আজ পুতুলকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়িতে একেবারে সত্যিকারের পুতুল মনে হচ্ছে। কেননা আজ পুতুলের বিয়ে। তার রুমে তার সব কাজিনরা মিলে সাজাচ্ছে আর তার প্রশংসা করছে। কেউ কেউ তো বলছে,
,,, দেখিস দুলাভাই যেন আবার হার্ট এট্যাক না করে।
কথাটা বলেই সবাই হাসতে লাগলো। পুতুলের লজ্জায় মরে যায় অবস্থা। তার মা তার রুমে প্রবেশ করতেই একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। মেয়ের থেকে চোখ সড়াতে পারছেন না। তার ছোট্ট মেয়েটা আজ কত বড় হয়ে গেছে। আজ কারো ঘরের বউ হতে চলেছে। আবার সে কোন একদিন কারো মা হবে, কারো আবার শাশুড়ি হবে। সত্যি মেয়েদের জীবনটায় অদ্ভুদ। একেক বার একেক জায়গায় একেক চরিত্র ধারণ করতে হয়। আর বিধাতাও তাদের মধ্যে এই গুণটা দান করেছেন।
পুতুলের মা পুতুলের দিকে এগিয়ে এলেন।
,,, মারে, আজকে তোকে এতো সুন্দর লাগছে যে বলে বোঝাতে পারবো না। আজ আমার মেয়েটা অন্যের ঘরে চলে যাচ্ছে। এই বাড়িটাও একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে।
পিহন থেকে পুতুলের ছোট ভাই তিয়াস বলে উঠল,
,,, কেন আমি কি মরে গেছি নাকি যে বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে ?
,,, তুই থাকা যা না থাকাও তা। সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবি আর বাড়িতে আসলেই আমাকে জ্বালায় খাবি।
,,, ওহ, এখন তো তোমার মেয়েই সব। আমার আর কি। আমি যাচ্ছি চলে।
পুতুল ভাইকে নাম ধরে ডাক দিয়ে থামিয়ে দিল।
,,, কথা দে বাবা মাকে একটুও বিরক্ত করবি না।
,,, তুই তো জানিস মানুষ পণ করে পণ ভাঙ্গিয়া হাফ ছাড়িয়া বাঁচার জন্য।
,,, আর আমি চলে গেলে একটুও কাদবি না কিন্তু।
,,, তোর জন্য আমার কাঁদতে মনে হয় বয়েই গেছে।
,,, সত্যি কাঁদবি না তো ?
,,, জানি না। তবে তোকে মিস করব খুব। তুই না থাকলে কাকে জ্বালাবো শুনি। কার ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করব শুনি ?
,,, আমি চলে যাওয়ার পর তুই কিন্তু খবরদার আমার ঘরে ঢুকবি না। আমার কোন জিনিসে হাত দিবি না।
,,, তুই একবার বাড়ি থেকে বের হ, তোর ঘর আর আস্ত রাখব না।
,,, তবে রে শয়তান। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।
এই বলে ভাইয়ের কান ধরে টানতে লাগলো।
,,, আহ, আপু ছাড়। লাগছে তো !!!
পুতুল তিয়াসের কান ছেড়ে দিল। পরম আদর আর স্নেহে জড়িয়ে ধরল ছোট ভাইকে। তিয়াসও জড়িয়ে ধরল তার প্রিয় মানুষটাকে। যার প্রতিটা পছন্দই ছিল তিয়াসের পছন্দ। ভাই বোনের এই পরম মুহূর্তে বাগড়া দিল তার মা।
,,, কিরে আর কতক্ষন এভাবে জড়িয়ে ধরবি ? ওকে তো নিচে নিয়ে যেতে হবে নাকি ?
পিছন থেকে সজল সাহেবের কণ্ঠস্বর ভেসে আসল।
,,, তোমরা কিছুক্ষণের জন্য একটু বাইরে যাও। আমার মেয়ের সাথে আমার একান্ত কিছু কথা আছে।
সবাই সজল সাহেবের আদেশক্রমে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পুতুল সজল সাহেবের দিকে তাকাতেই অবাক। মাশাল্লাহ !!! একেবারে রাজপুত্র মনে হচ্ছে সজল সাহেবকে। পুতুলের প্রথম ভালোবাসার মানুষ তার বাবা। সজল সাহেব গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। তার আদরের মেয়েটাকে আজকে অন্যের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছেন। প্রত্যেক বাবার কাছে এটা যেমন একটা আনন্দের দিন তেমনি বুকের এক পাশ খালি হয়ে যাওয়ার দিন।
সজল সাহেবের কান্না তার মেয়েও স্পষ্ট টের পাচ্ছে। মেয়েরও কষ্ট হচ্ছে তার বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে। কি এক অদ্ভুদ মুহূর্ত !!! সব কিছু জেনে থেমে গেছে। আজ বোধহয় বিধাতাও বাবা মেয়েকে তাদের শেষ সময়টুকু দান করেছে। যে বাবা একমাত্র সেই বুঝে এই কষ্ট।
সজল সাহেব মেয়ের গালে হাত দিয়ে চোখ মুছে দিলেন।
,,, এই বুড়ি কাঁদিস কেন ?
,,, বারে বুড়ো, তুমিও তো কাঁদছ।
,,, এটা কান্নার জল নারে পাগলি। এটা তো খুশির জল। আজ আমার মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে। যেই
বাবা ছোটবেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে সেই বাবাকে ছেড়ে অন্য বাবার মেয়ে হয়ে যাবে।
,,, আমি চলে গেলে কিন্তু নিজের খেয়াল রাখবে তো ?
,,, আমার বুড়িটা যখন বলছে তখন না রেখে কি আর উপায় আছে।
,,, সময় মতো ওষুধ খাবে কিন্তু। আর একদম টেনশন করবে না। টেনশন করলেই প্রেশার বেড়ে যাবে। এমনিতেই তোমার হাই প্রেশার।
,,, আমার বুড়িটা এতো বড় হয়ে গেল কবে ? নিজের বাবাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছে।
,,, তোমার মেয়ে তো। তাই।
,,, দেখ মা। ঐ বাড়ির সবাই কিন্তু অনেক ভালো। তোকে কখনো কষ্ট পেতে দিবে না। দেখবি মেঘ তোকে অনেক সুখে রাখবে। তাদেরও মেয়ে আছে। তারাও তাদের মেয়েকে পরের ঘরে পাঠিয়েছে। তাই তারা ভালো করেই জানে মেয়েকে নিজেদের থেকে দূরে পাঠানোর কষ্ট।
,,, বাবা তুমি দোয়া কর। তাহলেই আমি পারবো।
,,, দোয়া করি মা। যাতে তুই সব সময় সুখে থাকিস। কোন কষ্ট যেন তোকে গ্রাস করতে না পারে।
দরজায় খটখট আওয়াজ হলো।
,,, মেয়ের সাথে গোপন আলোচনা শেষ হলে তাড়াতাড়ি করো। মেয়েকে নিয়ে নিচে নামতে হবে তো। সবাই অপেক্ষা করছে।
,,, হ্যাঁ, এইতো। বের হচ্ছি। তোমরা ওকে নিয়ে নামো। আমি নিচে গেলাম। বরপক্ষদের কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা দেখে আসি।
সজল সাহেব চলে গেলেন। পুতুলের কাজিনরা ওকে নিয়ে নিচে নামলো।
কাজি সাহেবের বিয়ে পরানো শেষ হতেই পুতুলকে নিয়ে স্টেজে বরের পাশে বসালো। পুতুল আর চোখে মেঘের দিকে তাকাল। মাশাল্লাহ !!! তার বরকে আজকে একেবারে রাজপুত্র মনে হচ্ছে। যেন সে কোন রাজকুমারীর বর। কিন্তু সেই রাজকুমার তো পুতুলের।
মেঘ হা করে পুতুলের দিকে তাকিয়ে আছে। একে তো তার ভালোবাসার মানুষটা তার বউ হয়ে গেছে এটা সে কোন মতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার উপর আবার পুতুলকে দেখতে একেবারে শাহজাদী মনে হচ্ছে। মেঘের ইচ্ছে করছে এখনি একটু আদর করে দিক। কিন্তু লোকজনের সামনে কেমনে কি ? মান সম্মান বলতেও তো একটা জিনিস আছে। পুতুল মেঘের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসল। কি এক অমায়িক সে হাঁসি। এই হাঁসির জন্য মেঘ নিজের জীবন দিতেও তৈরি।
মেয়েকে যখন বিদায় জানানোর পালা এলো তখন পুতলের মা বাবা আর ভাই পুতুলকে আরেকবার
জড়িয়ে ধরে কেঁদে নিলেন।
মেঘ দূর থেকে লক্ষ্য করছিল।
,,, যতো কাদবা আজ কাঁদো। এই শেষ। আবার যদি কোনদিন কেদেছ তো মেরে তক্তা বানিয়ে দিব। তোমার কান্না আমি একে বারেই সহ্য করতে পারি না। (মনে মনে)
মেঘের বাবা দিনার সাহেব সজল সাহেবকে আশ্বস্ত করে বললেন,
,,, এমন করছিস যেন মেয়েকে সারাজীবনের জন্য দিয়ে দিচ্ছিস। আরে আমার ঘরে মেয়ের অভাব পূরণ করতেই তো তোর কাছে তোর মেয়েটা চেয়েছি নাকি ?
,,, কথা দে, আমার মেয়েটা যেন কোন কষ্ট না পাই।
,,, আরে পাগল নাকি। ছোটবেলার বন্ধুত্ব বলে কথা। এই বন্ধুত্বের বাঁধন কি এতো সহজেই ভাঙতে দিব ?
সজল সাহেব মেঘের দিকে এগিয়ে গেলেন।
,,, মেঘ বাবা, আমার মেয়েটা কোনদিন মুখ ফুটে আমার কাছে কিছু চাই নি। আমি যা দিয়েছি তাই হাঁসি মুখে নিয়েছে। আশা করি তুমি আমার মেয়েকে সুখে রাখবে।
,,,ও তো শুধু আপনার মেয়ে না বাবা। ও এখন আমার বাম পাঁজরের হাড়। ও কষ্ট পেলে তো আমারও কষ্ট হবে।
সজল সাহেব অশ্রুসিক্ত চোখে মেঘের মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন।
বর কনেকে গাড়িতে উঠিয়ে বিদায় জানালেন কনেপক্ষ।
গাড়ি উঠেই মেঘ পুতুলের হাত জড়িয়ে ধরল। পুতুল মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,
,,, সব কিছু কেমন জানি স্বপ্ন মনে হচ্ছে তাই না ?
,,, হয়তো। কিন্তু একটা কথা কি জানো ?
,,, কি ?
,,, জীবনটা সিনেমার থেকেও বেশি কষ্টের আবার তার থেকেও বেশি কষ্টের। কারণ জীবন সংসারের পরিচালক সৃষ্টিকর্তা নিজে। তাই তো তোমাই পেলাম। আমাদের মনে ভালোবাসার জোর ছিল বলতে পারো। সে জন্যই তো কত থেকে কি হয়ে গেল।
পুতুল মেঘের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাঁসি দিল। যে হাঁসি মেঘ আজীবনের জন্য নিজের বুকের কোটরে আটকে রাখল।
(সমাপ্ত)