বিয়ের পর থেকে বউকে পটানোর চেষ্টা করে চলেছি। বউ বাসর রাতেই আমাকে বলে দিয়েছে, “আপনার কি মনে হয় এরেঞ্জড ম্যারেজ না হলে আপনি আমাকে পটাতে পারতেন? যদি নিজের প্রতি কনফিডেন্স থাকে, তবে আগে আমাকে পটান, তারপর কাছে আইসেন” । মনে মনে এমন ইচ্ছে আমারো ছিল। বিয়ে করার পর বউয়ের সাথে আগে প্রেম করব, তারপর বাকিসব। তাই আমিও খুশিমনে রাজি হয়ে গেছিলাম।
কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই নিজেকে বাপ্পারাজ মনে হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম বউ নিজে থেকে আগ্রহ দেখাবে, আমি দুয়েকটা প্রেমের কথা বললেই পটে যাবে। কিন্তু পরিস্থিতি এখানে ভিন্ন। বউ এখানে সদ্য কলেজে ওঠা মেয়ের মত শক্ত হয়ে বসে আছে। সে রান্নাঘরে যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকি, সে বলে “বখাটেদের মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন?” তা শুনে আমি তখন রোভার স্কাউটের মত সোজা হয়ে যাই। প্রতিদিন ফুল এনে দেই, সেদিন ফুলের দোকানদার বলছে “ভাই, আপনি আমার দোকান থেকে এত ফুল নিছেন যে, আমি নিজেই পটে যাচ্ছি, আর সেই মেয়ে পটে না! তার কি এটা মন নাকি ইটের টুকরা?”
সে আমাকে একটা ভাল প্রস্তাব ও দিল। সে এখন থেকে আমার বাড়িতে কর্মচারী দিয়ে রোজ একটা ফুল পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু নিজ পায়ে হেঁটে গিয়ে ফুল না আনলে কি প্রেম হয়!
বউ গান শুনতে পছন্দ করে। তাই এক গায়ক বন্ধুর কাছে গান শিখতে গেলাম। বন্ধু আমাকে একটা গানের অন্তরা শুনিয়ে সেটা গাইতে বলল। আমি একটু গাইতেই সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল, তার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। সে একটু সুস্থ হলে তার বউ চুপিসারে আমাকে এসে বলল, “একবার মাহফুজুর রহমানের গান শুনে উনার এ অবস্থা হয়েছিল। রোগ টা ধরতে পারছিনা!” ভাবির কথা শুনে নিজের ইজ্জত নিয়ে সেদিন কোনমতে পালিয়ে এসেছি। পরে এক সপ্তাহ প্র্যাক্টিস করে “কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো” গান টা মুখস্ত করলাম। বউকে একটু শোনাতেই বউ থামিয়ে দিয়ে বলল, “এই গানের গীতিকার আর সুরকার কে জানেন?” আমি কবির বকুল, আর বুলবুল সাহেব ছাড়া কাউকেই চিনি না সঙ্গীত জগতের গীতিকার-সুরকার দের। তাই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে দিলাম। বউ তো রেগে আগুন, সে নাকি সংগীতের খুব কদর করে, তাই এই গান গাওয়া আমার উপর ব্যাকফায়ার করল। মনে মনে ভাবলাম, মেয়ে পটানোর জন্যে সাধারণ জ্ঞান ও লাগে, মেয়ে পটাচ্ছি নাকি বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছি!
তারপর অন্যভাবে চেষ্টা শুরু করলাম। সকাল বেলা উঠে বউকে “গুড মর্নিং” বলে চা হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। বউ বলল, “আমি রঙ চা খাইনা” অথচ তাজা টিব্যাগের ভারতের কমার্শিয়াল টা দেখে সেদিনই গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে আমাকে দিয়ে ওরকম কাপগুলো কিনিয়েছে। আমি বউয়ের রান্নাবান্নার কাজেও সাহায্য করার চেষ্টা করি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রথম দুদিনেই মায়ের চোখে পড়ে গেছি। সেদিন বউকে সিদ্ধ আলুর চামড়া ছুলে দিচ্ছিলাম, মা আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি আলুর না, কোন মানুষের চামড়া ছাড়াচ্ছি। তড়িঘড়ি করে ছিলা আলুটা মুখে পুরে দিলাম যেন মা ভাবেন আমি খাওয়ার জন্যে এসেছি।
সেদিনই আমাকে ডেকে বললেন, “তুই যে গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত হচ্ছিস সেটা জানিস?”
“কোন প্রাণী মা?”
“অনুমান কর”
“গরু?”
“তা তো তুই আগে ছিলি। এখন কুকুর হয়ে গেছিস। বউয়ের কথায় উঠছিস বসছিস”
“আরে না মা! বিষয়টা এমন না। আসলে আমি তাকে পটাচ্ছি। অনেকটা পটে গেছে। শুধু অল্প একটু পটেনি। ওটুকু পটাচ্ছি”।
“আমারই ভুল হয়েছে। তুই শুধু কুকুরই না, আগের মত গরুও রয়ে গেছিস”
এ কথা বলে মা রাগ করে চলে গেলেন। আমি আবার আলু ছিলতে চলে গেলাম।
বউয়ের জন্য প্রায়ই চকলেট কিনে আনি। বউ চকলেট খায় আর তার বান্ধবীর স্বামীদের গল্প বলে। এ কয়দিনের গল্পে তার বান্ধবীর স্বামীদের স্যালারী আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। এখন সে যখনি তার কোন বান্ধবীর কথা বলে আমি তখন স্যালারি দিয়ে মনে রাখি। আশ্চর্য এক আইডেন্টিটি হয়ে যায় মেয়েদের বিয়ের পর। আর মেয়েরা অন্য মেয়ের সমালোচনা করতে পছন্দ করে। আর যারা তাদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলায় তাদের পছন্দ করে। আমি সেই পদ্ধতিই এপ্লাই করছি। চকলেট খেতে খেতে বউ তার বিভিন্ন বান্ধবীর সমালোচনা করে, আর আমি চায়ের থেকে কাপ গরমের মত রেগে যাই ওদের প্রতি, আর বউকে এপ্রিশিয়েট করি। মাঝে মাঝে বউয়ের অনেক প্রশংসা করি। বউ আমার দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “Awww! you’re so cute!” বলে আমার গাল টেনে দেয়। আমার মনে তখন আতশবাজির মত ঠুশঠাশ লাড্ডু ফুটতে থাকে।
বউ যে আমার প্রতি দুর্বল হয়েছে তার প্রমাণ আমি কিছুদিন ধরেই পাচ্ছি। রাতে সে সিরিয়াল দেখতে গিয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে কান্না করে। আমিও মনে মনে এখন খুব চাই যে কোন না কোন কারণে নায়ক-নায়িকার ঝগড়া হয়ে যাক, কিংবা নায়ক মরে যাক, নায়িকা মরে যাক। সেদিন দেখলাম এক নাটকে দুইটা বিয়ে একসাথে হচ্ছে, খুশি খুশি আমেজ। আমি মনে মনে বললাম, “এই বিয়ে ভেঙে যাক। বউয়ের একটু কান্না করার সুযোগ আসুক!” কি আশ্চর্য! পরদিন ই দুটো বিয়ে একসাথে ভেঙে গেল। আর বউ ও কান্নায় ভেঙে পড়ল। এতে একটা বিষয় প্রমাণ পেলাম, ভারতের বিয়ে আর বাঙালী মেয়ের চোখ – কখন ভাঙবে কেউ বলতে পারেনা।
যাহোক বউ আমার এই কাঁধকে মাথা রাখার ঠাঁই হিসেবে নিয়েছে এটা অনেক বড় ব্যাপার। তাই পরিকল্পনা করেছি রাতে একদিন একটা রোমান্টিক মুভি দেখবো দুজনে মিলে, তাকে কোনকিছু উপহার দেব, আর প্রপোজ করব।
পরিকল্পনা মত বউয়ের জন্যে ফুল আর শাড়ি নিয়ে এলাম। রাতে বউকে শাড়ি হাতে দিলাম। বউ খুশিতে আমায় জড়িয়ে ধরলো, বললো “Aww! you’re so cute!” এই কথাটা দ্বারা যে সে কি বোঝাতে চায় তা আমি আজও বুঝতে পারিনি। তাও এই কথাটায়া খুশি লাগে। বউ শাড়ি পরে আসলে দুজনে মিলে মুভি দেখতে লাগলাম। একটা রোমান্টিক সিন আসতেই আমি সোফা থেকে নেমে হাটুগেঁড়ে বসলাম আর ফুল বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “I Love you”
“Aww! Thank you!”
“You don’t love me?”
“Yeah I love you too but as a friend”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কি বলব বুঝতে পারছিলাম। আশেপাশে বাপ্পারাজের আত্মারা ঘুরছিল চরকার মত। সবাই যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে আর বলছে, “তুই তো আমাকেও ছাড়িয়ে গেলি!” চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি আসবে আসবে করেও আসেনি। সেইদিন থেকে ‘গরিবের বাপ্পারাজ’ উপাধিটি আমার।