–ভাইয়া, আছেন?
–জ্বী আপু, বলেন।
–আপনার একটা স্ট্যাটাস দেখলাম।
–কি?
–“বয়ফ্রেন্ড ইগ্নোর করলে নক দিও”।
–হাহাহা। এসব তো এমনিতেই ফান করে দেই। মানুষ হাসানোর জন্য।
–যাই হোক ভাই। বফ ইগ্নোর করতেছে অনেকদিন থেকেই। একটা সাহায্য চাই। আশা করি না করবেন না।
–আচ্ছা বলুন, চেষ্টা করব।
–আপনি তো মেডিকেলে পড়ছেন। অনেক ওষুধ পত্রের নাম জানেন। এমন কোন ওষুধ কি আছে যেটা খেলে আমি মরব না কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে?
–না। আমি এসব ব্যাপারে উপদেশ দেই না।
–আচ্ছা লাগবে না। এটলিস্ট কয়েকটা হাই পাওয়ারের ঘুমের ওষুধের নাম বলেন। আমি কোন রাত ঘুমাতে পারিনা।
–কখনো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন?
–হ্যা, প্রায় ই খাই। আমি ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে পারতাম। কিন্তু এখন ওষুধেও কাজ করে না।
–কাজ করবে কি করে? ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ খাওয়া উচিত না জানেন না? ভাতের মতো প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খেলে আপনার ওষুধ এর প্রতি আসক্তি চলে আসবে। যাকে বলে ড্রাগ ডিপেন্ডেন্স। আপনি এর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। তখন ওষুধ ছাড়া ঘুম হবে না। আর আগের পাওয়ারেও কাজ হবে না। ডোজ বাড়াতে হবে।
–এখন কি করব? ডোজ বাড়াব?
–না। ওষুধ ছাড়া ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে।
–আমি তো চিরতরে ঘুমাতে চাই। যাতে আর কখনো কারো মুখ দেখতে না হয়। এই পৃথিবীর মায়ার বন্ধন কিছুই ভালো লাগে না আমার। আমি চিরমুক্তি চাই।
–আপনি কি মরতে চান?
–জি ভাই।
–আপনি সিরিয়াস?
–এসব নিয়ে কি কেউ ফাইজলামি করে? আমি সিরিয়াস আমি আমার মরণ চাই।
–আচ্ছা, আপনার রক্তের গ্রুপ কি?
–ভাইয়া মরার সাথে রক্তের গ্রুপের সম্পর্ক কি?
–দরকার আছে। বলেন।
–এ নেগেটিভ।
–আপনাকেই তো দরকার।
–কি জন্যে?
–আপনি জানেন আপনার রক্ত কত দামী? কত রেয়ার?
–হ্যা জানি। তোহ?
–আপনি কাল আমার সাথে দেখা করেন। একজন গরীব থ্যালাসেমিয়ার বাচ্চা আছে। প্রতিমাসেই তাকে রক্ত দিতে হয়। বলতে গেলে রক্তের উপর ই বেঁচে আছে সে। তার রক্তের গ্রুপ এ নেগেটিভ। কাল আপনি তাকে রক্ত দিবেন।
–না ভাইয়া। আমি কখনো রক্ত দেই নি। আমি রক্ত দিতে ভয় পাই।
–আপনি তো মরেই যাবেন। একটা ভালো কাজ করে যান। বাচ্চাটা চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
–না ভাইয়া। আমি অনেক ভয় পাই।
–আপনি আরেকটি কাজ করতে পারেন। দুদিন আগেই পোস্ট দিয়েছিলাম একজন মায়ের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিমাসেই ডায়ালাইসিসের জন্য অনেক টাকা লাগে। উনার পরিবারের পক্ষে সে টাকা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। জায়গা জমি যা ছিলো সব শেষ। আপনি যদি আপনার একটি অথবা দুইটি কিডনিই দান করে দেন তাহলে আল্লাহ চাইলে মহিলাটা প্রাণে বেঁচে যায়।
–উনাকে কিডনি দিলে আমি বাঁচবো কি করে?
–ওমা, আপনি না বললেন বাঁচতে চান না? তাহলে এই কথা আসে কি করে?
–ভাইয়া আপনি কিন্তু অতিরিক্ত করছেন। আমি বলছি বলেই কি আমি মরে যাচ্ছি? আমি তো কথার কথা বললাম। আপনি আমাকে জোর করেই মেরে ফেলতে চাচ্ছেন।
–আচ্ছা, তার মানে আপনি মরতে চান না?
–না ভাইয়া। আমি আপনার গল্পে পড়েছি মরার পর পোস্ট মর্টেমে কি জঘন্য ভাবে কাটাকাটি করে। আমি মর্গে যেতে চাইনা। আল্লাহ যেদিন চাইবে সেদিন মরণ হবে। আমি স্বাভাবিক মরণ চাই।
–দ্যাটস গুড। এবার বলেন কেন এত অভিমান? কি জন্য এত কাহিনী?
–আগে বলেন, মেডিকেলে কি সত্যিই অনেক প্রেসার?
–হ্যা প্রেসার তো থাকেই। প্রতিদিন পরীক্ষা থাকে। সকাল বিকাল ক্লাস থাকে। ফেইল করলে পিছিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
–নিজের গার্লফ্রেন্ডকে সময় দেওয়ার মতো সময় থাকে না?
–আসলে সময় টা ব্যাক্তিগত ব্যাপার। অনেকেই আছে সারাদিন রাত পড়াশোনা করে। অনেকে অল্প পড়ে। অনেকের পড়তে সময় লাগে বেশি। অনেকের কম সময় লাগে। গফের জন্য সময় বের করা কঠিন কিছু না। চাইলে বের করা যায় যদি না সেই ছেলে আঁতেল না হয়।
–আমার বয়ফ্রেন্ড ডাক্তার। এবার পাশ করলো। কিছুদিন আগে ইন্টার্নি শুরু হইছে। আগে যাও অল্প সময় দিত এখন তাও দেয়না।
–বাহ। আপনার বফ তাহলে আমার সিনিয়র ভাই। ভাই ডাক্তার হয়েছে এই খুশিতে ট্রিট দিতে পারেন।
–উফ! মজা করছিনা। সারাদিন রাত সে ব্যস্ত থাকে। মেয়েদের সাথে রাত দুইটা /তিনটায় ছবি আপলোড দেয়, সাথে ক্যাপশন “বন্ধু আছে,আর কি লাগে?”
–উনারা নিশ্চয়ই কলিগ। নাইট ডিউটি থাকে। আচ্ছা আমি এই ব্যাপারে পরে কথা বলছি। অন্য কিছু জিজ্ঞেস করি।
–আচ্ছা।
–জ্বর আসলে কি করেন?
–সাথে সাথেই নাপা/প্যারাসিটামল খাই।
–খাওয়ার সাথে সাথেই ভালো হয়ে যায়?
–হ্যা, অনেক সময় দুই তিন মিনিটেই জ্বর ভালো হয়ে যায়। অনেক সময় একটু বেশি সময় লাগে।
–আচ্ছা দুই/ তিন মিনিটেই জ্বর ভালো হবে কি করে? প্যারাসিটামল তো কাজ শুরু করেই আধা ঘণ্টা পর। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না?
–কি বলেন ভাইয়া? এমন টাই ত দেখে এসেছি। জ্বর হলে প্যারাসিটামল খায়। কিছুক্ষণ পরেই জ্বর ভালো হয়ে যায়। ত্রিশ মিনিটের আগেও ভালো হয়, ত্রিশ মিনিটের পরেও ভালো হয়। আপনার কথা যদি সত্য হয় তাহলে তো আগে জ্বর ভালো হবার প্রশ্নই ওঠে না? কেন এমন হয়?
–বলছি। তার আগে বলুন মাথা ব্যাথা হলে কি খান?
–শরীরে কোথাও ব্যাথা হলে এসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাই। নাম মনে নেই?
–এসপিরিন ১৫ মিনিট পর কাজ শুরু করে। কিন্তু অনেককেই বলতে শোনা যায়, এসপিরিন খাওয়ার সাথে সাথেই মাথা ব্যাথা সেরে গেছে।
–এমন কেন হয়? বুঝিয়ে বলুন।
–কারণ আপনার মন জানে আপনি ওষুধ খেয়েছেন। ওষুধ খেলেই জ্বর,মাথা ব্যাথা ভালো হয়ে যাবে। এটা আপনার বিশ্বাস। এটাকে বলা হয় the placebo effect. আমাদের একটা কমন অভিযোগ হচ্ছে ডাক্তাররা সময় নিয়ে রোগী দেখেন না। আসলে রোগীদের বিশ্বাস ডাক্তার ভালো করে তার সমস্যা শুনে ওষুধ দিলে সেটা খেলেই সে ভালো হয়ে যাবে। হ্যা অনেক সময় ভালো হয়েও যায়। এটা বিশ্বাসের জোরেই হয়। placebo effect কাজে লাগে। তাই বলা হয়ে থাকে, রোগী ডাক্তারের কাছে গেলেও অর্ধেক ভালো হয়ে যায়। এটা মনের সন্তুষ্টি,বিশ্বাস। অনেক ডাক্তার সময় দেন না কিংবা অনেক রোগীর চাপে সময় দিতে পারেন না। এই কম্পলেক্সিটি থেকে বের হয়ে আসি।
–আচ্ছা বুঝলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে সময় দেয়না এ ব্যাপারটা কিভাবে দেখবেন?
–বলব, বলব। আমাকে শেষ করতে দিন। বৃষ্টিতে ভিজেন?
–হ্যা, প্রায় সময়ই ভিজি।
–সব সময় জ্বর আসে?
–না। ভিজলে কখনো জ্বর আসে, কখনো আসে না।
–আপনি খেয়াল করে দেখবেন, অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজার পর আপনার এক সময় মনে হয় “আজ মনে হয় জ্বর আসবে,একটু বেশিই ভিজছি”। এরকম যেদিন আপনার মনে হয় সেদিন ই কিন্তু আপনার জ্বর আসে। আর যেদিন কিছু মনে হয় না সেদিন জ্বর আসার সম্ভাবনা কম। এটা একটা পরীক্ষিত পরীক্ষা। আপনি দেখতে পারেন।
–হ্যা হ্যা। এমন হয় ভাইয়া। আশ্চর্যজনক ব্যাপার। কিভাবে এমন হয়?
–এটা হল পজিটিভ বিশ্বাস। পজিটিভ বিশ্বাস আমাদের দেহে পজিটিভ প্রভাব ফেলে। একটা গল্প আছে এমন। আপনি হয়তো জানেন। তবুও বলি।
এক শিক্ষক ক্লাসে গল্পটা বলছিলেন এক দম্পতি শীপ এ করে বেড়াতে গেছেন। হঠাৎ করে শীপটা ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়। সাথে সাথে দুইজন চিন্তা করল লাইফ বোটে উঠবে। কিন্তু সেই লাইফ বোটে মাত্র একজনের দাঁড়ানোর মত জায়গা ছিল। সেই মুহূর্তে লোকটা তার ওয়াইফ কে ধাক্কা দিয়ে পিছনে ফেলে দেয় এবং লাইফ বোটে এ লাফ দিয়ে উঠে পড়ে।ওয়াইফ সেই ডুবন্ত শীপ এর ভেতর দাড়িয়ে চিৎকার করে মাত্র একটা কথা তার স্বামীকে বলে!! এরপর টিচার থামলেন এবং ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন “ বলত লোকটার ওয়াইফ চিৎকার করে তার স্বামীকে কি বলেছিল” ?? বেশীর ভাগ ছাত্র বলল যে–“ আমি তোমাকে ঘৃণা করি, তুমি খুব খারাপ”।
“তুমি আমাকে ফেলে যেতে পারলে”? সবাই নেগেটিভ উত্তর দিল! হঠাৎ করে টিচার আবিস্কার করলেন যে একটা ছাত্র কোন উত্তর দেয়নি। সে চুপ করে বসে আছে। টিচার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন এবং ছাত্রটি উত্তর দিল–“ স্যার আমি বিশ্বাস করি, “ওই মহিলা চিৎকার করে বলেছিল–দয়া করে আমাদের বাচ্চার যত্ন নিও, ওর যেন কোন কস্ট না হয়” !! টিচার খুব অবাক হয়ে বললেন– তুমি কি এই গল্প আগে কোথাও শুনেছ ? ছাত্রটি তার মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দিল–না ! “কিন্তু এই কথাটাই আমার মা আমার বাবাকে বলেছিল মারা যাবার আগে”।তখন টিচার বললেন–তোমার উত্তর সঠিক। টিচার আবার বলা শুরু করলেন, শীপ ডুবে গেল। লোকটা বাড়ি ফিরে এসে একা একা তার মেয়েটাকে বড় করে তুলল!!
লোকটা মারা যাবার অনেকদিন পর মেয়েটা তার বাবার লেখা একটা ডায়েরি খুঁজে পায়। সেখানে মেয়ের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল–
“আমরা শীপ এ বেড়াতে যাবার আগেই জানতে পারি যে তোমার মা একটা বড় অসুখে ভুগছেন এবং ডক্টর বলেছিলেন যে কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবে। সেই জন্য আমি সেদিন তোমার মাকে পেছনে ফেলে লাইফ বোটে ঊঠেছিলাম, শুধু তোমার কথা ভেবে”!
“আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমার মার সাথে আমি ও ওই সাগরে ডুবে যাই, কিন্তু শুধুমাত্র তোমার কথা চিন্তা করে তোমার মাকে চিরদিনের জন্য সাগরে ফেলে এসেছিলাম”!
আসলে মানুষের জীবনে প্রতিটা ঘটনার পিছনে একটা কারন বা কমপ্লিকেশন থাকে, যেটা সহজে বোঝা যায়না।
কিন্তু আমরা সেই কারণ গুলোকে পজিটিভ ভাবে না দেখে প্রথমেই নেগেটিভ ভেবে নেই। আর সেই জন্যই আমরা মানুষকে না বুঝে তার বিচার করে ফেলি, তার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারনা করে ফেলি। ভুল বুঝি।
আমাদের আজকের নয় বহুদিনের অভ্যেস মানুষকে নেগেটিভ ভাবে কথা বলা।
–আপনি তো অনেক কিছু জানেন। আচ্ছা, তাহলে চলুন আমার বয়ফ্রেন্ডের কিছু পজিটিভ ব্যাপার আপনাকে বলি।
–জ্বি বলুন।
–ও আমাকে সময় দেয় না ঠিক ই। কিন্তু ও আমার অনেক কেয়ার করে। রোজ রোজ ভালোবাসি বলেনা ঠিক ই কিন্তু আমি জানি সে আমাকে কত ভালোবাসে। সে ডাক্তার, আমি নন মেডিকেল। তার পরিবার চেয়েছিল সে ডাক্তার বিয়ে করুক। কিন্তু সে সবাইকে কনভিন্স করেছে যে সে আমাকেই বিয়ে করবে। সে মেয়েদের সাথে ছবি দেয়,নিশ্চিত ওরা তার কলিগ। অবশ্য আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে নিয়ে তার সাথে আমার ঝগড়া হয়নি। সে নাইট ডিউটি করে, এটা নিশ্চিত তার দায়িত্ব। ডিউটি করতেই হবে। সে একটু হাবাগোবা টাইপের। আমি জানি সে কোন মেয়েকে পটাতে পারবে না। আমি সেই সুযোগ দিলে তো! হাহা।
–আপনি তাকে বিশ্বাস করেন সে আপনাকে ঠকাবে না?
–হ্যা ভাইয়া। ওর বাসায় আমার কথা বলেছে। ওর আম্মুর সাথে আমার মাঝে মাঝে কথাও হয়। আমি শুধু শুধু নেগেটিভ চিন্তা করছিলাম। আর জানেন ভাইয়া? একা থাকি আমি। কোন ফ্রেন্ডস নেই। তাই একা থাকতে থাকতে বোরিং লাগে। মন চায় বফের সাথে অনেক কথা বলি, ঘুরতে যাই। কিন্তু ও ডিউটি তে থাকলে ফোনই ধরে না। তাই উল্টাপাল্টা ভেবে নিজে নিজেই ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম। ভাইয়া আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেকদিন পর নিজেকে ফ্রেশ লাগছে, শান্তি লাগছে।
–আচ্ছা। শোনেন।
–জি।
–থ্যালাসেমিয়া রোগীকে রক্ত দিবেন না?
–হ্যা ভাইয়া অবশ্যই দিবো। আপনি এড্রেস দিয়েন। আমি কালকেই আসব রক্ত দিতে।
–আচ্ছা অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।