আজকে আমার বাসর রাত। তবে এইটা আমার প্রথম বাসর না, এর আগেও আরেকটা বাসর আমার হয়েছে, অর্থাৎ এটি আমার দ্বিতীয় বিয়ে। আমার বর্তমান স্বামীরও এটি ২য় বিয়ে এমনকি তার আগের ঘরের দুইটা বাচ্চাও আছে। ওদের বয়স ২ আর ৪ বছর। আমার প্রথম বিয়ের পরে সময়টা খুব আনন্দের ছিল ভাল সময় যাচ্ছিল। এরপর এশা এলো আমার কোল জুরে। আনন্দ অনেক বেরে গেল, আমার মেয়েকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। দেখতে দেখতে এশার বয়স তিন বছর ঠিক সেই সময় থেকে এশার বাবা বদলে যেতে শুরু করল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম অফিসের আরেকটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে। এটি নিয়ে আমাদের মাঝে প্রতিদিন ঝগড়া চলত।
একপর্যায় আমি ডিভোর্স চেয়ে বসলাম এইভাবে আর পারছিলাম না। এশার বাবা খুশি মনেই ডিভোর্স দিয়ে দিল। সমস্যা হল এশাকে নিয়ে। এশাকে কি করব? আইন আদালতে গেলে হয়ত আমি এশাকে আনতে পারতাম কিন্তু আমার বাবার সেই আর্থিক অবস্থা ছিল না যে তার ডিভোর্সপ্রাপ্ত মেয়ে আর নাতনীকে পালবে। অনেকটা নীরবেই এশাকে রেখে চলে আসলাম। একজন মা তার সন্তানকে রেখে একা থাকা যে কত কষ্টের সেটা কোন মা ছাড়া কেউ কোনদিন বুঝবে না। তাই আমি আর সেগুলো কাউকে বললাম না। শুধু এই টুকু বলি, এমন কোন রাত নেই যে এশার কথা ভেবে বালিশ ভেজাইনি। এই যেমন- এখন বাসর ঘরে বসেও মেয়েটার কথা ভাবছি।
মাঝে মাঝে এশার সাথে দেখা করতে যেতাম, ওরা সব সময় দেখা করতে দিত না। বাসার রাস্তার পাশে বসে কান্না করতাম, রাস্তার মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো, অনেকে জিজ্ঞেস করতো কি হয়েছে? কিছুই বলতে পারতাম না। একদিন এক পুলিশ আমাকে কান্না করতে দেখে থানায় নিয়ে যায়। সব শুনে কয়েকজন পুলিশ পাঠিয়ে এশাকে এক দিনের জন্য এনে দেয় আমার কাছে। আর বলে দেয় আবার আসলে যেন সারাসরি থানায় চলে আসি তারা ব্যবস্থা করে দিবে। এর পরে কয়েকবার এশার সাথে এই ভাবে দেখা করি।
একবার এশা বলে মা তুমি আর আমাকে দেখতে এস না তুমি দেখতে আসলে ওরা আমাকে মারে। এরপর আর এশাকে দেখতে যাইনি। পরে আমার এক আন্টির মাধ্যমে এই লোকের সাথে আমার বিয়ে হয়। তার স্ত্রী এক এক্সিডেন্টে মারা গেছে। বিয়ে বলতে আসলে আমার মূল কাজ বাচ্চাদের দেখাশুনা কারা। নয়ত দুই বাচ্চার বাপ আমার মত ডিভোর্সি মেয়েকে প্রেম করার জন্য বিয়ে করবে না। বাবার দিকে তাকিয়ে সব মেনে নেই। এখন অপেক্ষা করছি নতুন স্বামীর জন্য। বাসর রাতে আমার স্বামী শুধু একটা কথাই বলছে আমার সন্তাদের নিজের সন্তান মনে করবে আর আমার বাবা মাকে নিজের বাবা মা মনে করবে। আর আমাদের এইটা জয়েন ফ্যামিলি তাই সবার সাথে মিলে মিশে থাকবে।
বিয়ের কয়েক মাস পর বুঝতে পারলাম আমার স্বামী খুব কম কথা বলে। বিশেষ দরকার ছাড়া কোনো কথা বলে না, কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হা বা মাথা ঝুলিয়ে উত্তর দেয়। তবে বাসার সবাই তাকে অসম্ভব ভঁয় পায়, তার অনুমতি ছাড়া বাসার বাজারও হয় না। এমন কি আমিও খুব ভঁয় পাই। আমার আগে স্বামীকে আমি তুমি করে বলতাম, আর তাকে আপনি করে বলি। তবে এই বাসার সবচেয়ে বেশি যেটা ভাল লেগেছে সেটা হলো তারা কেউ আমার অতীত নিয়ে কোনো ধরণের প্রশ্ন তুলে নাই, আমি এই বিষয়টা নিয়ে খুব আতঙ্কে ছিলাম। লোকে যখন জিজ্ঞেস করবে আমার ডিভোর্স কেনো হয়েছে আমি কী বলব? কিন্তু বাসার কেউ এই প্রশ্ন করেনি আমাকে।
একদিন শুধু আমার শাশুরি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল তাকে সব খুলে বলছিলাম। এর পরে এটি নিয়ে আর কোন কথা হয়নি। ওর সন্তানদের আমি নিজের সন্তানের মতই আদর করি। ওরা আমাকে মা বলে ডাকে ওরা যতবার মা বলে ডাকে আমার ততবার এশার কথা মনে পরে। জানিনা ক্যামন আছে?
দেখতে দেখতে আমার নতুন বিয়ের প্রথম বছর পার হয়ে গেল। আজকে আমার ২য় বিয়ের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। প্রথম বিয়ের সময় এই দিনটি নিয়ে অনেক এক্সাইটেড ছিলাম কিন্তু আজকে নেই। তবে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমার স্বামী কি দেখলাম না এরকম কোন সময় হয় না। সব সময় আমি ঘুম থেকে উঠে আমি ওকে জাগাই। নাস্তার টেবিলেও ওকে দেখলাম না। আমার ননদ আমাকে প্রশ্ন করে বসল ভাবি ভাইয়া কোথায়? আমি বললাম জানি না তখন আমার শাশুড়ি জবাব দিল- সে নাকি আমার জন্য গিফট আনতে গেছে।
আমি বেশ অবাক হলাম এই রকম একটা রাগি লোক আবার আমার জন্য গিফট আনবে? সারাদিন ওর অপেক্ষা করলাম এল না, ভীতরে ভীতরে ক্যামন অশান্তি লাগছে ফোন দিলাম সেটাও ধরল না। ঠিক রাত ৮ টার দিকে ও আসল খালি হাতে। আমার ননদ বলল ভাইয়া ভাবির গিফট কোথায়? ও মুচকি হেসে বলল আছে আগে তোর ভাবিকে চোখ বন্ধ করতে বল। আমার অপেক্ষা না করে আমার ননদ আমার চোখ ধরল পিছন থেকে। চোখ খোলার পরে যা দেখলাম তাতে মনে হয় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। এটা কি করে সম্ভব আমার চোখের সামনে আমার মেয়ে এশা দাঁড়িয়ে আছে! আমি কথা বলতে পারছিলাম না আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল, আমি আমার মেয়েকে জরিয়ে ধরে রেখে শুধু কান্না করছিলাম।
তখন আমার স্বামী তার বাচ্চাদের ডাক দিয়ে বলল, এ হচ্ছে এশা তোমাদের বড় আপু এখন থেকে তোমাদের সাথেই থাকবে। যাও এশাকে তার রুম দেখিয়ে দেও। বাচ্চারা এশার হাত ধরে খুশি মনে নিয়ে গেল। আসল ঘটনা হল আমার স্বামী আমার শাশুরির মুখ থেকে আমার আগের ঘরের সন্তানের কথা শুনে তারা তখনই সিদ্ধান্ত নেয় এশাকে এখানে নিয়ে আসবে। পরে তারা এশার বাবার সাথে যোগাযোগ করে। এশার বাবাও ব্যাপারটা বুঝতে পারে যে এশার নতুন মা মানে তার নতুন স্ত্রী এশাকে মেনে নিতে পারছে না। তাই তারা আর আপত্তি করেনি কোন রকমে ঝামেলা বিদায় করতে পারলেই বাচে। তাই আমার বর্তমান স্বামী গিয়ে এশাকে নিয়ে এসে আমাকে চমকে দেয়।
আর এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। এই ফ্যামিলিতে এশাকে কেউ কোন দিন কোন কিছুতে বঞ্চিত করেনি। অন্য বাচ্চাদের মতই আদর করছে। আমিও কোন দিন আমার স্বামীর আগে ঘরের সন্তানদের পর মনে করিনি নিজের সন্তান মনে করে পেলেছি। এর পরে আমার আরেকটা সন্তান হয় এই নিয়ে আমারা মোটামুটি সুখেই আছি।
তবে এশার আসল বাবা তার ভুল বুঝতে পেরেছে তার নতুন স্ত্রী এর সাথেও সে সুখে নেই শুনেছি ডিভোর্স হয়ে যেতে পারে। তবে এশার বাবা মাঝে মাঝে এশাকে দেখতে আসে। আমার বর্তমান স্বামী তাকে কোন দিন অসম্মান করেনি। খুবি সম্মান করে বাসায় বসিয়ে কথা বলছে এমন কি এশাকে এক দুই দিনের জন্য তার কাছে দিয়েছে তার কাছে রাখার জন্য। তবে কোন দিন আমার সাথে দেখা করতে দেয়নি। তার একটাই কথা তুমি বর্তমানে আমার স্ত্রী তার না। আমিও আমার স্বামীর কথা মেনে নিয়েছি।
The End