“ইস! বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথাটা বেড়েছে রে !”
কথাটা শুনে আমার দিকে ঝট করে ফিরে তাকাল আকাশ । রেগে কাই হয়ে আছে । নিঃশ্বাসের সাথে সাথে নাকের পাশটা বারবার ফুলে ফুলে যাচ্ছে ওর । ও যখন খুব ক্ষেপে যায় তখন এমনটা হয় । নাকের পাশটা ফুলে ফুলে যায়। এই অবস্থার নাম আমি দিয়েছি “ফুলা অবস্থা”! ফুলা
অবস্থায় থাকলে আকাশের মুখ দিয়ে যা ইচ্ছে বের হতে পারে। আমি গালি শোনার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম ।
“শালা *** তোর কি ধারণা তুই শেখ হাসিনার মেয়ের জামাই? নাকি বেগম খালেদার নাত জামাই? তুই এদের কিছুই না। তুই হলি একটা ধাড়ি রামছাগল। তোর চেয়ে একটা ইঁদুরের সাহস বেশি ! একটা মেয়েকে পছন্দ করিস ৩ বছর যাবত, অথচ বলতে গেলেই তোর বুকে চিনচিন ব্যাথা শুরু হয় ।”
আমি হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম । আকাশ যা বলেছে তার একাংশও মিথ্যে নয় । আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি। সে আমার এলাকাতেই থাকে। আমার চেয়ে ২ ক্লাস নিচে পড়ে। তাকে আমি চিনি গড়পড়তা ৩ বছর যাবত ।
প্রথমদিন দেখে আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগে । ডাঙ্গায় তোলা মাছ যেমন খাবি খায়, তেমনি হাঁ করে আমি অক্সিজেন খেতে লাগলাম !
রাত্রিতে বাসায় ফিরে গাঁয়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো ! এতো সুন্দরী মানুষ হয় ? এটা কি মেয়ে নাকি “পরীদের রাণী”? নিশ্চয়ই “পরী” !
নইলে সেদিন হঠাত করে আমার এমন জ্বর আসবে কেন !
মিলিকে আমার পছন্দের কথাটা কখনো জানানো হয় নি। আমার বন্ধুমহলের এক আলোচিত ঘটনা হলো মিলি। মিলিকে সবাই চিনে, এমনকি আমার চেয়ে বেশি চিনে। অনেকেই জানিয়েছে, মিলিও নাকি আড়ালে আবডালে আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু মেয়েলোক বলে কথা, “বুক ফাটে, তাও মুখ ফাটে না!” তাই মুখ ফাটানোর দায়িত্ব আমারই নিতে হলো । আকাশ এগিয়ে এলো নিজ থেকেই । ক্লাস ২ থেকে বন্ধু আমরা । একজন আরেকজনের সম্পর্কে নাড়িনক্ষত্র সব জানি । আকাশ বোধ করি বুঝতে পেরেছিল আমাকে দিয়ে মুখ ফাটানো সম্ভব নয় ! তাই নিজেই এসে ভর করলো আমার ঘাড়ে। এতদিন মাথায় ছিল পরী! এবার ঘাড়ে চাপল ভূত !
“পারবো না পারবো না” কথাগুলো ধূপে টিকলো না। তাই, কোনো এক নভেম্বর মাসের পড়ন্ত বিকেলে আমি আকাশের হাতে আটক অবস্থায় রওনা দিলাম ধানমণ্ডির KFC তে, যেখানে অপেক্ষা করছে সেই “হুরপরী” যাকে দেখলেই বুকটা কেমন যেনো মোচড় দিয়ে উঠে !
-তুই তৈরি তো?
আকাশের গলা কানে যেতেই বাস্তবে ফিরে এলাম । জানালার পাশ দিয়ে মিলিকে দেখা যাচ্ছে । একদম সামনের দিকের একটা টেবিলে বসে আছে । হাতে মোবাইল ফোন । মনে হয় সময় কাটানোর জন্য গেমস খেলছে অথবা ইন্টারনেট ব্রাউস করছে। মিলিকে দেখার আগ পর্যন্ত নিজের উপর পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম । এখন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে বরং পালাতে পারলে বাঁচি ! যাই হোক । আকাশ প্রায় এক মিনিট গভীর মনোযোগে এবং একাত্তচিত্তে আমাকে বুঝালো কি করতে হবে । আমি প্রায় সবই শুনলাম । কিন্তু শত চেষ্টা করেও মাথায় ঢুকাতে পারলাম না। অবশেষে মাথা নেড়ে আকাশের কথায় সম্মতি জানিয়ে ঢুকে পড়লাম দরজা ঠেলে ।
ঢোকার সাথে সাথেই মিলি মাথা তুলে তাকাল আমার দিকে । মুখে অপূর্ব সেই হাসি, যা দেখে জ্বরে কাতর হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম পুরো এক সপ্তাহ ! লক্ষ্য করলাম, আমার মাথাটা কেমন ঘুরাচ্ছে! শরীরটা ভারী ভারী ঠেকছে । বহু কষ্টে মিলির হাসির রিপ্লাই দিতে একটু হাসির চেষ্টা করলাম । সেই হাসি দেখতে কেমন হয়েছিলো তা ভাবলেই এখন ভয় লাগে !
হেঁটে গিয়ে বসলাম মিলির পাশে । কোশল বিনিময়ের পর জানতে চাইলাম কি খাবে । বলল, দুপুরে একটু দেরি করে খেয়েছে… তাই ভারী কিছু অর্ডার না করলেই ভালো । আমি উঠে গিয়ে দুজনের জন্যই হালকা খাবার দাবার নিয়ে আসলাম । মিলি খুব আস্তে আস্তে খায় । আর কথা প্রায় বলে না বললেই চলে । আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু তার উত্তর দেয় । আমি পড়লাম বিপদে। মাথার মধ্যে হাজারো বাক্য ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু চামড়ার মুখ দিয়ে তার একটাও বের করতে পারছি না! “হে প্রভু, ধরণীকে তুমি ভাগ করে দাও! আমি আমার মুখটা লুকাই!” অবস্থা আমার ! একথা সেকথা বলার পর আসল কথাটা পারলাম ।
“মি, আকাশ নিশ্চয়ই তোমাকে সব বলেছে !” মিলি মাথাটা খানিক নামিয়ে বলে, “জি না। আকাশ ভাই তো আমাকে শুধু আসতে বললেন । তেমন কিছু তো বলেননি !”
“ওহ, আসলে মিলি, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই । কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না!”
মিলি খানিকটা শরম পায় । আস্তে করে চোখ দুটো আমার দিকে তুলে বলে, “আপনার যা ইচ্ছে বলতে পারেন সাইম ভাই । আমি কিছু মনে করবো না!”
“আসলে মিলি, আমি যা বলবো, তা হয়তো তুমি আশা করছ না। ইয়ে, মানে, আমি … আমি … … উমমম … আমি আসলে তোমাকে… … …”
মিলি খানিকটা সাহস দেয়ার চেষ্টা করলো, “বলুন সাইম ভাই ! আপনার মুখ থেকে আমি কথাটা একবারের জন্য হলেও শুনতে চাই !”
আমি এবার পুরোই ঘাবড়ে গেলাম । ঢাকায় শীত শীত ভাব পড়া শুরু হয়েছে। তার উপর এসি চলছে । আমি তারপরও ঘেমে নেয়ে অস্থির । মনে হচ্ছে মাত্র গরম পানি দিয়ে গোসল দিয়ে উঠলাম! তোয়ালে ছিল না তাই গাঁয়ের পানি মুছতে পারি নি ! বহু কষ্টে মনের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে বললাম, “আসলে মিলি, আমি তোমাকে যা বলতে চাচ্ছিলাম তা হলো, আমার শরীরটা হঠাৎ খুবট খারাপ লাগছে ! বুকের ব্যাথাটা বেড়েছে ! মনে হয় পানি খেতে হবে ! আজকে যাই, আরেকদিন তোমার সাথে কথা হবে !”
বলে সাথে সাথে আমি উঠে গেলাম । মিলির চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছিল কেঁদে ফেলবে । তবুও আমাকে নিষেধ করলো না। আমি যেই বের হবার জন্য ঘুরব তখন আমাকে ডেকে বলল, “সাইম ভাই !”
আমি ঘুরে মিলির দিকে তাকালাম। মেয়েটার চোখের কোণে ২ ফোঁটা অশ্রু ঝলমল করছে। কিছু মানুষকে কাঁদতে দেখলেও মনে হয় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ! আজ আমার তেমনই অনুভুতি হলো ! নিজেই মনে মনে বললাম, “এ নির্ঘাত হুরপরী ! হুরপরী না হয়ে যায়ই না !”
“মিলি, কিছু বলবে !”
মিলি ওর একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “সাইম ভাই, আমি যদি আপনাকে আমার হাতটা ধরতে বলি, আপনি কি ধরবেন?”
আমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো বসে পড়লাম চেয়ারে ! মুখটা আবার সেদিনের মতো হাঁ হয়ে গেছে ! মাছের মতো শ্বাস নিচ্ছি! বললাম, “ধরবো !”
মিলির চোখে পানি টলমল করছে ! সে খুব আবেগজড়িত গলায় বলল, “যদি বলি আজীবনের জন্য ধরে রাখতে, রাখবেন?”
আমি দুহাত দিয়ে মিলির বাড়ানো হাতখানা ধরি ! গভীর মমতা আর ভালোবাসায় আপ্লূত সেই হাত ধরে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “রাখবো !”
আমি জানি, আজ রাতেও আমার জ্বর আসবে । আমি আজ রাতেও জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকবো । কিন্তু, আমি এও জানি , আজ আমি এমন একজনকে পেলাম যার জন্য আমার জন্ম হয়েছিলো পৃথিবীতে। আজ রাতে আমি ঘুমাব শান্তির ঘুম ।