হুজুর স্বামী

হুজুর স্বামী

আমি তখন অনার্স (BSc) চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। আমাদের কলেজের আবু সাঈদ স্যার ছিলেন সেই মাপের একজন জীববিজ্ঞানের শিক্ষক। খুব ভালো বোঝাতে পারতেন তিনি। আমরা কয়েকজন স্টুডেন্ট মিলে তার কাছে প্রাইভেট পড়তাম। স্যার ছিল খুব রসিক টাইপের মানুষ। আবার যখন রাগ ধরবে, তখন হাতের সামনে যাকে পাবে তাকে পিটিয়ে সাইজ করবে। ওহ্ হ্যাঁ, স্যার শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি একটা বেসরকারী মেডিকেলে ডাক্তারিও করতেন। তাই যখন তখন যেকোনো অসুস্থতা দেখা দিলে আমরা স্যারের চেম্বারে গিয়ে তার সাথে শেয়ার করতাম।

তো যাইহোক, সেদিন কলেজ থেকে ছাত্রীনিবাসে ফেরার পথে রাস্তা পার হতে যেয়ে একটা বাইকের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাই। ভাগ্যিস বাইকটা স্লো আসছিল। নইলে ততক্ষণে ভোগে যাইতাম। গুরুত্বর আগাত না পেলেও পড়ে যাওয়াতে হাত-পায়ের কিছু অংশ কেটে গিয়ে রক্ত ঝড়ছিল। আমার লাইফে এটাই প্রথম রোড এক্সিডেন্ট। তীব্র ব্যথা আর এরকম রক্ত ঝড়া দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। আমার রুমমেট তানিয়া ও আরো দু’জন ফ্রেন্ড সি.এন.জিতে করে আমাকে নিয়ে স্যারদের হসপিটালে নিয়ে গেল। তৎপর দ্রুত স্যারের কেবিনে নিয়ে আসলো। হাঁটতে পারছি না। পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। স্যার আমাকে এরকম দেখে একটু রাগান্বিত হয়ে বলতে লাগলেন- ‘রাস্তা-ঘাট দেখে শুনে চলাচল করতে পারো না! আল্লাহ্ না করুক, এতক্ষণে যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তাহলে কী হতো!’ তানিয়া আমার হাতের কাটা জায়াগায় রুমাল দিয়ে শক্ত করে পেঁচিয় ধরে আছে। তবুও ফিনিক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রনায় আমার জীবন যায় যায় অবস্থা। পাশ থেকে অপর দুজন ফ্রেন্ড বলে উঠলো- ‘স্যার, বকা-ঝকা পরে হবে। এখন যা করার দ্রুত করেন।’

স্যার আমাকে কেবিনের বেডে শুয়াতে বলল। প্রথমত ক্ষত থেকে রক্তপাত বন্ধ করার ব্যবস্থা করলেন। তারপর আমার হাতের ক্ষতাংশটি স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে আন্টিসেপ্টিক ভায়োডিন দ্রবণ ও ডিটল দিয় বেন্ডেজ করে দিলেন। অনুরূপভাবে পায়েও বেন্ডেজ করে দিলেন। পরিসমাপ্তিতে ‘টিটেনাস ইনজেকশন’ দিলেন এবং প্রেকসিপশনে কিছু ব্যথানাশক ওষুধের নাম লিখে দিলেন। তারপর হসপিটালের বেডে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বললেন। আমি শুয়ে আছি। হঠাৎ বাম পাশে মাথা ঘুরার সাথেই আমি চমকে উঠলাম। ইয়ে মানে, একটা ছেলের উপর ক্রাশ (কাউকে প্রথম দেখার পর থেকে তাঁর প্রতি অদ্ভুত এক ধরনের আকর্ষণবোধ করাকেই ক্রাশ বলে।) খাইছি। কি অদ্ভুত ধরনের মায়াবী হাস্যোজ্জ্বল মুখ! শরীরের রঙ কাঁচা হলুদের ন্যায় তুল্য। মুখে নব্য কৃষ্ণ বর্ণের দাড়ি। তাঁর দিকে দেখতে দেখতেই ইতঃপূর্বের হাত-পায়ের ব্যথাগুলো মনে হচ্ছে উধাও হয়ে গেল। তাকে আবিষ্কার করলাম- কাউকে হয়তো রক্ত দেয়ার জন্যই এখানে এসেছে। তাঁর শরীর থেকে রক্ত ডোনেট করা হচ্ছে। মনে মনে বলতে লাগলাম- ‘আমৃত্যু সাধনার বিনিময় হলেও এই জীবনে তোমাকে চাই। তোমার প্রতি যে আমি সত্যিই দূর্বল হয়েছি। কী তোমাকে পাবো এ জীবনে?’

কিছুক্ষণ পর ছেলেটা রক্ত ডোনেট করে চলে গেল। ভুলেও আমার দিকে একবারও চোখ তুলে তাকালো না। বরং মাথা নিচু করে স্থান ত্যাগ করল। কী এলিয়েন মার্কা পোলা মাইরী! ধেৎ, আর হসপিটালে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। ছেলেটা আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো আরও থাকতাম। অচেনা, অজানা ও অপরিচিত একজন ব্যক্তি। জানি না, তাকে আর কখনো দেখতে পারব কি-না। যাক, ভাগ্যে থাকলে এমনিই হবে। না হয় স্যারের থেকে তার সম্পর্কে বায়ো-ডাটা নিয়ে যোগাযোগ করব। নিশ্চয়ই স্যারের কাছে কিছুটা হলেও তথ্য পাবো। অন্তপক্ষে নামটা তো জানতে পারব! দু’দিন পর কিছুটা সুস্থবোধ মনে হচ্ছে। তাই কোনোমতে প্রাইভেটে গেলাম। যাওয়ার সাথেই স্যার বলতে লাগল- ‘তোমার বিচার আছে। কঠিন বিচার!’ ‘আমি আবার কী করলাম স্যার?’ ‘না কিছু নয়। ব্যথা ভালো হয়েছে?’ ‘জ্বী স্যার। তবে আপনাদের হসপিটালে যেয়ে ক্রাশ রোগে আক্রান্তিত হয়েছি। এই ব্যথা থেকে কেমন করে মুক্ত পাব স্যার?’ ‘হোয়্যাট? এটা আবার কী? তুমি কি বলতে চাইতেছ?’ ‘এখন না স্যার। ফোনে ব্যক্তিগতভাবে আপনার সাথে কথা বলব।’

প্রাইভেট শেষে ছাত্রীনিবাসে ফিরে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে বিকালের খাবার খেয়ে স্যারকে ফোন করলাম- ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’ ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ বলো।’ ‘স্যার, আপনি তো আমার বাবার বয়সী লোক। যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা বলতে চাই। প্লিজ স্যার।’ ‘আরে বল কি বলবি। আবার অনুমতির কি আছে!’ ‘আমি সেদিন যখন আপনাদের মেডিকেলে ছিলাম, তখন আমার বেডের কিছুদূর পাশের বেডে যে ছেলেটা রক্ত ডোনেট করল। তাকে চিনেন? প্লিজ, তার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিন স্যার। ছেলেটাকে আমার খুব ভালো লেগেছে।’ ‘কী?’ শুধু এতটুকু বলেই স্যার ফোনটা হুট করে কেটে দিলেন। এর পর বারবার ফোনে ট্রাই করেও স্যারকে পাইনি। আমি মনে মনে প্রচণ্ড ভয় পেতে লাগলাম। স্যার যদি এসব বাড়িতে বলে দেয়, তাহলে আব্বু আমাকে মেরেই ফেলবে। আব্বু বড় আপুর পড়ার টেবিলে একটা কোনো ছেলের চিঠি পেয়েছিল। আর এজন্যি আপুকে কত শাস্তি দিয়েছিল, তা সহ্য করার মতো নয়।

রাত ৮টার পর স্যার নিজেই আমাকে ফোন দিল। ভয়ে ভীতুচ্ছন্ন হয়ে ফোনটা রিসিভ করলাম। স্যার বলতে লাগল- ‘তুই চিন্তে করিস না। কালকে আমার সাথে একবার দেখা কর। আর তোর বাবার ফোন নাম্বারটা দে।’ ‘কিন্তু স্যার ‘কোনো কিন্তু নয়। তুই নিশ্চিন্তে আমাকে নাম্বারটা দে।’ আমি স্যারকে বাবার ফোন নাম্বার দিলাম। স্যার বাবার সাথে ফোনে কি আলাপ করেছে তা জানি না। তবে কথা মতো পরের দিন স্যারের সাথে দেখা করলাম। স্যার আমাকে বলতে লাগল- ‘ছেলাটাকে কি তোর খুব পছন্দ হয়েছে?’ আমি কোনো কথা না বলে নিশ্চুপ রইলাম। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ, এটা স্যার সহজেই বুঝতে পেরেছে। তাই প্রসঙ্গ এড়িয়ে আবার আমাকে প্রশ্ন করল- ‘তুমি কি নামাজ পড়ো?’ ‘আগে পড়তাম। ইদানীং অলসতার কারণে আর পড়া হচ্ছে না স্যার।’ ‘তাহলে কিভাবে সম্ভব?’ ‘প্লিজ স্যার, এখন থেকে নামাজ পড়ব।’

‘তাহলে শুনো, ছেলেটার নাম আতিক। গত দুই বছর আগে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে একটা বেসরকারী কম্পানিতে জব করত। কোনো কারণ বশত চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছে। সে আগে এরকম হুজুর টাইপের ছিল না। কিন্তু কিভাবে যে এতটা পরিবর্তন হলো তা আমি জানি না। হ্যাঁ, সে আমারই একমাত্র ছেলে।’
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে বললাম,- ‘স্যার ‘কি, অবাক হচ্ছিস? আরে তুই কোনো চিন্তে করিস নে মা। আমি তোর বাবার সাথে বিয়ের কথাও পাকা করেছি।’ ‘কিন্তু আতিক কি আমাকে দেখেছে? সে কি রাজি?’ ‘আরে ধুর! সে তোমার নাম শুনেই রাজি হয়েছে।’ ‘স্যার ‘এখনো স্যার ডাকবি!’ ‘কি বলে ধন্যবাদ দিব স্যার?’ ‘তুই কি বলছিস এসব!’ ‘হিহিহি ‘বিয়ে কিন্তু সামনে মাসের দুই তারিখেই হবে।’ ‘এত তাড়াতাড়ি! কিন্তু আমার এক্সামের কি হবে? ছয় মাস পর তো অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম!’ ‘কোনো টেনশন করিস না। পড়া-লেখার ক্ষেত্রে আতিক খুব এক্সপার্ট আছে। পরীক্ষার আগে সব কভার করে দিবে।’ আমি স্যারের প্রতি কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব বুঝতে পারছি না। এ মুহূর্তে আমি এতটাই আনন্দিত যে, এটাও লিখে প্রকাশ করার মতো নয়। স্যারের সামনে মাথা নিচু করে কোনো রকম ‘শুকরিয়া’ কথাটা বলে বিদায় নিলাম।

কথানুযায়ী এক মাস পর আমাদের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। ফুলশয্যার রাত্রিতে আপাদমস্তক ঘোমটা দিয়ে খাটের উপর কনে সেজে বসে রয়েছি। অপেক্ষার প্রহর আর কত! অবেশেষে কক্ষের দুয়ারে এসে উপস্থিত সেই সুদর্শনী যুবক। যার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম এতদিন ধরে। সে এসেই আমাকে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?’ এমনভাবে সালাম দিলো যেন অনেক আগের-ই পরিচিত কেউ। আমি নিম্নস্বরে সালামের প্রত্যুত্তর দিলাম। সে আমার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে কপালে চুমো এঁকে দিয়ে কি যেন একটা দোয়া পড়ল। সেদিন ছিল শুক্লাদ্বাদশীর রাত্রি। ডিম লাইটের নিষ্প্রভ আলোতে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছি। সে মাথা নিচু করে বলতে লাগল, চলো দু’রাকাত নামাজ আদায় করে নিই।

নামাজ শেষে সে আমাকে ঘুমাতে বললো। কিন্তু সে? সে না ঘুমিয়ে টেবিল লাইটের তীব্র আলোতে কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করতে লাগল। মনে মনে বলতে লাগলাম, ‘নব বধুকে কাছে পেয়েও যাওনি হে যুবক আল্লাহকে ভুলে! সাবাশ হে যুবক সাবাশ!’ আমি আবারও অনিমেশ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে-ই আছি। এই হলো আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ক্রাশ- হুজুর স্বামী। এখনো সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর আমি পাগলীর মতো ভালোবাসি। হুজুর ইজ অলওয়েজ হুজুর এন্ড পাগলা-পাগলীর ভালোবাসা ইজ্রিয়েল।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত