“তুমি খুব পচা,আমাকে চকোলেট দাও না” ইশার সাথে দেখা হলেই ও এই কথা টি বলল।আমি মুচকি হেসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।সারাদিন অফিস করে এসে এই ৪ বছরের ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে না ধরলে যেন পুরো দিন টাই মাটি হয়ে যায়। আমার পরিচয় টা দিয়ে নিই।আমি নোমান। একটা বেসরকারী ব্যাংকে নতুন জব নিয়েছি।আমি এখনো অবিবাহিত।তাই নিজের খরচ টা ভালভাবেই চলে যায়। এশা মেয়েটির পরিচয় ও দিয়ে দেই।আসলে এশা আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়।আমার পাশের ফ্লাট এর রিতা ভাবীর মেয়ে হল ইশা।বয়স এখন ৪ চলে।সারাদিন চকলেট খায় আর ফোকলা দাতে বকবক করতেই থাকে।
আমি এই বাসায় উঠেছি প্রায় ৫ মাস হবে।উঠার ২ দিন পরে সবকিছু যখন গুছিয়ে নিলাম তখন পাশের বাসার থেকে রিতা ভাবী পরিচিত হতে আসলো।তখন তার কোলে ইশা ছিল।খুব কিউট ছিল মেয়েটি। এরপর থেকেই তার সাথে আমার খুব ভাব জমে যায়।সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার কাছে চলে আসত আর আমাকে শাসন করত পাগলি মেয়েটা।আমি অফিসে যাওয়ার সময় চকোলেট নিয়ে আসতে বলত। এরপর বিকালে যখন বাসায় আসতাম তখন আবার আমার কাছে এসেই চকোলেট এর বায়না ধরত।যেকারনে আমি সবসময় আমি তার জন্য চকোলেট নিয়ে আসতাম। সে চকোলেট খেত আর সারাদিন কি কি করলো সব ঝর্নার মত প্রবাহিত করা শুরু করত। তবুও তার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র বিরক্তি আসেনি।কারন ততদিনে আমি তাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। সাপ্তাহিক ছুটি তে আমি তাকে ঘুড়তে নিয়ে যেতাম।তার বাবা মা ও আমার কাছে ওকে নিশ্চিন্তে পাঠিয়ে দিত। কি কর?(ইশা)
-রুমে বসে সন্ধায় কাজ করছিলাম।তখন এসে কথা টা বলল। আমি বললাম-কিছুনা।কাজ করতেছি।
-ওহ।আম্মু বলছে নিজের কাজ নিজে করা ভালো।তাই আমি নিজের হাতেই ভাত খাই।(ইশা)
-তোমার আম্মু ঠিক ই বলছে।আমার কাজে হেল্প করবা?(আমি)
-নাহ।দেখোনা আমি চকোলেট খাচ্ছি?(ইশা)
-আমি একটু মুচকি হেসে কাজ করতে লাগলাম।আর ও একা একা খেলতে লাগলো।
একটু পর ওর মা এসে ওকে নিয়ে যায়।যার ফলে আমার খুব একা একা ফিল হতে থাকে।পরে আর থাকতে না পেরে তার মায়ের কাছে বলে ওকে আমার কাছে নিয়ে আসি রাতে আমার কাছে থাকার জন্য।হাহা।পাগলিমেয়েটার সেই দিনের গভীর রাত পর্যন্ত বকবকের কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। ওর বকবক শুনে শুনে খুব ঘুম পাচ্ছিলো।পরে ওকে আমি ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই। কিন্তু মাঝরাতে হঠাত তার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই।আমার ঘুম ভাঙার পর যা দেখলাম তা তে খুব ভয় পেয়ে যাই।
দেখলাম তার নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।এরপর ওকে কোলে নিয়েই ওর আব্বু আম্মুর ফ্লাটে চলে যাই।তারা ওকে ওই অবস্থায় দেখেই কান্না জুড়ে দিলেন।অত:পর কোন সময় নষ্ট না করে জলদি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।তার বাবা মার কান্না দেখে তাদের সান্তনা দিতে গিয়ে ও পারলাম না। কারন আমার নিজের ই যে বুক ফেটে কান্না আসছে।বারবার মনে হচ্ছে ওর যেনো কিছু না হয়।আল্লাহর কাছে বারবার দোয়া করছি। কিছুক্ষন পর ডাক্তার এসে আমার জীবনের সবথেকে দু:সংবাদ টা দিয়ে গেলেন। ইশার নাকি ব্রেইন ক্যান্সার হয়েছে।এবং সেটা লাস্ট স্টেজে।বাচার সম্ভাবনা খুব ই কম।১০% এর থেকেও কম। এই খবর শুনে রিতা ভাবী অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।কিন্তু আমি তাকে ধরতে যাই নি।আমার কোন সেন্স কাজ করতেছিলোনা।আমারপৃথিবী পুরো থমকে গিয়েছিলো। তখন আমি বুঝতে পারলাম ইশা মেয়েটাকে আমি কতটা ভালবাসি।মনে হচ্ছিল কলিজা টা কেউ ছিড়ে বের করে নিয়ে আসলো।আমার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল।
আমার ছোট্ট পরী টা কে কেমো থেরাপি দেয়া হয়।যার কারনে তার সুন্দর চুলগুলি অতীতে আশ্রয় নেয়।এখন আর সে হাসি খুশি থাকেনা।অতটুকু মেয়ে হয়ত বুঝে গেছে সে আর বেশিদিন থাকবে না। কিন্তু আমি এটা মেনে নিতে পারিনি। আমি অফিস থেলে লম্বা একটা ছুটি নিয়েছিলাম।শুধুমাত্র সবসময় তার সাথে থাকার জন্য।আমি ওকে মনের অজান্তেই আরো বেশী ভালবাসতে শুরু করলাম।মনে হত ও আমার নিজের ই মেয়ে। ওকে বাচানোর জন্য যেকোন কিছু করার প্রয়োজন হলে আমি তাই করব। কারো প্রতি ভালবাসা জন্মাতে রক্তের বন্ধন থাকা জরুরি নয়।জরুরি হচ্ছে আত্মার বন্ধন থাকা টা। ডাক্তার ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে ইশা আর মাত্র ২৫-৩০ দিন বাচবে। ওর বাবা মা এখন পাগল প্রায়।তবুও মেয়ের মুখে হাসি দেখার জন্য তারা যেকোন কিছু করে যাচ্ছেন। একদিন আমি ওকে নিয়ে ছাদে দোলনায় বসে আছি। এমন সময় ও বলে উঠলো,
-তুমার বউ নেই ক্যানো?(ইশা)
-তুমি আছোনা?বউ লাগবে ক্যানো?(আমি)
-ইশ।দেখেছো?আমার মাথায় একটা চুল ও নাই।আমাকে বউ বউ লাগেনা।(ইশা)
আমি তার কথা শুনে নির্বাক।কলিজা টা ফেটে যাচ্ছে।হে আল্লাহ।এই ছোটো মেয়েটা কি এমন পাপ করেছে যে তুমি ওকে এমন শাস্তি দিচ্ছো?অবশ্য সে তোমার তোমার ই সম্পদ তাই তুমি তাকে নিজের কাছে নিয়ে নিচ্ছো।
কিন্তু আমার কলিজা টা ছিড়েই ক্যানো?আমার চোখ দিয়ে লোনা পানি গড়িয়ে পড়ছে।পারলে ওকে আমি নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম। এরপর থেকে এক মুহুর্তের জন্য ও ওকে আমি চোখের আড়াল হতে দেইনি।ওকে নিয়ে অনেক ঘূরে বেরিয়েছি।যা চেয়েছে তাই দিয়েছি।
-তুমি একটা বিয়ে করে ফেলো।তোমার বউ কে দেখবো।(ইশা)
-ওরে পাকনা বুড়ি।বেশী পেকে গেছো না?(আমি)
-আমাকে বুড়ি বলবানা।আমি এখনো ছোটো।বড় হয়ে আমি তোমাকে মারব।(ইশা)
-হ্যা মামনি।তুমি জলদি বড় হবে।তোমাকে আরও অনেক চকোলেট দিবো।(আমি)
-হিহি।আমি বড় হয়ে নিজেই চকোলেট কিনে খেতে পারবো(ইশা)
-আমি মুচকি হেসে বুকের ব্যাথা চাপা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আচ্ছা,,,মানুষ সবসময় নিজের প্রিয় জিনিস গুলোকে এত জলদি হারিয়ে ফেলে ক্যানো?অন্য মানুষের কথা জানিনা।আমি আমার বাবাকে খুব ভালোবাসতাম।সেও আমাকে ছেড়ে ছোটবেলায় চলে যায়।আজ এই মেয়েটাও চলে যাচ্ছে।বারবার মনে হচ্ছে আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও এই মেয়েটাকে বাচিয়ে রাখতে পারতাম। এর কিছুদিন পর সত্যি সত্যি সে হারিয়ে যায় আমার জীবন থেকে। যেইদিন সে আমাকে ছেড়ে চলে সেদিন হাসপাতালে সে আমার আঙুল ধরে ছিল।আমার ছোট্ট পরি টা আমার প্রতি তার ভালোবাসার জানান দিতে দিতেই চলে গেলো। সেদিন তার বাবা মাকে দেখেছি চিৎকার করে কাদতে।আর আমি? আমি দেয়ালের এক কোনায় নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম।চোখ থেকে এক ফোটা পানি ও বের হয়নি।নির্জীব বস্তু হয়ে ঊঠেছিলাম আমি। এরপর থেকেই সবসময় তার কথা পড়তে থাকে।আচ্ছা,পর মানুষ গুলো ও কি এভাবে আপন হতে পারে?এভাবে মনের মধ্যে গেথে যেতে পারে?
আমি তখন থেকে খুব ভেঙে পড়ি।আমার মা এবং ভাই এসব ব্যাপারে জানতেন।তাই তারা আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোড় করে বিয়ে করিয়ে দেন।যেই মেয়েটাকে আমি বিয়ে করি সেই মেয়েটাকে ও সব খুলে বলি।
ইশার কথা মনে হলেই আমার মন খারাপ হয়ে যেত।আর আমার মুখ থেকেই আমার স্ত্রী সেটা বুঝে ফেলতো।
একদিন সে আমাকে বলল,তোমার জীবনে নতুন ইশার আগমন ঘটতে চলেছে।আমি তার কথা তখন বুঝতে পারিনি।
তখন সে বলল, আরে বুদ্ধু তুমি বাবা হতে চলেছো।আর আমাদের বাবু টা হবে একটা পরী।আমি নাম ও ঠিক করে রেখেছি।ওর নাম হবে ইশা। খবর টা শুনে আমি কেদে ফেলি।চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরেও আজ চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।কারন এটা দুখের নয়,বরং সুখের কান্না। বি:দ্র: এই গল্পটার কাহিনী এর কিছু অংশ বাস্তব জীবন থেকে নেয়া।মানুষ ভালোবাসে তাকেই যাকে তার হৃদয়ে জায়গা দেয়।এরমানে এই না যে তাকে সেই মানুষটির সাথে রক্তের সম্পর্ক থাকিতে হবে।সম্পর্ক হতে হলে আত্মার মিলন ই বেশী প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।