ফাল্গুনের পড়ন্ত বিকেল।হালকা হালকা শীত করছে।সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। প্রকৃতিতে বয়ে বেড়াচ্ছে হালকা বাতাস। আমি বসে আছি স্টেষনের পেছনে বড় জাম গাছটার নিচে।অপেক্ষা করছি চারুর জন্য।কিছুক্ষন পর হয়ত চারু চলে আসবে।আবার কিছুক্ষন পর চলেও যাবে।
কিন্তু চারু যে সত্যি সত্যি আসেনা। আসে শুধু তার প্রতিচ্ছবি। আমি চারুলতাকে এতটাই ভালবেসেছিলাম যে,এই জামগাছটার নিচে এসে বসলেই মনে হয় চারুলতা আমার পাশেই বসে আছে।আমার সাথে গল্প করছে। কিন্তু যখনি আমি তার হাতটা ধরতে যাবো তখনি সে হাওয়ায় মিশে যায়। তখন খুব কষ্ট লাগে।কী দরকার একটু সময়ের জন্য আসার।এসেই শুধু বুকের ভেতরের কষ্টের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়ে যায়।
তার পুরো নাম ছিল চারুলতা। আমি তাকে চারু বলেই ডাকতাম।চারুর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল,আমাদের স্কুলের ক্লাসেই। আমি তখন নবম শ্রেণীতে। চারু আমাদের স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল।নবম শ্রেনীর প্রথম দিনেই তার সাথে আমার দেখা হয়। চারু ছিল খুব শান্ত স্বভাবের একটা মেয়ে।
চারুকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। হালকা ফর্সা চেহারা। লম্বা লম্বা চুল।তার কালো মায়াবী চোখ আমায় তার দিকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু আমি ভয়ে তার সাথে কথা বলতে পারতামনা। তার সামনে যেতে চাইলেই মনে হত কেউ পা দুটো শেকল দিয়ে বেধে রেখেছে।কিন্তু আমার মন মানছিলনা। আমি যে কখন তার প্রেমে পড়ে গেছিলাম নিজেই বুঝতে পারিনি।
একদিন আমি ক্লাসে শুধু তার দিকেই এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম। তখনো ক্লাসে স্যার আসেনি। হঠাৎ করেই আমি চারুর কাছে ধরা পড়ে গেলাম।সে আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।খুব লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন। প্রথমবার আমি কোনো মেয়ের দিকে এরকম ভাবে তাকিয়ে ছিলাম।আবার সেই মেয়েটার কাছে ধরাও পড়েছিলাম।কী লজ্জা জনক কান্ড ছিল সেটা।
ব্যাপারটা লজ্জা জনক হলেও আমার মন মানতনা।আমার চোখ শুধু বার বার তার চোখের দিকে তাকাত।তার চোখে কী এমন আছে তা আমি নিজেই জানতামনা। আমার চোখ শুধু তার চোখের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েই থাকত।আবার মাঝে মাঝে চারুও আমার দিকে তাকাত।আর তখন আমি চোখ নিচে নামিয়ে ফেলতাম।
এভাবে চলে গেলো কয়েকমাস। কিন্তু আমার চারুর সাথে কথা বলার সাহস হয়নি।কী ভাবে তার সাথে কথা বলব তাও খুজে পাচ্ছিলাম না।একদিন আমি টিফিনের সময় বারান্দার একটা বেঞ্চিতে বসে নিচে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।কিছুক্ষন পর আমি লক্ষ্য করলাম,কেউ একজন আমার পাশে এসে বসল।আমি ঘুরে দেখলাম চারুলতা। চারুকে দেখেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।তখন আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলামনা।কপাল দিয়ে ঘাম ঝড়ছিলা।খুব নার্ভাস ছিলাম সেদিন।প্রথমবার চারুলতা আমার এত কাছে বসেছে।
আমার মনে হল আমার এখান থেকে উঠে যাওয়া উচিত।না হলে এখানে যা কিছু হয়ে যেতে পারে।আমি উঠে দাড়াতেই চারুলতা আমাকে বাধা দিল,
–এই জয় কোথায় যাচ্ছো?বস এখানে।আর তুমি এত ঘামতেছ কেনো?
–এমনিতেই গরম লাগতেছে।
–আচ্ছা,তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
চারুর এই কথাটা শুনে আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। আমার সাথে চারুর কী কথা থাকতে পারে?
–কী কথা?
–তুমি সবসময় এরকম আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকো কেনো?
–খুব ভালো লাগে তো……
আমি কথাটা শেষ না করেই জিভে কামড় দিলাম।কী বলে ফেললাম আমি এটা। চারু এখন কী মনে করবে।আমি ভয়ে ভয়ে চারুর দিকে তাকালাম।চারু আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
–সরি,আসলে আমি…(আমি)
চারু আমায় পুরো কথা বলতে না দিয়েই বলল,
–থাক আর বলতে হবেনা।আমি সব বুঝে গেছি। অবশ্য আমারো তোমাকে বেশ ভালোই লাগে।তবে একটা শর্ত আছে।
–কী শর্ত?
–আমি কবিতা খুব পছন্দ করি। কালকে আমার জন্য একটা কবিতা লিখে আনবে।যদি কবিতাটা আমার পছন্দ হয় তাহলেই আমি তোমার প্রস্তাবে রাজী হব।
এ কথা বলেই চারু আমায় কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে গেল।
সব কিছুই স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছিল।চারুও আমাকে পছন্দ করে তা আমি ভাবতেই পারিনি।কিন্তু চারু যে শর্ত দিল তা কী আমি পুরন করতে পারব?কবিতা কীভাবে লিখব।কখনো তো কোনো কবিতা লিখিনি এবং লিখতেও পারিনা।কিন্তু আমায় পারতেই হবে।চারুলতার মন জয় করতে হলে আমাকে একটা কবিতা লিখতেই হবে।
রাতে একটা খাতা ও কলম হাতে নিয়ে বসলাম কবিতা লিখতে।কিন্তু মাথায় তো কিছুই আসছেনা।অনেক কষ্টের পরে ছোট্ট একটা কবিতা লিখলাম।আশা করছি চারুর ভালো লাগবে।এখন শুধু কাল হওয়ার অপেক্ষা।
পরদিন একটু তাড়াতাড়ি স্কুলে গেলাম।বাড়িতে খুব টেনশন হচ্ছিল।স্কুলে এসেই চারুকে খুজতে লাগলাম।কিন্তু কোথাও পেলামনা।মনে হয় এখনো স্কুলে আসেনি।প্রায় সাড়ে নয়টার দিক চারু স্কুলে এলো।চারুকে দেখেই আমি তার সামনে গেলাম।আমাকে দেখেই চারু বলল,
–কী কবিতা এনেছ?আমার ভালো না লাগলে কিন্তু কী হবে তুমি জানোত?
–আশা করি ভালো লাগবে।
–তাহলে শোনাও।
–এখানে না চলো ছাদে যাই।কবিতা শোনার জন্য একটা নির্জন জায়গা চাই।আর এখানে সবাই কথা বলতেছে।
–ঠিক আছ…চলো ছাদে যাই।
–এবার বল।দেখি তুমি কেমন কবিতা লিখতে পার?
আমি আর দেরি না করে কবিতা পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম।খুব নার্ভাস লাগছিল।টেনশনও হচ্ছিল খুব। আমি বলতে শুরু করলাম,
“”তোমার হাত ধরে হাটব নদীর ধারে,
-তুমি শুধু থেকো আমার পাশে।
-তোমার চুলের সুবাস উন্মাদ করবে আমায়,
-ভরিয়ে দেব তোমার জীবন আমার ভালোবাসায়।
-প্রোপস করছি তোমায়,দিয়ে একটা রোস,
-তোমার কপালে চুমু,দিব আমি রোজ।””
কবিতাটা বলেই সংগে আনা গোলাপ ফুলটা পকেট থেকে বের করে চারুর দিকে এগিয়ে দিলাম। চারু চুপ করে আছে। কোনো কথা বলছেনা।মনে হয় কিছু ভাবছে। আর এদিকে আমি খুব ভয়ে আছি। চারু কী আমার প্রোপসাল এক্সেপ্ট করবে?আমি তাই ভাবছি।
–বাহ!ভালোই হয়েছে কবিতাটা। আমার পছন্দ হয়েছে কবিতাটা।(চারু)
চারুর কথা শুনে একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ছাড়লাম।আমার ভয়টা মুহূর্তের মধ্যেই খুশিতে পরিনত হল।আমি সেদিন এতটাই খুশি হয়েছিলাম যে,মন হয় আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি।
চারু আমার হাত থেকে লাল গোলাপ ফুলটা হাতে নিয়ে,মুখে একটা মিষ্টি মুচকি হাসি দিয়ে নিচে চলে যেতে লাগল।আর আমি আনন্দে আমার মাথার ক্যাপ্টা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে চারুর কাছে ছুটে গেলাম।
সেদিন থেকে আমাদের প্রেমের গল্প শুরু।টিফিন টাইমে নির্জন কোনো স্থানে বসে গল্প করা ছিল আমাদের নিত্য দিনের কাজ।যার মধ্যে স্পেশাল জায়গা ছিল ষ্টেশনের পেছনের বড় জামগাছের তোলায়।মাঝে মাঝে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম। স্কুলে শেষে বিকেলে বেলা আমরা সেই বড় জামগাছটার নিচে বসে গল্প করতাম।সেই জামগাছটার নিচেই বসে আমি প্রথম চারুর গালে একটা চুমু খেয়েছিলাম।চারু সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিল।লজ্জায় আমার দিকে তাকাতে পারছিলনা।
দেখতে দেখতে আমাদের এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো।চারু আর আমাদের বাড়ি পাশাপাশি গ্রামে।তাই পরীক্ষার পরও আমরা দেখা করতে পারতাম।আমরা আগের চেয়ে বেশি সময় একসাথে কাটাতে লাগলাম। আমদের সময়গুলো খুব ভালো ভাবেই কেটে যাচ্ছিল।কিছুদিন পর আমাদের পরীক্ষার রেসাল্টও বের হলো।চারু ভালো ছাত্রী হওয়ায় এ প্লাস পেয়েছিল।আর আমি মোটামুটি ভালোই করেছিলাম।কিন্তুরেসাল্ট দেয়ার পর আমার জীবন পাল্টে গেলো।চারু হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।
রেসাল্ট বের হওয়ার কিছুদিন পর চারু আর আমার সাথে দেখা করতে আসতনা।এর কী কারন তা আমি জানতামনা।চারু আর আমার কাছে কোনো ফোনও ছিলনা যে,যোগাযোগ করব।চারু প্রতিদিন বিকেলে জামগাছটার তলায় আসত।আমি প্রতিদিন জামগাছটার তলায় অপেক্ষা করতাম,কিন্তু চারু আসতনা।এভাবেই চলে গেল এক সপ্তাহ।আমি চারুর কোনো খোজ পেলামনা।আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল।চারুর কিছু হয়নিত।আমি আর থাকতে পারলামনা।আমি চারুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
চারুরা ছিল অনেক ধনী।তাদের ছিল বিশাল বড় বাড়ি।আমি যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যাবো তখন এক মধ্য বয়ষ্কী লোক(বাড়ির দারোয়ান)আমার পরিচয় চাইল।
আমি বললাম,
–আমি চারুলতার বন্ধু।তার সাথে দেখা করতে এসেছি।
–চারু মামুনিতো আমেরিকা চলে গেছে।পড়া লেখা করার জন্য।
–কবে গেছে?
–এই প্রায় এক সপ্তাহ হলো।
আমি আর সেখানে দাঁড়ালামনা।চলে আসলাম।চারু আমেরিকা চলে গেলো…অথচ একবারও আমাকে জানালো।সে কী জানেনা তাকে না দেখলে আমি কতটা কষ্ট পাই।খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।জামগাছটার নিচে বসে অনেকক্ষন ধরে কেঁদেছিলাম।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো ছয় বছর।আমি এখনো চারুর জন্য অপেক্ষা করি।বসে থাকি বড় জামগাছটার নিচে।আমি জানি চারু একদিন আমার কাছে ফিরে আসবে।কিন্তু সেদিন কবে আসবে আমি জানিনা।
কিছুক্ষন পর আমি পাশ ফিরে দেখলাম,চারু আমার পাশেই বসে আছে।আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।তার এই হাসিটা দেখে স্কুকে লাইফের কথা মনে পড়ে গেল।আমি যেদিন প্রথম চারুকে প্রোপস করেছিলাম,সেদিনও চারু এই মিষ্টি হাশিটা দিয়েছিল।
–আজকেও এসেছ?আমার কষ্টটা বাড়িয়ে দিতে।(আমি)
–কী বলো?আমি কী প্রতিদিন তোমার সাথে দেখা করতে আসি নাকী?(চারু)
–হ্যা আসো।কিন্তু কিছুক্ষন পর আবার হারিয়ে যাও।যতক্ষন বসে থাকো তখন আমার মনে প্রশান্তি আসে।কিন্তু যখন চলে যাও তখন খুব ব্যাথা দিয়ে যাও।
–আচ্ছা,ঠিক আছে।আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবোনা।তোমার পাশেই বসে থাকব।
–কেন মিথ্যে বলছ?
–আরে বুদ্ধ আমি মিথ্যে বলছিনা।আমি সত্যিই সত্যিই এসেছি।আমি বিদেশ থেকে ফিরে এসেছি।
এই কথা শুনার পর আমি চারুর দিকে তাকালাম।আমি এখনো ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিনা।আমার এরকম চেহারা দেখে চারু বলল,
–তোমার বিশ্বাস হচ্ছেনা,তাইনা?তাহলে আমার হাতটা ধর।
বলেই চারু তার হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।আমি হাতটা ধরব কী ধরবনা দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
–কী হলো ধর আমার হাতটা।(চারু)
আমি আস্তে আস্তে চারুর হাতটা ধরলাম।
চারুর হাতটা ধরে আমি অবাক হয়ে গেলাম।সত্যিই সত্যিই চারু আমার পাশে বসে আছে।আমি খুশিতে চারুকে জড়িয়ে ধরলাম।খুশিতে কখন যে চোখে দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে গেছে বুঝতে পারিনি।চারুও আমাকে জড়িয়ে ধরল।
–কেনো আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলে।তুমি জানো আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি।(আমি)
–শুধু কী তুমিই কষ্ট পেয়েছ?আমি কষ্ট পাইনি?আমাদের পরীক্ষার রেসাল্টের কিছু দিন পর হঠাৎ করেই বাবা আমাকে বিদেশে নিয়ে গেল।তোমাকে জানানোর কোনো সময় পায়নি।বিদেশে গিয়ে এমন কোনো দিন নেই যে আমি তোমাকে মিস করিনি।আর তোমার কোনো কন্টাক্ট নাম্বারও আমার কাছে ছিলনা।
–আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেনাত?
–আর কখখনো তোমাকে ছেড়ে যাবোনা।সবসময় তোমার পাশেই থাকব।
আজ অনেকদিন পর নিজেকে হালকা হালকা লাগছে।মনে আজ প্রশান্তির হাওয়া বয়ে বেড়াচ্ছে।চারু আমার কাধে মাথার রেখে আছে।আমি দুই হাত দিয়ে তার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে আছি।আর কখনো কোথাও হারিয়ে যেতে দেবনা।সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দিব।