— পৃথিবীর সব মেয়ে একেবারে একরকম। তুই এদের মধ্যে একটুও পার্থক্য খুঁজে পাবি না। সবগুলোও লোভী আর স্বার্থপর। স্বার্থ শেষ, খোদা হাফেজ। তুই তো দোস্ত এখনো সিংগেল। আমার একটা উপদেশ শোন, জীবনে প্রেম করিস না ভাই। জীবন তামা তামা হয়ে যাবে।
আজ সাইফের জন্মদিন। তাই আজ নিজের বন্ধু বান্ধবীদের জন্য একটা ছোটখাটো পার্টির ব্যবস্থা করেছে সাইফ। এই হালকার উপর ঝাপসা এলকোহল টাইপ ড্রিংকের ব্যবস্থা সে করেছে তার বন্ধুবান্ধবদের জন্য। একজন দুইজন করে সবাই ধীরে ধীরে আসছে।
সাইফের এক বন্ধুর নাম রকি, আবির হাসান রকি। সে এখন সাইফের পাশে বসে বসে সাইফকে জ্ঞান দিচ্ছে। সাইফ এসব কথা আবিরের মুখে শুনে যথেষ্ট অবাক হচ্ছে। যেই ছেলে সারাদিন তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে সেই ছেলে আজ সাইফকে প্রেমবিরোধী উপদেশ দিচ্ছে। ব্যাপারটা ভাবা যায়? নাহ ব্যাপারটা মোটেও ভাবা যায় না।
ধীরে ধীরে প্রায় সবাই চলে এলো পার্টিতে। শুধু বাকি আছে রিশিতা আর তরী, দুই জমজ বোন। এই দুইজন অলটাইম লেট লতিফ ট্যাগপ্রাপ্ত। সবকিছুতেই তারা লেট করে। এমনকি জন্মের সময়েও নাকি এরা দুজন ডাক্তারের দেয়া ডেটের কয়েকদিন পর জন্ম নিয়েছিল। জন্মের সময়ই যারা লেট করেছে তারা তো আজীবন লেট করবেই।
— হ্যালো তরী কই তোরা? তোরা জীবনেও কি মানুষ হবি না?
— দোস্ত আরেকটু ওয়েট কর। এই মাইশার জন্যই তো দেরী হচ্ছে। আমরা তিনজন পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।
— ওহ….!
রায়হান ফোন কেটে দিল। তারমানে এখনো তিনজন বাকি আছে। মাইশা , রিশিতা আর তরী।
রায়হান ভেবে পাচ্ছে মাইশাকে ইনভাইট কে করলো? নাকি মাইশা বিনা ইনভাইটেশনে চলে আসছে? হতেও পারে, এই মেয়ে যেই পরিমান ছ্যাঁচড়া। বিনা দাওয়াতে চলে আসলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
পাঠকরা হয়তো ভাবছেন এই মাইশা কে! এই মাইশা হচ্ছে সাইফের এক্স, খাঁটি বাংলায় প্রাক্তন। কিছুদিন আগেই মাইশা আর সাইফের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত একজন অপরজনের ছায়াও মাড়ায়নি। সব সোশাল মিডিয়ায় সাইফ মাইশাকে চোখ বন্ধ করে ব্লক করে দিয়েছে। অর্থাৎ পুরোপুরি মাইশা সাইফের জীবন থেকে উধাও হয়ে গেছে। আজ এতদিন পর আবার মাইশার সাথে সাইফের দেখা হতে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভাবতেই সাইফের পেটব্যাথা শুরু হয়ে গেল।
পেট চেপে ধরে সাইফ দৌড় দিলো টয়লেটের দিকে। অপয়া মাইশার নাম নিতে না নিতেই সাইফের অবস্থা হালুয়া, সামনে আসলে কি হতে পারে আল্লাহ জানে।
কমোডে বসে সাইফ চিন্তা করছে কিভাবে মাইশার কাছ থেকে দূরে থাকা যায়। ওই ডাইনিটার কাছে মোটেও যেতে চায় না সাইফ। কেনই বা যাবে সে? সামান্য একটা কারণে দুইবছরের সম্পর্ক এভাবে কেউ শেষ করতে পারে?
কি সুন্দর দিন কাটছিলো তাদের। প্রতিদিন হাতে হাত রেখে কলেজে যেত তারা, সারাদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়তো চায়ের দোকানে অথবা পার্কের নরম ঘাসের উপর। একে অপরের শরীর ঘেঁষে বসে থাকতো তারা, ঠিক যেন ছোট্ট খড়ের বাসায় দুটি ক্লান্ত চড়ুই।
সারাদিন একসাথে থাকার পরেও তাদের তৃষ্ণা মিটতো না। ধরতে গেলে সারারাত ভিডিও কলে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে তারা ঘুমিয়ে পড়তো তা তারা নিজেরাও জানতো না। তবে সকালবেলা ঠিকই কে আগে ঘুমিয়েছে এটা নিয়ে ক্যাম্পাসে ছোটখাটো যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিত।
দিনগুলো এভাবেই কেটে গেলে হয়তো ভাল হতো। কিন্তু তা আর হলো কই? হঠাৎ করেই যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।
আরো কিছু হয়তো ভাবতো সাইফ , কিন্তু তার আগেই কে যেন টয়লেটের দরজায় ধুন্ধুমার ধাক্কা শুরু করে দিলো।
— ওই কে আছিস রে ভেতরে? তাড়াতাড়ি বের হ। আমার তো পড়ে গেল রে।
আশিক ছাড়া এই কাজ আর কারো হতেই পারে না। এই হারামীটার অলটাইম লুজ মোশন চলে। তাই ওকে পার্টিতে ইনভাইট করাটা বিশাল বোকামি হয়েছে সাইফের । এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে টয়লেট থেকে বের হলো। এতক্ষনে হয়তো রিশিতা, তরী আর মাইশা চলে এসেছে। সাইফ নিজেকে মনে মনে কিছুটা প্রবোধ দিলো এইভাবে,
— সাইফ কিচ্ছু হবে না। ও তোর এক্স, তাই নো টাল্টুবাজি। কোন কথা বলবি না ওর সাথে। বিনা দাওয়াতে আসছে, খেয়ে চলে যাবে। কোন কথা হবে না ওর সাথে। যদি নিজ ইচ্ছায় কথা বলতে আসে তাহলে কথা বলা যায়… না না মোটেও যায় না। একটা সিঙ্গেল ওয়ার্ডও হবে না।
এভাবে নিজের মনকে সামলাতে সামলাতে সাইফ সবার সামনে চলে আসলো। আর সাথে সাথেই মাইশা , তরী আর রিশিতা ঘরে প্রবেশ করে। মাইশাকে দেখেই সাইফ অন্যদিকে ঘুরে তার বন্ধু হাসিবকে বললো,
— দোস্ত পার্টি শুরু কর। একটা ঝাকানাকা গান বাজা। আজকে লুঙ্গি ডেন্স হবে।
সাইফের বলার সাথে সাথেই গান বাজনা শুরু হয়ে গেল। এদিকে মাইশা তরীকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললো,
— কিরে তরী সাইফ এখানে কি করে?
— কি করে মানে? আজকে তো সাইফের বার্থডে।
— কিহ? তুই না বললি তোর এক কাজিনের বার্থডেতে নিয়ে যাবি?
— আরে সাইফই তো আমার কাজিন। সাইফ আমার মায়ের খালাতো বোনের ছেলে। তারমানে কি দাঁড়ালো?
মাইশা কোন কথা না বলে চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইলো। আজ রায়হানের বার্থডে ছিল। কিন্তু মাইশা ভুলেই গেছে একেবারে। আর ভুলে তো যাবেই, কারন তারা তো এখন আলাদা সত্বা।
কোন দুঃখে যে মাইশা এখানে এলো তা মাইশা বুঝতে পারছে না। এতদিন পর সাইফের সাথে দেখা। ইশ ও আগের থেকেও কত সুন্দর আর হ্যান্ডসাম হয়েছে।
— না না মাইশা একদমই দূর্বল হলে চলবে না। মনে রাখিস সাইফ এখন শুধু তোর এক্স ছাড়া আর কিছু না। ভূলে যাসনা এই সাইফ সামান্য একটা কারণে তোর সাথে ব্রেকআপ করেছিল। মনকে শক্ত কর। ওইখানে কিংফিশারের বোতল দেখা যাচ্ছে। তুলে নিয়ে দুই ঢোক মেরে দে।
নিজেকে এভাবেই শান্ত করতে করতে মাইশা বোতলের দিকে এগিয়ে গেল। ঠিক ওই মূহুর্তে সাইফও এগিয়ে আসলো সেই বোতলের দিকে। তারপর কি আর হবে? দুইজনেই এক বোতল নিয়ে টান দিলো।
দুজনেই কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর প্রায় একসাথেই দুজনে বোতল থেকে হাত সরিয়ে নিল।
মাইশার চেহারাটা আগের চেয়ে অনেক মায়াবী হয়েছে। চোখদুটো যেন আরো সুন্দর লাগছে। নিশ্চয়ই কাজল দিয়েছে। আচ্ছা ব্রেকআপের পর নাকি নিজের প্রাক্তনকে অনেক বেশি সুন্দর লাগে, কথাটা কি সত্যি?
এদিকে মাইশা ভাবছে অন্য কথা। সেদিন হয়তো সাইফের দোষটা কম ছিল, মাইশার দোষ ছিল বেশি। কিন্তু দোষ তো সাইফের অবশ্যই ছিল। আচ্ছা আজকে ওর জন্মদিনে কি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করা যায়?
— কেমন আছো মাইশা?
মাইশা সাইফকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই সাইফ মাইশাকে প্রশ্নটা করলো। মাইশা হকচকিয়ে তাকালো সাইফের দিকে। সাইফের চেহারায় একটা অন্যরকম মায়ামায়া ভাব টের পাচ্ছে মাইশা।
— ভাল আছি। তুমি?
এতটুকু বলেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো মাইশা । হঠাৎ কেন যেন রোদেলার কান্না পাচ্ছে। কেন সেদিন ওভাবে রিয়েক্ট করেছিল মাইশা?
সেদিন দুজনে মোবাইলে কথা বলছিলো। হঠাৎ সাইফ বলে উঠলো,
— আচ্ছা মাইশা আমি রাতের খাবার খাইনি এখনো। খেয়ে এসে কথা বলি?
— তুমি এখনো রাতের খাবার খাওনি? তাড়াতাড়ি গিয়ে খাও। তারপর কল দাও আমাকে।
সাইফ ফোন কেটে দিল। মাইশা পড়ার টেবিলে বসে একটা উপন্যাস খুলে বসলো। তার উপন্যাস পড়তে ভাল লাগে। প্রায় দেড়ঘন্টা পর মাইশা সাইফের নাম্বারে কল দিলো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ফোন ওয়েটিং। একাধারে পাঁচবার কল দেওয়ার পরেও ফোন ওয়েটিং। এতক্ষন কার সাথে কথা বলছে সাইফ?
মাইশা মোবাইল রেখে দিয়ে চুপ করে বসে রইলো। মাঝে মাঝেই সাইফের নাম্বারে কল দিচ্ছিল, প্রতিবারই ওয়েটিং। প্রায় একঘন্টা পর সাইফ ফোন দিল। প্রায় দশবার ফোন দিল সাইফ কিন্তু মাইশা ফোন ধরলো না। আরে কয়েকবার ফোন দেয়ার পর মাইশা ফোন ধরলো।
— হ্যালো, কার সাথে কথা বললা এতক্ষন?
— ওহ এই কারনে রাগ করে ফোন ধরোনাই? তুমি পারো বটে।
— সাইফ আমি আমার উত্তর পাইনি। কার সাথে কথা বললা এতক্ষন?
— গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল।
— তাই বলে এতক্ষন কথা বলা লাগে?
— আজব এভাবে রিয়েক্ট করছো কেন?
— কিভাবে রিয়েক্ট করলাম?
— এমনভাবে রিয়েক্ট করছো যেন আমি কোন মেয়ের সাথে রসের আলাপ করে তোমাকে ফোন দিচ্ছি।
— আমারো তো তাই মনে হয়। নয়তো এতক্ষন ধরে কেউ গ্রামের বাড়িতে কথা বলে?
— রোদেলা তোমার কি মনে হয়না তুমি একটু বেশিই করে ফেলতেছো?
— ওহ উচিত কথা বললেই বেশি হয়ে যায় তাইনা?
তারপর আর কি? সেই গতানুগতিক চিৎকার, চেঁচামেচি, কুত্তা বিলাই হাতি ঘোড়া এবং অপ্রতাশ্যিতভাবে ব্রেকআপের খড়গ। দুজনের কেউ বিশ্বাস করতে পারলো না যে তারা ব্রেকআপ করে ফেলেছে।
তারা চাইলেই পরদিন সবকিছু ঠিক করে ফেলতে পারতো। কিন্তু ইগো বলতে একটা ব্যাপার মানুষের মগজে ঠাসা থাকে। আর ব্রেকআপ পরবর্তী প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে এই ইগো ব্যাপারটা বস্তাভর্তী থাকে।
— আমি আছি মোটামুটি।
হঠাৎ মাইশার অতীতের ভাবনায় সাইফ ছেদ টানলো। মাইশা ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকালো সাইফের দিকে। সাইফ বোতলটা এগিয়ে দিয়েছে মাইশার দিকে। ইতস্তত ভাব নিয়ে মাইশা বোতল হাতে নিল। আচ্ছা সাইফকে কি সরি বলা যায়?
— আচ্ছা মাইশা একটা কথা বলি?
— বলো? ( মাথা নিচু করে)
— সরি।
— কেন?
— সেদিনের জন্য। বিশ্বাস করো আমি কোন মেয়ের সাথে কথা বলিনি। বড় চাচ্চু গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছিল। আমার ফোন দিয়ে পুরো ঘরের সবাই একে একে কথা বলেছিল।
— ( মাইশা এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।)
— দেখো সেদিন কিন্তু শুধু আমার দোষ ছিল না। একশো ভাগের মধ্যে সত্তর ভাগ দোষ ছিল তোমার।
— কি বললা? আমার সত্তর ভাগ দোষ ছিল? আমি নাহয় ভুল করে তোমাকে উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলাম। তাই বলে
তুমি আমাকে এভাবে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলবা?
— আসলে ওই সময় কেন যেন মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। তাই..!
— তাহলে দোষ কার বেশি হলো? আচ্ছা যাও দুজনের দোষ পঞ্চাশ পঞ্চাশ।
— নাহ মোটেও না। আমার দোষ চল্লিশ আর তোমার ষাট।
— না না মানি না। পঞ্চাশ পঞ্চাশ হতে হবে, নয়তো মানি না।
— আচ্ছা যাও আমার পঁয়তাল্লিশ আর তোমার পঞ্চান্ন। এবার কিন্তু মানতে হবে।
— ( কিছুক্ষন ভেবে) আচ্ছা ঠিক আছে যাও। ৫৫-৪৫।
— সরি।
— আমিও সরি।
— তুমি আবার মনে করোনা যে তোমার সাথে আমি আবার প্রেম করবো। আমি শুধু সরি বলতে এসেছিলাম।
— ( বেশ খানিকটা অবাক হয়ে সাইফের দিকে তাকিয়ে রইলো)
— তোমার সাথে প্রেম করার সাধ মিটে গেছে।
— হুহ আমিও তোমার সাথে প্রেম করার জন্য আসি নাই। আমিও সরি বলতে আসছি। আর শোনো আগের চেয়ে বেশি কিউট হয়ে গেছো। অন্য মেয়েরা নজর দিবে কিন্তু।
এবার সাইফ হেসে দিল। তারপর আকষ্মিক আক্রমনে মাইশার হাতে থাকা কিংফিশারের বোতল কেড়ে নিয়ে বোতলের মুখ খুলতে খুলতে বললো,
— তুমি বোধহয় মেকআপ মেরে আসছো বেশি করে। আগে তো এত সুন্দর লাগতো না।
— যাহ শয়তান। ( কপট রাগ প্রদর্শন)
এদের প্রেম কি আবার শুরু হয়ে গেল? নাকি প্রেমরোগে চিরদিনের জন্য আক্রান্ত হয়ে গেল তারা?