–বাবা পরশুদিন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে মেহরাব, তুমি সেটা জানোনা?
— জানি… কোনো বাবা-মা তার সন্তানের খারাপ চায় না মিহি, কোনো সন্দেহ ছাড়াই চাচা অনেক ভালো একটা ডিসিশন নিয়েছে…
–ভালো ডিসিশন? তুমি জানো না মেহরাব আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি?
–তুমি জানো না আমার হাতে সময় বেশি নেই? কেনো নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিতে চাইছো মিহি?
–তোমার সাথে কাটানো সময়গুলোই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহুর্ত মেহরাব, ওই সময়গুলোর স্মৃতি নিয়েই না’হয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবো !
–এটাকে পাগলামি বলে !
–পাগলামি কি’না জানি না, আমি শুধু এটা জানি, আগামিকাল রাত ২টায় আমি নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, তুমি আসবে এবং আমরা এই এলাকা ছেড়ে অনেক দূর চলে যাবো…
–মিহি, কেনো এমন অবুঝের মতো?
কথাটা শেষ করবার আগেই মিহি ফোনটা কেটে দেয়…
*
পরেরদিন রাত ১২:৩০মিনিট। আয়নার সামনে বসে অনেক সুন্দর করে বউ সাজছে মিহি। লাল শাড়ি, কপালে লাল টিপ, চোখে কাজল, মাথায় টিকলি… অনেক যত্ন করে মিহির যখন বউ সাজা কমপ্লিট। তখন রাত ১টা ১৫মিনিট । মিহি একবার দরজায় কান পেতে বাইরের অবস্থা বুঝতে চাইলো, যেহেতু বিয়ে বাড়ি তাই বাড়িতে হয়তো অনেক মেহমান থাকতে পারে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার…
রাত ১টা ৪৫মিনিট। দরজায় কান পেতে মিহি আবারো বাইরের অবস্থা বুঝতে চাইলো। নাহহ, বেশ শান্ত বাইরের পরিবেশটা… এখনই ঘর থেকে বের হতে হবে। হয়তো এতক্ষণে মেহরাব নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে…
আগে থেকেই গুছানো ব্যাগটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি রুমের দরজাটা খুললো মিহি… ভালো করে একবার বাড়ির চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো সে… নাহহহ, কোথাও কাউকেই দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চিন্তে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে !
খুব আস্তে আস্তে পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে যায় মিহি। বাড়ির গেইটের কাছে আসতেই মিহি থমকে যায়, বুকটা ধুক করে উঠে… গেইটের বাইরে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, বাবাকে দেখার সাথে সাথে মিহি হাতের ব্যাগটা মাটিতে রেখে দেয়। আর তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা…
মিহি ভালো করে একবার বাবার চোখের দিকে তাকায়, কি অদ্ভুত… কি আজব… বাবা কান্না কেনো করছেন? আমাকে এসে ধমক কেনো দিচ্ছেন না? অথবা গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে ঘরে কেনো নিয়ে যাচ্ছেন না? তাহলে কি বাবা আমার ভালোবাসাটা মেনে নিলেন? হয়তো হ্যাঁ, এজন্যই হয়তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান্না করছেন। অনেক ভয়ে ভয়ে মাটিতে রাখা ব্যাগটা আবারো হাতে নেয় মিহি… বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাড়ির গেইট দিয়ে আস্তে আস্তে বের হয়ে যায়, মনে মনে মিহি চিন্তা করতে থাকে- বাবার চোখের সামনে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসলাম, অথচ বাবা কিছু বললেন না কেনো? আটকালেন না কেনো? তারমানে আমার ভালোবাসাটা নিশ্চই তিনি মেনে নিছেন…
রাত ২টা ১০মিনিট… মাথা থেকে সব চিন্তা সরিয়ে ফেলে মেহরাবের জন্য অপেক্ষা করছে মিহি, উফফফ… এই ছেলেটা সবসময় সব কিছুতে দেরি করে। তাই বলে কি আজকেও দেরি করতে হবে? হয়তো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা, ধুত্ত… ঘুমাতে যাবে কেনো? এরকম রাতে কেউ ঘুমাতে পারে না’কি? হয়তো ব্যাগ গুছাতে সময় লাগছে, তাই হয়তো আসতে দেরি হচ্ছে। হয়তো এখনই চলে আসবে… মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে মিহি!
রাত ৩:১৫ মিনিট… ১ঘন্টা পার হয়ে গেছে, কিন্তু মেহরাব আসেনি । এই ১ঘন্টায় ১০০বারের উপর মেহরাবের নাম্বারে কল দিছে মিহি, কিন্তু প্রতিবার রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে, মিহি টেনশনে পড়ে যায়। মেহরাব এতো দেরি করছে কেনো? ও কি জানে না ভোর হওয়ার আগেই আমাদের এই এলাকার বাইরে চলে যেতে হবে… এতো রাতে একা একটা মেয়েকে কেউ এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে? উফফফ… কেনো এতো দেরি করছে? টেনশনে এপাশ থেকে ওপাশ হাটাহাটি করতে থাকে মিহি…
রাত ৪টা ২০মিনিট… এখনো মেহরাব আসেনি। এতোক্ষণ ওর নাম্বারটা রিং হয়ে কেটে গেলেও এখন বার বার সুইচ অফ আসছে… কান্না করতে করতে মিহির অবস্থা একদম একাকার। চোখের পানিতে কাজলগুলো একদম বিশ্রী হয়ে গেছে… কান্না করতে করতে চোখগুলো একদম লাল হয়ে গেছে, অনেকগুলো রাতের জমানো স্বপ্নগুলো যেনো একটা রাতেই চুরমার হয়ে গেছে। রাত এখনো শেষ হয়নি, মিহি এখনো অপেক্ষা করতে থাকে। মেহরাব আসবে… অবশ্যই মেহরাব আসবে…
ভোর ৫টা… অনেক দূরের কোনো এক মসজিদ থেকে ফজরের আজান কানে আসে মিহির। চোখ থেকে এখনো অবিরাম পানি পড়ছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। আস্তে আস্তে রাতের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে।নিমগাছের নিচ দিয়ে মসজিদের ইমাম সাহেব ফজরের নামাজ পড়াতে মসজিদে যাচ্ছেন, মিহিকে দেখেই একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ইমাম সাহেব বললেন “আহারে, ছেলেটা ক্যান্সারে মারা যাওয়ার একটা বছর হয়ে গেলো, অথচ এখনো মেয়েটা প্রতিটা রাত নিমগাছের নিচেই দাঁড়িয়ে থাকে, ইমাম সাহেব আস্তে আস্তে মিহির কাছে এসে বলেন “ভোর হয়ে গেছে মা, বাড়িতে চলে যাও…”
একদম অচেতন হয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে মিহি, নিজের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে “মেহরাব আসবে… মেহরাব আসবে… মেহরাব আসবে…”
বাড়ির গেইটের সামনে এখনো দাঁড়িয়ে আছেন মিহির বাবা, আস্তে আস্তে মিহি গেইটের ভিতর ঢুকে পড়ে। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিটা রাতেই মিহিকে এভাবে বাড়ি থেকে বের হতে দেখেন তিনি, আবার ভোরে এভাবেই বাড়িতে ফিরতে দেখেন।
আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমের দরজার কাছে পৌছে যায় মিহি, রুমের ভিতর ঢুকে দরজাটা লাগাতে লাগাতে বলে, “মেহরাব আসবে… অবশ্যই মেহরাব আসবে…।
গেইটের সামনেই মাটিতে বসে কান্না করতে থাকেন মিহির বাবা… একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলেন “উফফফ, আমার মেয়েটা মনে হয় আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না…”