রাত ১১ টা বাজে হঠাৎ তিথি আপুর আগমনে আমরা সবাই চমকে গেলাম। মা দৌড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কি ব্যাপার,এতরাতে তুই একা এসেছিস ! ইফতি কোথায়’? বাবা, কৌতুহল চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।আপু সবাইকে চমকে দিয়ে বললো, ‘আমি ইফতিকে ডিভোর্স দিতে চাই।ওর সাথে আমি আর সংসার করবো না।’
আপুর কথা শুনে বাবা খুব রেগে গিয়ে বললেন, ‘এই কথাগুলো এখন বলছো কেন? যখন আমাদের না জানিয়ে ইফতির হাত ধরে বাড়ির বাহিরের পা বাড়িয়েছিলে তখন তোমার আবেগ কোথায় ছিলো? শুধু তোমার মা আর ছোট বোন মিথির কান্নাকাটি দেখে তোমাকে একসেপ্ট করেছিলাম না হয় কখনো তোমাকে আমি এই বাড়িতে জায়গা দিতাম না’। বাবার কথা শুনে তিথি আপু ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি আপুর হাত ধরে রুমে নিয়ে যেতে যেতে বললাম, ‘তুমি কষ্ট পেও না আপু। বাবারা এমনি হয়।তারা যেমন কঠোরভাবেশাসন করে তেমনি তাদের মনটাও অনেক কোমল হয়’। এবার বলো, ‘কি হয়েছে তোমার আর ইফতি ভাইয়ার মাঝে? তুমি তো কখনো ইফতি ভাইয়াকে ছাড়া একা আসো না! ‘ আপু কিছু না বলে আবারো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
মনে হচ্ছে এক পৃথিবী সমান কষ্ট বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে আপু।আপুর উচিত এই কষ্ট গুলো মনথেকে উজাড় করে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেয়া। না হয় এতগুলো কষ্টের ভার সে একা বইতে পারবে না, অচল হয়ে যাবে। কাল রাতে আপুকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। সকাল সকাল আপু নিজের থেকেই এসে বললো, জানিস মিথি, ইফতি অনেকটা চেইঞ্জ হয়ে গেছে।এখন আর আগের মতো ও আমাকে ভালোবাসে না এমনকি আমাকে সহ্য পর্যন্ত করতে পারে না। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম সেই পর্যন্ত ওর পাশে থাকতে যখন ওর পাশে কেউ থাকবে না। ইফতি আজকাল প্রায়ই রাত জেগে বারান্দায় গিয়ে কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলে। ও আজকাল একটা মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে ইনভলভ হয়েছে। আমাকে বুঝতে দেয় না ব্যাপারটা। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পারি।
সেদিন ঐ মেয়েটা কল করেছিলো যখন ইফতি গোসল করায় ব্যস্ত ছিলো। মেয়েটা ‘হ্যালো’ বলতেই আমি কলটা কেটে দিয়েছি, পাছে মেয়েটা কি না কি বলে ফেলে যেটা শুনে আমি কষ্ট পাব বলে! জানি না আমার প্রতি ইফতির ভালোবাসা কেন কমে গেছে। কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালবাসা আজো কমেনি আর কোনদিন কমবেও না। তাই ওদের সুখের জন্যে আমি চলে এসেছি। এখন আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে মুক্তি দিতে চাই। ভালো থাকুক ও আর ওর নতুন সঙ্গিনী। কথাগুলে বলতে না বলতেই আপুর চোখ থেকে আবারো কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। যেই অশ্রু মুহূর্তের মধ্যে না থামলে পৃথিবীতে এক ভয়ংকর বন্যার সৃষ্টি হবে।যে বন্যার স্রোত কেবল বিশ্বাসঘাতক মানুষগুলোকে পৃথিবী থেকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ! আপুর কাছ থেকে ফোন ✆ নং নিয়ে ঐ মেয়েটাকে কল করলাম যার সাথে নাকি ইফতি ভাইয়া কথা বলে। ফোনে রিং বাজতেই ওপার থেকে কেউ একজন ফোনটা রিসিভ করে বললো,
-‘হ্যালো, কে বলছেন ‘?
-‘জি, আমি ইফতি ভাইয়ার বোন ‘মিথি’ বলছি। আপনার নামটা জানতে পারি?’
-আমি ‘রোজ’ বলছি।বলুন কেন ফোন করেছেন?
-একচুয়ালি আমি জানতে চাচ্ছিলাম , ইফতি ভাইয়ার সাথে আপনার কিসের সম্পর্ক?
-ইফতির সাথে আমার কিসের সম্পর্ক মানে? ইফতি আমার বয়ফ্রেন্ড।ও আমাকে বিয়ে করতে চায়।
-আচ্ছা আপনি কি জানেন সে ম্যারিড,তার ওয়াইফ আছে?
-হ্যাঁ, জানি। তাতে কি হয়েছে? ইফতি ওকে ডিভোর্স দিলেই তো হয়ে যাবে। ডিভোর্সর কথা শুনে আমার প্রচন্ড রাগ হলো।
তাই বললাম, ‘শুনুন আপনাদের মতো কিছু মেয়েদের জন্য সমাজে অন্যসব মেয়েদের কথা শুনতে হয়।কি পেয়েছেন ওর কাছে আপনি? অনন্ত ওর ওয়াইফের স্থানে আপনার বোনকে বসিয়ে তারপর বিচার করুন আপনি যা করছেন ঠিক করছেন কিনা। শুনে রাখুন, টাকা দিয়ে কেবল বিলাসবহুল জীবন কাটানো যায় কিন্তু সুখ নামক জিনিসটা কেনা যায় না। বেঁচে থাকার জন্য কেবল সুখ নামক জিনিসেরই দরকার যেটা থাকলে কুঁড়ে ঘরেও শান্তিতে থাকা যায়। মেয়েটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কলটা কেটে দিলাম। একটুপরে আপুর হাত ধরে টেনে নিয়ে ওদের মানে ইফতি ভাইয়ার বাসার দিকে রওনা হলাম। গিয়ে দেখি সে কেবলমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। আমাদের দেখে ভাইয়া খুশী হলো না, সেটা তার ভাবসাব দেখেই বুঝেছি। আমি বললাম, আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই, আপনার সময় হবে’?
-‘হ্যাঁ, হবে।যা বলতে চাও তাড়াতাড়ি বলো আমার অফিস আছে’। আমি বলতে লাগলাম, ‘আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন আপনার জীবন থেকে ঘটে যাওয়া ৪ বছর আগেরকার অতীত। আপুর জন্য আমরা ছেলে ঠিক করেছিলাম বিয়ে দেয়ার জন্য। আপনি তখন হুট করে আপুকে নিয়ে চলে গেলেন আপনার ভালবাসার অজুহাত দেখিয়ে। আমাদের মনে কষ্ট দিয়েছিলেন সেটাও আমরা মেনে নিয়েছিলাম। তখন আপনার কোন চাকরি ছিলো না আপনি ছিলেন একজন শিক্ষিত বেকার। তখন কত কষ্ট করে কেটেছিলো আপনাদের দিনগুলো। আপু কিন্তু আমাকে বলেছিলো মাঝেমধ্যে আপনাদের না খেয়ে থাকার দিনগুলোর কথা।
কই? তখন তো আপু আপনাকে ছেড়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসেনি। তাহলে আজ কেন আপনি কিছু টাকার মালিক হয়ে আপনার অতীত ভুলে গেলেন? দেখুন এগুলো বলছি দেখে আপনি এটা ভাববেন না যে আপুকে আপনার ঘাড়ে আমি চাপিয়ে দিতে এসেছি। আপুকে এখন আমরাই আর আপনার কাছে ফিরতে দিবো না। “রোজ” নামের একটা আধুনিক মেয়ে পেয়েছেন তাই না? তো দেখি মেয়েটা কত ভালোবাসে আপনাকে! আপনি যে রোজকে নিয়ে ভালো আছেন এটা আপু দেখে না গেলে সে ভালো থাকতে পারবে না। আপনি এখন রোজকে কল করে বলবেন, আপনার শরীরে ভয়ংকর কোনো রোগ ধরা পড়েছে।আপনার ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিত।
আপনি আপনার ওয়াইফকে ডিভোর্স দিয়েছেন। এই বলে জিজ্ঞেস করুন তাকে,সে বাকিটা জীবন আপনার সাথে কাটাবে কিনা? মাঝেমধ্যে মিথ্যা বলতে হয়, না হয় আসল এবং নকলের ফারাক বোঝা যায় না। এতক্ষণ আমার কথাগুলো শুনে ভাইয়া অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেলো। সত্যিই ভাইয়া ওকে কল করলো।একটুপরে মেয়েটার কাছ থেকে এন্স নেগেটিভ তো আসলোই সাথে কিছু বকাও ফ্রি পেলো। অনেকসময় মানুষ চোখের সামনে সত্যিকারের ভালবাসাকে অবহেলা করে মরিচীকার পিছনে দৌড়ায়। একসময় তারা ঠিকই বুঝতে পারে এটা তাদের ভুল ছিলো।অবশেষে তারা কেবল আফসোস করে যেটা নিতান্ত ভিত্তিহীন। আপুকে নিয়ে উঠলাম বাসায় যাবো বলে।
এরমধ্যে ভাইয়া দৌড়িয়ে এসে আপুর হাত চেপে ধরে বললো, ‘সরি,তিথি! আমি আর কখনো এমন করবো না। আমাকে মাফ করে দাও! আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আর,আপু? সেও কাঁদতে কাঁদতে তার স্বামীকে মাফ করে দিলো। মধ্যে খানে শত্রু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি! মাঝেমধ্যে শত্রু হয়ে কারো মিল দেখতে বড্ড ভালো লাগে আমার! শক্তিশালী হোক সমস্ত সম্পর্কের বন্ধনগুলো আর ভালবাসা ছড়িয়ে পড়ুক হৃদয় থেকে হৃদয়ে।