“আমি বিবাহিত। আপনি এখন আসতে পারেন”
.
স্বর্ণার মুখে এমন কথা শুনে পাত্রের চাচা সহ স্বর্ণার নিজের চাচা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একে অপরের
মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন।আর স্বর্ণার বাবা ইমরান সাহেব মুখ টিপেটিপে হাসছে।
.
কারণ এই দিয়ে ছবার পাত্র পক্ষ এমন অবস্থার মধ্যে পরলো।গত দুই মাসে ইনি সহ স্বর্ণাকে ছয়টা পরিবার
থেকে দেখে গেছে।স্বর্ণার চাচার মাথায় এক এক বার একেকরকম ভূত চাপে।গত দুইমাস আগে চেপেছে
তিনি রাজপুত্রের মত ছেলের সাথে তার ভাতিজির বিয়ে দিবেন।দুই মাসে কই কই থেকে কাকে না
কাকে ধরে এনেছে মেয়ে দেখানোর জন্যে। তারা কোন না কোন ভাবে অপদস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছে।
বরাবরের মত এবারও তাই হলো।তবুও স্বর্ণার চাচা থামবার পাত্র নয়…
.
পাত্রের চাচা হাতে থাকা পানির গ্লাসটা রেখে উঠে দাঁড়ালেন।
.
উনারা বাসা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে স্বর্ণার চোখ জোড়া অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। স্বর্ণা
তার বাবাকে বললো
.
” তুমি তোমার ভাইকে নিষেধ করো না কেন?.. তুমি তো সবটা জানোই…তারপরেও? দুরর ছাই
ভাল্লাগেনা…
.
স্বর্ণা ওর রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো….
.
ইমরান সাহেবের ভাই উনার থেকে বেশ কয়েক বছরের বড়।আর তিনি তার বড় ভাইকে যথেষ্ট সমীহ করেন।
তাই মুখের উপর কিছু বলতে পারেন না। কিন্তু পাত্রপক্ষ যখন স্বর্ণাকে দেখতে আসে তখন মেয়ের মুখের করুণ
অবস্থা দেখে খুব মজা পান। তাই তো মিটিমিটি হাসেন…… তবে আজকে এরকম হাসার পেছনে অন্য একটা
কারণ আছে…
.
ইমরান সাহেব সোফায় বসে আরেক দফা মিটিমিটি হেসে নিলেন। তারপর স্ত্রী কে ডেকে বললেন
.
– কই গো লিমা…. আরেক কাপ চা দিয়ে যাও।তোমার মেয়ের কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতে কাপের
চা সব জুড়িয়ে গেছে……
.
ইমরান সাহেব ও উনার স্ত্রী জানেন যে তার মেয়ের শ্রাবণ নামের ছেলেটার সাথে সম্পর্ক আছে। কিন্তু
বড়ভাইকে মুখের উপর ইনিয়েবিনিয়ে এমন কথা বলাটা বেয়াদবি।তাই তিনি নিশ্চুপ আছেন… তবে মেয়ের
সম্পর্ক থাকাতে তাদের কোন আপত্তি নেই।মেয়ে বড় হয়েছে। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে
নেওয়ার অধিকার তার আছে। তারা সেখানে হস্তক্ষেপ করতে চান না….. আর যদি ছেলে মনেরমত হয়
তাহলে তো কথায় নেই। আর শ্রাবণ ছেলেটা নেহাতি মন্দ নয়। মাস্টার্সটা কমপ্লিট হয়ে গেলেই একটা জব
পেলে মেয়েকে চোখবন্ধ করে ছেলেটার হাতে তুলে দেয়া যায়।ফাইনাল এক্সাম দিয়েছে রেজাল্ট
বের হবে হয়তো সামনে সপ্তাহে…..
.
তাদের মেয়েটা একটু চাপা স্বভাবের।নিজে থেকে উনাদেরকে সম্পর্কের কথাটা জানায়নি।
.
ইমরান সাহেব ও উনার স্ত্রীর ২৫তম বিবাহ বার্ষিকীর দিন দুজনে ঘুরতে বেরিয়ে ছিলেন।ইমরান
সাহেবের স্ত্রীর খুব শখ হলো রাস্তার ধারের ভ্যান গাড়ি থেকে খুব বেশি ঝাল দিয়ে ফুচকা খাবেন ।
আর ইমরান সাহেব পরমযত্নে উনার চোখের পানি মুছে দিবেন আগের মতোন করে। ইমরান সাহেবের স্ত্রী
ফুঁচকা খেতে শুরু করলো।আর ইমরান সাহেব রুমাল হাতে স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। হঠাৎই তিনি
দেখছিলেন ঢাকার শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় তার রাজকন্যার হাত ধরে অপরিচিত এক বালক রাস্তা পাড়
করাচ্ছে….. একসময় তিনি যেমন ভাবে তার রাজকন্যার হাত ধরে রাস্তা পাড় করাতেন ঠিক তেমন ভাবে।
রাস্তা পার হয়ে স্বর্ণা মা-বাবাকে দেখে চমকে গেলো…
.
ফুচকা খাওয়া শেষে ইমরান সাহেব উনার স্ত্রী আর আর সদ্যপরিচিত হওয়া বালক কে নিয়ে একটা কফিশপে
বসলেন।
.
ইমরান সাহেবের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।মানুষ চেনার ক্ষমতা। শ্রাবণের সাথে ইমরান সাহেব যখন কথা
বলছিলেন তখন শ্রাবণের চোখে মুখে পবিত্রতা প্রকাশ পাচ্ছিলো…. তবুও একটা মাত্র মেয়ে… নিজের
অনুমান শক্তি সত্য কিনা জানার জন্য ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজ- খবর নিলেন। যা শুনলেন তাতে ইমরান
সাহেব ও উনার স্ত্রী যথেষ্ট সন্তুষ্ট…. দোষের মধ্যে শুধু ছেলেটাকে মাঝেমধ্যে সিগারেট ফুঁকতে দেখা
যায় তাও হঠাৎ হঠাৎ… এটা অন্তত সাধারণ ব্যাপার… ছেলেমানুষ!! দুইএকটা সিগারেট বন্ধুদের সাথে
আড্ডাবাজির সময় ফুঁকা দোষের কিছুনা… এটাকে দোষ ধরা একেবারেই চলেনা।তিনিও ফুঁকতেন যুবক
বয়সে।এখন হার্টের প্রব্লেমের কারণে স্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে।আর বুড়া বয়সে স্ত্রীর
নিষেধজ্ঞা যেন প্রত্যেক প্রেমিক পুরুষের কাছে শিরোধার্য…..
.
রাগ কমাতে স্বর্ণা লংটাইম ধরে শাওয়ার নিলো….লংটাইম ধরে শাওয়ার নিলে নাকি স্বর্ণার রাগ
কমে যায়। আজ দুদিন শ্রাবণের সাথে ঠিকমত কথা হয়নি…. বাথরুম থেকে বের হয়ে স্বর্ণা ফোনটা হাতে
নিলো… ২৮টা মিসড কল…
.
কলব্যাক করতেই সাথে সাথে একগাদা স্যরি ভেসে এলো স্বর্ণার কানে….
.
” থামো এবার!! আর স্যরি বলতে হবেনা….
.
“কই তুমি??… চাকুরী নিয়ে ব্যস্ততার কারণে আজ দুইদিন তোমার সাথে ঠিকমত কথা হয়নি ….
.
“বাসায় শুয়ে আছি…
.
“আচ্ছা শোন বিকাল সাড়ে তিনটায় রাইফেলস্কয়ারে চলে আসবে….ইমার্জেন্সি দেখা করা দরকার
তোমার সাথে….
.
” আচ্ছা….
.
তারপর আরো কিছুক্ষণ চলতে থাকে দুষ্টুমিষ্টি প্রেমালাপ…..
.
ফোন রাখার পর স্বর্ণা আনমনে ভাবতে থাকে ছেলেটার বলা একটা ছোট্ট শব্দ “স্যরি” এর মধ্যে কি
অলৌকিক কোন শক্তি আছে?? যা দুদিনের জমে থাকা রাগ আর অভিমানের বরফ গলিয়ে পানি করে
দিলো…. শুধু একবার না স্বর্ণা লক্ষ্য করে দেখেছে শ্রাবণ স্যরি বললেই বারবার ওর উপরে জমে থাকা রাগ
অভিমান নিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে যায়…
.
ওদের পরিচয় ও হয় এই ছোট্ট একটা শব্দ দিয়ে… লেকপারের রাস্তা ধরে অন্যমনস্ক ভাবে হাটার কারণে
ধাক্কা লেগেছিলো ছেলেটার সাথে। ছেলেটা সাথে সাথে বলেছিলো স্যরি ম্যাম!!… স্বর্ণা ঘোর
লাগানো চোখে তাকিয়েছিলো ছেলেটার দিকে… ছেলেটার কোন দোষ নেই দোষ ওর নিজের অথচ
ছেলেটি স্যরি বললো?….
.
বাসায় ফেরার পরে স্বর্ণার কানে ছেলেটার বলা কথাটায় বার বাজতে ছিলো…. “স্যরি ম্যাম”
আশ্চর্য!! শুধু এই কথাটায় কানে কেন বাজছে??
.
ঘটনার কয়েকমাস পর বাসের ভিতরে হঠাৎ বৃষ্টির মতোন ছেলেটার সাথে দেখা হয়ে গেলো….
ছেলেটার চেহারাটা ভুলবার নয়… সেদিন সামান্য কিছু কথা বার্তায় দুজনের মনে ভালোলাগার সৃষ্টি
হয় এবং সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে ভালোলাগাটা ভালোবাসায় পরিণত হয়….
.
এখন স্বর্ণার মনটা বেশ ফুরফুরে… কিন্তু সকালের কথা ভাবতেই মেজাজটা আবারো খারাপ হয়ে
গেলো…
.
বিকালের অপেক্ষা করতে করতে চোখজোড়া সামান্য লেগে গেছিলো… হঠাৎ করেই জেগে উঠে
দেখলো শ্রাবণ কল করেছে… স্বর্ণা কলটা রিসিভ করে বললো
.
” তুমি কি চলে এসছো?.
.
” হ্যা আধাঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি।কিন্তু ম্যাম আপনি কই??
.
“বুঝতে পারিনি চোখজোড়া কখন লেগে গেছিলো…
.
“আচ্ছা সমস্যা নেই।আসো তুমি।আমি অপেক্ষা করছি…
.
” আচ্ছা
….
এরপর আধাঘণ্টা পরে দুজনের দেখা হলো….স্বর্ণা কাছে আসতেই শ্রাবণ বললো
.
“খুব বেশি রেগেছিলে তাইনা??
.
“হুমম… ছিলাম তোমার উপরে আর বড় চাচার উপরে।দুইদিন তো তোমার সাথে ঠিকমত কথা হয়নাই।আর তার
মধ্যে আজকে সকালে চাচা কই থেকে জানি একজনকে ধরে নিয়ে আসছে আমাকে দেখাবেন বলে…
এটাকে কি বলে ভাগিয়েছি জানো??বলেছি যে ” আমি বিবাহিত ”
.
” হ্যোয়াট দ্য… এইটা কি করছো?
.
” কি করছি মানে? ঠিকই তো করছি। আর বাবা যে কেন চাচাকে কিছু বলেন না।আমি বুঝিনা…
.
”
ধুরর আমি ভেবেছিলাম তোমাকে তোমার আব্বু জানাবে?
.
” কি জানাবে?
.
” আজ সকালে তোমাকে আমার ছোট চাচা দেখতে গিয়েছিলো…. আর বিকালে আমি বের হওয়ার সময়
আমাকে গম্ভীর ভাবে বললো তোমার পছন্দ করা মেয়েকে সকালে দেখতে গিয়েছিলাম.… আমি
জিজ্ঞেস করলাম কেমন দেখলেন?? কিছুই বললো না শুধু মুখটাকে আরো গম্ভীর করে রাখলো…
.
” হায়! হায়! বাবা তো আমাকে কিছুই জানায়নি।
এই জন্যেই আমি যখন বের হচ্ছিলাম তখন মিটিমিটি হাসছিলো আমার দিকে তাকিয়ে..… আর তোমার
চাচাকে আমি চিনি নাকি?
.
“ভালোই… কিন্তু তোমার বাবা কেন তোমাকে জানালো না বুঝতেছি না…
.
“এখন কি হবে??
.
” কি হবে??
.
“কি হবে?
.
“ধুরর ছাই…
.
” যা বলেছো তাইই হবে!
.
“মানে??
.
“মানে আসছি…
.
শ্রাবণ একটু দূরে গিয়ে স্বর্ণার বাবা ইমরান সাহেব কে ফোন দিলো… শ্রাবণের চাচা অনকটা মিশুক
স্বভাবের হলেও এমন বেয়াদবি তিনি সহজে মেনে নিবেন না।হয়তো এতক্ষণে বাসার সবাইকে
জানিয়ে দিয়েছে।
.
স্বর্ণার বাবা ইমরান সাহেব আলমারি থেকে সিল্কের পাঞ্জাবীটা বের করতে করতে বললেন
– কই গো লিমা… জলদি তৈরি হয়ে নাও… তোমার মেয়ের বিয়ের সাক্ষী হতে হবে যে.…
.
ইমরান সাহেব আর উনার স্ত্রী রেডি হয়ে রিক্সা নিয়ে কাজী অফিসের দিকে যাচ্ছেন…
.
এদিকে শ্রাবণও স্বর্ণাকে নিয়ে রিক্সা করে কাজী অফিস যাচ্ছে…. বিয়েটা হয়ে গেলে চাচাকে
জবাব দেয়া যাবে যে মেয়ে কেন বলেছিলো সে বিবাহিত?কিন্তু স্বর্ণাকে শ্রাবণ এখনো কিছুই
বলেনি।শুধু ওর হাতটা শক্ত করে ধরে আছে।
আজকে স্বর্ণার অবাক হওয়ার দিন!!….
.
স্বাভাবিক ভাবে যদি মেয়েকে বিয়ে দিতেন?
তাহলে মেয়ের তার বাচ্চাকাচ্চাদের বলার জন্য গল্পটা তেমন ইন্টারেস্টিং হতো না। কিন্তু এরকম উদ্ভট
কাজের জন্য মেয়ের বিয়ের গল্পটা অন্য ভাবে লেখা হয়ে গেলো।উমমম এই গল্পের নাম দেয়া যেতে
পারে “এ সারপ্রাইজিং ডে”….
.
ইমরান সাহেব নিজের জীবনে অনেকবার লক্ষ্য করেছেন উনার মন যা বলেন সবসময় ঠিক তাইই হয়।ইমরান
সাহেব রিক্সায় বসে আবারো মিটিমিটি হাসছেন….তৃপ্তির হাসি হাসছেন।কেননা ইমরান সাহেবের
গতকাল রাত থেকে ঠিক এরকমটা মনে হচ্ছিলো… আর হুবহু তাই তাই আজকে সারাদিন ঘটেছে এবং ঘটতে
যাচ্ছে…
.
মেয়ের বিয়ের সাক্ষী হিসাবে সাইন করার সময় ইমরান সাহেবের মন বলছিলো যে তার “মেয়েটা সুখী
হবে”.…
সব কিছুই তো হুবহু মিলে গেলো… হয়তো এইটাও মিলে যাবে…..
বাবা হিসেবে উনি কি খুব বেশিকিছু চেয়ে ফেললেন?
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক