সিনেমেটিক

সিনেমেটিক

বিয়েটা করেই ফেললাম। দীর্ঘ দিন থেকে আম্মার ঘ্যান ঘ্যান, ছোট বোনের প্যান প্যান আর আব্বার নানান ভাবে বিয়ে কেন করি না সে বিষয়ে জানতে চাওয়া থেকে রেহাই পেলাম শেষ পর্যন্ত। অবশ্য বিয়ে দেওয়ার জন্য আমার পরিবারের উঠেপড়ে লাগার পেছনে অনেক কারণ। প্রথমত, পড়াশোনা শেষ করেছি আরো পাঁচ বছর আগে। দ্বিতীয়ত, চাকরির বয়স প্রায় দুই বছর হতে চলল। হ্যান্ডসাম স্যালারি হওয়ার পরেও মেসে থাকি, খাওয়া দাওয়ার চরম অসুবিধা, বাইরে বাইরে খাই। এসব আম্মার সহ্য হচ্ছিলো না। তৃতীয়ত, মাথার চুল পড়তে পড়তে অর্ধেকে এসে ঠেকেছে। ছোট বোন প্রতিদিন সংকেত দিচ্ছিলো, ভাইয়া তুই কিন্তু বউ পাবি না। এরকম বুইড়া ভামকে কে বিয়ে করবে! আরো অনেক অনেক কারণ। যাই হোক বিয়েটা ভালোই ভালোই সম্পন্ন হল। এখন অনেকটা হালকা লাগছে।

আমি ঢাকায় একটা প্রাইভেট জব করি। প্রাইভেট জবে নানান যন্ত্রণা। ছুটিছাটা নেই বললেই চলে। বিয়ের জন্য আমার ছুটি বরাদ্দ হয়েছে মাত্র চার দিন। খুবই দুঃখজনক। সরকারি চাকরি এদিক দিয়ে খুবই লাভজনক।
আমাদের বিয়েটা সম্পূর্ণ এরেঞ্জড। পারিবারিক দেখাশোনায় হয়েছে। বউ আমার আম্মা পছন্দ করেছেন। আম্মার পছন্দে আমার শতভাগ আস্থা আছে। তাই আমি আর আগ বাড়িয়ে বউ দেখতে যাই নি। অবশ্য ছবি দেখেছিলাম। শুনেছিলাম সম্প্রতি মেয়ে নাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা কম্পলিট করেছে।

যিনি আমার মতো একজন আস্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষকে তিন বার কবুল করলেন তার নাম মৌরি। মৌরি নামটা বেশ চমকপ্রদ। স্কুল লাইফে আমার এক জুনিয়রের নাম ছিল মৌরি। সে এখন কোথায় আছে জানি না। হালকা ক্রাশও খেয়েছিলাম বাল্যকালে। বাদ দেন, বাল্যকালের পাগলামির কথা শুনে লাভ কি? যেদিন প্রথম মৌরির নাম শুনলাম, চিন্তাভাবনায় অনেকটা সিনেমেটিক হয়ে পড়লাম। ভাবলাম, এই মৌরি যদি সেই মৌরি হয়। অনেকটা বাংলা সিনেমায় হারিয়ে যাওয়া নায়িকাকে পনেরো বছর পর খুজে পাওয়ার মতো! আহা বেশ হবে! বেশ হবে!
সেই আশার গুড়ে বালি পড়েছিল বিয়ের তিন দিন আগেই। মেয়ের ঠিকুজীকোষ্ঠীর খবর নিয়ে জানলাম, এই মৌরি আমাদের পাশের গ্রামের। জন্ম এখানেই। বড় হয়েছে এখানেই। ওর বাবা ব্যবসা করেন। কিন্তু ওই মৌরির বাবা জব করতেন। যাহ! একটা এডভেঞ্চারাস বিবাহের আশার প্রদীপ অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল।

আমার বউ মৌরিকে আগে কোন দিন দেখেছিলাম কিনা খেয়াল নেই। পাশের গ্রামের বিধায় হয়তো দেখেছি।
এখন আমাদের গ্রামের বাজারে এসে বসে আছি। সন্ধ্যা সাতটা বাজে। আর ঘন্টা তিনেক পরেই বাসর ঘরে প্রবেশ করতে হবে। এই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে বেশ কথা চালাচালি হচ্ছে। এক বন্ধু বলল, দশটা অনেক রাত। সময় কম পাবি। তুই আটটায় বাসর ঘরে ঢুকে পড়।

আমি বললাম, ‘ধুর! তাই সম্ভব নাকি! বাড়ি ভরতি মানুষ। আমি পারবো না ভাই!’
আরেক বন্ধু বলল, ‘আমি তো নয়টায় মধ্যেই বাসর ঘরে ঢুকেছিলাম। আর সহ্য হচ্ছিলো না। এ নিয়ে গ্রামের ভাবী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তর হাসাহাসি হয়েছিল।’

আমরা সবাই হাসতে হাসতে শেষ। এই পাগলে বলে কি! আমি বললাম, ‘আমি কারো হাসির পাত্র হতে পারবো না দোস্তো। আমি ঠিক করেছি বাসর ঘরে ঢুকবো রাত বারোটায়। তখন বাড়ির সবাই ঘুম। চুপচাপ ঢুকে পড়বো।’
আমার কথা শুনে, সবার উন্মাদনার হাওয়া ভরতি টিউব যেন নিমেষেই চুপসে গেল। সবাই হতাশ। এত দেরিতে বাসর ঘরে কেউ ঢুকে! আমার এক বন্ধু কালা আজিজ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল, ‘না না মেহেদি আমি তোর কাছে এটা আশা করি নি!’ আবার হাসির তুবড়ি ছুটলো সবার মাঝে।

ও, আপনাদের সাথে একটা কথা শেয়ার করি। তবে অনুরোধ রইলো, মৌরিকে বলবেন না যেন। ও যেন ঘুনাক্ষরেও টের না পায়। তাহলে বাসর রাতে আর বেড়াল মারা হবে না আমার। আমি নিজেই মারা পড়তে পারি।

আমি ছয় মাস যাবত একটা রিলেশনে আছি। মেয়ের সাথে ফেসবুকে পরিচয়। নাম নীল প্রজাপতি। আমরা নিয়মিত কথাবার্তা বলি। ও থাকে চট্টগ্রামে। তাই দেখা টেখা হয় নি। এ মাসেই আমাদের কক্সবাজারে দেখা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আর হল কই! বিয়েই তো করে ফেললাম। আমি ওর কোন ছবি পর্যন্ত দেখি নি। আমাদের প্রথম শর্তই ছিল যেদিন দেখা হবে সামনাসামনি হবে। এর আগে ছবিও দেখা যাবে না। তবে ফোনে কথা বলা যাবে। আমি মূলত ওর কন্ঠের প্রেমে পড়েছিলাম। ময়না পাখির মতো মিহিন সূরে কথা বলে। নেশা ধরে যায়।

আজ দুপুরে যখন বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে গেলাম। তখনই নীল প্রজাপতি অর্থাৎ নীলুকে সব কথা জানালাম। আমি ওকে নীলু ডাকতাম। সে তো কেঁদে কেটে হাট বসিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর হঠাত কান্না থামিয়ে দিয়ে প্রতারক, ছোটলোক, কুত্তা, হারামী আরো নাম না জানা অনেক গালি দিয়ে আমার বংশ উদ্ধারে মনোনিবেশ করলো। এখন চিন্তামুক্ত আছি। কারণ, কবুল বলার আগেই নীলুকে ফেসবুকে ব্লক মেরেছি। ওর ফোন নাম্বারও ব্লকড। যাক বাবা বাঁচলাম। এই মেয়ে আমাকে খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। আর যেই মুখের ভাষা! আল্লাহ বাঁচাইছে।
বন্ধুরা জোর করে, ঠেলে, গুঁতিয়ে আমাকে এগারোটার সময় বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিলো। এমন ঠেলাঠেলি অবস্থায় আব্বা এ দিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। আব্বা আমাদের দেখে মুচকি হেসে চলে গেলেন। কি লজ্জা! কি লজ্জা!
বাসর ঘরে ঢুকেই আমি অবাক। দেখি একটা সুন্দর পুতুলের মতো মেয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। চোখ ভরতি জল উপচে উপচে পড়ছে। চোখের কাজল লেপ্টে একাকার অবস্থা। আমি খানিকটা অপ্রস্তুত ভাবে খাটে এক প্রান্তে বসে বললাম, ‘এই তুমি কাঁদছো কেন? প্রশ্নটা করেই যেন হোঁচট খেলাম। বুঝলাম বিয়ের দিন মেয়েরা কাঁদে। বাবা মাকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে এসে কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক। আর এরকমই হয়। আমি ওর উত্তরের আশা না থেকে আবার বললাম, ‘সকালেই তুমি তোমাদের বাসায় যেও। বেশি দূরে তো নয়। এখন আর কেঁদো না প্লিজ।’ সে রীতিমতো হেচকি তুলে কাঁদঁছে।

এবার সে ভেজা চোখ গরম করে আমাকে বলল, ‘আপনাকে কে বলেছে আমি বাসার জন্য কাঁদছি?’
– ‘তাহলে কাঁদছো কেন? আমাকে কি তোমার পছন্দ হয় নি? শোনো আমার বয়সটা একটু বেশি হলেও মনে মনে কিন্তু আমি এখনও তরুণ। হি হি।’

সে এবার চোখ মুছলো। কাজল আরো খানিকটা লেপ্টে গেল। ‘শোনেন, এতো বক বক কইরেন না। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। না হলে কি বিয়ে করতাম? আমি কাঁদছি কারণ আজ আমার রিলেশনশিপ ব্রেকাপ হয়েছে।’
এ কথা শোনার পর মনে হল, কেউ আমাকে দশ তলার ছাদ থেকে লাত্থি মেরে নিচে ফেলে দিলো। এই মেয়ে বলে কি? বিয়ের রাতে রিলেশন টিলেশন! ওর দাদি বা ভাবি কি ওকে শিখিয়ে দেয় নি বাসর রাতে স্বামীর মন জয় করতে হয়। ও আমার মন তো জয় করার চেষ্টাই করছে না। উল্টো উল্টাপাল্টা কথা বলছে।

সে আবার বলল, ‘আজ দুপুরে আমার প্রেমিক আমাকে ব্লক দিয়েছে। ফোন নাম্বারও ব্লক। চিন্তা করুণ কি খারাপের খারাপ!’

আমি এবার নড়েচড়ে বসলাম। ঘটনাটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। বললাম, ‘কি… কি বলছো এসব! শু…শুয়ে পড়ো অনেক রাত হয়েছে।’ বলে পাশের বালিশে মাথা রেখে কোন রকমে শুয়ে পড়লাম!

– ‘কি মিস্টার মেহেদী হাসান? ঘুমিয়ে পড়লে চলবে কি করে? বাসর রাতে বিড়াল মারতে হয় জানেন না?’
আরে আরে এই মেয়ে বলে কি? লাজ লজ্জা নেই নাকি!

এবার সে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করলো। ‘ভেবেছো কি তুমি? হ্যাঁ? নীলূর সাথে ব্রেকাপ করে মৌরির সাথে ঘর করবা? সেটা আমি হতে দিচ্ছি না। তোমাকে নীলুর সাথেই ঘর করতে হবে।’

বিরাট ধরা খেয়ে গেলাম। বিয়ের রাতে এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমার মনে হয় না কেউ এর আগে পড়েছে। একেবারে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেল। আমি বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে পড়ে রইলাম। কানের কাছে ফিসফিস করে মৌরি বলল, লাইটটা অফ করে আসি। তারপর তোমার বিচারকার্য শুরু হবে।
সিনেমেটিক

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত