বিয়ের রাত

বিয়ের রাত

বিয়ের দিন রাতে ইয়াসির যখন দরজা বন্ধ করে আমার কাছে আসছিলো, আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের পারিবারিকভাবেই খুব হঠাৎ করেই বিয়েটা হয়েছিল। জাস্ট যেদিন দেখতে এসেছিলো সেদিনই ওর সাথে আমার হালকা কথা হয়েছিল।

এর আগে কখনো মা’কে ছাড়া একা কোথাও থাকা হয়নি। মনের মধ্যে অন্য রকম নার্ভাসনেস কাজ করছিলো। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ খাপ খাওয়াতে পারব কি না? গ্রামের মেয়ে, শহরের ছেলে, শহুরে পরিবেশ কীভাবে সব মেনেজ করবো? সে কেমন মানুষ হবে? তারউপর মা’য়ের জন্য খুব প্রাণ কাঁদছিলো। এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে এমনিতেই হাত, পা কাঁপছিল। ইয়াসির রুমে এসে যখন বিছানায় বসলো আমার কম্পন কয়েকগুণ বেড়ে গেলো! সে বিয়ের রাতে আমাকে আন্টি পড়িয়ে দিচ্ছিলো, আর আমার হাত এমনভাবে কাঁপছিলো, যেমনটি প্রচণ্ড শীতে গ্রামের পুকুরে গোসল করে উঠার পর হয়।

তখনই সে খুব সহজভাবে বললো, এভাবে কাঁপছেন কেন? আমাকে দেখতে কি খুব বেশী ভয়ঙ্কর মনে হয়? আমি ঘোমটার ভেতর চুপ হয়ে ছিলাম, কিছুই বলিনি। সে আবার বললো, কি হলো, চুপ করে আছেন যে? খুব নার্ভাস কি? আমি আস্তে করে বললাম, ভয় হচ্ছে, ইয়াসির আমার কথার দিকে কর্ণপাত না করে, ঘোমটা উটিয়ে বললো, এই যে আমাকে দেখুন, আমাকে কি ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে? আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। সে খুব হালকা গলায় বললো, আচ্ছা বাবা, আমি আপনাকে দেখবো না, ভয় পেতে হবে না। জানেন, আপনাকে যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম, সেদিনই আপনাকে আমার বেশি ভালোলেগেছিল।

এতো ভারি শাড়ি, গহনা, মেকাপ আপনার সত্যিকারের সৌন্দর্য্যকে ম্লান করে রেখেছে। জানি আপনারও খুব অস্বস্তি হচ্ছে এসব পড়ে, সেজে থাকতে। আপনি বরং এসব চেইঞ্জ করে, ফ্রেস হয়ে নিন। কিন্তু আমি তো শুধু আপনার জন্যই সেজেছি। হুম, আমার জন্যই সেজেছেন, তাই তো আমার রুপসি বউটাকে আমি ছাড়া গায়রে মহরাম কেউ দেখেনি। আমার বউটা এতই সুন্দরী যে এসব মেকাপ, গহনা আমার বউয়ের রুপের কাছে লজ্জা পেয়ে যাবে।

সত্যি আমি এসব ভারি শাড়ি আর গহনায় খুব আনইজি ফীল করছিলাম। ওর এসব কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলাম।
আর আমি জানি, আমি তেমনটা সুন্দরি নই। হয়তো আমাকে খুশি করার জন্য সে এসব বাড়িয়ে বলেছে অথবা আল্লাহ আমাকে ওর চোখে সুন্দর করে দিয়েছেন। অনেকটা সহজ হলেও ভয়টা এখনো যায়নি। চেঞ্জ করে হালকা হেটে বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। সে আমার পরনের শাড়িটা নিয়ে ভাঁজ করছিলো। আমাকে দেখে শাড়িটা একপাশে রেখে আমাকে দুই বাহু ধরে খাটে বসিয়ে দিলো। আমার মুখে মুচকি হাসি ফোটে উঠলেও বুকের ভেতর ড্রাম বাজতেছে।

জানি আমাকে সহজ করার জন্যই এত ফ্রিভাবে সে কথা বলছিল। আমার অবস্থা বুঝে বললো, এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আপনার যদি ঘুম পায় ঘুমিয়ে যেতে পারেন। যদি না চান, আমি আপনাকে স্পর্শও করবো না। আপনাকে শুধু আজকের জন্য বিয়ে করিনি, সারাজীবনের জন্য আমার করে পেয়েছি। আমাদের বিয়েটা যেহেতু অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ যতক্ষণ আপনি আমার সাথে ফ্রি হতে পারবেন না, আমরা বন্ধু হয়ে থাকবো। কি আপত্তি আছে তো আমার বন্ধু হতে? আমি সবসময় চেয়েছি, আমার স্ত্রীই হবে আমার একমাত্র মেয়ে বান্ধবী। অহ হ্যা, আপনাকে কিন্তু এখন দারুণ লাগছে। আমি মুখে কিছু না বলে, মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বন্ধুত্ব করারোপণ সম্মতি জানালাম। সেও মুচকি হেসে বললো, জানেন? আমিও এমনই, এত ছোট ঠোঁটটা নেড়ে জবাব দিতে পারি না, এত বড় মাথাটা নেড়েই ‘হ্যা’ ‘না’ জবাব দিই।

এবার সত্যি আমার হাসি পেয়ে গেলো খুব বেশি করে। আমি নতুন বউ, বিয়ের প্রথম রাতে তো আর জোরে হাসতে পারি না। হাসিটা চেপে রেখে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে বললো, সুমু, তুমি কি জান? তোমার হাসিটা খুব বেশি সুন্দর। আর হাসি চেপে রাখলে কিন্তু অনেক প্রব্লেম হয়। এবার সত্যিই না হেসে পারলাম না। এই মানুষটি মন ভালো করে দিতে উস্তাদ। ইয়াসির আবার হেসে বললো, ওহ আপনার জন্য, কিছু একটা রেখেছি। বলে আমার হাতটা ধরে ওয়াল কেবিনেটের সামনে নিয়ে গিয়ে, কেবিনেটের ভেতরে ছোট একটা কেবিনেটে বেশ কয়েকটা বিভিন্ন আচারের বয়াম।

আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার আচার খুব পছন্দ, আমি উনাকে বলিনি। হয়তো ভাইয়ের কাছ থেকেই শুনেছে। কিন্তু এই কয়দিনে সে কীভাবে কালেক্ট করলো। আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবার ইয়াসির বললো, আপনি আচার খেতে ভালোবাসেন, তাই আপনার জন্য আচার এনে রেখেছি। নিন যত ইচ্ছা খান। আমার জানা নেই কোন বর, বিয়ের রাতে বউকে এতগুলা প্রিয় খাবার গিফট করেছে কি না। এবার কেন জানি না কীভাবে বলে ফেললাম, বললাম, আপনি আগে তুমি করে বলেন, তারপর আপনার সব কথাই শুনবো। আচ্ছা ওকে বাবা, বলবো। আরো একটা উপহার আছে। আপনার বয়েসটা কিন্তু দারুণ। মাতাল করে তোলে, মাদকতা জড়ানো।

আবার আপনি, অহ, তুমি, তুমি তুমি। বলে কেবিনেটের অপর পাশটা খোলল, দেখলাম অনেকগুলা ধর্মীয় বই, বোখারি, মুসলিম শরীফ। তাফসীর ইবনে কাসির। বললো, আমার এত বই পড়ার সময় হয় না। বই পড়ি না বললেই চলে। তুমি বই পড়তে ভালোবাসো বলেই তোমার জন্য, বইগুলা কিনেছি। তোমার কেমন বই পছন্দ জানি না। আন্দাজ করে নিয়েছি। তোমার ভালোলেগেছে? আমি অবাক হয়ে, পরম নির্ভরতায় ওকে হাতটা জড়িয়ে ধরে অনেক অনেক শুকরিয়া জানালাম, মহান আল্লাহর এবং উনার।

যে আমি কিছুক্ষণ আগে উনার স্পর্শেও ভয় পাচ্ছিলাম সেই আমিই উনার হাত ধরে ফেলেছি বলা যায় জড়িয়ে ধরেছি, নিজেই বুঝতে পারিনি। উনি শুধু আমার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছিল। হয়তো মনে মনে বলছিল, আমাকে সহজ করার উনার প্রচেষ্টা সফল হলো। বিছানায় ঘুমাতে যাওয়ার সময় বললেন, তোমার আনইজি লাগলে, আমি ফ্লোরে বিছানা পেতেও ঘুমাতে পারি। না, আমার একা ঘুমাতে ভয় করে, আর বোনের সাথে ঘুমাতে ঘুমাতে কারো গায়ের স্পর্শ না লাগলে ঘুম আসে না।

সে তার ভুবনজয়ী মিষ্টি হাসিটা দিল, যা আমায় পাগল করে তুলে। আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হলো, সেদিন ওকে বলেছিলাম, ইয়াসির তোমার মনে আছে, বিয়ের দিন কত সুন্দর করে আমাকে সহজ করেছিলে। কীভাবে পারলে? তোমায় প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি বলে। ভালোবাসাকে জোর করে আদায় করা যায় না। ভালোবাসা দিয়েই আদায় করতে হয়। আর যদি প্রথম দেখায় ভালোবাসা না হতো? তখন নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে?

না কখনো নয়, কারণ, তুমি নিশ্চয় জানো, ইসলাম স্ত্রীদেরকে স্বামীর চাহিদার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছে, কিন্তু স্বামীকে নিজ চাহিদা আদায়ের ব্যাপারে উগ্র হবার কোন অনুমতি যেমন দেয়নি তেমনি স্বামীকেও স্ত্রীর চাহিদার প্রতি যত্মবান হবার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম স্ত্রীকে বলেছে যদি রান্নরত অবস্থায়ও স্বামী প্রয়োজনে ডাকে তবে সে যেন সাড়া দেয়, অন্য দিকে পুরুষকে বলেছে সে যেন তার স্ত্রীর সাথে ভালো আচরণ করে, স্ত্রীর কাছে ভালো সাব্যস্ত না হলে সে কিছুতেই পূর্ণ ঈমানদার বা ভালো লোক হতে পারবে না। এই কথা জানার পরও কোন পুরুষ কি স্ত্রীর সুবিধার প্রতি কোনরূপ লক্ষ না রেখেই যখন তখন তাকে নিজের প্রয়োজনে ডাকবে? ইসলাম পুরুষকে এব্যাপারেও সাবধান করে দিয়েছে যে নিজের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে স্ত্রীর চাহিদার কথাকে সে যেন ভুলে না যায়।

ইসলামে, রাসুল (স:) হাদীসটি যেমন বলেছেন, যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীকে বিছানায় ডাকে (যেমন- সঙ্গম করার জন্য), আর সে প্রত্যাখান করে ও তাকে রাগান্বিত অবস্থায় ঘুমাতে বাধ্য করে, ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত তাকে অভিশাপ করতে থাকে। (সহীহ : বুখারী ৩২৩৭, মুসলিম ১৪৩৬, আবূ দাঊদ ২১৪১) এই হাদীসটিও কিন্তু আছে, রাসুল (স:) বলেন, ঈমানওয়ালাদের মধ্যে পরিপূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার আচার-আচরণ উত্তম। আর তোমাদের মাঝে তারাই উত্তম যারা আচার-আচরণে তাদের স্ত্রীদের কাছে উত্তম। (তিরমিযি, হাদিস নং ১০৭৯)

আমি কি প্রথম রাত থেকেই তোমার কাছে উত্তম হওয়ার চেষ্টা করবো না? বিয়ে একপ্রকার ইবাদত। এই ইবাদতের প্রথম রাত থেকেই কেন জোর করে আদায় করবো। হালায় উপায়ে নিজের অধিকার আদায় করাও সওয়াবের। আর সেই সওয়াবটাই কেন আমি জোর করে আদায় করে নিব? আর আমি যদি জোর করি তোমার কাছে উত্তম হলাম কীভাবে?

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত