ড্রয়িং রুমে শাড়ি পড়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে নিমিশা। আশেপাশে সব মুরুব্বি আর ছেলেপক্ষের সবাই বসে কথা বলছে। নিমিশার বিয়ের কথা চলছে। পাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাফাত। রাফাত ঠিক নিমিশার সামনের সোফাতেই বসে আছে। কিন্তু ঠিকমত তাকে দেখতেও পাচ্ছে না নিমিশা। বড় আপুর কড়া নির্দেশ, ছেলেপক্ষের সামনে বেশি নড়াচড়া করা যাবে না, চুপচাপ মুখে হালকা একটা হাসি দিয়ে একদম মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে। এটা কোন কথা? যার বিয়ে সেই মাথা নিচু করে বসে থাকবে? দুই একবার তাকানোর চেষ্টা করলেও, পাশে জল্লাদ আপুকে দেখে আর সাহস হয়নি। তাই আড়চোখেই শাড়ির আচলের ফাঁক দিয়ে রাফাতকে দেখার চেষ্টা করছে নিমিশা।
চশমা পড়া, কালো ফরমাল স্যুটে একটা ছেলে রোবটের মত বসে আছে যেন কোন লিডিং কোম্পানিতে চাকুরির ইন্টারভিউ নেয়া হচ্ছে। এই অবস্থা দেখে নিমিশার খুব হাসি পেলেও বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখে। এতদিন জানত ইঞ্জিনিয়ার ছেলেরা অনেক কিউট আর হাসিখুশি হয়, কিন্তু এই ছেলে তো পুরাই বোবট, গুরু গম্ভীর । দুই পরিবার থেকেই বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলেও নিমিশার বাবা দুইজনকে আলাদাভাবে কথা বলতে বলে। প্রথমে ছেলের পরিবার রাজি না হলেও নিমিশার বাবার অনুরোধে দুইজনকে আলাদা কথা বলার সুযোগ দেয়। নিমিশা ভেবেছিল এবার হয়ত ছেলেটা মন খুলে কথা বলবে। কিন্তু কিসের কি? এবার উলটা নিমিশার মনে হল সে কোন চাকুরির ইন্টারভিউ দিতে বসেছে।
বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়, ডেটও। নিমিশার ফাইনাল শেষ হলেই শীতের শুরুতেই বিয়ে। নিমিশা জানত তার বিয়ে এই ছেলের সাথেই হবে। অনেক বছরের পরিচয় ওর বাবা আর হবু শ্বশুরের। বাবার ইচ্ছার কথা অনেক আগে থেকেই জানত সে এবং সেই অনুযায়ীই নিজেকে তখনই প্রস্তুত করে ফেলেছিল। বাবার প্রিন্সেস বলে কথা! ছেলেপক্ষ চলে যাওয়ার পর বাসায় ছোটখাটো একটা উৎসবের সৃষ্টি হয়। সবাই খুশি, মিষ্টি খাচ্ছে, বিয়ের প্ল্যানিং করছে এখনই। নিমিশার মাথায় শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরছে, “ছেলেটা কি এমন পাথরই?!”
প্রথম দিকে নিমিশা নিজেই রাফাতকে ফোন করত। কিন্তু অপর পাশ থেকে শুধু কিছু ফরমাল রিপ্লাই আর হুহা ছাড়া অন্য কোন কথাই আসত না। পরে নিজের ক্লাস, পরীক্ষা নিয়ে বিজি হয়ে যাওয়ার পর আর ফোন দেয়া হয়ে ওঠেনি। দেখতে দেখতে বিয়ের সময় চলে আসে। বাসা ভর্তি আত্মীয় স্বজন। সবাই বিয়ের প্ল্যানিং নিয়ে ব্যস্ত। কাজিনগুলা হলুদে কি কি করবে সেই প্ল্যান করতে করতেই অস্থির। সামনের বুধবার দুইপক্ষ মিলে বিয়ের কেনাকেটা করতে যাবে। এখন থেকেই মায়ের নির্দেশনা চলছে, “বেশি কথা বলবি না ওখানে। যেটা কিনে দিবে সেটাই নিবি। তোকে জিজ্ঞেস করলেও বলবি আপনাদের যা ভাল লাগে এবং ইত্যাদি ইত্যাদি” নিমিশা বিরক্ত হয়ে ভাবে, “নিজের বিয়ের জিনিসও নিজে ঠিক করতে পারব না? এ কেমন মেন্টালিটির মানুষ?” শপিং মলে গিয়ে নিমিশার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। রাফাতের মা আর দুই ভাবি এসেছে, কিন্তু রাফাত আসেনি। তার নাকি অনেক কাজ। মা-কে বলেছে যেটা মন চায় সেটা তার জন্য কিনে নিয়ে যেতে। নিমিশাকে আর তার মা’র কিছু বুঝিয়ে বলা লাগে নাই। নিজেই একদম চুপ হয়ে গিয়েছে। মায়ের পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে ভাবছে, এতকিছু না ভেবে একটা প্রেম করে ফেললেই হত। বাবা রাগ করলেও পরে ঠিকই মেনে নিত। লাভ ম্যারেজগুলা অনেক সুন্দর হয়। কিন্তু না! ওর বোনেরও এরেঞ্জ ম্যারজ। এরেঞ্জ ম্যারেজ গুলাও তো অনেক সুন্দর হয়।
তবে রাফাত এমন কেন? নাকি অন্য কিছু? খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিমিশার মাথায় এসব উলটা পালটা চিন্তা ঘুরতে থাকে। কিন্তু এখন যে আর কিছুই করার নেই তার। নিজের নতুন জীবন নিয়ে অনেক ছোট ছোট সপ্ন ছিল। সব মুহূর্তেই চুরমার হয়ে যায়! বিয়েটা ঠিকঠাক মতই হয়ে যায়। নতুন ঘরটা বেশ সুন্দর করেই সাজানো, সবকিছু খুব সুন্দর করে গোছানো। বুঝাই যাচ্ছে, রাফাত বেশ পরিপাটি। ছেলেদের এত গোছালো হওয়ার ব্যাপারটা একটু অবাক হওয়ার মতই। হঠাত আলমারির দিকে চোখ পড়ে। আলমারির উপরে একটা গিটার প্যাকেট করে রাখা আছে। এটা দেখে নিমিশা যথেষ্ট অবাক হয়। গয়নাগুলা খুলে বক্সে ভরে ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে সেখানে একটা ডাইরি পায়, রিফাতের পার্সোনাল ডাইরি। পড়া শুরু করে। কিছুক্ষণ পড়ে রাফাত রুমে এসে দেখা মাত্রই এক ঝারি দিয়ে হাত থেকে ডাইরিটা নিয়ে আবার রুম থেকে বের হয়ে যায়। নিমিশা কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ড্রেস চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমে চলে যায়। এক-দেড় ঘন্টা পর রাফাত রুমে এসে দেখে নিমিশা রুমে নেই।
ওয়াশরুম,বারান্দা কোথাও নেই। বাসার সবাই ঘুম, অন্য রুমে থাকার কথা না। তাও সে আস্তে আস্তে সব রুমে খুঁজে দেখে। পুরা বাসায় কোথাও নেই। ছাদেও তালা। নিচে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে কেও বাইরে যায়নি। এবার টেনশনে রাফাতের গলা শুকিয়ে যায়। কাজটা মোটেও ঠিক করে নাই সে। রাত প্রায় দুইটা। এত রাতে কই যেতে পারে ভাবতে ভাবতে ডাইনিং রুমে এসে পানি খেতে নিয়ে হঠাত কিসের যেন আওয়াজ পায়। ভালমত খেয়াল করে বুঝতে পারে আওয়াজটা ওই টেবিলের নিচে থেকেই আসছে। চোর মনে করে টেবিলে রাখা ফ্ল্রাওয়ার ভাসটা হাতে নিয়ে নিচু হতেই দেখে, নিমিশা! হাফ-প্যান্ট আর বার্সেলোনার জার্সি পড়া, এক বক্স লাড্ডু নিয়ে মনের আনন্দে লাড্ডু খাচ্ছে সে। প্রথমে নিমিশাকে এভাবে দেখে একটু লজ্জাই পায় রাফাত। এদিকে নিমিশা এতই মনোযোগের সাথে লাড্ডু খাচ্ছে যে রাফাতকে খেয়ালই করে নাই। কাশির শব্দে একটু চমকে উঠলেও পড়ে রাফাতকে দেখে আবার খাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়। বাইরে আসতে বললে উলটা নিমিশা তাকে তার সাথে টেবিলের নিচে বসে লাড্ডু খাওয়ার আর গল্প করার প্রস্তাব দেয়। উপায় না দেখে রাফাতই শেষমেশ টেবিলের নিচে গিয়ে বসে। নিমিশা সাথে সাথে বক্সটা বাড়িয়ে দেয়, রাফাত কিছু না বলে একটা লাড্ডু নিয়ে নেয়। “আপনি এখানে বসে আছেন কেন?” “লাড্ডু খাওয়ার জন্য। সবার ঘুমানোর অপেক্ষায় ছিলাম। তাছাড়া এই গেটআপে দেখলে শ্বাশুরি আম্মু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। তাই টেবিলের নিচে ঢুকে পড়েছি। শীতের সময় না হলে অবশ্য বারান্দায় চলে যেতাম।
এখন এখানেই ভাল” “আপনার লাড্ডু অনেক পছন্দ?” “উহহ অন্নেক বেশি। এতদিন বাসায় এত লাড্ডু ছিল, আপু একটাও খেতে দেয় নাই। আমি নাকি লাড্ডু খেয়ে খেয়ে বিয়ের সময় নিয়েই একটা লাড্ডু হয়ে যাব” “তো এমন ইঁদুরের মত খাওয়ার কি দরকার? রুমে নিয়ে গেলেই তো হয়” “আপনার রুমে আপনার পারমিশন ছাড়া তো কিছু ধরা যায় না। তাই ভাবলাম আবার রাগ করেন নাকি” “অহ আমি সরি। আমি ইচ্ছা করে তখন ওরকম করি নাই। কাজটা একদম ঠিক করি নাই। আই এম রিয়েলি ভেরি সরি। মাফ করে দিয়েন প্লিজ” “ইটস ওকে। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি ইচ্ছা করে করেন নাই। আর আমাকে আপনি করে বলবেন না। আমি তো একটু ছোট আপনার থেকে। হাইটেও, বয়সেও। তাই বলে আমিও আর আপনি করে ডাকতে পারব না। এবার বল ওই ডাইরিতে কি ছিল?” “আমি আসলে সবার সাথে সবকিছু শেয়ার করতে পারি না” “একটা ডাইরির কথাই শেয়ার করতে পার না, আমার সাথে পুরো একটা জীবন শেয়ার করবা কেমনে? নাকি অন্য কিছু ছিল?” এবার রাফাত চুপ হয়ে যায়। কথা ঠিক। এই মেয়েটার সাথেই সে পুরো একটা জীবন কাটাবে।
“ইয়ে মানে তুমি যা ভাবছ তেমন কিছু না” “সেটা আমি জানি। বিয়ের আগে ভেবেছিলাম এক্স ওয়াই যেড এর ব্যাপার। কিন্তু পড়ে বুঝতে পারছি তোমাকে দিয়ে গার্লফ্রেন্ড বানানো সম্ভব হওয়ার কথা না…আরে ওমন করে দেখার দরকার নেই। তুমি যেমন নার্ড আর রোবট টাইপের, গার্লফ্রেন্ড হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ক্রাশ থাকলেও থাকতে পারে। আর যদি থাকতও তাহলে আমাকে আগেই বলতা। কারো লাইফ নিয়ে খেলার মানুষ তুমি না। তাছাড়া তুমি স্মোকও কর না” “ছ্যাকা খেলে স্মোক করা লাগে?” “আরে হ্যা! আমার একটা ফ্রেন্ড ছিল। সে ছ্যাকা খেয়ে খালি স্মোক করত। পারলে ভাতের বদলে সিগারেট খেত। যাই হোক, এবার তোমার কথা বল। কিসের এত রাগ?” “পুরা লাইফটার প্রতিই আমার রাগ।
আমার ফ্যামিলি সবসময় মানুষ কি বলল সেটার উপরে চলে। মানুষ যা ভাল বলবে তাই। বাবার উপরে আমরা কেও কথা বলতে পারি নাই। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা ছিল না কখনোই। বাবার কারণে পরতে হয়েছে। আমার ইচ্ছার তো কোন দামই নাই তাদের কাছে। আমার ইচ্ছা ছিল বিবিএ,এমবিএ করার। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। আমার কথা শোনার জন্য কেও ছিলও না, কারো সময় নেই। তারপর থেকেই আমি এমন। কোন আশা নেই আর লাইফ নিয়ে” “এটা কেমন কথা? কোথায় যেন পড়েছিলাম, ছোট ছোট অপূর্ণতাই বড় কোন পূর্ণতার আগমনবার্তা। যা চলে গিয়েছে গিয়েছে। তখন তোমারও দোষ ছিল কিন্তু। তবে যাই হোক, এখন বাকিটা জীবন এঞ্জয় কর। একটাই তো লাইফ। আর বিবিএ করতে পার নাই তো কি হয়েছে। এমবিএ করে ফেল। আমরা একসাথে করব, ওকে? একসাথে ক্লাস, ফুচকা খাব, বৃষ্টিতে ভিজব, পড়াশোনাও করব।ওয়াও হাউ কিউট” “হাহাহা…ভেবে দেখার বিষয়। তুমি ফুটবল লাইক কর?” “আরে হ্যা। অনেক বেশি। আমি কিন্তু খেলিও ভাল। কিন্তু বুঝলা কেমনে?” “জার্সি দেখে। মেয়েরা সচরাচর জার্সি পড়ে না। আমিও লাইক করি এন্ড সেইম টিম” “গ্রেইট। তাহলে একসাথে খেলা দেখাও হবে। এই তুমি গিটার বাজাও?” “হুম বাজাতাম। কিন্তু এখন বাজাই না। সময়ও পাই না। আর বাসায় কেও পছন্দও করে না। আমার সব কাজই তাদের কাছে অকাজ। কিছু করতে গেলে কেও বিরক্ত হলে আর সেটা করার মুড থাকে না”“কে বলছে কেও পছন্দ করে না? আমাকে শোনাবা। আমি গিটার অনেক পছন্দ করি। আর কি কি শখ আছে তোমার?”
“থাক বাদ দাও। কি হবে সেগুলা শুনে? চল ঘুমাতে যাই” “কি হবে মানে? সব হবে। আমার মেমোরি অনেক শার্প আছে, সবগুলা শখের কথা মনে থাকবে। তারপর সেই সব গুলো পূরণ করা হবে। তোমার গুলাও, আমার গুলাও। দুইজন একসাথে সব শখ পূরন করব। যদি কোন কোনটা মিলে যায় তাহলে তো ব্যাপারতা আরো এক্সাইটিং হবে। আর এখনো তো আমার খাওয়াও হল না। বল বল “উফফ মেয়েটা তো দেখি পুরাই একটা পাগল” রাফাত একটা একটা করে সব বলা শুরু করে। কত কথা জমে ছিল তার মনে! অনেকক্ষণ কথা বলার পর পাশে ঘুরে নিমিশার দিকে তাকানো মাত্রই ফিক করে হেসে দেয় রাফাত। নিমিশা পুরো একটা লাড্ডু মুখে পুড়ে চোখ দুটো বড় বড় করে গভীর মনোযোগের সাথে রাফাতের কথা শুনছে। এখন নিমিশাকেই আস্ত একটা লাড্ডুর মত দেখা যাচ্ছে! রাফাতকে থেমে যেতে দেখে কথা বলতে না পেরে হাত দিয়েই কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করে।
রাফাত অবাক হয়ে নিমিশার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেই ছেলেটার কোন কথার গুরুত্বই কেও দিত না, যেই ছেলেটা এতদিন শুধু অন্যের কথামত চলে এসেছে, আজ তার কথা কেও এতটা গুরুত্ব দিয়ে শুনছে। নিমিশা ঠিকই বলছে, ‘ছোট ছোত অপূর্ণতাই বড় কোন পূর্ণতার আগমনবার্তা। আর রাফাতের জীবনে সেই পুর্ণতা হল নিমিশা। আজ আবার রাফাতের নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করছে, নতুন করে সপ্ন দেখতে ইচ্ছা করছে, নতুন করে ক্যানভাসে রঙ দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু একা না, নিমিশার হাত ধরে। আজ প্রথম কাওকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালবাসতে ইচ্ছা করছে। এই কিউট লাড্ডুটার হাত ধরে পুরো একটা জীবন প্রচন্ড ভালবাসা নিয়ে কাটিয়ে দেয়াই যায়। উহু একটা জীবনও হয়ত অনেক কম হয়ে যায়! রাফাতের কথা বলা চলতেই থাকে, নিমিশাও মনোযোগ দিয়ে সবকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনছে। ঘড়ির কাটার সাথে টিকটক টিকটক করতে করতে রাত প্রায় শেষের দিকে, সেই সাথে বক্সের লাড্ডুও! নতুন সকালের অপেক্ষা, যেই সকাল সূচনা ঘটাবে লাড্ডুর মত মিষ্টি এক ভালবাসার গল্পের!