ক্যাম্পাসের এক কোণে বসে একাএকা আপন ভাবনায় কবিতা লিখছিলাম যদিও আমার ঝুলিতে শব্দ আর কথার তেমন ছড়াছড়ি নেই। তবুও একটু মুক্তচিন্তার পথে এগোতে চেয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ কোথা থেকে একটি মেয়ে দৌড়ে এসে আমার পাশে বসলো।
-আমাকে একটু হেল্প করেন প্লিজ। আমি এবার নতুন। সেকেন্ড ইয়ারের আকাশ ভাইয়া আমার পিছু নিয়েছে আমায় প্রপোজ করবে বলে কিন্তু উনাকে কেমন গুণ্ডাপাণ্ডা টাইপের লাগে। এখন এই ছেলেকে ধরে মারে, আবার ওই ছেলেকে থাপড়ায়। আমাকে হেল্প করেন প্লিজ, যেন উনি আর আমার পিছু না ঘুরে।
-আমি কিভাবে হেল্প করতে পারি!
-আমার হাতটা ধরে একটু বসে থাকেন। যেন আকাশ আমাদের এভাবে দেখতে পায় তাহলে আর প্রপোজ করতে আসবেনা।
-পাগল নাকি! যদি এসে আমাকে আচ্ছা করে মাইর দিয়ে বলে যে তুই ওর সাথে কি করছিস! তখন আমি কি বলবো! আমার এতো মাইর খাওয়ার শখ নাই।
-প্লিজ। হেল্প করেন। একটা অসহায় মেয়েকে আপনি বিপদে ফেলে যাচ্ছেন!
-আপনার সহায় হলে একটুপর আমাকেই অসহায় হয়ে যেতে হবে!
বলে আমি চলে আসতেছিলাম। পিছন থেকে মেয়েটি আমার হাত ধরে আবার আমার সামনে এলো। চোখে অশ্রু ছলছল করছে। এমন সময় আকাশ ভাই আমার সামনে এলো! আমিতো ভয়ে চিৎপটাং অবস্থা! উনার সাথের এতোগুলো পোলাপান মিলে যদি আমাকে একটা মাইর দেয় তাহলে আমায় আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
-কিরে তোর গার্লফ্রেন্ডকে ছেড়ে কই যাচ্ছিস? দেখছ না মেয়েটা কাঁদতেছে?
-ভাই কি করবো বলেন আমার সাথে ওর রিলেশন সেই নবম শ্রেণী থেকে। আজ পাঁচ বছর! তবুও ও যদি আমার রিলেশনের মাঝে আকাশ নামের একটা ছেলেকে আনতে চায় তাহলে কি করবো বলেন? দুই নৌকায় পা দিয়ে কেউ তো আর এগোতে পারবেনা! আমিতো ওকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম। মেয়েটার জন্য আমি প্রতি রাতে কবিতা লিখতাম। প্রতি বিকেলে আর্ট ক্যানভাসে ওকে ভাবতাম! এখন খুব মিস করবো ওকে ভাই। এখন প্রতিরাতে কবিতা হবেনা, বালিশ ভিজবে! বিশ্ব জানুক আরও একটি দেবদাসের গল্প। আকাশ নামের ওই ছেলের সাথে যদি ও ভালো থাকে তবে আমি আমার ভালোথাকা ভালোলাগা বিসর্জন দিলাম।
আকাশ ভাইয়ের চোখে জল টলমল দেখে ভাবলাম যাক কাজ হয়েছে! দারুণ অভিনয় করেছি। বাপ্পারাজের দেবদাসের মতো বারবার ছ্যাকা খাওয়া কৌটাটা এবার আমিই পাবো। আমি নিশ্চিত বাপ্পারাজ নায়ক রাজের ছেলে না হলে পরিচালকরা এতোদিনে আমাকেই খুঁজে নিতো।
তারপর কানে আর গালে জোরেশোরে একটা লাগতেই বাপ্পারাজের ভাবনা বাদ দিয়ে ভারতীয় বাংলা এক্টর ইন্ডাস্ট্রির কাঞ্চন মল্লিকের মতো ওবাবাগো বলে যেই দৌড় দিতে যাচ্ছিলাম তখনি আকাশ ভাই আমার হাত ধরে বললেন,
-আরে বোকা আকাশ তো আমিই। তুমি ভুল বুঝেছ তোমার গার্লফ্রেন্ডকে। আসলে আমিই ওর পিছু নিয়েছিলাম। আর ও আমার থেকে পালাত কারণটা এখন বুঝেছি। সত্যিই ও তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। ঠিক তোমার মতো। এই নাও ওর হাত ধরো। এবার ক্লাসে যাও। অমর হোক এমন ভালোবাসার গল্পগুলো।
তারপর আমি মেয়েটার হাত ধরে কিছুদূর এসে যখন দেখলাম আকাশ ভাই চলে গিয়েছে তখন উনার হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম,
-কি ম্যাডাম হেল্প করতে পেরেছি তো?
-হুম। খুব পেরেছেন। আপনাকে বাংলা সিনেমায় সুযোগ দেওয়া হোক।
-তাহলে তো ভালোই হয়। মুসাফির,পোড়ামন,ঢাকা এটাক,দেবী মুভিগুলো দেখার পর ভাবছি বাংলা সিনেমা উন্নতি আকাশছোঁয়া, অভিনয়ের সুযোগ কাজে লাগালেই বাঙ্গালি স্টার! তাছাড়া ওপার বাংলায় তো সুপারহিট মুভি আছেই গেম,বস,ভিলেন আরও অনেকগুলো। আর দুই বাংলাতেই রোমান্টিক মুভিগুলোও দেখার মতোই হয়। যদিও তামিল ছবি আমার সবচাইতে বেশি ভালোলাগা। আমি প্রতিটা তামিল মুভির বিশাল ফ্যান।
-ধুর। আচ্ছা আপনি আকাশ ভাইকে কিভাবে চিনলেন?
-আপনি বললেন না গুণ্ডাপাণ্ডা টাইপের? যখন তখন একে ওকে ধরে মারে? তাই উনার সাথে পোলাপান দেখে বুঝলাম।
-ও আচ্ছা, ট্যালেন্ট আছে বটে!
-আমি আসি তাহলে?
-জ্বী। আর হ্যা ধন্যবাদ।
-স্বাগতম। হঠাৎ একদিন আমাকে থার্ড ইয়ারের ভাইয়েরা ধরে বসলো!
-ওই ছোট এদিকে আয়!
-জ্বী ভাই বলেন।
-হিরোগিরি করছ?
-না ভাই!
-তাহলে কলারের বোতাম লাগা! আর শার্টের হাতা নামা।
-জ্বী ভাই নামিয়েছি।
-এবার ওই গ্রুপটা দেখছিস ফাস্ট ইয়ারের মেয়েদের?
-হুম।
-ওখান থেকে একটা মেয়েকে নিয়ে ছাদে উঠে বন্ধুত্ব করে আবার আমাদের কাছে এসে বলবি ফ্রেন্ডশিপ ডান! যদি পারিস তবে কথা দিচ্ছি ক্যাম্পাসে তোর জন্য সব কিছু উন্মুক্ত। কেউ তোকে কিছু বলবেনা তুই যেভাবে ইচ্ছা চলতে পারবি। আর যদি না পারিস তবে কখনওই ক্যাম্পাসে কোনো মেয়ের হাত ধরে হাটতে পারবিনা। আর শার্টের কলার,হাতা চুলের স্টাইল আমাদের চোখে পড়লে মাইর মিস হবেনা! এবার যা!
আমি বুঝছি! র্যাগিংয়ের কবলে পড়ছি। উপায় নেই করতেই হবে। এতো কঠিন শর্ত! এমনিতেই এখন আমার কলারে বোতাম আর হাতার দিকে তাকাইলে কেমন মধ্যবয়সী সাজপোশাকের মতো লাগছে! তার উপর ওইগ্রুপে সবগুলা মেয়েকেই সুন্দরি লাগছে! ওরাতো আর বুঝবেনা আমি বাধ্য হয়ে এমন সেজেছি! তাছাড়া একটা সুন্দরী মেয়েকে এমন একটা ছেলের সাথে ছয়তলার উপর ছাদে যেতে বললে সেতো যাবেই না তাও আবার অপরিচিত! না পারার জন্যই ওরা আমাকে এমন কাজ করতে বলছে! তবুও অনেকটা ভয় নিয়ে মেয়েগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম! আরে এখানে সেদিনের হেল্প চাওয়া মেয়েটাও আছে! কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কাছে গিয়েই হাতটা ধরে টানতে টানতে বললাম,
-আমিও পরিস্থিতির স্বীকার প্লিজ আমাকেও একটু হেল্প করেন।
-কি হয়েছে?
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সব ঘটনা বললাম। তারপর ছাদে উঠে দুহাত উঠিয়ে তাদের জানান দিলাম আমি এতটুকু পেরেছি। তারপর নিচে গিয়ে ভাইদের কাছে যেয়ে বললাম,
-ভাই ফ্রেন্ডশিপ ডান।
-তোর তো হেবি দম! আমি চুপ করে রইলাম।
-এবার যা। তোকে কেউ আর ক্যাম্পাসে ধরবেনা।
-আচ্ছা ভাই। তারপর সেখান থেকে এসে ধন্যবাদ দিয়ে মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম,
-হাই! আমি নিশান হাসিব শান্ত। বন্ধুত্বটা কি সত্যি সত্যি করা যায় না? মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-আমি ফৌজিয়া ফারুকি ফ্লোরা। আরোহীও বলতে পারেন!
-অরু বলতে পারবো? নামটা অনেক সুন্দর লাগে!
-আচ্ছা আমরা তো বন্ধু কিন্তু আপনি আপনি করছি কেন? ক্যান উই কল ইচ আদার তুই?
-কেন নয়!
তারপর থেকে আমাদের বন্ধুত্ব চলছে হাসি ঠাট্টা আর বেশিরভাগ ঝগড়া করেই! কেউ কাউকে ছাড়া ক্যাম্পাসে ভাবতেই পারিনা। এভাবেই দুটি বছর চলে গেলো। মেয়েটা যে আহামরি সুন্দরি তাও না। শ্যাম বর্ণের মধ্যে কাজল কালো টানা টানা চোখ, পাতলা গড়নের ঠোট আবার ঢেউ খেলানো চুল। সবমিলিয়ে ও রূপবতী না হলেও মায়াবতী তো বটেই! ঠোট,নাক,চোখ,চুল এগুলোর গঠন দেখলে যে কেউ ওর প্রেমে পড়তে বাধ্য! আমিও সেই প্রথম দিনেই পড়েছিলাম যেদিন ও হেল্প চাইতে এসেছিল। কিন্তু এতোদিনেও মুখে বলতে পারিনি। তবে মুখে সরাসরি বলতে না পারলেও ইশারা ইঙ্গিতে আর বিভিন্ন কথার ছলে ঠিকই বুঝেয়েছিলাম। ও কতটা বুঝেছে জানিনা। তবে এতটুকু বুঝাতে চেয়েছি ওকে ছাড়া আমার কিছুতেই চলবে না। তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন একদিন এক ট্রাজেডি আমার পুরো মন আর দেহের উপর দিয়ে গেলো! হঠাৎ একদিন আমাকে ও চতুর্থ বর্ষের হিমু নামের একটি ছেলের ছবি দেখিয়ে বলল এই ছেলেটিকে ও অনেক ভালোবাসে। আমি ভাবছি সারাক্ষণ এতোভাবে বুঝানোর পর, সারাক্ষণ আমার সাথে থাকার পরও ও কিভাবে অন্য একটি ছেলের প্রেমে পড়তে পারে! আমি ওকে বেষ্ট অফ লাক বলে জিজ্ঞাস করলাম,
-কিভাবে প্রেমে পড়লি?
-ছেলেটা রোজ আমায় আবেগপূর্ণ কবিতা টেক্সট করতো। শত ভাবনার ভালোবাসার কথাকলি লিখে দিতো সাদা কাগজে ভালোবাসার আঁকিঝুকি করতো। সে আমাকে বলছে সে আমাকে অনেক ভালোবাসে।
-অনেক ভালোবাসলেই ভালো।
-হুম। আমিও ভালোবাসি তাকে।
-আচ্ছা।
তারপর ওর কথা মনে হলেই শুধু মন খারাও হয়ে যেতো। কিছুই ভালো লাগতো না। এই বুঝি ওকে হারিয়ে ফেলবো। মনের উপর দিয়ে এতো ঝড় তুফান সহ্য করতে না পেরে আমি হোষ্টেল থেকে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি চলে আসলাম। একপক্ষ দিন পরে আবার রুমে শুয়ে আছি। বাড়ি থেকে জার্নি করে ফেরার পর ক্লান্ত দেহে ঘুম চলে এসেছিল। আমার রুমমেট জিসানের ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম।
-হাসিব তোর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে!
তাকিয়ে দেখতেই লাফিয়ে উঠলাম।
-অরু! কখন এসেছিস?
-বাড়ি যাওয়ার সময় বলে গেলিনা কেন?
-এমনি সবকিছু হঠাৎ আর তাড়াহুড়ো হয়ে গেছিলো তাই।
-তোর খোঁজে প্রায় প্রতিদিন আসতাম তোকে পাইনি। তোর গ্রামের বাড়ির ঠিকানাও জানেনা কেউ। আর ফোন তো যাওয়ার পর থেকেই বন্ধ রাখছিস।
-আচ্ছা বাদ দে। এখন বল হিমু ভাই কেমন আছে?
-ওই প্রতারকটা খুব ভালোই আছে!
-প্রতারক মানে!
-প্রতারকই তো!
ও আমাকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে আমার আবেগ নিয়ে খেলছিল! আসলে ওর আরও একটি রিলেশন ছিলো। আমি একদিন জয়াদের সাথে ফুসকা খেতে যেয়ে দেখি খুব চেনা কেউ একজন একটি মেয়েকে ফুসকা খাইয়ে দিচ্ছে। একটু কাছে যেতেই দেখলাম ওটা হিমু। তখন জয়াদেরকে সব খুলে বললাম। তারপর ওদেরকে আড়ালে নিয়ে আমরা হিমুকে ফলো করলাম। দেখলাম ও মেয়েটিকে নিয়ে রিক্সায় চড়ে ইকো পার্কে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে বসে আছে আর মেয়েটি ওর কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। তারপর ওর সামনে যেতেই ও চুপ করে থেকে বলল ও ওই মেয়েটিকে ভালোবাসে। তারপর আমি ওকে দুটো চড় মেরে চলে এসেছি। এগুলো জানাতেই রোজ তোর এখানে এসে দেখতাম তুই নেই। আমার মনে হচ্ছিলো তোকে জানাতে পারলে আমার সবকিছু হালকা লাগতো! কিন্তু তোকে এতোটাই অনুভব করেছি প্রতি মুহুর্তে তোকে ছাড়া আমার চলবেনা এমন মনে হয়েছিল।
-আচ্ছা চল। ওই বেটা আমার সিনিয়র হলে কি হবে আমার বেষ্টুর সাথে প্রতারণা করার জন্য আজকে ওকে পোলাপান দিয়ে মাইর দিবো।
-প্রয়োজন নেই। একটা প্রতারককে মেরে তোদের হাত নোংরা করতে হবেনা।
-আচ্ছা।
-হাসু তোকে একটা কথা বলি?
-হুম বল।
-তোর প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া মায়াবতীটা যদি সারাজীবনের জন্য তোর হতে চায়?
-তোকে এসব কে বলল?
-ডায়েরীটা সাথে নিয়ে যাসনি। বলেই ডায়েরীটা আমাকে দিলো। আর বলল তোর বিছানার পাশে দেওয়ালে মায়াবতী আর তোর সেলফি ও ফটোগুলোও একটি অপ্রকাশিত সত্যি ভালোবাসার স্বাক্ষী দেয়! কিরে হাসু ডায়েরীর কথাগুলোর মতোই ভালোবাসবি তো তোর গল্পের মায়াবতীকে? মায়াবতীর তরে লিখবিতো অজস্র তারার কবিতা? অরু নামে সাজাবিতো তোর গল্প?
-হুম অরু। খুব বাসবো,লিখবো আর সাজাবো।
তারপর ও আমার বুকে আলতো করে কিল দিয়ে বলল স্টুপিড আমিতো বোকা বলে বুঝিনি সত্যি কাকে আমার মন নিজের করে চাইতো কিন্তু তুইতো বুঝেছিলি, বললি না কেন তোর বোকা মায়াবতীটাকে!
আমি মাথা নিচু করে আছি। মায়াবতীটা আবার স্টুপিড বলে আমার বুকে মুখ লুকালো। জিসান আর রাহাত বই দিয়ে মুখ ঢেকে বলল আমারা কোনো স্টুপিড আর মায়াবতীকে জড়াজড়ি করতে দেখিনি।