অঝোর ধারায় আকাশটা কেঁদেই যাচ্ছে। চুপচাপ জানালার পাশে বসে আছে নিশিতা। ডেস্কের উপর অফিসের ফাইল-পত্রের ছড়াছড়ি। অনেক কাজ পড়ে আছে। কিন্তু কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছেনা ও। না চাইতেও বারবার চোখটা চলে যাচ্ছে মোবাইলের দিকে। কিন্তু না আসছে কোন কল, না আসছে কোন মেসেজ।
কি করে ভুলে যেতে পারলো ইমন। আজ ওদের ফার্স্ট ম্যারিজ ডে। কাল রাত থেকে ও ইমনের একটা কলের জন্য অপেক্ষা করছে। অথচ ইমন কিনা ভুলেই গেলো। দুদিন আগে ইমন জরুরী কাজে ঢাকার বাইরে গেছে। হয়তো প্রচন্ড কাজের চাপ ওখানে। তাই বলে আজকের দিনটার কথা ভুলেই যাবে। ও তো খুব বেশি কিছু চায়নি।
শুধু একটা ফোন, সেটা কি খুব বেশি কিছু। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে নিশিতার। এজন্যই ও ডাক্তার প্রজাতি একদম সহ্য করতে পারে না। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। কাজ আর পড়ালেখার বাইরেও যে একটা জীবন থাকতে পারে, সেটা তাদের জ্ঞানের পরিধির বাইরে। কিন্তু ওর কপালে সেই প্রজাতির-ই একজন জুটলো। সবই কপাল।
ভার্সিটি লাইফে কপোত-কপোতীদের দেখে নিশিতাও স্বপ্ন দেখেছিল হয়তো ওর জীবনেও একদিন এমন কেউ আসবে যে ওকে অনেক ভালোবাসবে। অতঃপর তাদের বিয়ে হবে, ছোট্ট একটা সংসার হবে…ব্লাহ…ব্লাহ…ব্লাহ। মোটকথা প্রেমের বিয়ের প্রতি ভীষন রকমের একটা আকর্ষন ছিল নিশিতার। কিন্তু দূর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্যবশত তার আর প্রেম করা হয়ে উঠলো না।
সেদিনের কথা আজও মন আছে নিশিতার। ক্লাস শেষে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে দেখে ইমন দাঁড়িয়ে আছে। নিশিতা এগিয়ে গেলো। ইমন নিশিতার মায়ের খালাতো বোনের ছেলে। সম্পর্কে কাজিন হওয়া সত্ত্বেও ইমনের সাথে ওর তেমন কথা-বার্তা হয় না, তা অবশ্য ইমনের লাজুক স্বভাবের কারনেই। একেতো ডাক্তার, তার
উপরে ভ্যান্দা টাইপের এই ছেলেটার সাথে নিশিতাও তাই যেচে কখনো তেমন কথা বলেনি। কিন্তু এই ভ্যান্দা তার ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে কি করছে সেটা মিলাতে পারছিল না ও।
– আররে ইমন ভাইয়া যে…হঠাত এদিকে? কি মনে করে?
– আসলে একটা কাজে এখানে এসেছিলাম। তাছাড়া আজকে তোমাদের বাসায় যাওয়ার কথা। এখান থেকেই যেতাম। কিন্তু আম্মু ফোনে বললো তুমি নাকি ক্যাম্পাসে। তাই ভাবলাম গন্তব্য যখন একটাই তাহলে একসাথেই যাই।
– ও। ঠিক আছে। চলো। সেদিন বাসায় যাওয়ার পথে এমনকি যাওয়ার পরেও ওদের মধ্যে তেমন কোন কথা হয়নি কিন্তু সেই সময়টাতে নিশিতার মনে হাজারো প্রশ্নের
ঝড় উঠেছিল। সেই ঝড় থামলো যখন রাতে নিশিতা ঘুমুতে যাওয়ার যখন ওর মা এসে ইমনের সাথে ওর বিয়ের প্রসংগ তুললো। কথাটা শোনামাত্রই ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। নিশিতার মা প্রায়ই দুষ্টুমি করে ওকে বলতো, “ডাক্তার পছন্দ করিস না তো। দেখবি শেষ পর্যন্ত তোর কপালে একটা ডাক্তারই জুটবে।“ নিশিতা তখন হেসে সে কথা উড়িয়ে দিত। কিন্তু সে কথাগুলো যে এভাবে সত্যি হয়ে যাবে তা ও কল্পনায়ও কখনো ভাবেনি।
যেহেতু ওর নিজের তেমন কোন পছন্দ নেই, আর ওর বাবা-মাও অনেক সাধ করে ইমনকে ওর জন্য পছন্দ করেছে, তাই অগত্যা ওকে রাজি হতে হলো। দেখতে দেখতে বিয়ের একটা বছর যে কি করে পার হয়ে গেল নিশিতা এখনো তো ভেবে পায় না। হসপিটাল, চেম্বার আর রোগী নিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময়ই ইমন ব্যস্ত থাকে। কিন্তু ওই ব্যস্ততাটুকু ছাড়া গত এক বছরে ইমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো আর কিছুই খুঁজে পায়নি নিশিতা। ভীষন রকম ভালোবাসতে জানে ভ্যান্দা টাইপের এই
ছেলেটা। তাই কিছুতেই ভেবে পায় না ও, কি করে ইমন ভুলে গেলো। হঠাত একটা শব্দে চমকে ওঠে নিশিতা। খেয়াল হতেই বুঝতে পারে দরজায় কেউ নক করছে।
“ইয়েস, কাম ইন” বলে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে ও।
– ডিস্টার্ব করলাম?
– তুমি!!!
– হুমম। চলে এলাম।
– কালকেও তো কথা হল। বলোনি তো আসবে!
– বলিনি। ব্যস্ত?
– না। কেন?
– ঘুরতে যাবো।
– এই বৃষ্টির মধ্যে!
– হুমম। কেন? তোমার কি এলার্জি আছে বৃষ্টিতে?
– না, তা হবে কেন? তুমি একটু বসো, আমি হাতের কাজটা গুছিয়ে নিই।
– ওক্কে। ফাইভ মিনিটস। তুমি কাজ গুছিয়ে আসো। আমি গাড়িতে আছি।
ইমন বেরিয়ে যেতেই নিজের উপর ভীষন রাগ উঠে নিশিতার। কি ও! এতোদিনেও ইমনকে চিনতে পারলো না ও। ছেলেটা শুধুমাত্র ওর জন্য এতোদূর থেকে ছুটে এসেছে। আর ও কিনা!
আশুলিয়ার রাস্তা ধরে ওদের গাড়িটা এগিয়ে চলছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। দুজনের মুখেই মিটিমিটি হাসি, যেন নতুন কোন কপোত-কপোতী একসাথে মেঘের
মাঝে ভাসছে। স্লো ভলিউমে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে। মাঝপথে হঠাত গাড়ি থামায় ইমন।
– কি হলো? এখানে থামালে যে?
– ভীষন ভিজতে মন চাইছে বৃষ্টিতে। চলো না ভিজি।
বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে ইমন। কিছুই বলার সুযোগ দেয় না ওকে।
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে নিশিতা।
যে ছেলে বৃষ্টিতে একটু ভিজলে ঠান্ডা জ্বর বাঁধিয়ে বিশ্রী অবস্থা করে ফেলে বলে বৃষ্টি একদম সহ্য করতে পারে না, সে আজ শখ করে বৃষ্টিতে ভিজছে।
গাড়ি থেকে নামতেই একটা হিম শীতল শিহরন বয়ে যায় ওর শরীরে। ইমনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নিশিতা। আলতো করে ওর হাতটা ধরে ইমন। দুজনেই নদীর জলে বৃষ্টির জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার অপরূপ দৃশ্য দেখতে থাকে অপলক দৃষ্টিতে।