প্রেমিকাকে দেশে রেখে ভাইয়া কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।কাল রাত আড়াইটায় ফ্লাইট।মা খুব যত্ন করে তাকে লাগেজ গুছিয়ে দিলেন।এতোদিন দেশে থেকে সবার মুখে অকর্মা শব্দটা শুনেই দিন কেটেছিলো তার।কাল সে-ই প্রবাসে গিয়ে কাজ করা একজন ব্যস্ত মানব হয়ে যাবে।খারাপ লাগা আর ভালো লাগা দুটোর মিশ্রণ এখানে।পরিবার থেকে এতোদূরে একা থাকার সাহস ভাইয়ার কখনো হয়ে উঠেনি।এই প্রথম পরিবার থেকে তার দূরে যাওয়া।ভাইয়া তার প্রেমিকাকে বিয়ে করার জন্য কিছুদিন আগে বাবা মায়ের কাছে তার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলো।প্রেমিকাকে দেশে ফেলে রেখে বিদেশ চলে গেলে হয়তো মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে এই ভয়টা ভাইয়ার কাজ করতো।শুনেছি মেয়েটার বিয়ের জন্য নাকি ছেলে খোঁজা হচ্ছে।ভালো ছেলে পেলেই মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিবে।আর তাই ভাইয়া,বিয়ে করে বিদেশ যাওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিলো কিন্তু পরবর্তীতে সেই চেষ্টা আর সফল হয় নি।প্রেমিকাকে দেশে রেখেই ভাইয়াকে বিদেশ চলে যেতে হচ্ছে।সেদিন ভাইয়া আমাকে ডেকে বললো-
-পরী,তোকে একটা কাজ দিলে করতে পারবি তো?
-কি কাজ?
-পুষ্পাকে তো চিনিস তাই না?
-তোমার প্রেমিকাকে তো ভালো মতোই চিনি।এখন ঘটনাটা বলো যে কি বলার জন্য তুমি এতো ব্যস্ত হয়ে পরেছো?
-কানাডায় যাওয়ার পর আমি যখন সেখান থেকে বাড়িতে ফোন দিবো তখন তোকে আমি একটা নাম্বার বলে দিবো।এই নাম্বারটা তুই পুষ্পার কাছে পৌঁছে দিবি।পারবি না?
-হু পারবো।কিন্তু এই কাজের বিনিময়ে আমি কি পাবো?
-চকোলেট পাবি।
অতঃপর চকোলেটের ঘুষ নিয়ে আমি তার কাজটা করে দিবো বলে ভাইয়াকে ভরসা দিলাম।
ভাইয়া তার কথা মতো কানাডায় গিয়ে বাসার সবাইকে তার ঠিকঠাকভাবে পৌঁছানোর ব্যাপারটা জানালো।সবার শেষে ফোনটা আমি ধরতেই ভাইয়া আমাকে একটা ফোন নাম্বার দিলো তার প্রেমিকা পুষ্পাকে দেয়ার জন্য।
পরদিন আমি সেই নাম্বারটা নিয়ে পুষ্পা আপুদের বাসায় গেলাম।পুষ্পা আপুর মন খারাপ।এতোটাই মন খারাপ যে সে কাঁপা কাঁপা গলায় আমার সাথে কথা বলছে।যেকোনো সময় কেঁদে দিবে।আমি ভাইয়ার নাম্বারটা পুষ্পা আপুর হাতে দিলাম।পুষ্পা আপু আমাকে বললো-
-নাম্বার দিয়ে কি হবে যদি ফোন না থাকে!
-কেন?তোমার ফোন কোথায়?
-আমাকে ফোন চালাতে দেয়া হয় না।আর কোনো উপায় নেই।আজ যেই ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতে এসেছিলো তারা আমাকে খুব পছন্দ করেছে।যেকোনো সময় বিয়ে হয়ে যাবে রে।
-তুমি তারপরও সবাইকে বুঝাও।
-তোর ভাইয়া দেশে থাকলে আমি ওকে নিয়ে সত্যি পালিয়ে যেতাম।এখন আমি নিরুপায়।
আমাকে হতাশায় বেধে দিয়ে পুষ্পা আপু বিদায় দিলো।ভাইয়া আবারও ফোন করলো কানাডা থেকে।আমি পুষ্পা আপুর কাছ থেকে কোনো খুশির খবর দিবো হয়তো এমন কোনো আশায় রয়েছিলো সে।কিন্তু আমি খুশীর কিছু বলতে না পারায় ভাইয়া সেদিন কোনো উত্তর না দিয়েই ফোনটা কেটে দিলো।ওদিকে পুষ্পা আপুও কেঁদে অস্থির।
একবার আমি চালাকি করলাম।কায়দা করে বাসার ফোনটা লুকিয়ে পুষ্পা আপুর কাছে নিয়ে এসে বললাম ভাইয়াকে ফোন দিতে ওই নাম্বারে।পুষ্পা আপু ফোন দিলো।সেদিন তাদের দুজনের ফোনালাপ হলো।আমি একটু দূরে সরে আসলাম।কতোদিন দুজনের এক সাথে কথা বলে না।আজ বলুক,মন খুলে বলুক।আমি সামনে থাকলে হয়তো কথা বলতে সংকোচ করবে।পুষ্পা আপু আমাকে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে বললো-
-তুই আমার ননদিনী হলে ভালোই হতো রে।দুজনে জমতো বেশী।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম তারা তাদের শেষ কথাটুকু ফোনে বলে বিদায় নিয়েছে।এর দুইদিন পর খবর পেলাম পুষ্পা আপুর কাবিন হয়ে গেছে।এই দুইদিনে ভাইয়া একবারও বাসায় ফোন করে নি।
প্রায় এক সপ্তাহ পর ভাইয়া ফোন করলো।আমি ভাইয়াকে কখনো কাঁদতে দেখি নি।ভাইয়ার কান্নার আওয়াজটা ফোনের ওপরপ্রান্ত থেকে শুনেই ভাইয়ার কান্নার দৃশ্যটা কল্পনায় চলে আসলো।ভাইয়া ফোন হাতে নিয়েই কাঁদছে।ভাইয়া কাঁদতে কাঁদতে বলছে-
-পরী আমি হেরে গিয়েছি রে।জীবনে অনেক খেলা দিয়েছি।কেউ আমাকে কখনো হারাতে পারে নি।জীবন নামক খেলাঘরটা আমাকে হারিয়েই ছাড়লো।পুষ্পাকে বলিস আমি তাকে ভালো থাকতে বলেছি।সে যেন ভালো থাকে।তাহলে আমিও ভালো থাকবো।
ছেলেদের কান্না এতোটা কষ্টের হতে পারে আমি জানতাম না।আমি কি বলে সান্ত্বনা দিবো বা এই মুহূর্তে কি বলা উচিৎ আমি বুঝতে পারছি না।ফোন হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি।আর ভাইয়া ফোনের ওপরপ্রান্ত থেকে কেঁদেই যাচ্ছে।