রোজকার মতন রাতে জনাব আফজাল চৌধুরী সোফায় বসে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। এটা তার রোজকার অভ্যাস। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার পর এই ম্যাগাজিনটায় তার একমাত্র ভরসা একাকিত্ব দূর করার। তার স্ত্রী সিনথিয়া গত হয়েছেন বছর বিশেক হলো। ঘরে আর মানুষ বলতে তার একমাত্র মেয়ে অথৈ। বিবিএতে পড়ছে। বড়ো শান্ত স্বভাবের মেয়েটা। আফজাল সাহেব তার মেয়েটাকে ছোটবেলা থেকেই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। তার একমাত্র আদরের মেয়েটাকে সৎ মায়ের হাতে তুলে দিতে চাননি বিধায় ছোট বোনের কথা অমান্য করে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। তার মতে তিনি নিজেই তার মেয়েকে মানুষ করতে পারবেন।
ছোটবেলা থেকে শান্ত স্বভাবের অথৈ সবসময় তার বাবার হাতে খেত চেত। বাবাকে চোখের আড়াল হতে দেখলেই কান্না জুড়ে দিত। আফজাল সাহেবও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তার মেয়েটার মায়ের অভাব দূর করার। তার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে সন্তানেরা ছোটবেলায় মাকে কাছে না পেলেই বড় হয়ে উগ্র স্বভাবের হয়। কিন্তু তার মেয়ের বেলা সম্পূর্ণ বিপরীত। তার মেয়ে অথৈ অন্যদের মতো চলাফেরা করে না। নিজের মতো করে থাকতেই বেশী ভালোবাসে। ভার্সিটিতেও তার দুই একটার বেশি ফ্রেন্ড নেই। তাও মেয়ে। অথচ তারই কয়েকজন ব্যবসায়ী বন্ধুদের ছেলেমেয়েরা তাদের বাবার টাকা পয়সা খরচ নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা লাগায়। আর তার মেয়ে কিনা এতো টাকা থাকতেও কগনো কোন কিছু কেনে না। তার বাবা যেটুকু তাকে দেয়। ব্যস এই পর্যন্তই।
আফজাল সাহেব ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। পাশের ঘরে তার মেয়ে অথৈ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ তিনি পায়ের শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি তাকিয়ে দেখেন অথৈ। অথৈ এসে সোজা তার কোলে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। এটা অথৈয়ের নিত্যদিনের স্বভাব। ছোটবেলাতেও প্রায় এমন করত। আফজাল সাহেব অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেন আর অথৈ এসে তাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ত।
আফজাল সাহেব অথৈ মাথায় হাত রাখলেন।
আফজাল সাহেব: কিরে মা ঘুমাস নি ?
অথৈ: না বাবা ঘুম আসছে না।
আফজাল সাহেব: তা কি করলে ঘুম আসবে শুনি ?
অথৈ: বারে তুমি জানো না বোধহয়।
আফজাল সাহেব হাসলেন।
আফজাল সাহেব: গল্প শুনবি ?
অথৈ মাথা ঝাকালো।
আফজাল সাহেব: তাহলে শোন। তখন আমি সবেমাত্র ঢাকা এসেছি। একটা ছোট্ট গ্রাম থেকে আসা ছেলে যেমন বুকে হাজারটা স্বপ্ন নিয়ে আসে ঠিক তেমনি। মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা আসার একটাই উদ্দেশ্য ভালো কোনো ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া। আমার বাবার বাবা মানে তোমার দাদা সেকালের জমিদার ছিলেন। সময়ের সাথে সাথে জমিদারী প্রথা চলে যায়। আমার বাবা বেশ অভাবের মধ্যেই বড় হয়েছিলেন। আমিও আমার বাবার মতো বেশ অভাবের মধ্যেই বড় হয়েছিলাম। ঢাকায় এসে কোন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার কথা চিন্তাও করি না। আমি ছাত্র খুব একটা খারাপ ছিলাম। তখন এখনকার মতো কোচিং ছিল না।
ভার্সিটির স্যারদের কাছেই পড়া লাগতো। আমার তো ওই সময় ওত টাকা ছিল না। বাবা আমাকে যেটুকু দিয়ে পাঠিয়েছেন সেটুকু আমার কয়দিনের খাবার জোগাবে তাই সন্দেহ। অনেক কষ্টে পড়াশোনা করে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর অশেষ রহমতে ঢাবিতে ভর্তি হলাম। নতুন নতুন ভার্সিটি বেশ ভালোই লাগছিলো। ইতিমধ্যে কয়েকটি টিউশনিও জোগাড় হয়ে যায়। আমার খুব একটা অন্যদের সাথে মেশা হতো না। আমি এমনিতেই চুপচাপ স্বভাবের। তাই আমার কোনো বন্ধু বান্ধব ছিল না। ভার্সিটি, টিউশনি, মেছ এই। হঠাৎ তার সাথে দেখা হলো।
অথৈ: কার সাথে ? কি হলো চুপ হয়ে গেলে কেন।
আফজাল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললেন।
আফজাল সাহেব: মেয়েটা প্রতিদিন ভার্সিটিতে আগে আগে আসত। আমি বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করেছি মেয়েটা প্রায় আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমিও আড় চোখে তাকে দেখতাম। তার সাথে চোখাচোখি হতেই আমি চোখ সরিয়ে ফেলতাম। আমি গরিব ঘরের ছেলে। এইসব প্রেম তখনকার দিনে শুধু অধিক টাকা পয়সাওয়ালা মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল। মেয়েটা হয়তো ঢাকা শহরেরই কোন বড়লোক বাপের মেয়ে ছিল। আমি এ নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় নি। তার সাথে আমার কখন কথা হয়নি। হঠাৎ একদিন সে নিজে থেকেতেই আমার সাথে কথা বলল। আমি সেদিন টিএসসিতে বসে ছিলাম। সে আমার সামনে এসে বলল,
মেয়েটি: আমি কি এখানে বসতে পারি ?
আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমি কখনো অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলি না। আর কোন মেয়ের সাথে তো প্রশ্নই উঠে না। আমি আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম।
আমি: জি… জি বসতে পারেন।
মেয়েটি: আপনার কোন অসুবিধা হবে না তো।
আমার হাতে মার্টিনোর একটা বই ছিল। মেয়েটি আমার হাতে বইটির দিকে লক্ষ্য করল।
মেয়েটি: আপনার মার্টিনোর বই পড়তে ভালো লাগে ?
আমি: আসলে তেমন কিছু না। তবে দুর্ধর্ষ অভিযানের গল্প লিখতে মার্টিনোর সাথে কারো তুলনা হয় না।
মেয়েটি: আমার তো কবিতা পড়তেই বেশি ভালো লাগে। আচ্ছা আপনার রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভালো লাগে না জসীমউদ্দীনের ?
আমি হাসলাম।
আমি: দুজনেরই। দুজনের কবিতায় দুই ধরনের তৃপ্তি পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা আর জসীমউদ্দীনের কবিতায় আমাদের গ্রামবাংলার সৌন্দর্যের বর্ণনা।
মেয়েটি: আচ্ছা আপনি প্রেমের কবিতা পড়েন ?
আমি: পড়ি তবে খুব একটা না।
মেয়েটি: এত কথা বললাম অথচ নামটাই জিজ্ঞেস করলাম না। আচ্ছা আপনার নামটা … ?
আমি: হিমু।
মেয়েটি: বেশ সুন্দর তো। আপনার মধ্যেও একটা হিমু হিমু ভাব আছে।
আমি: আপনার নামটা ?
মেয়েটি: রূপা।
আমি: প্রেমের গল্প গুলোর মতোই কিন্তু আপনার নামটা। আপনার সাথে বেশ মিল আছে।
তারপর আমরা বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। সে আমার কথা জিজ্ঞেস করল। আমি কোথায় থাকি, কি করি এইসব আরকি। আমি মেয়েটার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যেত।
এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। আমাদের কথা বার্তা আরো বেড়ে যায়। তখন এখনকার মতো এতো সামাজিক মাধ্যম ছিল না। তাই আমরা চিঠি আদান প্রদান করতাম। প্রতিদিন ভার্সিটি শেষে দেখা তো করতামই। কিছুদিন পর মনে হলো আমাদের সম্পর্কটা ভালো বন্ধুর মতো হয়েছে। ততদিনে আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছিলাম। সে আমার জন্য প্রায় রান্না করে আনত। আমার কাছে তার রান্না বেশ লাগত। সে প্রায় আমার মেছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। আমি নিচে নামতেই আমার হাত ধরে সোজা রমনা চলে আসত। ২ টাকার বাদাম কিনে চাবাতাম আর দুজনে গল্পের তুবরি ঝারতাম। চুপচাপ স্বভাবের ছেলে হয়েও যে একটা মেয়ের সাথে এতটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তাতে আমি নিজে বেশ অবাক হয়ে গেছিলাম।
বৃষ্টির দিনে জোর করে আমার হাত ধরে টেনে বৃষ্টিতে ভিজত। সময়টা গল্পের মতো কাটত। বৃষ্টি শেষ হলে সে আবার নিজে থেকেই বকাঝকা করত। কেন তার সাথে ভিজলাম। ঠান্ডা লেগে যাবে এসব। তার এসব শাসন আমার বেশ ভালোই লাগত। হঠাৎ একদিন জানতে পারি বাবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমি গ্রামে চলে আসি। কেন যেন সেদিন আমার চোখ থেকে পানি বের হচ্ছিল না। আমি একেবারে পাথর হয়ে যায়। ছোট বোনটা জুলেখা তো আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বার বার বলছিল, আব্বা আর নেই ভাইয়া। আব্বা আর নেই।
বেশ কিছুদিন গ্রামে ছিলাম। আব্বা মারা যাওয়ার পর আম্মাও বেশি বাঁচেন নি। ছোট বোনটাকে গ্রামে একা রাখতে ভরসা পাই নি। তাই নিজের সাথে ঢাকা নিয়ে আসি। ওকে সাথে নিয়ে তো আর মেছে থাকা যাবে না। তাই মেছ ছেড়ে দিয়ে একটা বাস ভাড়া নি। রূপার সাথে জুলেখাকে পরিচয় করিয়ে দি। রূপায় আমাকে কমের মধ্যে একটা বাসা খুঁজে দেয়। আরো কিছু টিউশনি জোগাড় করি। বোনটা যেন পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে সে জন্য দিন রাত এদিক সেদিক ঘুরে চাকরি খুঁজতে থাকি। বোনটাকে একটা সরকারি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। আমার মেধাবী বোনটা ক্লাসে ফার্স্ট হতো সবসময়। ভালো রেজাল্ট করতে পারলেও আমি তাকে কিছু উপহার কিনে দিতে পারতাম না।
রূপা জুলেখাকে মাঝে মাঝে এটা সেটা কিনে দিত। আমার এসব পছন্দ না হলেও বোনটার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতাম না। আসলে গরিব ঘরে জন্মেছি তো। তাই কখনো কোন কিছুর আবদার করতে পারিনি। রূপা প্রায় আমার আর জুলেখার জন্য রান্না করে আনত। জুলেখা আর রূপাকে দেখলে মনে হতো দুজনেই যেন আপন বোন। আমার ওদের এই মিলটা বেশ লাগত। রূপার জন্য একটা আলাদা জায়গা অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে গেছিল এই বুকের মধ্যে। আর দিন দিন সেটা যেন আস্তে আস্তে আরো বেশি বিস্তার লাভ করছিল।
বুঝলাম রূপা আমার পুরো হৃদয় জুড়ে রয়েছে। রূপার মনেও যে আমার জন্য এক আলাদা অনুভূতি রয়েছে তা আমার জানতে বাকি নেই। কিন্তু কেউই মুখ ফুটে নিজেদের অনুভূতির কথা বলতে পারতাম না। তাতে কি। আমরা তো একে অপরের চোখের ভাষা বুঝতে পারতাম। সেটাই যথেষ্ট ছিল।
একদিন আমি রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে থামলো। আমি পিছনে তাকাতেই দেখি কোর্ট টাই পরা লোক গাড়ি থেকে নেমে এল। লোকটা বেশ গম্ভীর গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
লোকটা: আমার মেয়ের সাথে তোমার কি সম্পর্ক ?
আমি: আপনার মেয়ে ?
লোকটা: হুম। রূপা।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
আমি: আমরা তো শুধু ভালো বন্ধু।
লোকটা: যত ভালো বন্ধুই হও না কেন ওর থেকে দূরে থাকবে।
আমি আর কিছু বললাম না।
সেদিন বিকেলে রূপা আমার সাথে দেখা করতে এল। রূপা বেশ কান্না করছিল।
রূপা: বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।
কেন যেন আমার বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলাম। রূপা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না। আমি তাকে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দি।
তারপর তার সাথে আমার আর যোগাযোগ হয় নি। রূপার এক মাস পর বিয়ে। আমি ঘরবন্দি থাকতে লাগলাম। কিছুই ভাল লাগতো না। জুলেখা আমার এই অবস্থা দেখে শুধু চোখের জল ফেলতে থাকি। তারপর ছোট বোনটার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। হয়ে যায় বললে ভুল হবে। থাকার চেষ্টা করি। প্রতি নিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করি।
একদিন রূপ নিজে আমার সামনে হাজির হল। আমার হাতে বিয়ের কার্ড দিয়ে বলেছিল,
রূপা: শেষ বারের মত আমার সাথে দেখা করতে আসবে প্লীজ।
আমি কার্ডটা নিয়ে সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে রূপার বিয়ের দিন ঘনিয়ে এল। একবার ভাবলাম নিজ চোখের সামনে নিজের ভালোবাসাকে অন্য কারো হতে কিছুতেই দেখতে পারব না। আবার ভাবলাম বড়লোকের মেয়ে। বিয়েতে নিশ্চয় দামী দামী খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। নিজের জন্য না হোক। অন্তত ছোট বোনটাকে তো ভালো মন্দ খাওয়াতে পারি।
রূপার বিয়ে দিন সকালে বিছানায় শুয়ে আছি। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আমি দরজা খুলতেই দেখি রূপা। রূপা চুপচাপ আমার ঘরে ঢুকল। আমি বেশ অবাক হলাম। আজ না রূপার বিয়ে। তাহলে ও এখানে কেন। আমি কথাটা জিজ্ঞেস করতেই বলল,
রূপা: আমি বিয়েটা করব না।
আমি: কেন ?
রূপা: কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আমি: সেটা হয় না রূপা। জীবনটা কোন গল্প নয় যে যা ইচ্ছা তাই সম্ভব।
রূপা: চাইলেই সম্ভব।
আমি: মানে ?
রূপা: যানো হিমু, আমার বাবা ছোটবেলা থেকেই আমাকে প্রচন্ড শাসনের মধ্যে মানুষ করেছে। মাকে ছোটবেলায় হারিয়ে ছিলাম। বাবা থাকতেন নিজ কাজে, আর আমাকে ঘরে রেখে যেতেন কাজের লোকদের সাথে। ছোটবেলা থেকেই বাবা মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত। একা আমি ছোটবেলা থেকেই নিজের মতো করে বড় হতে চেলেই বাবা আমার ইচ্ছে গুলো দমিয়ে রাখত। আমি মেয়ে বলে একা কোথাও চলেও যেতে পারতাম না। কি আর করব বলো। আমাকে আবার বাবার কাছেই ফিরে আসতে হতো। যতই হোক আমি তো একটা মেয়ে। আমার কোন ইচ্ছা নেই। আমার কোন স্বাধীনতা নেই। ঐই সমাজ বার বার আমার বাবাকে একথায় মনে করিয়ে দিত। আমার বাবাও সমাজের সেই সব কথায় আমার উপর তার পছন্দ অপছন্দ গুলো চাপিয়ে দিত। আমিও আমার স্বপ্ন গুলোকে মাটি চাপা দিয়ে রাখি। এই প্রথমবার আমি বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। হিমু, আমাকে প্লীজ বিয়ে করবে ?
আমি একদম চুপ হয়ে যায়। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
আমি আর রূপা কাজি অফিসে গিয়ে আমার বোন আর কয়েকজন বন্ধুদের ডেকে ফোন করি। সেদিনই আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়। আমি, রূপা আর জুলেখা সেদিনই বাসের টিকিট কেটে চট্টগ্রাম চলে আসি।
অথৈ: আবার চুপ হয়ে গেলে কেন ? উফফফ বলতে থাকো না।
আফজাল সাহেব: রূপার বাবা আর কোনদিন আমাদের খোঁজ নেন নি। আমি ভাবি মানুষ এতোটা পাষাণ কি করে হয়। তারপরই বুঝতে পারি এই সমাজটাই আমাদেরকে পাষাণ হতে বাধ্য করে। আমার পড়াশোনা শেষ তাই চাকরির খোঁজ করি। পেয়েও যায়। কয়েকদিন পর চাকরিটা ছেড়ে রূপার কথা মতো ব্যবসায় ঢুকে যায়। দিন রাত পরিশ্রম করতে থাকি। রূপার অনুপ্রেরণায় সফলও হয়। একটা মেয়ে চাইলে একটা ছেলের জীবন নষ্ট করতে পারে, আবার চাইলেই সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে পারে। রূপার বেলায়ও তাই। ছোট বোনটাও ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। একদিন আমার জন্মদিনে রূপা আমার জীবনের সেরা উপহারটা দেয়। বলে আমি বাবা হতে চলেছি। আমার খুশি সেদিন দেখে কে।
আমি ব্যবসার দিকে পুরো মনযোগ দেওয়ায় রূপার দিকে খেয়াল রাখতে পারতাম। বাড়িতে অবশ্য কাজের লোক আর জুলেখা ছিল। রূপার নয় মাস হতে চলল। হঠাৎ একদিন জুলেখা ফোন করে বলল,
জুলেখা: ভাইয়া তাড়াতাড়ি আই। ভাবী বাথরুমে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। প্রচুর রক্ত পরছে। আমরা ভাবীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তুইও তাড়াতাড়ি আয়।
কথাটা শুনেই আমি অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে পৌঁছালাম। আমি হাসপাতালে পৌঁছেই দেখি রূপাকে অটিতে নেওয়া হয়েছে। জুলেখা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
জুলেখা: ভাবী ঠিক হয়ে যাবে। তাই না ? বল না, ভাবী ঠিক হয়ে যাবে।
আমি জুলেখাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
আমি: কাদিস না। ওর কিচ্ছু হবে না। ও আমাকে কথা দিয়েছে। ও শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমার পাশে থাকবে।
অটিতে ডাক্তাররা তাদের কাজে লেগে পরেছেন। এ দিকে আমি বাইরে পায়ে চারি করছি। আমার বেশ ভয় হতে লাগল। জুলেখার কান্না থামার নাম নেই। আমি ওকে বেশ কয়েকবার বললাম বাসায় চলে যা। কিন্তু গেল না। হঠাৎ ডাক্তার অটিতে বের হয়ে আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
ডাক্তার: আপনি ?
আমি: জি, পেসেন্টের হাসব্যান্ড।
ডাক্তারের চেহারার ভাবমূর্তির পরিবর্তন দেখা দিল।
ডাক্তার: দেখুন পেসেন্টের কন্ডিশন একদমই ভালো না। আঘাতের কারণে প্রচুর রক্ত ব্লিডিং হয়েছে। এতো রক্ত যোগাড় করা সম্ভব হবে কিনা জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি যে এমতাবস্থায় আমরা যেকোনো একজনকে বাঁচাতে পারবো।
আমি একদম চুপ হয়ে গেলাম। আমি সিন্ধান্ত নিতে পারছি না। আমার কাকে চাই ? আমার রূপা নাকি আমার সন্তান ? আমি ঠিক করে ফেললাম যে আমার রূপাকে চাই। আমি ডাক্তারকে বললাম,
আমি: যে করেই হোক আমার রূপাকে বাঁচান প্লিজ।
ডাক্তার আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,
ডাক্তার: আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। আল্লাহকে ডাকতে থাকুন। তিনিই পারেন সব ঠিক করে দিতে।
ডাক্তার আবার আটিতে ফিরে গেলেন। এদিকে আমি আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম। আমি আর জুলেখা হাসপাতালের নামাজের ঘরে নামাজ পড়তে লাগলাম।
আমি অটির বাইরে অপেক্ষা করছি। এমন সময় বাচ্চার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আল্লাহ কি তাহলে আমার কথা শুনেছেন ? আল্লাহ তোমার আশেষ রহমত। নার্স আটি থেকে একটা তোয়ালে তে ফুটফুটে বাচ্চাকে জড়িয়ে নিয়ে বের হয়ে বলল,
নার্স: সুখবর। আপনার মেয়ে হয়েছে।
এই বলে আমার কোলে তুলে দিল সদ্যজাত মেয়েটিকে। জুলেখা কাছে এসে বলল,
জুলেখা: দেখ ভাই মেয়েটা একদম ভাবির মতো হয়েছে তাই না ?
তখনই ডাক্তার বের হয়ে এলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
আমি: আমার ওয়াইফ কেমন আছে ?
ডাক্তার: আপনি ভিতরে যান।
আমি আমার মেয়েটাকে জুলেখার কোলে দিয়ে দৌড়ে ক্যাবিনের ভিতর ঢুকলাম। গিয়েই দেখি রূপা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আমার আওয়াজেই চোখ মেলে তাকাল।
রূপা: আমাকে ক্ষমা করে দিও হিমু। আমি সারাজীবন তোমার পাশে থাকতে পারলাম না।
আমি: এ কথা বলছো কেন ?
রূপা: তুমি আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও আমাদের মেয়েটাকে সবসময় দেখে রাখবে, কখনো বকা দিবে না।
আমি: তুমি প্লিজ এমন করে বলো না। আমার কষ্ট হচ্ছে তো।
রূপা: আমার হাতে কিন্তু বেশিক্ষণ নেই। আমাকে একটু জরিয়ে ধরবে প্লিজ।
রূপার এমন সব কথায় আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল যে আমি রূপাকে খুব কাঁদি। বাবা মা মারা যাওয়ার পর আমি একটুও কাঁদিনি। পুরো পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেন কাঁদতে পারিনি জানি না। তবে রূপার বেলা আমার প্রচুর কান্না পাচ্ছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল যে তাকে জড়িয়ে ধরে বলি,
আমি: কোথায় যাবে তুমি হ্যাঁ ? কোথায় যাবে ? কোথাও মেতে দিব না তোমাকে। তোমার মেয়েটাকে আমি একা সামলাতে পারবো না। তুমি না ঠিক করেছিলে যে আমরা দুজন মিলে আমাদের বাবুর নাম রাখবো ? তোমাকে না দেখতে পেলে কান্না করবে আমাদের বাবুটা।
খেয়াল করলাম রূপা নড়ছে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি মানতে পারছি না যে আমার রূপা আর নেই। আমার পিছনে ডাক্তার এসে দাঁড়ালো।
ডাক্তার: আসলে অপারেশনের আগে আপনার স্ত্রীর স্বল্প জ্ঞান থাকা অবস্থায় আমাদের কাছে বারবার মিনতি করে বলেছিলেন যে আমরা যেন যে করেই হোক বাচ্চাটাকে বাঁচায়। তিনি তার দেওয়া শেষ উপহার হিসেবে বাচ্চাটাকে গিফট করেছেন।
রূপার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। ও কি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারত না যে,
রূপা: আমি চলে গেলে একটুও কাঁদবে না। আর খবরদার অন্য কোন পেত্নীকে বিয়ে করবে না।
সে তো নিজের দায়িত্ব থেকে পালিয়েছে। কিন্তু আমি পালাব না অন্য কারো জন্য না হোক। অন্তত আমার মেয়েটার জন্য। আমি বাইরে এসে দেখলাম জুলেখা আমার মেয়েটাকে কোলে করে দাঁড়িয়ে আছে।
জুলেখা: আচ্ছা ভাই, আমিই তৌর মেয়েটার নাম রাখি ?
আমি: আচ্ছা, রাখ।
জুলেখা: ওর নাম হবে রিতিশা ফারহানা অথৈ। আমি ওকে অথৈ বলে ডাকবো।
অথৈ। মানে অগাধ। কথা দিলাম আমি ওকে অথৈ সাগরের সব সুখ দেবো।
আর একটা কথা বলতে তো মনেই নাই। ওর নাম আসল নাম সিনথিয়া। আমার নামও হিমু না হলেও আমরা একে অপরকে হিমু রূপা বলেই ডাকতাম।
আফজাল সাহেব কথা থামালেন। তার চোখ দুটোতে জল চলে এসেছে। তিনি অথৈয়র দিকে তাকিয়ে দেখলেন অথৈ ঘুমিয়ে পরেছে। কি মিষ্টি চেহারা। হুবহু তার মায়ের মতো। যেন অথৈ রূপার মরীচিকার প্রতিফলন। আফজাল সাহেব অথৈকে কোল নিলেন। এই বুড়ো বয়সেও বেশ শক্তিসামর্থ রয়েছে তার মধ্যে। তিনি অথৈকে ঘরে শুইয়ে কাঁথাটা টেনে দিলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এই ২০ বছরে তিনি অথৈকে বিশ হাজার বারেরও বেশি এই গল্পটা শুনিয়েছেন। তবুও অথৈ বারবার শুনতে চাই। আফজাল সাহেব হাসলেন। অথৈকে দেখলেই রূপার স্মৃতি গুলো তার মনে মরীচিকার মতো প্রতিফলিত হয়। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেই তিনি সব কষ্ট ভুলে যান। মাঝে মাঝে তার মনে হয়,
‘ জীবনটা সিনেমার থেকেও বেশি কষ্টের। আবার সিনেমার থেকেও বেশি আনন্দের। শুধু অনুভূতি আর ভালোবাসা গুলো এক থাকলেই জীবনের সকল কষ্ট নিমেষেই পার করে সুখ গুলো হাসিল করা যায়। ‘
রূপার চলে যাওয়ার পর অথৈই সেই অনুভূতি আর শিহরণ গুলো টিকিয়ে রেখেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই অথৈ দেখলে সে বিছানায় শুয়ে আছে। সে জানে কে তাকে এখানে এনেছে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। হাতে নিয়েই দেখলো রাহাতের নাম্বার। অথৈ ফোনটা ধরলো।
অথৈ: হ্যালো।
রাহাত: তো তুমি রুমডেটের জন্য তৈরি ?
অথৈ: উহু। না।
রাহাত: মানে ? এরকম তো কথা ছিল না। তুমি আমায় কথা দিয়ে ছিলে ভুলে গেছো ?
অথৈ: ভালোবাসলে বিশ্বাসের থেকেও বেশি মূল্যবান ভালোবাসার মানুষটিকে সম্মান করা। যেটা তুমি পারো নি। বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কে জড়ানোর আগেই তুমি আমার শরীরটা চাচ্ছো। এটা কি ঠিক ? তুমি হয়তো জানো না, আমার বাবা আমার জন্য কত কষ্ট সহ্য করেছে। তাকে কষ্ট দিয়ে তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না। তুমি বলেছিলে তাই না তোমার আর বাবার মধ্যে কাকে বেছে নিব ? তখনই আমি আমার বাবাকে বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু বলিনি। এখন বলছি। আমি আমার বাবাকেই বেছে নিব। আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।
আফজাল সাহেব দরজার আড়ালে সব শুনছিলেন। সত্যিই তার মেয়েটা রূপার প্রতিফলন। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। একজন বাবার তার মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারার সফলতার জল। যেটাকে পৃথিবীর কোন দামী জিনিসের সাথে তুলনা করা যায় না
(সমাপ্ত)