পার্কে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেয়া আমাদের প্রতিদিনের রুটিন। সাথে চা সিগারেট তো আছেই। যদিও পার্কের প্রবেশের পূর্বে লেখা আছে “সিগারেট খাওয়া নিষেধ”।
শহরে এটি মনে হয় একমাত্র পার্ক যেখানে কোন প্রবেশ ফ্রি দিতে হয়না। আর আমরাও এই পার্কের নাম দিই “গরীবের পার্ক”। আমার মতো বেকার যুবকের ব্যস্ত শহরে একটু নিশ্বাস নেয়ার জন্য এই গরীবের পার্কই যথেষ্ট।
বিকেলে পার্কের প্রতিটি বেঞ্জিতে জোড়া জোড়া শালিক পাখি বসে। এ যেনো ফ্রিতে প্রেম করার সূবর্ন্য সুযোগ। তাদের দেখলে মাঝে মাঝে হিংসে হয়। সবাই জোড়া জোড়া আর আমি আজ পর্যন্ত নিজের জোড়া ঠিক করতে পারলাম না। যদিও এ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। কারন আমার মতো শিক্ষিত বেকারের কপালে কোন মেয়ে জুটবে এটা স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না।।
প্রতিদিনের মতো আজকেও শেষ বিকেলে বন্ধুরা আড্ডা দিতে আসা।হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেলো পার্কের কোণে বসে থাকা মেয়েটির দিকে। যদিও এখানে জোড়া ছাড়া কোন মেয়ে আসে না। আর সিঙ্গেল কোন মেয়ে আসা মানে “গোবরে পদ্মফুল” মনে করা। তবে মেয়েটিকে ভীষন উদাসী মনে হচ্ছে। বারবার চারদিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে কি যেনো হারিয়ে ফেলেছে মেয়েটি। আমি বোকার মতো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। প্রথম দেখায় ভালো লাগা যাকে বলে।
বিকেলের সূর্যের লালছে আভা মেয়েটির মুখে এসে পড়ে। শ্যামল বরণ মেয়েটিকে আরো মায়াবতী লাগছে এখন। সে যেনো এক ভিন্নগ্রহ থেকে আসা অপ্সরী। তার চোখের নেশা যে কোন ছেলের ঘুম কেঁড়ে নেবে মনে হয়।এই ভাবনা গুলো একান্ত আমার। এই মুহূর্তে আমার চোখে মেয়েটি অপ্সরী। আমার চোখে সেরা সুন্দরী সেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মেয়েটি। যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।
সৃষ্টির সেরা আকর্ষন এই নারী। এই নারীকে নিয়ে কত কবিতা, কতো গল্প আর কতো স্বপ্ন। অবশ্য আমি যদি কবি হতাম তবে এই মেয়েটিকে নিয়েই একটি কবিতা লেখতাম। কবিতার নাম হতো “শ্যামলতা”। কিন্তু আফসোস, কবিতা লেখার মতো ছন্দ আমার জানা নেই।
হঠাৎ সিফাত আমার দিকে তাকিয়ে_কিরে মাম্মা!! মেয়েটির দিকে হা করে তাকিয়ে আসিস। কাহিনি কি?!
সিফাতের কথায় ভাবনার জগত ছেড়ে বাস্তবে আসলাম। শালা কথা বলার আর সময় পেলো না। ফিলিংসটাই নষ্ট করে দিলো।
আমি অনেকটা আবেগ নিয়ে সিফাতকে উদ্দেশ্য করে _মাম্মা, মেয়েটাকে দেখ। অনেকটা ডানা কাটা পরীর মতো, তাই না?! কিন্তু মনে হচ্ছে কোন সমস্যায় পড়ছে।
সিফাত কিছুটা বিরক্তি নিয়ে_আরে দূর, বয়ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করতেছে। পার্কে মেয়েরা কেন আসে তা বুজস না?!
আমি নিজের উপর আস্তা রেখে সিফাতকে_আরে নাহ, অনেকক্ষন ধরে লক্ষ্য করলাম। কি যেনো খুঁজতেছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করবো?!
সিফাত_তোর দরকার হলে তুই গিয়ে জিজ্ঞেস কর। আমাদের এতো ইচ্ছে নেই আগ বাড়িয়ে কথা বলার। আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলে উল্টা অপমানি হতে হবে।
সিফাতের কথায় অনেকটা আশাহত হয়ে বসে রইলাম। মনের তীব্র ইচ্ছে মেয়েটির সাথে কথা বলার। কিন্তু একা গিয়ে কথা বলবো ঐ সাহস এখনো হয়নি।
যদি ঐ সাহস থাকতো তাহলে হয়তো আরো দুই বছর আগেই একটা কিছু হয়ে যেতো। দুই বছর আগের কথা।
“শেষ বিকেলে সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে মুক্ত অক্সিজেন গ্রহন করছি। আর চোখ বন্ধ করে নিজেকে সাগরের বিশালতার মাঝে উজার করে দিচ্ছি। এমন সময় পাশে কেউ একজনের উপস্থিতি টের পেলাম। সেদিন অবশ্য বন্ধুদের কাউকে না জানিয়ে একাই ঘুরতে গেছিলাম।
পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখি একটি মেয়ে আমার মতোই দাঁড়িয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। মেয়েটির চোখ বন্ধ করে আছে দেখেই মেজাজ গরম হয়ে গেলো। আমাকে ব্যঙ্গ করতেছে সাহস কতো।
অনেকক্ষন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু মেয়েটি তাকিয়ে আছে সাগরের বিশালতার দিকে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর আমার রাগটা এমনিতেই কমে গেলো। সত্যি বলতে কি, সুন্দরীদের সাথে রাগ করে থাকতে কম পুরুষই পারে। আর আমি ঐ কম পুরুষের মাঝে পড়িনা।
মেয়েটা সাগরের প্রান থেকে চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালো। আর আমি সাথে সাথে অন্যদিকে তাকানোর ভঙ্গিমা করি। মেয়েটা হয়তো বুজতে পারলো। মেয়েটা আমাকে উদ্দেশ্য করে
_ভাইয়া, একটা কথা জানতে চাচ্ছি। বলবেন প্লিজ?!
আমি অপ্রস্তুত ভাবে_জ্বি বলুন, কি জানতে চাচ্ছেন!!
_আমি দূর থেকে দেখলাম। আপনি অনেকক্ষন চোখ বন্ধ করে সাগরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে চিলেন!! কেনো জানতে পারি?!
আমি_আপনিও তো একটু আগে এমন করে সাগরের দিলে তাকিয়ে ছিলেন!!
_আসলে আমি এমনিতেই এমনটা করলাম। বুজতে চেষ্টা করলান কেনো আপনি এমন করছেন। কিন্তু কিছুই বুজলাম না!!
আমি মেয়েটার পাগলামু মার্কা কথা শুনে না হেসে পারলাম না। মেয়েটির সামনেই হেসে দিলাম। মেয়েটিও আমার হাসি দেখে হেসে দেয়। এটা কি ফরমালিটি ম্যান্টেইন করলো নাকি বুজলাম না।
জগতের কিছু মানুষ আছে অন্যকে কপি করে চলতে পছন্দ করে। যেমন, আমি হাসলাম পাশের জন হাসির কারন না জেনেও আমার সাথে হাসবে। আসলে মানুষ হাসতে চায় কিন্তু হাসির কারন খুঁজে পায়না অনেকে। তাই অন্যের আনন্দ দেখে নিজের আনন্দটা খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করে।
তবে কান্নার ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে। ধরুন, আমি রাস্তার ধারে বসে কাঁদতেছি। অনেকে দেখেও না দেখার ভ্যান করে চলে যাবে। আর কেউ কেউ আছে এসে আগে জানতেই চাইবে কান্নার কারটা কি। কারনটা যদি মারাত্মক কিছু হয় তাহলে হয়তো কেউ শান্তনা দিবে। আর নয়তো মনটা খারাপ করে চলে যাবে।
যাই হোক,
মেয়েটির প্রশ্নের জবাবটা কিভাবে দিবো বুজতে পারছি না। তাই কথা না বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়াটাই মনে হয় ভালো হবে।
যেই অন্যদিকে চলে যাবো মেয়েটি আবার আমাকে উদ্দেশ্য করে_ভাইয়া, চলে যাচ্ছেন?! বললেন না তো কেনো?!
আমি কিছুটা বিভ্রান্ত বোধ করে_কিছু না এমনিতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। মুক্ত অক্সিজেন গ্রহন করার জন্য।
মেয়েটি মনে হয় বুজতে পারলো আমি তার প্রশ্নে বিরক্ত বোধ করছি। সত্যি বলতে কি, বিরক্তবোধ করার প্রধান কারন হলো “ভাইয়া” বলে ডাকা। এতো সুন্দর একজন রমনীর মুখে ভাইয়া ডাকটা শুনতে ইচ্ছে করছে না। অবশ্য প্রথম পরিচয়ে ভাইয়া বলাটা স্বাভাবিক। আংকেল খালু চাচা তো আর ডাকেনি। তবুও কেনো যেনো ভাইয়া শব্দটা সহ্য হচ্ছে না এখন।
মেয়েটি আর কোন কথা না বলেই চলে যাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছিলো মেয়েটিকে ডেকে কথা বলি। কিন্তু সাহস হচ্ছিলোনা বা ইগো প্রবলেমের কারনে আর ডাকা হলো না মেয়েটিকে। এক সময় মেয়েটি হারিয়ে গেলো দৃষ্টি সীমানার বাহিরে।
মানুষ মায়ায় আবব্ধ হতে চায় বার বার। চলার পথে সঙ্গী খুঁজে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। কেউ পায়, কেউ পেয়েও হারায়। আমি হয়তো পেয়েও হারালাম। আমার একটা মারাত্মক সমস্যা কারো সাথে আগবাড়িয়ে কথা বলার প্রবনতা কম।
তবে প্রথম দেখায় বা প্রথম কথায় কাউকে নিয়ে এতোটা আর ভাবা হয়নি। ক্ষনিকের মায়ায় আবন্ধ হয়ে গিয়েছি হয়তো। কিন্তু যখন বুজতে পারলাম মায়ায় জড়িয়ে গেছি তখন দৃষ্টির বাহিরে চলে গেলো।
আচ্ছা,
প্রথম দেখায় বা সামান্য কিছু কথায় কি মানুষ প্রেমে পড়তে পারে?! হয়তো পারে!! তা না হলে সামান্য একটু দেখা আর কথায় মেয়েটির প্রতি আলাদা একটা অনুভূতি আসলো কেনো!! মনে হচ্ছে মেয়েটির ছবি মনের ক্যানভাসে বারবার দোলা দিচ্ছে!!
হুমায়ূন আহম্মেদ স্যারের “হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম” উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে গেলো।
প্রতিটি ছেলে মেয়ের হাতে নাকি পাঁচটি করে নীলপদ্ম থাকে। যাকে প্রথম ভালোবাসে সেই নীলপদ্ম গুলো নাকি তাকেই দেয়া হয়ে যায়। তাহলে কি আমার নীলপদ্ম গুলো মেয়েটিকে দিয়ে দিলাম?! বা মেয়েটি কি আমাকে তার নীলপদ্ম গুলো দিয়েছে?! নাকি দিতে চেয়েও আর দেয়নি!?
হঠাৎ ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ গানটার কথা মনে পড়ে গেলো। সত্যি তো আমরা সময়ের কাজ সময়ে করিনা বলেই আমাদের এতো অপূর্ণতা আর হতাশা।
সেদিনের পর থেকে মেয়েটিকে অনেক খুঁজেছি। অনেকবার শেষ বিকেলে সাগর পাড়ে গিয়ে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু আর খুঁজে পাইনি। মেয়েটির নামটাও জানা হয়নি তাই নাম দিয়েছি ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’!!
শুনেছি প্রকৃতি একটি মানুষের সাথে চারবার দেখা করিয়ে দেয়। যে কোন কাকতালীয় ভাবে। তাহলে কি কোন একদিন আবার দেখা হবে আমার নীলপদ্ম নেয়া মেয়েটির সাথে। হয়তো হবে, হয়তো বা হবে না!!”
আজকের মেয়েটিকে দেখে আমার মনে আবারো তুপান বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আবারো ক্ষনিকের মোহে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। মেয়েটির সাথে কথা বলার প্রবণতা তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। আচ্ছা, আমার নীলপদ্ম গুলো তো অনেক আগেই সাগর পাড়ে দেখা মেয়েটিকে দিয়ে দিয়েছি।
তাহলে আজকের এই মেয়েকে দেয়ার জন্য নীলপদ্ম গুলো পেলাম কোথায়?! তাহলে কি ঐ মেয়েটিকে দেয়া হয়নি?! ঐটা কি আবেগ ছিলো?! শুধুই ক্ষনিকের মোহ!?
নাকি এটাও আবেগ আর শুধু ক্ষনিকের ভালোলাগা ছাড়া আর কিছু নই। হয়তো ‘হ্যাঁ’ হয়তো ‘না’। এই ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ শব্দ দুটো অনেক ছোট কিন্তু এই শব্দ গুলো একেকটা জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়া। বলা যায় শব্দ দুটো খুব ডেঞ্জারেস।
মেয়েটি চলে যাচ্ছে তার সাথে আমার কথা বলার তীব্র ইচ্ছে থাকলেও আর সামনে যাওয়ার ইচ্ছে করছে না। কারন আমি এখন মোহ, ভালোলাগা আর ভালোবাসার হিসেব মিলাতে ব্যস্ত।
দ্বিতীয় বারের মতো আবারো পরাজিত হয়েছি হয়তো। হয়তো আরো একটি অপ্রকাশিত ভালোবাসার সূচনা হলো। হয়তো নতুন করে আবার অপেক্ষা করবো মেয়েটির জন্য। হয়তো এই মেয়েটিকে খুঁজে বেড়াবো পাগল প্রায় হয়ে। অজানা এই মেয়েটিরও নাম হবে ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’!!
এভাবে প্রতিনিয়ত আমি প্রেমে পড়বো। আর একটি একটি করে অপ্রকাশিত ভালোবাসার সূচনা হবে। শেষ বিকেলের রক্তিম সূর্যের আলোয় খুঁজে বেড়াবো “শেষ বিকেলের মেয়ে” গুলোকে।
বি. দ্র:- গল্পের ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ