প্রথম বারের মতো খাদিজার সাথে ঘুরতে বের হয়েছি।স্থান তিতাস নদী। দুজনে নিরব হয়ে,সায় দাঁড়িয়ে আছি।নদীর জল কলকল ধ্বনি উচ্চারিত না হয়ে ঠান্ডায় পরিণত।মনে হয় ভাটা পড়েছে,তাই আমার আর খাদিজার মতো নদীও নিরব।সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে ধীরে ধীরে তলে যাচ্ছে। চারপাশ জনমানবহীন। নেই কোনো সারাশব্দ।প্রকৃতিও যেন তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।নাকি প্রকৃতিও আমার মতো। হয়তো। আচ্ছা আমার মতো একটা ছেলের সাথে খাদিজা কিভাবে প্রেম করল।মাঝে মাঝে খুব চিন্তায় পড়ে যায়।কিভাবে করল,সেটাই আজ আপনাদের বলব।কাম ব্যাক কলেজ লাইফ শেষের দিকে।এই কলেজ লাইফে কারো সাথে বিশেষ করে মেশা হয়নি।দু এক জন বন্ধু বাদে কারো সাথে একটা ভালো সম্পর্ক করি নাই।না,আমি করতে ইচ্ছুক হয়তো তারা আমার সাথে করতে চাই নাই। কারণ আমি খুব নিরব প্রকৃতির মানুষ।কারো সাথে আজও কথা বলি নাই। না, এটা আমার ইচ্ছা না।প্রকৃতি আমাকে নিরব থাকতে বাধ্য করেছে।
তাই তো আজও আমি নিরব।বাকি জীবনটাও নিরব হয়ে বেঁচে থেকে প্রকৃতি আর সমাজের সাথে লড়াই করে যেতে হবে।সময় সান্নিধ্য থাকার সত্যেও আমি কারো সাথে কথা বলতে পারি না।এটাতে আমার কোনো হাত নেই।ওপর ওলার ইচ্ছাতেই আমি এমন নিরব প্রকৃতির মানুষ। একদিন ক্লাসে কোনো এক মেয়ে আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। এবং মেয়েটি আমার কাছে এসেও বলেছিল “এই তুমি কথা বলো না কেন।সবসময় চুপচাপ থাক” আমি তখন কিছু বলতে পারি নাই।নিরব থেকে শুধু একটু হাসি দিয়েছিলাম।মেয়েট ি আমার হাসির মানেটা কি বুঝতে পেরেছিল সেটা আমার অজানা।আমি মেয়েটিকে এড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসি।কি জানে মেয়েটি হয়তো ভাবতেছে আমি ভাব নিয়ে চলি।হয়তো এটা জেনেই বাকি জীবন পার করে দিবে।তাতে আমার কিছুই করার নেই। এদিকে যেই বাসাতে থাকি।বাসার মালিকের মেয়েটি সম্ভবত কোনো এক ক্লাসে পড়ে আমার জানা নেই।
তবে আজ পর্যন্ত মেয়েটির সাথে আমার কথা হয় নাই।তবে অনেক সময় মেয়েটি আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকত।আমি তার তাকিয়ে থাকার মানেটা আজও বুঝি নাই। এই তো সে দিন,বাসা থেকে যখন বের হব তখন মেয়েটিও বাসা থেকে বের হচ্ছে।যখন নিচে নামতে যাব তখনই মেয়েটি আমার সামনে এসে পড়ল।আমার যাওয়ার রাস্তা আটকে রেখে আছে।কিছুই বলছে না।আমি যখন পাশ কাটিয়ে যাব তখন মেয়েটি আমার হাতটা ধরে ফেলল।আমি করুন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি।অসহায় হয়ে তার হাত থেকে আমার হাত টা ছুটাতে চাচ্ছি।কিন্তু মেয়েটি তা করতে দিচ্ছে না।আমি কিছু বলতেও পারতেছি না।মেয়েটি আমার সাথে কথা বলার জন্য যখন ইচ্ছে করল,ঠিক তখনই আমি হাত টা ছাড়িয়ে চলে আসলাম।
যেখানে আমার কিছু বলার নেই সেখানে আমাকে নিরব হয়ে থাকতে হয়।কথা বলার শক্তি যদি আজ থাকত তাহলে মেয়েটি কে ইচ্ছে মতে কিছু বলতাম।মেয়েটির ধারনা আমি মেয়েটি কে ভালোবাসি। যাই হোক সেই দিনের মতো মেয়েটি আর আমর চোখের সামনে পড়ে নাই। একদিন আমাদের বাসাতে কোনো এক আত্মীয় এসেছিল।আমি এর আগে কখনো দেখি নাই।যখন ওরা রুমে আসল তখন আমি তাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।কিছুই বলতে পারি নাই।তারা হয়তো ভাবতেছে ছেলেটা বিয়াদব। পরে এক সময় আমার মার কাছ থেকে তারা জেনে গেছে যে আমি নিরব।তার জন্য হয়তো তারা নিজের প্রতি ধিক্কার জানাচ্ছে।
এতে তাদের কোনো অপরাধ নেই।তারা জানে না তাই তারা আমার প্রতি এমন মনোভাব পরিলক্ষিত করেছে।এখন তারা জানে তাই তারা নিজের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে অনুশোচনা করতেছে। যাই হোক তারা তাদের মনোভাব দিয়ে আমাকে দেখেছে।আমার তাতে কিছুই করার নেই। কারণ আমি নিরব প্রকৃতির মানুষ। আমাকে নিরব থেকেই যেতে হবে। আমার প্রতি কারো যদি এমন মনোভাব তৈরি হয় তাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ থাকে না।এর জন্য আমাকেই অনুশোচনা করতে হয়।আমার ভাগ্য খারাপ তাই আমি এমন।
মাঝে মাঝে মনে হয় অপারে চলে যায়। কিন্তু না আমার বেঁচে থাকার দরকার আছে।আমি যদি মরে যায় তাহলে আমার মতো আর যারা এমন নিরব প্রকৃতির মানুষ আছে তারা আমার প্রতি ঘৃণা জন্ম নিবে তাদের মনে।তারা ভাববে তাদেরও চলে যেতে।না, তা হবে না।আমি নিরব প্রকৃতির মানুষ। আমাকে পরিবেশ এবং প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে যেতে হবে।তাই আজও বেঁচে আছি। এদিকে আমাদের বাসার মালিকের মেয়েকে আমার ভালো লাগলেও কোনো দিন মুখ ফুটে বলতে পারি নাই।যদি আমার প্রতি তার কোনো এমন চিন্তা ভাবনা না থাকে তাহলে সে আমাকে কি ভাববে। তাই কোনো দিন বলা হয়ে ওঠে নি যে,”আমি তোমাকে ভালোবাসি খাদিজা” হ্যাঁ, মেয়েটির নাম খাদিজা (খাদিজাতুল কুবরা)।তাকে দেখলেই আমি করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।সে হয়তো আমার এই তাকিয়ে থাকার মানেটা বুঝতে পারে। হয়তো তার মনে দ্বিধা কাজ করে।তাই এমনি ভাবে চলে যায় দিন গুলো।
একদিন কলেজ শেষে বাড়ি ফিরতেছি। রাস্তায় কোনো রিক্সা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ খাদিজা আমাকে দেখেই তার রিক্সাটা দাঁড় করাল।অর্থাৎ সে একটা রিক্সা করে একাই বাড়ি যাচ্ছে।আমাকে দেখেই দাঁড় করাল। সে বলল,”চলে আস আমরা তো এক বাসাতেই থাকি দুজনে এক সাথে যাওয়া যাবে” আমি তখন কোনো কিছু বলতে পারি নাই। আমিও সাথে সাথে খাদিজার পাশে এক রিক্সাতে বসে গেলাম। আমি কিছুটা অসস্তিবোধ হচ্ছি।সারা রাস্তায় আসলাম কোনো কথা হয় নি।যখন বাড়ির সামনে রিক্সা এসে থামে,ঠিক তখনি সকল নিরব বাধা অতিক্রম করে খাদিজা বলল,”আজ সন্ধায় একটু ছাদে আসবে কথা আছে”
এই বলে খাদিজা চলে গেল।আমি মনে মনে ভাবতেছি কি কথা বলবে আমার সাথে। আমি যদি আর ওর দিকে না তাকায় এগুলো। আর যদি ওর সামনে না পড়ি এগুলো। নিজের মধ্যে এক অজানা ভয় কাজ করতেছে।তাহলে কি আমি খাদিজাকে হারিয়ে ফেলব।তা কি করে হয় আমি যে খাদিজাকে ভালোবাসি। অনেক।সে যদি আমাকে না করে দেয় তাহলে আমি আর ওর সামনে যাব না।আমার প্রতি তার কোনো ভালোবাসা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।নিরব প্রকৃতির মানুষদের প্রতি অন্যের মনে ভালোবাসা নাথাকাটাই শ্রেয়।কি জানে হয়,হয়তো জানি না।খাদিজা যদি আমাকে না করে দেয়। আমি স্বেচ্ছায় তার কথার কোনো প্রতুত্তর না দিয়ে চলে আসব। অবশেষে সন্ধা হলো। রুমের মাঝে আমি বসে আছি।যাব নাকিযাব না।এমন চিন্তায় মগ্ন।এমন সময় আমার মোবাইলে একটা মেসেজ আসল।
মেসেজটা ছিল,”এই কোথায় ছাদে আস” আমার আর বুঝতে বাকি রইল না।কে এই মেসেজ দিয়েছে।আমার নাম্বার পেল কোথাই। তাহলে কি খাদিজা আমাকে অনেক আগে থেকেই ফলো করে।তাহলে কি খাদিজাও আমাকে হয়তো। যখন ছাদে একটি পা রাখলাম আর একটি পা এখনো বাহিরে।ঠিক তখনই অনেকে এক সাথে বলে ওঠল..”হ্যাপি বার্থডে টু ইউ জুবায়ের” পাশ দিয়ে অনেকটি বেলুন ওপরে ওঠল। পরক্ষনেই অন্ধকার ছেদ করে আলো দিয়ে আলোকিত হয়ে ওঠল ছাদ।আমি তখন বিস্মিত। এই মেয়ে জানে কিভাবে আজকে আমার জন্মদিন।আর আমারও মনে আছে আজকে যে আমার জন্মদিন।আর আজকে হলো ১৭ই নভেম্বর।আমার এই দিনটার কথা সবসময় মনে থাকে কারণ এই দিনেই আমি জন্মগ্রহণ করেছি।এটা কিভাবে ভুলে যাব।
একে একে সবাই আমার সামনে আসতে লাগল।আর এখানে তো বেশির ভাগ আমার সকল বন্ধুরা।তার মানে তাদের মাধ্যমেই আমার জন্মদিন এবং আমার সম্পর্কে সব কিছু খাদিজা জেনেছে।সবাই তখন ব্যস্ত কেক কাটা নিয়ে।কেক কাটা হয়ে গেল। পরিশেষে দেখি খাদিজা ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে আনমনে।তখন আমার সব বন্ধুগুলো বলল,”আমি খাদিজার কাছে যেতাম।” খাদিজার কাছে যেতেই খাদিজা আমার দিকে ঘুরে তাকাল।দেখি খাদিজার চোখে পানি।খাদিজা কেন কাঁদতেছে।তখন খাদিজা চোখেরপানি মুছে বলতে লাগল, “জুবায়ের দেখ তুমি নিরব প্রকৃতির মানুষ। তুমি বোবা।কথা বলতে পার না। এতে তোমার কোনো দুষ নেই।এটা নিয়ে নিজেকে সবসময় ছোট মনে কর কেন।
অন্যের মাঝে নিজেকে বুঝাতে চাও না কেন যে,তুমিও একজন মানুষ।বাঁচতে চাও সবার সাথে।সবসময় নিজেকে দূরে রাখ। তুমি আমাকে ভালোবাস আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি।তুমি ভাবতেছ আমি তোমাকে না বলব।তা কি করে হয় আমিও যে তোমাকে অনেক ভালোবাসি।বাসবে কি আমাই ভালো। হবে কি আমার পথ চলার সঙ্গি। “আই লাভ ইউ জুবায়ের” আমি তখন খাদিজার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।কি বলব আমার জানা নেই।আমার চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে লাগল।আর খাদিজা নিজ হাতে আমার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে।আমি সাথে সাথে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে,মোবাইলে লিখে খাদিজাকে দেখালাম,”আই লাভ ইউ টু” সাথে সাথেই খাদিজা আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।চারদিকে নিস্তব্ধ।
চাঁদের আলোয় আলোকিত চারপাশ।শুধু দুটি মানুষ একে অপরের খুনশুটি গুলো ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। সেই সুবাদে আজ তিতাস নদীর তীরে আমার আর খাদিজার আগমন।আনমনে তাকিয়ে আছি নদীর পানির দিকে।পরক্ষনেই খাদিজা বলল, “কি ভাব জুবায়ের” আমি পকেট থেকে কাগজ আর কলম বের করে লিখে দেখালাম, “ভাবি আমার মতো বোবা ছেলেকে তুমি যে ভালোবাস” খাদিজার মুখ খানি মলিন হয়ে গেল।আর বলতে লাগল,”এসব আর কখনো ভাববা না। তুমি বোবা,কথা বলতে পার না আমি কি কখনো তা বলেছি।আমি তো চাই না তুমি কথা বলতে পার।
আমি চাই শুধু আমাকে ভালোবাসবে আর সারা জীবন তোমার পাশে রাখবে।হাতে হাত ধরে হাটতে দিবে,বুকে মাথা পেতে ঘুমোতে দিবে,কাধে মাথা রেখে শেষ সময়ের সূর্য ডুবে যাওয়া দেখতে দিবে,তোমার লেখা গল্পের নায়িকা দিবে,এক মগে কফি খাওয়ার ভাগ দিবে,মাঝ রাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না দেখার অধিকার দিবে,এগুলোই চাই।সাথে তোমাকে।” সেই সুখে চোখ থেকে দু ফোটা পানি ঝড়ে গেল।এই পানি কষ্টের না,ভালোবাসার।এভ াবেই সারা জীবন খাদিজার পাশে থাকতে চাই,ভালোবেসে। যা কখনো ফুরাবে না।শেষ হবে না একে অপরের প্রতি রাগ-অভিমান।হারাবে না প্রকৃত সুখ।বেঁচে থাকুক খাদিজার ভালোবাসা।