দ্বিতীয় সুখ

দ্বিতীয় সুখ

”মামা, একটু জোড়ে চালান না!” মাঝ বয়সী রিকশাওয়ালা নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে তার সবকটা দাঁত দেখিয়ে বললেন, ”আম্মা এইডা তো পেলেন না তিন চাকার রিশকা এর চাইতে জুরে চালাইতে পারুম না হেহেহে।” নিবেদিতা কিছু না বলে উত্কন্ঠিত মন নিয়ে চুপ করে বসে রইলো। ঢাকার রাস্তার জ্যাম যেন আজ হঠাত্ আরও বেড়ে গেছে সাথে রিকশার অলস গতি। জগত এমনি প্রয়োজনের সময় সবকিছুই মন্থর হয়ে যায়। অবশেষে যেন একযুগ পরে নিবেদিতার গন্তব্য গ্যালাক্সী হাসপাতালের সামনে এসে রিকশাটা থামলো। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গটমট করে হাসপাতালের ভেতর ঢুকে পড়ে নিবেদিতা।

৮ তলা থেকে লিফটটা নামছেই না। দেরী সহ্য করতে না পেরে অগত্যা সিঁড়ি বেয়েই নিবেদিতা উপরে উঠতে শুরু করলো। হাঁপাতে হাঁপাতে চার তলার ২৩২ নম্বর বেডের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। এই রুমেই গতকাল সন্ধ্যায় প্রচন্ড বুক ব্যথায় কাতর সাহেদকে ভর্তি করা হয়েছে। পাঁচ বছরের প্রেম তাদের। দীর্ঘ পাঁচ বছর। রাত ৯টার দিকে নিবেদিতা খবর পেয়েই ছুটে এসেছিলো। বুকের ব্যথায় কাতর সাহেদের বিকৃত মুখ দেখে কি ভীষন কেঁদে ছিলো সে। সাহেদ তার কান্না দেখে বললো, ”কলটা বন্ধ করো না প্লীজ এমনিতেই ঢাকা ওয়াসার পানি সংঙ্কট!” নিবেদিতা অশ্রু সজল চোখ নিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। সাহেদটা এমনি খালি রসিকতা করে। বন্ধ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে নিবেদিতা লম্বা করে দম নেয় কল্পনায় ভেসে ওঠে সাহেদের চিরচেনা হাসিমুখ। আলতো ধাক্কায় দরজাটা খুলে ফেলে সে। কিন্তু পুরো রুমে ওয়ার্ড বয় ছাড়া আর কেউ নেই, কেন? কাল রাতে সাহেদের ফোন বন্ধ ছিলো তবু যদি রিলিজ পেতো তবে তো অবশ্যই সাহেদ ওকে ফোন করতো। কিন্তু ও ফোন করেনি কেন? ওয়ার্ড বয় বেডে নতুন চাদর বিচাচ্ছিলো। নিবেদিতার বিস্মিত আর হতভম্ব মুখ দেখে ওয়ার্ড বয় বললো, ”আফা এতো লেটে আইলেন ক্যান ভোরের দিকেই তো এই বেডের লোকটা মইরা গ্যাছে। লাশ নিয়া গ্যাছে ঘন্টা খানেকের বেশী অইবো!” মুহুর্তেই নিবেদিতার বুকের খাঁচাটা শুন্য হয়ে যায়। চারপাশটা ফাঁকা আর ভোঁতা হয়ে আসে তার। নিবেদিতা বিশ্বাস করতে পারে না সাহেদ আর নেই। সাহেদ আর কোনদিন ফিরে আসবে না!

এলোমেলো ভাবে পা ফেলে নিবেদিতা হাসপাতালের সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে শুরু করে। পৃথিবীটাকে বড্ড বেশী অসহনীয় লাগে তার। স্রষ্টার প্রতি নিবেদিতার খুব রাগ হয়। বাস্তবতা এতো কঠিন কেন? টলমল পায়ে নিবেদিতা হাসপাতালের গ্রাউন্ড ফ্লোলের ওয়েটিং রুমে এসে দপ করে বসে পড়ে। সাহেদ নেই অথচ পৃথিবীর কোলাহল থেমে নেই এমনকি বেঁচে আছে সেও। মৃত্যুর মত নিষ্ঠুরতা জগতে আর কিছু আছে বলে নিবেদিতার মনে হয় না। আচ্ছা, সাহেদ নেই তাহলে একদিন ভরা পূর্নিমায় জোনাক ডাঙ্গার মাঠে তার আর সাহেদের কল্পিত আয়োজনের কি হবে? নিবেদিতা আর ভাবতে পারে না। চোখের সমুদ্রে জোয়ার আসে কিন্তু হায় এখন আর কে তাকে বলবে ‘কেঁদো না প্লীজ কাঁদলে যে তোমার চোখের কাজল নষ্ট হয়ে যাবে!’ নিবেদিতা কাঁদছে। চারপাশের মানুষ অবাক হয়ে দেখছে। নিবেদিতা ভেবে পায় না রাস্তার পাশের চা খেতে খেতে সাহেদ আর কোনদিন মিথ্যে গল্পে হাহা করে হেসে উঠবে না। মাঝ রাতে ফোন করে বলবে না, ”ভূতের গল্প শুনবে?” আকাশফাটা রোদে ক্যাম্পাসের সামনে এসে লাজুক ভঙ্গীতে হেসে বলবে না ”হঠাত্ তোমার চোখগুলো দেখতে ইচ্ছে হলো তাই…!” নিবেদিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই দীর্ঘশ্বাস বড় বেশী কষ্টের, বড় বেশী বেদনার।

”এই মাইয়া এই! কানতাছো ক্যান? কি অইছে নিবু? আরে কি আজব আমার বইনডারে কেউ কিছু কইছে নাকি?” নিবেদিতা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে সাহেদের বড় ভাই রাসেদ পান চিবুচ্ছে আর তার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রাসেদ নিবেদিতাকে খুব স্নেহ করেন। নিবেদিতা ভেজা চোখে তার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। তিনি এতো স্বাভাবিক কেন? রাসেদ বললেন, ”একাউন্টসে গেছিলাম। ট্যাকা পয়সা সব মিটাইয়া দিছি। সাহেদের গ্যাষ্টিকের ব্যাথা উঠছিলো এখন একদম ফিট। আমরা একটু পর বাসায় যামুগা। কিন্তু তুমি কানতোছো ক্যান?” নিবেদিতা উত্তর না দিয়ে বললো, ”দাদা আমি সাহেদের কাছে যাবো প্লীজ প্লীজ প্লীজ।” রাসেদ অবাক হয়ে স্নেহমাখা গলায় বললেন ”কিন্তু এই কান্দনের রহস্যটা একটু বলবা?” নিবেদিতা ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো, ”২৩২ নম্বর রুমে সাহেদকে রাতে রেখে গেলাম, আপনিও ছিলেন কিন্তু সকাল ১১টার দিকে ঐ রুমে গিয়ে শুনি… রোগী মারা গেছে।” সবকথা শুনে রাসেদ হাহা করে হেসে উঠে বললেন, ”চলো চলো সাহেদের কাছে চলো।” ২৩৬ নম্বর রুমে সাহেদ লম্বা হয়ে বসে আছে। নিবেদিতার সাহেদ। নিবেদিতা সাহেদকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও লজ্জ্বায় তা পারলো না। রাসেদ সব কথা সাহেদকে খুলে বললেন। শুনে সাহেদও ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বললো, ”আরে শোনো কাল রাতে তুমি চলে যাবার পর ২৩২ নম্বর রুমটা চেন্জ করেছিলাম কারন রাস্তার গাড়ীর শব্দ আসছিলো। পরে রাতেই হয়তো ওরা ঐ রুমটায় অন্য কোন রোগী ভর্তি করিয়েছে। আর তুমি হাহাহা… বোকা মেয়ে একটা।”

নিবেদিতা আর সাহেদ রিকশায় পাশাপাশি। নিবেদিতা অপলক চোখে সাহেদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাহেদ মিষ্টি করে হেসে বলে, ”খুব ভয় পেয়েছিলে না?” নিবেদিতা কোন কথা না বলে সাহেদের ঘাড়ে মাথা রাখে। সাহেদ নিবেদিতার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে, ”তুমি আমায় এতো ভালোবাসো কেন হুম?” নিবেদিতা এই প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে সাহেদকে জড়িয়ে ধরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে ”তুমি আমার দ্বিতীয় সুখ! কথা বলো না! একদম কথা বলো না!” সাহেদ আর কোন কথা বলে না। দুপুরের কাঠফাটা রোদে নিবেদিতার চোখে-মুখে-ঠোঁটে তার দ্বিতীয় সুখ লুটোপুটি খায়… এভাবেই বেঁচে থাকে ভালোবাসা অবর্ননীয় ভালোবাসায়!

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত