আইশা কে যখন বিয়ে করি সে ছিলো ৩৭ কেজি ওজনের ছিপছিপে গড়নের ঊনিশ বছরের এক স্বপ্ন তরুণী। আমার সাথে বিয়ে হওয়ায় আমার অসুস্থ মায়ের দেখা শোনা, ঘরের কাজ কর্ম, তারপর খুব তাড়াতাড়ি কনসিভ করায়, গ্রেজুয়েশন তার আর কমপ্লিট করা হয়নি,সংসারে জড়িয়ে গেছে পিচ্চি মেয়েটি।
সেজন্য অবশ্য সে আমাকে কখনোই দোষারোপ করেনি। আমি যে খুব বেশি বয়স্ক ছিলাম তা না, তার তুলনায় অবশ্য বয়স কিছু বেশিই ছিলো বাইশ। আমাদের বিয়ে পারিবারিক ভাবে হলে কি হবে প্রেম ছিলো একশ ভাগ। আইশার’র সবকিছুই আমাকে আকর্ষণ করতো। তার হালকা পাতলা গড়ন,মেদহীন পেট,প্লাগ করা ভ্রু,ঠোঁটের নীচের গাঢ় কালো তিলটা,ওর চিকন কোমর, ওর নরম গলায় কথা বলা মোটকথা পুরা আইশাই আমার ক্রাশ ছিলো।আমি ওকে পরী বলেই ডাকতাম। আর ও ছিল আমার মনের আকাশের পরী। ওকে আমার হাতের উপরই ঘুম পাড়াতাম,শোবার সময় ওর ঠোঁটের নীচের তিলে চুমু না খেলে আমার ঘুম আসতো না। বাইরে যাবার আগে, এসে তার কপালে চুমু খাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের মেয়ে ওর হাতে শুতো আর আমার পরী টা ঘুুমাত আমার হাতে। কিন্তু এখন! বিয়ের ঊনিশ বছর পর, তাকে আমার আর একটুও আকর্ষনীয়া মনে হয়না। এখন আমার সব অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে কবে, আমি নিজেও জানিনা। এখন সে আর ৩৭ কেজি ওজনের ছিপছিপে তরুণী নেই, সাতষট্টি কেজি ওজনের একজন মোটা মহিলা।
এখন তার তিলটাকেও বেমানান মনে হয়,গলার নীচে মাংসের ভাঁজ দেখতে খুব বিশ্রী দেখায়। তাকে হাতের উপর নিয়ে কখন ঘুমিয়েছি মনে করতে পারিনা। তার ভ্রু গুলোও জোঁড়া ভ্রু হয়ে কপাল ছেয়ে গেছে। তার পাতলা ভুঁড়িটা বড় হয়ে নীচের দিকে ঝুলে পড়েছে। সপ্তাহ বা দশদিনে, খুব প্রয়োজন না হলে তার দিকে ফিরে শোয়াও হয়না,তাকে তেমন ছোঁয়াও হয়না। কখনো সে পাশ ঘেষে আসতে চাইলে, সরো তো আইশা,গরম লাগছে। তোমাকে দেখলেও গরম আরো বেশি লাগে। এক্সারসাইজ বা ডায়েট করতে পারোনা তুমি? কিভাবে করবো? তিনটা বাচ্চাই তো সিজারিয়ান। একটু বেশি ব্যায়াম করলে সেলাইয়ে ব্যাথা পাই। এরপরও তোমার ওজন কমানো দরকার,অনেক মোটা আর সাথে বুড়িয়েছো তুমি। মন খারাপ করেই হয়তো ও অন্য দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
আচ্ছা, ও কি তখন আগের কথা মনে করে চোখের জল ফেলে? জানিনা,জানতে ইচ্ছে করছেনা,ও বড্ড বুড়িয়ে যাচ্ছে, আমার আর ভালো লাগেনা। আমি অন্যপাশ ফিরে মোবাইলে নাটক বা ফানি ভিডিও দেখি। পরদিন, তোমার কাপড় খুলে শোয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করো আইশাা,দেখতে ভালো লাগেনা,সব মাংসের দলা। রাগ করোনা সত্যি বলছি। কিন্তু একসময় তো তুমি তাই পছন্দ করতে! তখন তুমি সুন্দরী ছিলে। আইশা কি মন খারাপ করলো, কথাটা শুনে? মিথ্যে তো কিছু বলিনি,আসলেই সে তখন অনেক সুন্দরী ছিলো,সেটাও তো সত্যি বললাম। আরেকসময়, আইশা, তোমার এতো ভ্রু কোত্থেকে এলো,প্লাগ করোনা? না,সে তো পাঁচ বছর ধরে করছিনা। কি! এতোদিন? হ্যাঁ, তুমি খেয়াল করোনি! ও যেন অবাক হয়। কি জানি, তা করছো না কেনো? খুব বাজে দেখাচ্ছে কিন্তু। শুনেছি অনেক গোনাহ,বেশি প্লাগ করলে পাগলও হয়ে যেতে পারে। আর বয়সও হচ্ছে না! ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে।
আরো ক’দিন পর, মাথা ঘোরে পড়ে যায় আইশাা,মেয়ে আমাকে ফোন করে জানায়। এসে দেখি,মাথায় পানি ঢালছে,আরো বেশি বুড়ি দেখাচ্ছে তাকে। চোখের নীচে একগাদা কালি। কি হয়েছে তোদের মায়ের? ক’দিন ধরে ডায়েট করছে,তাই বেশি দূর্বল হয়ে গেছে। মনে মনে অপরাধবোধ অনুভব করি,আমার জন্যই সে চেষ্টা করছে। তবে অতটুকুই। তাকে বলি, ডায়েট করা তোমাকে দিয়ে হবেনা। ব্যায়ামও তো করতে পারিনা ,আর কিভাবে করবো? দাঁড়াও ভেবে দেখি,হয়তো কোনো মেডিসিনে কাজ হতে পারে। আচ্ছা। আমি বাইরের ছিপছিপে মেয়েদের দিকে তাকাই আর আইশা’র সৌন্দর্য এর কথা ভেবে আফসোস করি। তবে তাকানো পর্যন্ত, খারাপ কিছু ভাবতে পারিনা।আমার নিজেরও মেয়ে আছে। তবে, এটা কি সব হাজব্যান্ড চায় না,ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে সুন্দরী, আকর্ষনীয়া বউয়ের আঁচল তলে বিশ্রাম নিতে?
আরেকদিন, আমার অফিসে পুরুষ মহিলা ক’জন জুনিয়র কলিগ বসে দেখি আলোচনা করছে। তারা আমাকে দেখেনি,খেয়াল করেনি। আলোচনার বিষয় আমি এক নারী :আকাশ সাহেবের বয়স কতো হবে? আরেক নারী: পঞ্চান্ন তো হবেই। ওনি যথেষ্ট বয়স লুকাবার চেষ্টা করেন কিন্তু, প্রতিদিন ক্লিন সেভ, ভালো ড্রেস আপ। পুরুষ : ধুর না,অতো বয়স হয়নি,বড় জোর পঞ্চাশ। বেশি হবে না, গত দুই বছর ধরে ডায়াবেটিস হওয়ায় ত্বক কিছুটা ঝুলে পড়েছে। তবে এর চেয়ে বেশি দেখায়, তাই না? হুম,মাথায়ও টাক পড়ছে। বলে কি এরা! তার বয়স মোটে বিয়াল্লিশ! আর এদের মনে হচ্ছে পঞ্চাশ, পঞ্চান্ন!? তা কি করে সম্ভব? আকাশ এর মন খারাপ হয়ে যায়। তাহলে সেও বুড়িয়ে যাচ্ছে! কই, আইশা তো কখনই বলেনি এ কথা। ও তো তাকে হাঁটতে বসতে বলে এসেছে।
মন খারাপ করেই সন্ধ্যায় তিনি বাসায় যান। আইশা, শোন তো কি? আমার বয়স কতো, তুমি জানো তো,না? হ্যাঁ, জানবো না কেনো? বিয়াল্লিশ। দেখতে কতো মনে হয়? সত্যি বলবো? অবশ্যই সত্যি বলবে। কিন্তু তার মনে ভয় হয়,না জানি আইশা কতো বলে আমার কাছে তোমাকে সবসময় জোয়ান মনে হয়,বিয়াল্লিশ লাগেনা। মনে হয় কতো? লজ্জানত হয়ে সে বলে, পঁয়ত্রিশ মতো,আমার নিজেকেই বড় লাগে তোমারচেয়ে। কি বলে এই মেয়ে! আমি সারাক্ষন তার দিনদিন অসুন্দর হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলি। আমি অবাক হই আর ভাবি, তার এতো এতো সৌন্দর্য দেখলাম না! সে চার বছর, আমার অসুস্থ মায়ের সেবাকরলো। সিজার করে আমার তিনটা বাচ্চার জন্ম দিলো। তাদের, আমারপেছনে কতই না সময়,আদর, যত্ন, ভালোবাসা ব্যয় করলো।
আমার সকালে অফিস থাকে বলে ছেলে মেয়েদের অসুস্থতায় অন্য রুমে নিয়ে সেবা করতো। আমার নিজের অসুখেও সে এতটুকু বিশ্রাম করেনি। কখনোই খাবার দাবার নিয়ে তাকে দু’কথা শুনাবার প্রয়োজন পড়েনি, সবসময় সব পারফেক্ট পেয়েছি। আমার দুই বছর ধরে ডায়াবেটিস হওয়ায়, খাবারের ম্যানু পরিবর্তন করে আমাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করছে।কোনোদিন তাদের কাউকে এতোটুকু অপূর্ণতা বুঝার সুযোগ দেয়নি। বিছানায় ইস্ত্রি করাকাপড় পেয়েছে প্রতিদিন। এতো পরিশ্রম, এতো ত্যাগ! আর সে কিনাসারাক্ষণ তার বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে তাকে বারবার ছোট করেছে! ছি: এতোটা ছোট মন কিভাবে হলো আমার ! আইশা’র সৌন্দর্য তো আমার কারনেই নষ্ট হয়েছে,তার সন্তানদের জন্ম দিয়ে,তাদের দুধ খাইয়ে,তা নয় কি? আকাশ মনে মনে লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়।
রাতের বেলা, আইশা,একগাদা কাপড় পরে ঘুমাবে কেমনে তুমি? না থাক,কাপড় ছাড়া খারাপ দেখায়। মোটেও দেখায় না দেখায়,আমি অনেক মোটা। কে বলেছে,তোমার চেয়ে হাজারগুন মোটা মানুষ আছে। আর এমন সামান্য মোটা না হলে ভালো দেখায় না। সত্যি বলছো? হ্যাঁ সত্যি।বলতেছি আমার পরী টা। আইশা, তুমি ঐ দিকে ফিরে শুচ্ছো কেনো? আমার হাতে আসো। না, না, তুমি পারবেনা,ব্যথা পাবে হাতে। পাবোনা,আসো তো।আমি তার ঠোঁটের নীচে তিলে চুমু খাই, আজ তিলটাকে প্রথম দিনের মতোই আকর্ষনীয় লাগছে।অনেক বছর পর আজ আবার মনে হচ্ছে আইশার মতো সুন্দরী মেয়ে পৃথিবীতে দুইটি নেই। আইশার চোখে পানি,সাথে আজ আমারো। তখন ই আইশা কে বললাম চলো না ছাদে যায়।
আইশা বলল তুমি যাও আমি কফি নিয়ে আসতেছি। আমি আইশা কে বললাম পায়ে নূপুর পড়তে। একটু পরে আইশা কফি নিয়ে ছাদে এলো। চাদের আলোই আমাক পরী টাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি আইশার মাঝে হারিয়ে গেলাম।এখন আমার পরী টা আমার বুকে মাথা রেখে যাপটি করে জরিয়ে ধরে আছে। আর আমি নিজের অজান্তে বলতে থাকলাম তুমি যদি চাঁদ হও আমি হারিয়ে যাব তোমার মগ্ধতায় তুমি যদি তারা হও আমি হব ওই বিশাল আকাশ তুমি যদি পরি হও আমি হব শুধু তোমারি নীল এইবলে আমি সেই প্রথম দিনের মত প্যোপস করলাম। কিন্তু ও কিছু না বলেই কান্না করতে লাগল। এ কান্না কোন কষ্টের নয়। এই কান্না হলো আনন্দের। আর আমার পরী টাকে কতটা ভালোবাসি তা আমার পরী টা বুঝতেই পারে না।
সমাপ্ত