– বাহ্ আপনি তো খুব ভালো ছবি আকেঁন।
– খুব ভালো কিনা জানি না।তবে ছবি আকঁতে আমার ভালো লাগে।
– ওহ্ এই পার্কে কি সবসময় আসা হয়?আমি প্রায় এই খানে আসি। আগে তো কখনো দেখেনি আপনাকে।
– না।আজকে সহ দু’ বার আসলাম।
– আচ্ছা।
– আপনি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন?
– না।আসলে এখানে আসতে আমার খুব ভালো লাগে।
পাশেই আমার কলেজ।বন্ধুদের নিয়ে মাঝেমধ্যে আসি।কিন্তু বেশীরভাগ সময় আমি একা আসি।
একা একা বসে থাকতে অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে। আমি একাই বকবক করবো।আপনি কিছু বলবেন না?
– কি বলবো? কি শুনতে চান বলুন? ছবি আঁকা আমার নেশার মত হয়ে গেছে।যখনি অবসর পাই।ছুটে যায় দূর দূরান্তে।
– ভালোই।
– আপনি বুঝি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এখানে বসে থাকেন?
– ওমা ক্লাস ফাঁকি দিবো কেন? জানেন মাঝেমধ্যে খুব বিরক্ত লাগে তাই একা একা বসে সময় কাটায়। আচ্ছা আপনার নামটা জানা হলো না? ছবি আঁকা ছাড়া আর কি করা হয়?
– আমার নাম ফারহান ইমতিয়াজ।পেশায় একজন আর্কিটেকচার। আপনি????
– সুমনা হক কাজল।এই তো বাংলায় ৩য় বর্ষে পড়ছি। আপনি আর্কিটেকচার তার মানে আপনি একজন মিস্ত্রী।
– তা হবো কেন?
– ঔ তো হলো।আপনি ডিজাইন করেন।সেই অনুযায়ী রাজমিস্ত্রী রা কাজটা সম্পূর্ণ করেন। এখন একটা কথা বলেন তো?
– আবার কি কথা?
– আপনারা যারা আর্কিটেকচার তাদের সেলারি টা অনেক তাছাড়া সম্মান টাও বেশী।
কিন্তু একজন রাজমিস্ত্রী কত মেধা খাটিয়ে একটা স্থাপনা কি সুন্দর করে তৈরি করে।কোথায় কতটা ইট দিতে হবে?রড কতটুকু দিতে হবে এরা ঠিকই বুঝে। অথচ তাদের মূল্যায়ন দেওয়া হয়। তাদের দাম কম। কেন বলেন তো?
– আচ্ছা ভবিষৎ এ কি জনসেবা করার ইচ্ছা আছ নাকি। খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন।
– জ্বি।সুযোগ পেলে অবশ্যই করবো।
– আসলে কি জানেন আমরা নিজেরাই শ্রেনীবৈষম্য তৈরি করেছি।তাহলে আমরা কি করে তা ভাঙ্গবো?
– ইমতিয়াজ সাহেব আমি মনে হয় আপনাকে ছবি আঁকায় বিরক্তি করছি?
– একদম না।সময় টা আমার বেশ ভালো লাগছে। হঠাৎ একজনের সাথে পরিচয়। আলাপচারিতা।সব মিলিয়ে আজকের দুপুর টা অসাধারণ।
– তা ঠিক।
ঠিক এভাবে হঠাৎ পরিচয় তিনমাস আগে ইমুর সাথে। ও হ্যাঁ,,, ইমু,,,আমি ইমতিয়াজকে ইমু বলে ডাকি।এই ডাকটা আমার খুব পছন্দের।ইমু ও পছন্দ করে।যখন ওর সাথে প্রথম পরিচয় হলো তার এক সপ্তাহ পর্যন্ত ও আর পার্কে আসেনি।আমি বারবার ওর জন্য পার্কে ছুটে যেতাম।আর অপেক্ষা করতাম ও আসবে।বিশ্বাস ছিলো নিজের উপর।এত সহজে ও হারাবেনা ঠিক হঠাৎ একদিন পার্কে এলো।এরপর থেকে সে প্রায় আসতো। তারপর আমাদের দুজনের মাঝে বন্ধুত্ব আর বন্ধুত্ব থেকে আমাদের ভালোবাসা।
আমাদের ভালোবাসা দুই পরিবার জেনে যায়। আমার বাবা খুব জেদী মানুষ। ছোট বেলা থেকে খুব ভয় পেতাম।আমার ভালোবাসার কথা বাবা প্রথমে মানতে চাইনি।সবকিছু মা ই সামলিয়েছে। ইমু ছবি আঁকতে অনেক জায়গায় যেতো।আমিও খুব জেদ ধরতাম আমাকে সাথে নিতে।বাধ্য হয়ে নিতো।ইমু যখন ছবি আঁকে খুব মনযোগ দিয়ে আমি তার পাশে চুপচাপ বসে থাকি।ওর মায়া ভরা চেহারায় তাকিয়ে থাকি।ওর গভীর দু’ জোড়া চোখ আছে।তার চোখের ভাষা আলাদা।সেই চোখের ভাষা দিয়ে সুন্দর করে আর্ট পেপারে রং বেরং এর ছবি আঁকে।
একদিন ইমুকে বলি,,,আমার একটা স্কেচ এঁকে দিও। এখনোও তার স্কেচ আঁকা সম্ভব হয়নি। ইমু আত্নভোলা।অনেককিছু ভুলে যায়।মনে থাকে না। মাঝেমধ্যে খুব রাগ করি। ইমু তুমি এমন কেন?ঝগড়াও করতে পারোনা। ইমু বলে তুমি সব করো আমি সব শুনে থাকবো।আর মাঝেমাঝে আমাকে মনে করিয়ে দিও। সবচেয়ে মজার হলো সেই আত্নভোলা ইমুর সাথে দু’দিন আগে আমার এনগেইজমেন্ট হলো। বিয়ে আগামী মাসে।ও তো মেস্ত্রী তাই ওকে একটা জরুরি কাজে দেশের বাহিরে যেতে হলো। তাই অপেক্ষা।
– ক্লাসে যাবি না?
– মা কথা ছিলো।বাবা নাকি বলেছিলো ইমুর কি খোঁজ খবর নিবে।কেন মা?বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেছে।
– তোর বাবা সব খবর নিয়েছে।
– কি বলো।
– তোর বাবা রাজী না।এই বিয়েতে।ইমতিয়াজ আসলে দেখা করতে বলেছে।
– মা এসব কি বলছো?বিয়ে ঠিক।তোমরা কথা দিয়েছো। আর সমস্যা কি আগে সেটা বলো?
– ইমতিয়াজ তোকে বলেনি কিছু নিজের ব্যপারে?
– মা আমি ওর ব্যপারে সবই জানি। কিন্তু ওর ব্যপারে তোমরা কি জেনেছো তা বলো।
– ইমতিয়াজের বাবা মা।এরা কিন্তু ওর আসল বাবা মা না।
ওরা তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়েছে। ওর কোন পিতৃ মাতা পরিচয় নেই।তোর বাবার এক কলিগের বাসা তাদের বাসার সাথে।ওনি তোর বাবাকে সব বলেছে।ওরা সবকিছু জানে। আমরা এসব জেনে শুনে তো এমন ছেলের হাতে তোকে তুলে দিতে পারি না।
– এই ব্যপার? আমি তো আগেই জেনেছি। ইমু আমাকে আগেই সব বলেছে।আমি তো মেনে নিয়েছি।এতে তো ওর কোন দোষ নেই।তাহলে ও কেন শাস্তি পাবে।
– তুই একবার ভাব।তোর সন্তানরা এটা মেনে নিবে?
– মা মা আমার সন্তানরা কেন এসব জানবে।
– তুই আবেগে বলছিস।তোর বাবা মানছে না।
– আমি ইমু কে কথা দিয়েছি।বাবাও কথা দিয়েছে।
– সে কথা তোর বাবা ফিরিয়ে নিবে।
– কিন্তু আমি পারবো না।
– তোর বাবার খুব জেদ।তুই তো জানিস।
– জানি।আর আমি সেই জেদী বাবার জেদী মেয়ে।
– কাজল শুন। এমন করিস না।
– মা,,,, বাবাকে বলে দিও।আমি তোমাদের মনে কষ্ট দিবো না।তোমরা এটা ভেবো না।তোমাদের অমতে আমি কিছু করবো।কিন্তু এটাও সত্যি আমি ইমুকে ভালোবাসি।আর ওকে আমি কথা দিয়েছি। সারাজীবন ওর পাশে থাকবো।ও যাদের কাছে থাকে তারাই ওর বাবা মা।এটা ও সবসময় জেনে এসেছে।
– তাহলে এটাই তোর সিদ্ধান্ত?
– হ্যাঁ মা।আমি কাউকে কষ্ট দিতে পারবো না।তুমি বাবাকে সবকথা জানিয়ে দিও।
সারারাত ঘুমাতে পারিনি।ইমুকে বাবা যদি সব বলে দেয়।ও খুব কষ্ট পাবে।এমনি তে সরল সোজা মানুষ। কষ্ট পেলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। যদি কিছু একটা করে বসে।খুব অপমানবোধ করবে। বাবাকে কি করে বুঝায়?ইমু তো তার জন্য দায় না।ও তার জীবনকে সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিয়েছে।আসল বাবা মার পরিচয়টা জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অংশ না।যারা তাকে মানুষ করেছে।তারাই ইমুর সবকিছু। আমরা কেন তার দূর্বলতায় আঘাত করবো? আমাদের নিজেদের ই তো দোষে দোষে ভরপুর জীবনটা।তাহলে কেন অন্যের দোষ নিয়ে ঘাটাঘাটি করবো? আর ভাবতে পারছি না উফ্।
– কি ব্যপার ইমু।তুমি কি আজকে অফিস যাবে না?
– না যাবো না।
– কেন? জানতে পারি।
– নতুন বিয়ে করলে,,প্রথম প্রথম অফিস যেতে নেই।বউয়ের কাছাকাছি থাকতে হয়।
– যথেষ্ট হয়েছে। আর কোন কথা হবে না।সোজা অফিস যাও।
– আজকে আমার ছুটি।
– ও তাই নাকি। আমি কি একবার অফিসে ফোন দিয়ে জেনে নিবো?
– জানতে হবে না।আমি আজকে অফিস যাবো না এটাই ফাইনাল
– তাহলে থাকো।
– শুনো না যেও না কাজল।
– গেলাম। ইমু আই লাভ ইউ। আর ভালো করে ঘুমাও।
– ঠিক আছে সময় কিন্তু আমারও আসবে।
ভাবছেন কি???এটা আমার আর ইমুর পাগলামো সংসার। আমার জেদী বাবা শেষমেশ মেনে নিলো।বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হলো। আমি কিন্তু জোর করিনি।আমি শুধু আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। আমার কাছে সবাই সমান।আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি।সবাইকে নিয়ে সুখে থাকতে চাই।হয়ত জেদ টা বেশী কাজ করেছে।