চেম্বারে বসে রোগী দেখতিছে তন্দ্রা। হঠাৎ করে বাইরে থেকে একটা স্ট্যাফ এসে বলল ম্যাডাম আপনার সাথে একজন ভদ্র লোক দেখা করতে এসেছে। উনাকে বসতে বলো,,আর বলো যে ম্যাডাম এখন ব্যস্ত আছে।(তন্দ্রা) উনাকে বলছি ম্যাডাম ব্যস্ত আছে কিন্তু উনি বললেন যাতে উনার নামটা আপনাকে জানাই। (স্টাফ) আচ্ছা,,কি নাম উনার?(তন্দ্রা) উনিতো বললেন নীল। (স্টাফ) নীল!!! নীল কথাটা শুনেই যেনো তন্দ্রা চমকে উঠলো। এটা কিভাবে সম্ভব?? যে মানুষটা এতো বছরে একদিনও আসেনি আজ হঠাৎ কি মনে করে এলো।
ঠিক আছে,,তুমি উনাকে পাঠিয়ে দাও। (তন্দ্রা) ভেতরে এসেই, মা তোমাকে দেখতে চেয়েছে আর মার শরীরটাও বেশী ভাল না। (নীল) মার শরীর খারাপ,, আগে জানাবা না।অকে দাড়াও আমি এই রোগীটা দেখেই যাচ্ছি।(তন্দ্রা) যখন বের হলো এক সাথে ক্লিনিকের সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কারন আজ পর্যন্ত তন্দ্রাকে কখনো কোনো ছেলের সাথে এমন ঘনিষ্ঠতায় কেউ দেখিনি। ক্লিনিকের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে,তারা জানেই না যে তারা স্বামী- স্ত্রী আর জানবেই বা কি করে নীল এর আগে এখানে কখনোই আসেনি আর তন্দ্রার সাথেও নীলকে তেমন দেখা যায়নি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবা-মায়ের জন্য নীলকে আজকে বিয়ে করতে আসতে হয়েছে। সারা বিয়ে বাড়ীতে সকলের মুখেই হাসি শুধুমাত্র নীল ছাড়া। বিষন্নমাখা মুখ নিয়েই নীলের জীবনের প্রথম বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে গেলো।
বাসর ঘরেই ঢুকতেই তন্দ্রা উঠে নীলকে সালাম করতে গেল কিন্তু সালাম করার আগেই নীল তন্দ্রাকে আটকিয়ে দিলো এবং বললো আমি এটার বিরোধী। তুমি আমাকে সালাম করার অর্থ হলো তুমি আমার কাছে মাথা নত করলা আর আমার জানা মতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো লাছে মাথা নত করা সম্পূর্ণ নিষেধ এটা বলেই নীল তন্দ্রাকে বিছানায় বসে দিল। তারপর বললো আমি শুনেছি তুমি নাকি পড়াশুনায় অনেক ভালো।। তো, পড়াশুনা বাদ দিয়ে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করলে কেনো?(নীল)
আপনি তো সবি জানেন আমার বাবা-মা নেই।চাচার বাসায় মানুষ হয়েছি। চাচা আমাকে পড়াতে চাইলেও চাচী তার বিরোধীতা করেন। এরপর আমি মেডিকেল এ চান্স পেলে চাচা চাচীকে লুকিয়ে আমাকে মেডিকেলে ভর্তি করে দেন কিন্তু তা বেশী দিন চাচীর কাছে গোপন থাকে না। তারপরও অনেক কষ্টে পড়াটা চালাচ্চিলাম কিন্তু তীরে এসে তরীটা শেষমেশ ডুবলই।(তন্দ্রা)
মেডিকেলের স্টুডেন্ট কথাটা শুনেই নীল চমকে উঠলো। অকে চিন্তা করো না,তুমি যেহেতু পড়তে চাও, আমি তোমাকে পড়াব। এখন অনেক রাত হয়ে গেছে আর আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে আমাদের উপর। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। তন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে নীল ঘুমিয়েছে। তন্দ্রা আগেও বাসর রাত নিয়ে যেসব ভয় করতিছিলো তা এখন শুধুই অবাকে পরিনত হয়েছে। বাসর রাতে আদৌ কেউ এইভাবে হুট করে ঘুমায় নাকি এইসব ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা নীলের পাশে শুয়ে পড়লো।
পরেরদিন নীল তন্দ্রার আবার পড়ার সব ব্যবস্থা করলো। নীলের মাও সব কিছু শুনে তিনিও রাজি হয়ে যান। এক সপ্তাহ পড়েই তন্দ্রার ক্লাশ শুরু হবে। এর মধ্যে নীল খুব প্রয়োজন ছাড়া তন্দ্রার সাথে কথা কথা বলতো না কিন্তু নীলের মুখে সব সময়ই প্রসন্নের হাসি লেগে থাকতো যা তন্দ্রাকে অবাক করতো। তুই মেডিকেলে পড়িছ কই তোর চাচা-চাচী তো জানায়নি মা। যাই হোক আমি শুনে অনেক খুঁশি হয়েছি। (নীলের মা) মা,একটা কথা বলার ছিলো। (তন্দ্রা) কি মা,,বলে ফেলো। ( নীলের মা)
নীল আমার মেডিকেলে পড়ার কথা শুনে এতো খুঁশি কেনো?(তন্দ্রা) তুই যেহেতু নীলের বউ তো সবকিছু জানা দরকার,,,,,,নীল প্রিমা নামক একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসত। প্রিমা নীলের ক্লাশমেট ছিলো। প্রিমা লেখা- পড়ায় অনেক ভালো ছিল। নীল তেমন ভাল ছিল না কিন্তু নীলের বাবার টাকা থাকায় মেয়েটা নীলের সাথে মিসতো। নীল প্রিমাকে টাকা দিয়ে অনেক সাহায্য করত। যখন যা লাগতো তাই দিতো। নীল প্রিমাকে মন থেকে ভালোবাসত কিন্তু প্রিমা শুধুই নীলের টাকাকে ভালোবাসত। এর মধ্যে হঠাৎ প্রিমা মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায়। প্রিমা দেখতে অনেক সুন্দরি ছিলো তার উপর মেডিকেলের ছাত্রী দেশের বড় রাজনৈতিক ব্যক্তির ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়।
নীল প্রিমাকে অনেক অনুরোধ করেছিল যাতে তাকে না ছেড়ে যায় কিন্তু প্রিমা তার কোনো কথাই শুনেনি বরং তাকে অনেক অপমান করেছিল আর বলেছিলো ডাক্তার মেয়ে তোমার জন্য না তুমি তোমার লেভেলের কাউকে খুঁজে নিও। নীল প্রিমার ধোঁকা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তারপর আস্তে আস্তে নীল স্বাভাবিক হতে থাকে। তারপর ওকে বিয়ের কথা বললেই ও এড়িয়ে যেত কারন ও প্রিমাকে কিছুতেই ভুলতে পারতো না, নীলের ভালোবাসা তো আর মিথ্যা ছিলো না।(নীলের মা)
তন্দ্রার চোখে এতক্ষনে পানি এসে গেছে। যতই হোক বাঙ্গালী নারীতো স্বামী অন্য মেয়েকে ভালোবাসে এটা শুনলে যে কারোই কষ্ট হবে। জানি তো শুনে তোর অনেক খারাপ লাগতিছে কিন্তু আমার তোর উপ্র পুরা বিশ্বাস আছে তুই আবার পুরানো নীলকে ফিরিয়ে দিতে পারবি। ওর জীবনে ঘৃণার অবসান ঘটিয়ে আবার ভালোবাসার ফুল ফুটাতে পারবি, কি পারবি না মা।(নীলের মা) তন্দ্রা তাৎক্ষণিক ভাবে চোঁখের পানি মুছতে মুছতে একটা হাসি দিয়ে বলে আমাকে যে পারতেই হবে মা।
নীল তন্দ্রাকে হোস্টেলে ভর্তি করে দিল। যদিও তন্দ্রার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না। যাওয়ার সময় তন্দ্রা বারবার নীলের দিকে করুন চোঁখে তাকাচ্ছিলো যদি একবার বলতো তোমার যাওয়া লাগবে না,তুমি এখান থেকেই পড়ো।
নীল তন্দ্রাকে হোস্টেলে রেখে আসে। নীল তন্দ্রার প্রয়োজনীয় খরচ এবং জিনিস পাঠে দিত কিন্তু কখনোই দেখা করতে যেত না। তন্দ্রাও অভিমানে নীলের সাথে কোনো যোগাযোগ করতো না।তন্দ্রা শুধু দু ঈদে বাসায় যেত। প্রথমে ভেবেছিল চাচার বাসায় যাবে সেখানে গিয়ে চাচাকে জানাবে যে সে আবার পড়া শুরু করেছে। কিন্তু সেখানে যে তার জন্য আর একটা চমক অপেক্ষা করতিছিলো না গেলে সে বুজতেই পারতো না। গেট খোলা ছিল তাই সোজা চাচার রুমে যেতেই সে কিছু একটা শুনতে পেল।
এই তুমি এতো টাকা কোথায় থেকে পেলে? (তন্দ্রার চাচী) এগুলা তন্দ্রার বাবার টাকা। ভাই মারা যাওয়ার আগে ব্যাংকে তন্দ্রার জন্য অনেক টাকা রেখেগিয়েছিল। আর তন্দ্রা বড় হলে ওকে এই টাকা দিয়ে ডাক্তারি পড়াস আর ভালো একটা ছেলে দেখে ওরে বিয়ে দিস,, ওর কোনো অভাব দিস না। তাইতো ওর পিছে এতো টাকা খরচ করেছিলাম যাতে সব টাকা ব্যাংক এর হয়ে যায়। ভাইয়া উইল করে গেছিলো যদি তন্দ্রা ডাক্তারি না পড়ে তাইলে সব টাকা ব্যাংকের হয়ে যাবে।(তন্দ্রার চাচা)
বলো কি? তুমি আমাকে আগে বলবা না? (তন্দ্রার চাচী) তুমি যেমন তোমার পেটে তো কোনো কথাই আটকে না তোমাকে বলি আর তুমি মুখ ফসকে ওরে বলে দাও।(তন্দ্রার চাচা) নিজের চাচার এই রকম রূপ দেখে তন্দ্রা যেন নিজের চোঁখ- কান কেই বিশ্বাস করতে পারতিছিলো না। কিভাবে সম্ভব? আপন চাচা হয়ে টাকার জন্য এমন অভিনয় করতে পারলো। তন্দ্রা সাথে সাথে ওখান থেকে চলে আসলো। যে টাকার জন্য এমন নিচে নামতে পারে সে নিশ্চয়ই টাকার জন্য তার ক্ষতি করতেও দ্বিধা করবে না। তাই তন্দ্রা সেদিনের পর থেকে চাচা-চাচীর সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল।
আজ ৩ বছর পর নীল তন্দ্রাকে নিতে এসেছে কারন তন্দ্রা আজ পরিপূর্ণ ভাবে ডাক্তার হতে পেরেছে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন বাসায় পৌঁছে গেছে তন্দ্রা বুঝতেই পারিনি। নীলের ডাকে তন্দ্রা বাস্তবে ফেরে।
আজ সকাল থেকেই নীল তন্দ্রার সাথে কথা বলার সু্যোগ খুঁজতিছে আর তন্দ্রা নীলকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কারন তন্দ্রা জানে আজ নীল তাকে কি বলবে আর নীল যে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে এটাও সে বুঝতে পেরেছে। যখন তন্দ্রা হোস্টেল থেকে আসতো নীল কথা বলার অনেক চেস্টা করতো কিন্তু বলতে পারতো না। তন্দ্রা তখন আরো রেগে যেত কারন নিজের বউয়ের সাথে কথা বলতেও কেউ সংকোচ করে নাকি।
রাতে খাওয়ার পর নীল রুমে যেয়ে দেখে তন্দ্রা ঘুমিয়ে গেছে। নীল ইচ্ছা করেই লাইট জ্বালালো কারন তন্দ্রার লাইট সহ্য হয় না। জ্বালালেই জেগে যায়। নীল আবিস্কার করলো যে ৫ মিনিট হয়ে গেল তবুও তন্দ্রার ঘুম ভাংলো না তার মানে তন্দ্রা জেগেই আছে। নীল তন্দ্রার কপালে একটা চুমা দিতেই তন্দ্রা চোখ খুলতে ধরলেই নীল বললো আগেই চোখ খুলো না, আমি কথাটা শেশ করি তারপর খুলো।
আমি কখনোই ভাবিনি যে আমি একটা ডাক্তার বউ পাবো। আর যখন শুনলাম তুমি মেডিকেলে পড়ো আমি তো খুশিতে আত্ন হারা হয়ে গেছিলাম। তোমার যাতে পড়ার ক্ষতি না হয় তাই হোস্টেলে পাঠাইছি। তুমি চলে যাওয়ার পর খুব শুণ্য শুণ্য লাগতিছিলো এবং মনের অজান্তেই ভালোবেসেছিলাম। (নীল) ভালো যখন বেসেই ছিলে আগে বলোনি কেনো? (তন্দ্রা) আমি চাইনি তুমি পড়াশুনা ছাড়া মাথায় অন্য কিছু আনো। আমি তখন ভালোবাসার কথা বললে হয়তো তুমি পড়াতে মন বসায়েই চাইতা না এবং বাসায় আসতে চাইতা যা আমি কখনোই চাইনি।(নীল) তাই বলে এতো কষ্ট দিবা?(তন্দ্রা) কষ্ট না দিলে তুমি আজ এই জায়গায় আসতে পারতা বলো?? আর আমি ডাক্তার বউ পেতাম বলো?(নীল) হুম,,পঁচা কোথাকার। (তন্দ্রা) যাই হোক আজ থেকে আমাদের নতুন জীবন শুরু। তুমি শুধুই আমার আর আমি শুধুই তোমার এই বলেই নীল তন্দ্রাকে তার বুকের উপর টানে নিল আর অন্য হাতে লাইট অফ করে দিল। বাকীটা নেটওয়ার্ক চলে যাওয়ায় সম্প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না।
সকালে নাস্তা করতে করতে নীল হঠাৎ টিভিটা অন করলো সাথে সাথেই ব্রেকিং নিউজ দেখতে পেল ধর্ষনের মামলায় মন্ত্রীর ছেলে গ্রেফতার। আর একটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখতে পেল আরে হ্যা এতো প্রিমার স্বামী।
মনের অজান্তেই এক প্রসন্নতা অনুভব করলো নীল। টাকার লোভে যে বিশ্বাসঘাটকতা করেছিল তার শাস্তি আজ পেল প্রিমা। এতোদিন পানিতে ভেজা ছিল নীলের চোঁখ এখন বাকী জীবনটাই ভেজা থাকবে প্রিমার চোঁখ। কারন না পারবে এটা মেনে নিতে না পারবে ওকে ছেড়ে দিতে। দুনিয়ার ধার দুনিয়াতেই শোধ হয়। অদ্ভুত খেলার অদ্ভুত নিয়ম।