রাফসান কে যখন বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম, আত্মীয় স্বজন, বান্ধবীরা সবাই ভেবেছিল টাকার জন্য ই বিয়েতে রাজি হয়েছি আমি। নয়তো আমার মত একজন শিক্ষিতা, স্মার্ট মেয়ে কেন একটা পঙ্গু ছেলে কে বিয়ে করতে যাবে?
সিদ্ধান্ত টা আসলে হুট করেই নেয়া। বিয়ের কোনো ইচ্ছে ই এমনিতেই আমার ছিল না। কত ছেলেকে ignore করেছি, কত বিয়ের প্রস্তাব reject করেছি, তার ইয়ত্তা নেই!!
কিন্তু রাফসানের মা যেদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাসায় এলেন, সেদিন তার মুখ টা দেখে জানিনা কেন যেন খুব মায়া লাগল। কিন্তু মা খুব রেগে গিয়েছিলেন। খুব অপমান করলেন রাফসানের মা কে। যতটুকু জানলাম, কলেজে পড়ার সময় অ্যাকসিডেন্টে রাফসান নামের ছেলে টা পঙ্গু হয়ে যায়। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেনি। মা তো কিছুতেই এরকম একটি ছেলের সাথে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি নন। কোটি টাকার দেনমোহর আর গয়নার প্রস্তাব সহ তাড়িয়ে দিলেন রাফসানের মা কে। খুব কষ্ট লাগলো। বাসায় কাউকে না জানিয়ে একদিন ফোন করলাম রাফসানের মা কে। জানালাম, রাফসানের সাথে দেখা করতে চাই। পরদিন দেখা করতে যাই রাফসানের সাথে। দেখলাম একটা জীবন্ত লাশ পড়ে আছে বিছানার উপর। যার বাম হাতটা ছাড়া পুরো শরীর ই অবশ। আমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো তক্ষুনি দৌড়ে পালাতো!! কিন্তু আমি পারিনি। রাফসানের মায়াভরা অসহায় মুখ টা দেখে পালিয়ে আসতে পারিনি।
মা কে আমার ছোট বেলা থেকেই খুব ভয় । কোনো দিন তার কথার অবাধ্য হইনি। কিন্তু এই একটা ব্যাপারেই আমি সবার অবাধ্য হয়ে গেলাম। শুধু মনে হচ্ছিল, একজন অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি আমি। আজ যদি সে সুস্থ থাকত আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো, তাহলে এতদিনে হাজার খানেক মেয়ে তার পেছনে ঘুরত। অথচ আজ সে পঙ্গু – প্যারালাইজড হয়ে আধমরা হয়ে পড়ে আছে বলে সবাই তাকে অবহেলা করছে , নাক ছিটঁকাচ্ছে। দুনিয়ার এই কঠিন নিয়ম মানতে পারিনি আমি, তাই তো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা দিয়েছি আমি। কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আজ আমার বিয়ে হয়ে গেছে। বিদায় বেলায় মা আমার মুখ টা পর্যন্ত দেখলেন না। বাবাই এগিয়ে দিলেন গাড়ি পর্যন্ত।
আধঘণ্টা ধরে এই ঘরটাতে বসে আছি, যাকে বলে বাসর ঘর। কিন্তু আর দশটা বিয়ের কনের মত অনুভূতি নেই আমার। কেবলই মনে হচ্ছে, কাজটা কি ঠিক করলাম! অনিশ্চয়তায় ভুগছি। কেবল মানবিক দিকটা বিবেচনা করেই বিয়েটা করেছি আমি। কোনো সাজগোজ নেই, কোনো গহনা নেই। শুধু একটা বেনারসি শাড়ি পরে আছি আমি। রাফসানের মা যদিও অনেক গহনা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি নেই নি। আমি তো একজন অসুস্থ মানুষ কে সেবা করতে এসেছি, প্রতিদান কেন নেব?
এসব সাত-পাঁচ যখন ভাবছি, তখনই দরজা খোলার শব্দ পেলাম। কেউ একজন ভেতরে আসছে। আমাকে বসিয়ে রেখে রাফসানের মা ওকে আনতে গিয়েছিলেন। বেচারা অসুস্থ মানুষ নিশ্চয়ই আসতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। ভাবলাম আমিই গিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসি।
তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কেউ একজন আমাকে ধরে ফেলল।
এক অচেনা যুবক কে ও?
চোর নাকি??
ভয় পেয়ে গেলাম।
– কে আপনি??
– আমার ঘরে ঢুকে আমাকেই জিজ্ঞেস করছ “কে আমি” ?
– আপনার ঘর মানে?? এ তো রাফসানের ঘর!
– আমিই তো রাফসান। চিনতে পারছ না?
– অসম্ভব!
দু পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠামদেহী সুদর্শন যুবকের দিকে আমি তাকিয়ে আছি। এ কি করে সম্ভব? যে রাফসান বিছানায় প্যারালাইজড হয়ে পড়েছিল, সে কিভাবে আমার সামনে দুপায়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে??
আমাকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুদর্শন জিজ্ঞেস করলো,
– অবাক হচ্ছো?
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
যুবক তখন বলতে লাগলো,
– আমিও অবাক হয়ে ছিলাম, পৃথিবী ভর্তি একগাদা স্বার্থপর আর লোভী মানুষ দেখে। মা যখন আমার জন্য পাত্রী দেখছিলেন, তখন অনেক মেয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছিল আমাকে বিয়ে করার জন্য। ছেলে লন্ডন থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা, সেখানেই সেকেন্ড, এমন ছেলে কি হাতছাড়া করা যায়?
সাথে মোটা অঙ্কের দেনমোহর আর কয়েক ভরি গয়নার দাবি তো আছেই!
এদের চোখে লোভ ছিল, কিন্তু বিন্দু মাত্র ভালোবাসা ছিল না আমার জন্য। এদের মধ্যে ভালোবাসা সম্মান খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।
মা আর আমি আঁতকে উঠলাম তাদের লোভের বাহার দেখে। অবশেষে আমরা এক প্ল্যান করলাম, প্যারালাইজড রোগী হওয়ার।
মা তখন সবাই কে মোটা অঙ্কের দেনমোহর আর গহনার লোভ দেখালেন। সবাই এলো বটে, কিন্তু আমার বেহাল অবস্থা দেখে ছুটে পালিয়েছে। শুধু তুমিই একজন ছিলে যে নিঃস্বার্থের মত আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছো, সারা পৃথিবীর সাথে লড়াই করে। আমি তো তোমার অপেক্ষায় ই ছিলাম এতদিন। কোথায় ছিলে তুমি??
… আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। নিজের চোখ কান বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এ কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব???
রাফসান তার শেরওয়ানির পকেট থেকে একটা পাথর বসানো সোনার হার বের করল।
” দেখি তো আমার লক্ষী বউটাকে এটা পড়লে কেমন দেখায়!”
বলে হারটা আমার গলায় পড়িয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল এ কোনো সোনার হার নয়, সোনার মেডেল পড়ানো হয়েছে আমাকে। সারা দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়ার মেডেল পেয়েছি আমি।
রাফসানের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে কাঁদছি আমি। এ কান্না বড়ই সুখের, বড়ই প্রাপ্তির!