিলাম,
-সরি ম্যাম আমি পরিশ্রমের অধিক পারিশ্রমিক নেই না।
-আমি নিতে বলছি তাই নিতে হবে। আর নামটাও জেনে রাখেন রাইসা আহমেদ!
রাইসা আহমেদ নামটা শুনে একটা ধাক্কা খেলাম মনে হচ্ছে! একটু ভালো করে মনযোগ দিতেই এটাতো সেই আট বছর আগের চেনা কণ্ঠস্বর! মুখোশের ভেতর দিয়ে তাকালেই দেখা যায় পরিচিত স্বার্থপর চোখদুটি!
ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষে সাহিত্যচর্চা অনুষ্ঠানে সেবার দ্বিতীয় হয়েছিলাম। প্রথম হয়েছিলো একটি মেয়ে। সেদিনই প্রথম আসে রাইসা। দেখতে বিত্তবান পরিবারের মেয়েই মনে হয়েছে,
-আপনিতো খুব ভালো কবিতা লিখেন। আমরা কি বন্ধু হতে পারি! উত্তর দেইনি চলে গিয়েছিলাম ক্লাসে। পরেরদিন আমাকে আবার পাঠাগারে গিয়ে জিজ্ঞাস করলো,
-কি হলো সাহিত্যিক সাহেব, বন্ধু হতে কি কোনো সমস্যা?
-আমি কারও বন্ধু হইনা।
-ভাব নিচ্ছেন বুঝি?
-ভাব নেই বলেই হইনা। আমি কারও বন্ধু হবার যোগ্য নই।
-বন্ধু হতে যোগ্যতা লাগেনা। ইচ্ছা আর বিশ্বাস থাকলেই ভালো বন্ধু হওয়া যায়।
তারপর আমি শত সংকোচ সত্ত্বেও ওর বাড়িয়ে দেওয়া হাতে বন্ধুত্বের হাত মিলিয়েছিলাম। প্রায়শই আমাকে বলতো ওই সাহিত্যিক তুই কবিতা লিখে এনে আমাকে শুনাবি আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক জবাব দিতাম। ও আমার সাথে অনেক দুষ্টুমি ফাজলামি করতো তবুও আমি তেমন হাসতাম না। এমন নয় যে অন্য সব বন্ধুত্বের মতো আমাদের বন্ধুত্বে এতোটা হাসি ঠাট্টা ছিলোনা। আমি ছোট বেলা থেকেই হাসতাম কম। বন্ধুত্বের একবছর যেদিন পূর্ণ হয়েছিল সেদিন ও নিজে আমাকে ভালোবাসি বলেছিল। বলেছিল,
-আমি যদি সারাজীবন তোর কাঁধে মাথা রেখে হাতে হাত রেখে গল্প শুনতে চাই তবে কি তুই শুনাইবি! আমার ননস্টপ কথা বলার অপলক চাহনির শ্রোতা হবি!
-না রে তোর সাথে আমার যায়না। আমার মতো নিম্নমধ্যবিত্ত বাবার সন্তানকে কোনো বাবা তার আদরের কন্যার জন্য চায়না। আর মায়ের পরিচয়তো জানিস। বাবা রিক্সা চালিয়ে আমার লেখাপড়া চালান সেটা তো নিজেই দেখিস।
-কিন্তু আমিতো চাই।
-এসব আবেগময় কথা ছাড়। এগুলা দিয়ে জীবন চলেনা। সংসার হয় টাকায়, ভালোবাসাটাই যথেষ্ট নয় শুধু।
-তাতে কি আমিতো তোকে এখনই কিছু চাপ দিচ্ছিনা আর কয়েক বছর পর তুই যখন চাকরি করবি প্রতিষ্ঠিত হবি তখন তোর পরিচয়ে তখন তোর বাবার গর্ব হবে।
-তাই যেন হয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ আগেই ভেবে রেখে এইভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
-চাইলেই সম্ভব।
কথাটা বলেই ও বাম হাতের কাঁচের চুড়িগুলো গাছের সাথে আঘাত করে ভেঙ্গে দিয়ে কয়েকটুকরো দিয়ে হাতে কয়েকটা আঁক দিয়ে দিলো!
-কি করছিস এসব?
-বল ভালোবাসিস?
-হুম ভালোবাসি।
-মন থেকে বলছিস তো।
-আমিতো মন থেকেই বাসতাম কিন্তু কথায় তো আছে অভাব যখন দরজা দিয়ে এসে দাঁড়ায় ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।
-কিছু ভালোবাসায় দেখা যায় ফুটপাতেও বুকের মধ্যে শুয়ে ঘুমায় অজস্র ভালোবাসার মানুষ।
-দেখা যাবে।
এর প্রায় মাস ছয়েক পর ও আমাকে অবহেলা শুরু করে। মুখে না বললেও আমি ঠিকই বুঝতে পারতাম। আগের মতো কথা বলেনা। বললেও কেমন বোরিং অনুভব করে। ক্যাম্পাসেও খুব একটা মিশে না। একদিন ও আমাকে বললো বিকেলে পুকুরপাড় দেখা করতে কথা আছে নাকি।
-কি হয়েছে? ডাকলি যে!
-একটা কথা ছিলো।
-কি কথা?
-বাবা গত মাসে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলো ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ে।
আমি কয়েকদিন ছেলেকে যাচাই করেছি অনেক। ছেলে ভালোই আছে। উচ্চ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিবন্ধন ফরম টানার পর চাকরি পেয়েছে তিনমাস হবে। তোর এখনও ভবিষ্যৎ তৈরি হয়নি। গত এক মাসে আমি ছেলেটির সম্বন্ধে যতটুকু জানতে পেরেছি ও আমাকে অনেক ভালোবাসতে পারবে। তুই আমার চাইতেও ভালো কাউকে পাবি। ভালো থাকিস। এই নে ছেলের ছবি। নাম তৌকির আহমেদ। ভালো থাকিস তুই। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস। সমাজে আমার বাবারও একটা সম্মান আছে।
আমি কথাগুলোর একটা উত্তরও দিতে পারিনি। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে ছিলাম ওর চলে যাওয়ার দিকে। আমাকে ইগনোর করার কারণ ছিলো ও অন্য কাউকে বুঝতে চেয়েছিল। আজ খুব ইচ্ছে করছে সেদিনের জবাবটা দেই। তাই গামছাবাঁধা মুখোশটা খুললাম। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-শেষ অব্দি বাপের মতো রিক্সাওয়ালাই হইলি! চাকরি পাইলি না বুঝি!
-তবুও তোর মতো স্বার্থপর হইনি। বেহায়াপনা আর নির্লজ্জতার একটা সীমা থাকে। নিজের স্বামীকে ঠকিয়ে পর পুরুষের সাথে রুমডেট করতে লজ্জা করেনা? ছিঃ!
-ও নিজেও তো প্রাইভেট পড়ুয়া ছাত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যায়!
-তাতে কি নিজের স্বামীকে যে সঠিক পথে না এনে এমন অশ্লীলতা করতে পারে তার মতো নষ্টা আর কে আছে!
খুব তো বলেছিলি ছেলেটি তোকে অনেক ভালোবাসতে পারবে! এখন কোথায় গেলো ভালোবাসা! যাক তোর মতো আর দ্বিতীয় কোনো কালনাগিনী এসে আমার জীবন নষ্ট করতে পারেনি। অবশ্য আমাকে অনেক বড় হতে হবে শিক্ষাটা তুই হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে গিয়েছিলি।
– (চুপ) চুপ করে রইলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া জবাব দিতে পারলো না!
-আর হ্যা ম্যাডাম নিজের স্বামীকে ধরে রাখুন এমন ভাবে চলাচল করলে বিয়েটা হয়তো টিকবেনা। ছবিতে তো
তৌকির সাহেবকে ভালোই দেখতে লাগছিলো। আর দুই ঘন্টা পর ভালোবাসা দিবস। আমার রিক্সাওয়ালা বাবার জন্য দিনটা উৎসর্গ করবো বলেই রিক্সা চালিয়ে বাবার জন্য উপহার কিনবো, যে বাবা আমায় রিক্সা চালিয়ে আমার সুন্দর ক্যারিয়ার উপহার দিয়েছেন। নিজের সেরাটা দিয়ে আমাকে বিসিএস করিয়েছেন। আমার বাবা সবচাইতে সেরা! রাত বারোটার পর আমি নিজে বাবাকে নিয়ে শহর ঘুরবো রিক্সা চালিয়ে। বাবার জন্য এর চাইতে শ্রেষ্ঠ উপহার আমি দিতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী অরু আর বাবা আসবে। পুরো শহর দেখবে নতুন এক ভালোবাসার গল্প। আর হ্যা তৌকির আহমেদের মতো আরও তিনশত চুয়াল্লিশ জন শিক্ষক ছাড়াও এই শহরের অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরীক্ষাকেন্দ্র আমার অধীনে আছে। ভালো থাকবেন।
তারপর ওর হাতে আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে রিক্সা টেনে চলে আসলাম, অরু আর বাবা অপেক্ষা করছে, বাবার আজ গর্ব করে তার ম্যাজিস্ট্রেট ছেলের পরিচয়ে! ভালোবাসার পৃথিবী অপলক নজরে দেখবে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তার ভালোবাসার মহাপুরুষটিকে রিক্সা চালিয়ে ঘুরাচ্ছেন। ওর চোখ থেকে ফোটায় ফোটায় অশ্রু ঝরছে। কার্ডটা নিয়ে ও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো যেখানে লেখা ছিলো ম্যাজিস্ট্রেট অফ কুমিল্লা এডুকেশন বোর্ড! সবশেষে আজ ভালোবাসা দিবসে আমার রিক্সাওয়ালা বাবাকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমিও ভালোবাসি বাবা। আর তোমাকেও অরু! পৃথিবী জানুক এক শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার গল্প।