ভালবাসার বাতিঘর

ভালবাসার বাতিঘর

-জানো দুপুরে ঘুমালে কি হয়?
-কি হয়?
-তেমন কিছু না।ওজনটা ষাট থেকে পচাত্তরে গিয়ে দাঁড়ায়।
আমার কথায় সুপ্তি কিছু বললো না।তবে এটুকু বুঝতে পারলাম যে,ও নিজেকে কেমন যেন আড় চোখে দেখার চেষ্টা করছে।হয়তো ভাবছে ঘুমানোর কারনে ওর নিজের কোন পরিবর্তন হলো কিনা।
আমি কিছু বলার আগেই সুপ্তি মুখ গোমড়া করে বললো,
-তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি?
আমি মেয়েটার কথায় মুচকি হেসে বললাম,

-আমি কখন সেটা বললাম।তবে এভাবে চলতে থাকলে ওরকম হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
আমার কথায় সুপ্তির রাগটা মনে হয় একটু বেড়েই গেলো।মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনার কেমন মেয়ে পছন্দ?
সুপ্তির কথায় আমি হাসি আটকে রেখে আস্তে করে বললাম,
-আর যাই হোক,ওরকম ঘুম কাতুরে আর ওজনটা ষাট থেকে পচাত্তরে গিয়ে দাঁড়ানো মেয়ে পছন্দ না।
কথাটি বলে আমি দাঁড়ালাম না।ছাদ থেকে নেমে এলাম।তবে এসময় মেয়েটার মুখের অবস্থাটা কেমন ছিল এটা হয়তো জানি না।কিন্তু সেটা যে মোটেই স্বাভাবিক ছিল না এটা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছি।

শফিউল সাহেবের সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয় সেদিন বেশ শীত ছিল।সন্ধ্যার পর যখন আমি ওনার বাসার ড্রয়িংরুমে বসে রিতিমত কাঁপছি তখন উনি মাত্রই গোসল করে বের হলেন।

আমি ওনার দিকে বেশ কিছুক্ষন অবাক চোখেই তাকিয়ে ছিলাম।এই বয়সে লোকটা গোসল শেষে দিব্বি হাসিখুশি মুখ নিয়েই আমার সামনে এসে বসলেন।দেখে মনেই হচ্ছে না যে উনি মাত্রই গোসল করে আসলেন।ওনার এ অবস্থা দেখে আমার কাঁপুনিটা নিমিশেই দূর হয়ে গেলো।

আমি কিছু বলার আগেই শফিউল সাহেব হাসিমাখা মুখে বললেন,
-তো ইয়াং ম্যান কেমন আছো?
-জ্বী ভাল।আপনি?
-আমাকে দেখেই বুঝতে পারছো আমি কেমন আছি।
লোকটার কথায় আমি মুচকি হেসে আমি মাথা নাড়ালাম।আমি একটু চুপ থেকে বললাম,
-আসলে আমি এসেছিলাম….
শফিউল সাহেব আমাকে পুরো কথা বলতে না দিয়ে উনি বললেন,
-হ্যা জানি কেন এসেছো।তোমার যদি রুমগুলা পছন্দ হয় তাহলে তুমি কালই এসে উঠতে পারো।
-আমিও সেটাই চাচ্ছিলাম।আচ্ছা তাহলে আজ আমি উঠি।
-কি বলো,অন্তত চা খেয়ে যাবে তো।
শফিউল সাহেবের কথায় আমি মুচকি হেসে বললাম,
-আজ না।এখন থেকে তো প্রতিদিনই দেখা হবে।অন্য কোন দিন আসবো।
-আরে বাবা স্পেশাল চা,তুমি খেয়েই দেখো।আমার মেয়ে বেশ ভাল চা বানায়।
লোকটার কথায় আমি আর না করতে পারলাম না।ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও আমি সোফায় বসে পড়লাম।আসলে এখান থেকে অফিসটা বেশ কাছেই হয়,তাই বাসাটা নেওয়া।

আমি চায়ে চুমুক দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালাম।কতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম খেয়াল নেই।তবে এরকম মিষ্টি মেয়ের হাতের চা যে খারাপ হবে এটা ভাবাও বোকামি ছাড়া কিছু না।খারাপ হতেই পারে না।কোন ভাবেই না।কিন্তু আমার মত মেয়েটা যে আমাকেও আড় চোখে দেখছে এইটা আমার চোখ এড়ালো না।
আমি আর বসলাম না।এদিকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে।আর এতক্ষন রুমের ভেতরে আমি যে শীতটা অনুভব করেছি সেটা এখন বেশ প্রকট আকার ধারন করেছে।আমি লিফটে না চড়ে সিড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম।এতে হয়তো শীতটা একটু কমতে পারে।তবে মনে হচ্ছে না এতে খুব একটা কাজ হবে।আমি গেইট দিয়ে বের হওয়ার আগে শেষ বারের মত আরও একবার বিল্ডিংটার উপরের দিকে তাকালাম।বাইরে থেকে দেখতে যতটা সুন্দর ভেতরটা এর থেকে একটু বেশিই সুন্দর।

আমাকে যখন কেও একজন পেছন থেকে ডাক দিল তখন আমি গেইট দিয়ে বের হয়ে বাইরে এসে দাড়িয়েছি।আমি ঘুরে দাড়াতেই দেখি বাড়িওয়ালার সেই মিষ্টি মেয়েটা।আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা আমার দিকে একটা চাদর এগিয়ে দিয়ে বললো,

-বাবার সামনে আপনার শীতে কাপুনিটা লুকাতে পারলেও আমি কিন্তু ঠিকই বুঝেছি।ধরুন এটা নিন।
আমি মেয়েটার কথায় চাদরটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
-ধন্যবাদ।কিন্তু এটা ফেরত দেবো কিভাবে?

আমার কথায় মেয়েটা এবার একটু জোরেই হেসে উঠলো।আমি কি কিছু ভুল বললাম নাকি!তবে মেয়েটা সাথে সাথে হাসিটাও বেশ মিষ্টি।মেয়েটা হাসি থামিয়ে বললো,

-আপনি নিশ্চই বাসাটা অন্যকারও জন্যে নেননি।সো আপনি না চাইলেও আপনাকে এখানে আসতেই হবে।তখন না হয় দিয়ে দেবেন।

কথাটি বলে মেয়েটা আর দাঁড়ালো না,ভেতরে চলে গেলো।আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বেকুবের মত।আসলে দু দিন পর থেকে যে আমাকে এখানেই থাকতে হবে এইটা একদমই মাথায় ছিল।আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না।শীতে একদম করুন অবস্থা।আমি চাদরটা গায়ে জড়িয়ে এই পিচ ঢালা রাস্তায় সোডিয়ামের আলোতে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে আবার বিল্ডিংটার দিকে তাকালাম।তিন তলার বেলকুনিতে আমি একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেলাম। আলো না থাকায় মুখটা দেখা না গেলেও আমার বুঝতে বাকি রইলো না কে ইনি।আমি আর দাঁড়ালাম না।তবে মনে হচ্ছে আজ শুধু বাসা ভাড়া নেইনি,সাথে অন্যকিছুও নিয়ে যাচ্ছি।অন্য কিছু।

বাড়িওয়ালার সেই মিষ্টি মেয়েটার নাম যে সুপ্তি এইটা আমি জেনেছিলাম মেয়েটাকে চাদরটা ফিরিয়ে দেওয়ার সময়।তবে সেদিন ওর নামটা ছাড়া কিছুই জানতে পারিনি।আসলে কিছু বলতেও পারিনি।
তবে কিছুদিন যেতেই এটুকু বুঝলাম যে সুপ্তির সাথে সুপ্তির বাবাও আমাকে বেশ পছন্দ করে।মাঝে মাঝে শফিউল সাহেব নিজেই আমার রুমে চলে আসেন।খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ।ওনাকে সঙ্গ দিতে আমারও খারাপ লাগে না।বেশ মিশুক,সাথে মজার একটা মানুষ।

সুপ্তির মা মারা যাওয়ার পর শফিউল সাহেব ই মেয়েকে আগলে রেখেছেন।উনি আমার সাথে এমন কিছু শেয়ার করেন যে মাঝে মাঝে মনে হয় আমি ওনার খুব কাছের কেও।খুব কাছের।

আজ প্রায় সপ্তাহ খানেক হবে সুপ্তির সাথে দেখা হয় না।একবার ভাবলাম ওদের বাসায় গিয়ে দেখে আসি কিন্তু কেন যেন যেতে পারলাম না।অবশ্য ওদের বাসায় যে আমি যাইনি তেমন না।কিন্তু এই বিষয়টা একটু ভিন্ন রকম।ওকে ছাড়া যে এতটা খারাপ লাগবে ভাবতেও পারিনি।

এসব ভাবতে ভাবতে আমি সিড়ি দিয়ে নামতেই শফিউল সাহেবের সাথে দেখা।আমাকে দেখেই উনি দাঁড়িয়ে গেলেন।তবে আজ ওনার মুখটায় কেমন যেন মলিন ভাব আমি লক্ষ করলাম।আমি কিছু বলার আগেই শফিউল সাহেব আমার দিকে মলিন মুখেই তাকিয়ে বললো,

-কেমন আছো বাবা?
-জ্বী চাচা ভাল।কিন্তু আপনি মনে হয় ভাল নেই।
আমার কথায় লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-মেয়েটা কয়েকদিন হলো কি হয়েছে কিছুই বুঝতেছিনা।
সুপ্তির আবার কি হলো।ও কি ঠিক আছে।হঠাৎ ই আমার বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো।আমি কিছু বলার আগেই উনি আবার ও বললেন,

-কিছুদিন হলো ঠিকভাবে খাচ্ছে না,ঘুমাচ্ছে না।কিছু জিজ্ঞেস করলে কিছু বলছেও না।বাবা তুমি কি একটু মেয়েটার সাথে কথা কথা বলে দেখবে।আমার মনে হয় তোমাকে ও সব বলবে।

শফিউল সাহেবের কথায় আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে মেয়েটা কেন এমন করছে।সুপ্তি যে আমার কথাটা এতটা সিরিয়াস ভাবে নেবে ভাবতেও পারিনি।আমি শফিউল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আপনি চিন্তা করবেন না।আমি দেখছি,সব ঠিক হয়ে যাবে।

কথাটি বলে আমি শফিউল সাহেবের সাথে ওনার বাসায় আসতেই উনি সুপ্তির রুমটা ইশারায় দেখিয়ে দিলেন।আমি ওনাকে অভয় দিয়ে সুপ্তির রুমের দিকে আগালাম।

আমি যখন সুপ্তির রুমে তখন মেয়েটা বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আকাশপানে চেয়ে আছে।হয়তো আমাকে লক্ষ করেনি।আমি সুপ্তির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,

-কেও একজন নাকি ঠিকভাবে খাচ্ছে না,ঘুমাচ্ছে না।
আমার কথায় মেয়েটা ঘুরে তাকিয়ে আমাকে দেখে একটু চমকেই উঠলো।কিছুটা চুপ থেকে বললো,
-সেটা আপনার না জানলেও চলবে।
-চলবে না বলেই তো জানতে আসলাম।
-আপনাকে কে বললো?
-তোমার বাবা।
-এই বাবাটা না,যাই হোক আপনাকে বলবেই।
আমি সুপ্তির কথায় ওকে ধরে আমার দিকে ঘুরিয়ে বললাম,
-আমার গুলুমুলু মেয়েই পছন্দ।একদম তোমার মত।
আমার কথায় সুপ্তি এবার অভিমানের সুরে বললো,
-তাহলে ওই দিন ওই কথা বললেন কেন?
-এমনিতেই।কিন্তু তুমি যে আমার কথাটা এভাবে মানবে আমি ভাবতেও পারিনি।
-আমি আপনার জন্যে সব করতে পারি।
সুপ্তির কথায় আমি মুচকি হেসে বললাম,
-আমার কথায় সব করতে পারো।তাহলে চলো খাবে।
কথাটি বলে আমি ঘুরতেই সুপ্তি পেছন থেকে বললো,
-তুমি খায়িয়ে দেবে?

সুপ্তির মুখে তুমি শুনে কেমন যেন খারাপ লাগলো না।মনে হচ্ছে ওর মুখে এই তুমি ডাকটাই বেশ ভাল মানায়।আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম,

-তুমি কি আমার বিয়ে করা বউ,যে খায়িয়ে দেবো।
আমার কথায় সুপ্তি আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-বিয়ে করবে আমায়?
-কিন্তু শফিউল সাহেব?
-বাবা সব জানে।আমি অনেক আগেই বলেছি।

সুপ্তির কথায় আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না।তবে এটুকু বুঝতে পারছি এখন যদি মেয়েটাকে জড়িয়ে না ধরি তাহলে ওর প্রতি আমার অবিচার করা হবে।কিন্তু সেই সাহসটাও তো পাচ্ছি না।আমার মনের কথাটা সুপ্তি কিভাবে বুঝলো আমার জানা নেই।মেয়েটা আমাকে কিছু না বলে শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো।বেশ শক্ত করেই।
আমি সুপ্তিকে খায়িয়ে দিচ্ছি আর মেয়েটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।ওদিকে শফিউল সাহেব দড়জার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। আর আমি ভাবছি অন্য কথা।এরকম শ্বশুর মশাইকে হাতছাড়া করা যাবে না।কোন ভাবেই না,কোন মতেই না।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত