প্লেটের গরম সিঙারাটা ভেঙে দিয়ে যখন ভেতরের ধোঁয়াগুলো বেরোনো দেখছিলাম৷ ঠিক তখনই আমার আমার সামনে রাখা চেয়ারটাতে শব্দ হয়৷ চোখ তুলে দেখি অণু মেয়েটা৷ হাসি হাসি মুখ নিয়ে চেয়ারটাতে টুপ করে বসে পরে৷
এবারের জ্বরটা মেয়েটাকে ভালোভাবেই পেয়েছে৷ অসুখের প্রভাবে চোখের নিচটাই কালো দাগ ভেসে উঠেছে৷ আমার বড্ড ইচ্ছে করে মেয়েটার গালগুলো একবার ছুঁয়ে দিতে৷
নিজের ইচ্ছেটাকে চেপে রাখি৷ এই চেপে রাখাটা আমি খুব ভালো পারি ছোটবেলা থেকেই৷
অণুর হাসির জবাবে আমিও মুচকি হাসি৷
আমার হাসি দেখে অণুর হাস্যোজ্জল মুখটা কটমট আকার ধারন করে৷
দাঁত মুখ শক্ত করে চেপে রাখে মেয়েটা৷
মেয়েটার সাথে ৪বছর ধরে পরিচয় আমার৷ তারপরও মেয়েটাকে বুঝে উঠতে পারিনি আমি৷
অণু তার হাতের লম্বা নখ দিয়ে টেবিল আচডাচ্ছে৷ মুখে কটমট ভাব৷
অামি হাসি থামালাম না৷
-হাসছিস কেন?
-নিষেধ আছে?
-হ্যা আছেতো৷
-কিসের ?
-আচ্ছা তুই এত বেহায়া কেন? এই যে তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করি৷ সেদিনও করলাম৷ তোর কি রাগ হয়না আমার প্রতি? অভিমান হয়না তোর?”
অণুর কথার প্রতুত্যরে আমি কি বলব ঠিক ভেবে পাই না৷ আমার বুক ফুঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিশ্চুপভাবে বেরিয়ে পড়ে৷
অণু মেয়েটা প্রায়ই অভিমান করে বসে আমার সাথে৷ রাগ করলে যা তা বলে বসে৷
অণুর রাগ-অভিমান ভাঙানোর জন্য আমি ঘন্টার পর ঘন্টা অণুর পাশে বসে থাকি৷
মাসের প্রথম দিকে হলে এক প্লেট ফুচকা অথবা আইসক্রিম এনে নিজ হাতে খাইয়ে দিই অণুকে৷
অার মাসের মাঝখানে হলে , ৫-১০টাকার বাদাম দিয়েই চালাতে হয়৷
আর মাসের শেষের দিকে হলে, অণুর পাশে মাথা নিচু করে বসে থাকি৷ সময়ের সাথে সাথে অণুর রাগটাও মলিন হয়ে আসে৷
একটাসময় অণুর তার নরম তুলতুলে হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়৷
আমি চুপচাপ অণুর নরম হাতটা আমার দু’হাতের মাঝে নিয়ে বসে থাকি৷
আমি ভেবে পাই না এগুলো আমি কেন করি?
অণুতো আমার প্রেমিকা না!
অণুর সাথে যখন আমার বন্ধুত্বের শুরু৷
আমি তুমি করে বলতাম৷ তুইতে আমার জড়তা ছিল৷
অণু আমার কান টেনে বলতো,
-শোন! তুমিতে আমার পোষাবেনা৷ কোনসময় আবার “তুমি”র দোহায় দিয়ে প্রেমপ্রস্তাব দিয়ে বসবি!
অণুর কথাশুনে আমি বিব্রত হই৷
“বৃষ্টিতে ভিজলেই অণূর জ্বর আসে৷ তারপরও বৃষ্টিতে ভিজতে মেয়েটার বড্ড শখ৷
গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বিকেলে যখন আমি আর অণু ফুটপাতে হাঁটছি৷
ঠিক তখনই বেরসিক বৃষ্টি এসে হাজির৷ বৃষ্টিতে ভিজতে আমারও দারুণ লাগে৷
তবে আমি ভিজিনা৷
এই নিয়ে অণুর বিরক্তির শেষ নেই৷ অণুর মতে আমার ভেতরে রোমান্টিছিজম বলতে কিছু নেই৷
বৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আমি দোকানের ছাউনিতে ঢুকে পরি৷
অণু বিরক্তি চোখে তাকায় আমার দিকে৷
আমি মুচকি হাসি৷
অণু বৃষ্টিতে ভেজায় মন দেয়৷
ঠিক তারপরের দিনই অণুর গা কাঁপানো জ্বর আসে৷ একটা শিক ভেঙে যাওয়া রঙিন ছাতাটা নিয়ে অণুর বাসার দরজায় ঠুকঠুক শব্দ করি আমি৷
অণুর বাবা দরজাটা খুলে দেন৷
ভদ্রলোক ঠিক কি কারণে আমাকে ভালো চোখে দেখেন না? সেটা আমি আজো বুঝতে পারিনি৷
মুখটা পানসে করে আমাকে বসতে বলেন৷
উনি পত্রিকা পড়ায় মনযোগ দেন৷
আমার ভেতরে ভেতরে রাগ হল একটু!
একটা ছেলে এই ঝুমবৃষ্টিতে একটা মেয়ের বাসার দরজায় কেন এসেছে?
বুড়োটা কি সেটা বুঝে না৷
মিনিট দুয়েক চুপ করে থাকলাম৷
বুড়োটা বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
-যাও অণুকে দেখে আসো৷
আমি হাফ ছেড়ে উঠে পরি৷
চোখে মুখে তৃপ্তির ভাব নিয়ে অণুর বাবার দিকে তাকালাম৷
আমাকে অবাক করে দিয়ে মানুষটা মুচকি হাসে৷
কিছু না ভেবে অণুর রুমের দিকে পা বাড়াই৷
অণু চুপচাপ শুয়ে আছে তার বিছানায়৷ আমি গুটিপায়ে হেঁটে অণুর শিয়রে গিয়ে বসি৷
অণুর কপালটায় হাত রাখতেই অণু জেগে উঠে৷
মিনিটখানেক চুপ করে থাকে অণু৷ তারপর শোয়া হতে উঠে বসে৷
-তোকে আমার রুমে ঢুকতে বলেছে কে?
অণুর কথা শুনে অবাক হই আমি!
-কি বলিস? তোর রুমে ঢুকতে কেউ বলতে হবে কেন?
-বলতে হবেনা কেন সেটা বল? তুই কে আমার?
-আমি তোর বন্ধু!
-শ্রাবণ তুই এখনই বের হবি আমার রুম থেকে৷ না রুম থেকে নয়৷ তুই বাসা থেকেই বেরিয়ে যাবি!
অণু রাগে ফোসফোস করছে৷
অন্যকেউ হলে হয়তো দ্রুতপায়ে বেরিয়ে পরতো৷ অণুর দিকে ফিরেও তাকাতোনা আর৷
কিন্তু আমি তা করিনি৷
“খুব ঠান্ডা লাগছে! চা খাওয়াবি এককাপ?”
কথাশুনে অণূ নির্বাক হয়ে গেল হয়তো৷ অণুর রাগে ফোসফাস করলেও মুখে কিছু বলতে পারেনি৷
চা আমি ঠিকই খেয়েছিলাম৷
সপ্তাহখানেক অণুর সাথে দেখা করিনি৷
ওর বাবার কাছ থেকে অল্পস্বল্প খবর নিয়েছিলাম৷
.
-কিরে শালা বেহায়া৷ উত্তর দে?
-কিসের উত্তর?
-তোর কি রাগ অভিমান নেই? তুই এমন কেন?
-রাগ-অভিমান কমবেশি সবারই থাকে৷ কিন্তু সবার রাগ-অভিমান ভাঙানোর মানুষ কই বল? ধর আমি তোর সাথে রাগ অভিমান করলাম৷
দিন দুয়েক হয়তো তোরও কষ্ট হবে৷
তারপর তুই তোর বান্ধবীদের কাছে গিয়ে বলবি “শালার একপ্লেট ফুচকা খাওয়ানোর মুরদ নেই! আমার রাগ করে” ইহা অতিব হাইস্যকর ব্যাপার!”
ভেবেছিলাম আমার কথায় অণু আবার রাগ করবে৷ সামনে রাখা সসের বোতলটা নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস দোঁড় করাবে৷
কিন্তু তার কিছূই হলো না৷
আমাকে অবাক করে দিয়ে অণু ফিক করে হেঁসে উঠে!”
-তুই শুধু বেহায়া না রে! হ্যাবলাও বটে৷ কে বলেছে আমি তোকে ছেড়ে যাবো৷ সেদিন রাগ দেখানোর পরও যখন চা চেয়ে বসলি তুই ৷
জানিস আমার খুব হাসি পেয়েছিল৷ অনেক কষ্টে চেপে রেখেছিলাম৷
জানিস শ্রাবণ! আমি প্রতিরাতে তোকে নিয়ে ভাবি৷
তোর সারল্যমাখা হাসিটা আমাকে বড্ড ভালো রাখে৷
আমি অনুভব করি , আমি খুব করে তোকে চাই৷
প্রতিটা বিকেলে আমি তোকে চাই৷
আমার জীবনের প্রতিটা বছর,মাস,সপ্তাহ,
দিন,ঘন্টা,মিনিট,সেকেন্ড এ তোকে আমার দরকার৷
তুই কি আমাকে নিয়ে ভাবিস শ্রাবণ? আমার মতো?”
-হু ভাবিতো৷
প্রতিটা বৃষ্টি বিকালে আমি তোকে নিয়ে ভাবি৷
শীতের সকালে চাঁদর মুড়ি দিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তোকে ভাবি৷
শেষবিকেলের মনখারাপ আর বিষণ্ণতায় তোকে নিয়ে ভাবি আমি৷
প্রতিটা সকালের ঘুম ভাঙে তোর ভাবনা নিয়ে৷
চাঁদের জোৎস্নার আলোতে দাঁড়িয়ে তোকে নিয়ে ভাবি আমি”!
-বলিস নি কেন?
-ভয় লাগে আমার৷
-কিসের ভয় শুনি?
-হারানোর ভয়৷
-চল তোর ভয় দূর করবো!
-কোথায় নিয়ে যাবি?
-বাবার কাছে নিয়ে যাবো৷
-শোন, আমি বেহায়া হলেও মরার ভয় খুব আছে৷ তোর বাবার খানদানি বন্দুকটা দেখলে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়৷
অণু খিলখিল করে হেসে উঠে৷ আমিও হাসি৷
“কোনো ভয় নেই৷ অসুস্থতার চলে বাবাকে বলে দিয়েছি সেদিন”!
-কি বলিস? কি উত্তর দিয়েছে শুনি?
-বাবা বলেছে, যে ছেলে ঝুম বৃষ্টিতে ভাঙা শিকের ছাতা নিয়ে তার মেয়েকে দেখতে এসেছে৷ অন্তত সে কখনো আমাকে কষ্ট দিবেনা! এবারতো যাওয়া যায়?
-আলবাত যাওয়া যায়৷
-আর শোন!
-বল?
-বিয়ের পরও তুই বেহায়া হয়ে থাকবি বুঝলি৷ আমার বেহায়া বর৷