অনেকদিন হল বাড়ি থেকে বিয়ে বিয়ে করে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। যেন এই মূহুুর্তে বিয়ে না করলে দেশে আর কোন অবিবাহিত মেয়ে পাওয়া যাবে না! সব ফুরিয়ে যাবে। এখন নিজের উপরই নিজের রাগ হচ্ছে। কেন যে এত তারাতারি লেখাপড়াটা শেষ করলাম! আরো দু-চারবছর ফেল করে হলেও পড়াশোনার উপরে থাকলে ভালো হত। অন্তত বিয়ে করার জন্য বাড়ি থেকে এত চাপ দিত না। মাঝেমধ্যে এমন হয়, একটু শান্তিতে খেতে পারি না। খেতে বসলেই শুরু হয়ে যায় মায়ের বকবক। বউ থাকলে কত সুবিধা হত, তার কত ইচ্ছা মরার আগে তার নাতি-নাতনীর সাথে খেলা-ধূলা করার। অমকের ছেলে বিয়ে করেছে, তমকের ছেলের একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। এরপর থেকে সে আর খেতে দিতে পারবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝেমাঝে তো দুঃখ করে কেঁদেও উঠে!
তখন আমার অবস্থাটা এমন হয় যে, খাব আর কি, তার কথা শুনেই পেট ভরে গেছে। খাওয়ার জায়গা নেই…
আমি রাজ, রায়হান রাজ। মাষ্টার্স শেষ করে ছোটখাট একটা জব করছি। যদিও বাবার নিজস্ব ছোট একটা প্রতিষ্ঠান আছে, তবে আমার ইচ্ছা নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপরে বিয়ে করা। বাড়িতে অভাব বলতে, মা-বাবার ভাষায় সুধু একটা বউ, আশ্চ্যর্য ব্যাপার! সুধুই একটা বউ হলে নাকি বাড়িটা পরিপূর্ণ হবে। কোন কিছুরই অভাব থাকবে না। দু-দিন আগে বাবা তার নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, হই নিজে মেয়ে দেখ, নইত তারাই মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দেবে। মা বন্ধুর মত হলেও, বাবাকে তেমন বন্ধু ভাবতে পারিনি। ছোটবেলা থেকেই কেমন মনের মাঝে ভয় গড়ে উঠেছে। কাজেই তার কথায় মাথা নিচের দিকে দিয়ে নিজের রুমে আসলাম। ভাবছি, জীবনটা সিনেমা বা গল্পের মত হলে ভালো হত। নিজের গার্লফ্রেন্ড বা কোন বান্ধবিকে ঘরে তুলে এনে বলতাম, এটাই তোমাদের বউমা! শালার কেন যে জীবনে প্রেম করলাম না, লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত না থেকে প্রেম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এখন কাজে দিত…
আজকে আমার বিয়ের রাত, বাসর রাত। শেষমেশ বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করতে হল। মেয়েটা মোটামুটি সুন্দরি, মাথায় লস্বা চুল, মুখটা খানিক লম্বাটে, নাক স্বাভাবিকের থেকে একটু বোচা, টানাটানা চোখ উচ্চতায় প্রায় আমার সমান আর শরিরটা সবমিলিয়ে ফিট! মোটাও না, চিকনও না। বাবা-মায়ের পছন্দ হয়েছে, আমার যে হয়নি, তা না। তবে বড় কথা হল বাবা-মায়ের পছন্দ হয়েছে। মায়ের বিশেষ পছন্দ হল বড় চুল আর মেয়ে গুনবতী সব ধরণের রান্না-বান্না আর কাজ-কর্মে এক্সপার্ট। সাথে অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী। কিছুদিন পরে হবে ৩য় বর্ষ। বাবার বিশেষ কি পছন্দ, সেটা জানিনা! সম্ভবত ভালো চা বানায়!! কারণ, মা তেমন ভালো চা তৈরি করতে পারে না। এ নিয়ে বাবা মাঝেমাঝেই মা’কে কথা শুনায়। কে জানে, হইত মেয়ে নিজ হাতে চা বানিয়ে বাবাকে খাইয়েছে…
যাই হোক…
মেয়ের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে করে আমাদের বাড়ি পৌছানোর পরেই নতুন বউকে ঘরে রেখে সেই যে বেরিয়েছে। এখন বাজে রাত ১১:৫৫ পি.এম!
ঘরে ঢুকে দড়জা আটকে দিতেই বউ বলল…
-সিগারেট খেয়ে আসছেন?
ওমা! সে কি কথা, নতুন বউ সালাম-কালাম নেই, মাথায় বড় ঘোমটা নেই। পরিচিতি পরিচয় পর্ব নেই। সে কি না বলে ‘সিগারেট খেয়ে আসছেন!’ বলার ভাব-ভঙ্গীমাটা এমন, যেন সে আমার কত বছরের চেনা! নাজানি কত বছর তার সাথে ঘর করেছি!
আমি অবশ্য সিগারেটই খেয়ে আসছি। একটা না, একসাথে ৪ টা! বিয়ের কারণে বিভিন্ন ব্যস্ততায় আর লোকজনের জন্য গত ৩ দিন হল সিগারেট খাই না বা খেতে পারিনি। সিগারেটটা নিতান্ত সখের বশে খেলেও, গত দু-দিন নেশাটা চরমে উঠে গিয়েছিল। তাই একেবারে চারটা খেয়ে শান্ত হয়েছি। তার (বউয়ের) কথার উত্তর না দিয়ে বিছানায় বসলাম। জানি না কেন বাসর ঘরে লোকজন গরম একগ্লাস দুধ রাখে, তবে আমি সেটা ঢকঢক করে খেয়ে ফেল্লাম। বউ আবার বলল…
-এখন থেকে আর সিগারেট খাবেন না। সিগারেট খেলে আমার সাথে থাকতে পারবেন না, বাইরে গিয়ে থাকবেন…
আমি অসহায় ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালাম। যেন ভুল করে ফেলেছি। আর তার জন্য লজ্জিত।
সে আবার বলল…
-প্রেম করেছেন কখনো? এযাবত কয়টা প্রেম করেছেন?
-একটা প্রেমও করি নি…
-মিথ্যা বলবেন না, মিথ্যা বলে লাভ নাই। যদিও করে থাকেন, তো এখন থেকে সব বাদ…
-আরে মিথ্যা বলব কেন, একটাও করিনি।
-আমাকে প্রশ্ন করলেন না? আমিই বলি… দুটো প্রেম করেছিলাম। একটা ক্লাস টেইনে থাকতে। আর আরেকটা অনার্স ১ম বর্ষে। কোনটাই টেকেনি। কারণ তাদের চাহিদাটা অন্য কিছু ছিল, চাওয়া-পাওয়াটা অবৈধ কিছু ছিল তাই…
আমি আর তার কথাই মনযোগী হলাম না। আমি আমার মোবাইলটা নিয়ে মনযোগী হলাম। ভাবছি ফেইসবুক রিলেশনশিপ ষ্টাটাসটা পাল্টাবো, জনৈক ভাবি ফোন করতে বলেছিলেন, বাসর রাতে কি কি করতে হবে, কি করা যাবে আর কি করা যাবে না। কিভাবে কি শুরু করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি তিনি সব আমাকে জানাবেন।
কাজেই ভাবিকে ফোন দিয়েছি। হ্যালো বলা মাত্রই রিফা (সদ্য বিবাহিত বউ) ফোনটা কেরে নিয়ে কানে দিল। সম্ভবত মেয়ে কণ্ঠ শুনে ফোনটা কেটে দিয়ে বন্ধ করে ফেলল। বলল……
-দেখুন, ফোন আমারও আছে! কিন্তু আজকের জন্য সব বন্ধ। আর বলেছি না, আজকের পর থেকে সব প্রেম বাদ, সব মেয়ের সাথে কথা বলা বাদ।
সে ফোনটা তার ব্যাগের ভিতর রাখল। বলল…
-ওযু করে আসুন, নামাজ পড়ব। তাছাড়া এশার নামাজও পড়া হয়নি। দুজনে একসাথেই পড়ব।
-আমি তো নামাজ পড়ি না!
-আজ থেকে পড়বেন, রেগুলার পড়বেন। না হলে আমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে পারবেন না!
মনে মনে বললাম, আপনার সাথে সম্পর্ক রাখতে আমার বয়েই গেছে! বাইরে বললাম……
-দাড়ান, আমি অযু করে আসছি…
সে খুশি হয়ে মুছকি হাসি দিল। নামাজ শেষে দুজনা বিছানায় সামনাসামনি বসলাম। সে তার দু-হাত দিয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরে তার কোলে নিল। আমি চট করে হাতটা ছুটিয়ে নিয়ে, নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। সে আবার হেসে উঠল, আর হাতটা আবার ধরে টেনে নিয়ে বলল…
-ওমন করছেন কেন? আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়নি?
-হয়েছে…
-তো? তো, হাত সরিয়ে নিলেন কেন?
-এমনি, কখনো এভাবে কেউ হাত ধরেনি তো তাই…
-আমি আপনার বউ আর আপনি আমার স্বামী। আমাদের ধর্ম মতে, আমরা একে অপরের পরিহিত বস্ত্র সরূপ, বুঝেছেন?
-হুম…
-কচু বুঝেছেন! আপনি আপনার শরিরে যেভাবে পাঞ্জাবি পড়েছেন আমি আমার শরিরে যেভাবে শাড়ি পড়েছি আর অন্যান্য বস্ত্র পড়েছি, আমাদের সম্পর্কটা হল তেমন। আমাদের মাঝে কোন পর্দা নেই, কোন বাধা নেই। আপনি আমাকে যেমন খুশি ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারেন, তেমনি আমারও আপনার উপর অধিকার আছে যেমন খুশি ব্যবহার করার। এবার বুঝলেন?
-হুম বুঝেছি…
-মনে হচ্ছে তাও বুঝেননি! ইচ্ছা করছে আপনাকে জড়িয়ে ধরে একেবারে আপনার বুকের মধ্যে ডুকে, আপনার সাথে মিশে গিয়ে, দুজনা মিলে একজনা হয়ে প্রাক্টিকেলি বুঝিয়ে দেই…
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসছে। যাকে বলে শয়তানকি হাসি! হয়ত আমি লজ্জা পাচ্ছি বলেই, সে আরো বেশি আনন্দিত হচ্ছে। আমাকে লজ্জা দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি বললাম…
-দেখুন, আমার ভীষণ ঘুম পেয়েছে। কাল সকালে কথা হবে, গুড নাইট……
বলেই দুটো বালিস একসাথে একই জায়গায় ছিল, সেখান থেকে একটা বালিশ একপাশে টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।
সে বলল…
-এই উঠুন, উঠুন বলছি। আজকে রাতে কোন ঘুম নেই! আর বালিশ ভাগ করছেন কেন? দুজনা একবালিশে ঘুমাতে হবে। আমাদের ভিতর কোন ফাঁকা জায়গা থাকবে না। প্রয়োজন আপনার বুকের উপর ঘুমাবো!
আমি উঠে বললাম,
-আমার ভীষণ ঘুম পেয়েছে, না ঘুমিয়ে কি করব?
-ঘুমানো চলবে না, কি করবেন, হু… মমম কি করবেন, চলুন গল্প করি!
-এত সুন্দর রাতে না ঘুমিয়ে গল্প করে কাটিয়ে দেয়ার কোন মানেই হয় না!
-রাত আর বেশি বাকি নেই! ঘুমালে ফজরের নামাজ পড়তে পারবেন না। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাবেন।
ঠিক তখন কারেন্ট গেল। যদিও ঘরে এতক্ষণ ডিম লাইটের হালকা আলোতে, আধো আলো, আধো অন্ধকারে কথা হচ্ছিল। কিন্তু, এখন ঘরটা ভিষণ অন্ধকারে পরিণত হল। রিফা… আও… ও… বলে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরল!
-আরে ছাড়ুন…
-ছাড়ব কেন? আর আমি অন্ধকারকে ভীষণ ভয় পাই…
-না ছাড়লে আলো জ্বালাবো কি করে?
-আলো জ্বালানোর দরকার নাই, এভাবেই থাকুন।
পড়লাম মহাবিপদে। এদিকে মোবাইলটা প্রথমেই আটকে রেখেছে। হাতের কাছে তেমন কিছুই নেই আলো জ্বালানোর মত। তারপরেও যেভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, যেন ঝড় আসলেই ছুটাতে পারবে না। ঠিক ততক্ষণে আমার লজ্জা শরম অনেকখানি ভেঙ্গে গেছে। সে জড়িয়ে ধরাতে তার লম্বা চুলের একধরণের পাগল করা গন্ধ আমার নাকে আসছে। মনের ভিতর একধরণের জান্নাতি প্রশান্তি পেলাম। আর মনে মনে বিধাতাকে ধন্যবাদ দিলাম, এমন একটা সময়, এমন একটা বউ আর কারেন্ট যাওয়ার জন্য। ততক্ষণে আমার দু-হাত দিয়েও তাকে জড়িয়ে ধরেছি…