ঘরে কি আর বউ নেই? আমি সারাদিন কাজ করবো কেন?
তুমি সবচেয়ে বেশি টাকা দেও সংসার খরচের জন্য।সেই হিসেব করলেও তো আমি রানীর মত থাকতে পারি।আমি ভার্সিটি গ্রাজুয়েট।তোমার ভাবিরা তো এইট পাশ ও করতে পারেনি। গাইয়া টাইপের ওরা।ওদের ই রান্নাঘরে লাকড়ি আর ধোয়ায় মানায়।আমাকে না।তারপরেও তো আমি করি।
এতগুলো কথা শুনার পর নিজেকে নিজে কিভাবে যে কন্ট্রোল করেছি সেটা আমার বোধগম্য নয়। নিজের স্ত্রীর মুখে এরকম কথা শুনতে হবে যদি আগে জানতাম তাহলে স্কলারশিপ এর জন্যে বিদেশ যেতাম না।এত বড় চাকরি করতাম না।গ্রামের একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি নিতাম।আর গ্রামের সহজ স্বভাবের মেট্রিক পাশ মেয়ে বিয়ে করতাম। যদিও শিক্ষাগত যোগ্যতা আর পারিবারিক পরিপক্বতা এক না।তারপরেও কম শিক্ষিতে হয়তো শঠতা কম থাকতো।
আমরা তিন ভাই। চার বোন। পরিবারে আমি সবচেয়ে ছোট।বাবা মা সহ পরিবারে নয়জন। বাবার চাকরিটা চলে যায়।এক রাজনৈতিক ঝামেলায়।সহজ মানুষের মুখের থালা সবাই ই নিতে চায়।আমার বাবারটাও নিয়ে গেছে।আমার বোনেরা পড়ার জন্যে খরচের টাকাটা পেতোনা। সবার প্রায় একটা করে জামা ছিলো। ছিড়ে গেলে বোরকার নিচেই পড়ে যেতো। আল্লাহ বোরকা দিয়ে একটা মেয়ের পর্দার সাথে সাথে গরিবী ও লুকিয়ে রাখে। বড় ভাইয়া তো পড়ার জন্যে টাকাটা জোগাড় করতো আমাদের দাদার থেকে পাওয়া সম্পত্তির কিছু গাছ আর জমি বিক্রি করে। টিউশন করে যা পেতো বাবার কাছে পাঠিয়ে দিতো। নিজের চাপা কষ্ট কোনোদিন কাউকে বলতোনা। আমার বড় ভাইয়ারা লজিং থেকে নিজের সাথে সাথে বাসার খরচ চালাতো।তাও ক্লাস এইট থেকে।
ছোট হওয়ায় সবার আদরের ছিলাম। নয়জনের সংসারে একটা ডিম কে পলি পাতা দিয়ে ভাজি করতো যাতে একটু বড় হয়।আর আমরা সেটা ভাগ করে খেতাম।একটা ডিমের নয়ভাগের মধ্যে সবাই আদর করে আমায় একটু ভাগ দিতো।আমি ছোট আর সবার আদরের বলে।
আমার এখনো মনে আছে একদিন ভাইয়া ঢাকা থেকে আসার সময় চিপস আনেনাই বলে আমি রাগ করে কথা বলিনাই।তখন বয়স ছিলো ছয় বছর। আঠারো বছর বয়সে জানতে পেরেছিলাম যে, ভাইয়া সেদিন তার ভার্সিটি হলের দারোয়ান থেকে আড়াইশো টাকা ধার নিয়ে টিকেট কেটেছিলো।
আমার জন্যে তারা নিজের কলিজা ভাগ করে দিয়েছে।
আমার পড়ার খরচ সহ আরাম আয়েশে থাকার ব্যবস্থা করার জন্যে তারা তাদের আরাম আয়েশ বিসর্জন দিলো।
ভাইয়ারা ভাইয়াদের বউদের জীবনে দামি কিছু গিফট করতে পারেনাই। তারা আমার কাছে শুধু ভাই আর ভাবি না তারা
বাবা আর মা। আমাকে যেমন ভালোবাসতো আমার স্ত্রীকে সবাই তেমনই ভালোবাসতো।
আজ যখন নিজের স্ত্রী তাদের বিপরীতে অভিযোগ দায়ের করে আমার ভালোবাসা আর সম্মানের মেরুকরণ হয়।মেরুকরণ হয় নিজের মেধা আর স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব এর।
একজন স্ত্রীর প্রতি যতটুকু সম্মান আর ভালোবাসা দেয়া দরকার আমি তার কোনোদিক দিয়ে কমতি রাখিনি। আমি আমার পরিবারের জন্যে কিছু করতে গেলেই স্ত্রীর বাধা আসে। যখনই কিছু বলি তখন ও ওর বান্ধবীদের উদাহরণ টেনে আনে।তার বান্ধবীরা নাকি সবাই ঢাকা শহরে বাড়ি করে ফেলেছে।আর সে নাকি গেরাইম্মা বধু।
একদিন ওর উদাহরণ দেখে আমিও আমার কলিগের উদাহরণ দিয়ে বললাম যে
আমার কলিগের স্ত্রী ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করে ডাক্তার হয়েছে। সে গ্রামে একটা চেম্বার দিয়ে সেখানের মানুষের সেবা করে। তার সার্টিফিকেট তাকে অনেক বড় দালানকোঠা দেয়ার সামর্থ্য রাখে।কিন্তু তার শাশুড়ি অসুস্থ এজন্যে গ্রামের এক কোণেই তার বসবাস।
এতটুকু উদাহরণ টেনে আনতেই তার সন্দেহ চলে আসলো আমি নাকি আমার কলিগের স্ত্রীকে পছন্দ করি।
আমি তাকে কি শিক্ষা দিলাম আর সে কি শিক্ষা পেলো সেটা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
একদিকে আমার পরিবার,আমার রক্ত মাংস গড়ার কারিগর অন্যদিকে আমার স্ত্রী,আমার জীবনচলার পথে সাথী।দুইদিকের ভারসাম্য করতে গিয়ে আমি আমার ভারসাম্য ফিরে পাচ্ছিনা।
জীবনে সিগারেটের শলাকা আমি টাচ করিনি।জীবনের ভারসাম্যহীণতার কারণে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ট্রেন রাস্তায় পড়ে থাকতে ইচ্ছে করতেছে।নিজের স্ত্রীকে কষ্ট দিতে পারছিনা। পরিবারের মায়া তো ছাড়াই যাবেনা।স্ত্রীকে বুঝাতেও পারছিনা। স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে বাড়ির পাশেই নদীর পাড়ে বসে বসে জীবনের হিসেব মিলাতে গিয়ে উন্মাদ হয়ে গেলাম।বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখি সবাই চুপ হয়ে বসে আছে।
স্ত্রী গলায় ফাস লাগিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলেছিলো।জানেন রফিক ভাই নিজের স্ত্রীর সকল কিছুর ভার তার স্বামী ই নিতে হয়। আপনি কাউকে শুধু ভালোবাসা দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে পারবেন এই চিন্তা আপনাকে একটা বাজে ধরনের অভিজ্ঞতা দিবে।কাউকে আগলে রাখতে চাইলে ভালোবাসার সাথে সাথে তার আত্মচিন্তার পুতুল হতে হয়।যেটা আমি পারিনি।তাই চার বছরের জেলের সাজা আমারই হয়েছে।
একটা মেয়ের প্রতি আপনার সকল ভালোবাসা উজাড় করে দিতে পারবেন।বিনিময়ে তার পুরোটা পাবেন।কিন্তু একটা আত্মকেন্দ্রিক মেয়েকে আপনার পুরোটা দিয়ে ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিলেও তার অভাবটুকু রয়ে যাবে।জীবনে ননীর পুতুলদের জীবন সঙ্গী করতে হলে ননীর পুতুল ই হয়েই বড় হওয়ার ধাপ পার করতে হয়।আর না হয় সংসার জীবনে বিড়াল হয়ে অথবা অপরাধী হয়ে থাকতে হয়।
খটখট করে সৈনিক একজন নক করলো। ওসি সাহেব নাকি চলে এসেছে। কনস্টেবল রফিক সাহেব কে নিজের গল্প বলতে বলতে চার বছরের আগের সব মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলো।অন্তরটা শক্ত হয়ে আছে। আগামী কালকেই মুক্ত বাতাসের দেখা পাবো। একটা ডিমকে নয়ভাগ করে খেলে মনে হয় অন্তরটা একটু হালকা হবে।