শীতকালে এত দ্রুত দিন ফুরিয়ে যায় কেন? দিন বোধহয় খুব শীতকাতুরে,তাই তাড়াতাড়ি পালিয়ে যায়!
ছাদের রেলিং এ পা দুলিয়ে বসে থেকে এসব কিছুই ভাবছিলো রিমি। আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, সূর্য, পৃথিবী আর চাঁদের কক্ষপথ ভ্রমণ -এতসব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ওর মনের মত হয় না। তাই নিজের মত করে ভাবুক মনে এমন সব উদ্ভট জবাব সে ভেবে নেয়।
ভাবনায় ছেদ পড়লো নানীর ডাকে।
নিচে থেকে নানীমা তারস্বরে চিল্লাছেন,
” ও রিমি, বোন নিচে আয় শিগগির। গায়ের শাল নিয়ে যাস নাই ক্যান? ঠান্ডা লাগবো। এক্ষণি নিচে নাম তুই!”
রিমি ধীরে সুস্থে হেলেদুলে নিচে নামলো। তার মন মেজাজ আজ ভালো। শুধু ভালো না,অত্যন্ত ভালো।বিয়ের পর এই প্রথম নানা বাড়িতে আসা হলো। রিমির স্বামী আসেনি। অফিসে ছুটি মিলেনি। এতে অবশ্য রিমির কোন আফসোস নেই। সে বরং মনে মনে যথেষ্ট স্বস্তি পেয়েছে। তার সেই স্বস্তি আনন্দ হয়ে চোখে,মুখে,দেহ,মনে ছড়িয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে তার বয়স কমে গিয়েছে। যেন বিয়ের আগের রিমিতে ফিরে গিয়েছে। রিফাত মানে রিমির স্বামী আশেপাশে থাকলে এরকম কখনোই সম্ভব হতো না।
বিয়ে হয়ে এক বছর হয়ে গেলেও রিমি এখনো রিফাতকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। আর রিফাত যে ব্যাপারটি বুঝে না তা নয়। তবুও তার যেন কোন গরজ নেই। রিমির মন পাওয়ার কোন বাসনাও নেই। অন্তত রিমির তাই ধারণা। কেমন যেন গা ছাড়া স্বভাব। রিমি রেগে থাকলে কোন পাত্তা দেয়া তো পরের কথা, রিমির রাগ বুঝতেও পারে না। না তাই বলে দায়িত্ব- কর্তব্যে কোন গাফিলতি নেই। চিরাচরিত আদর্শ স্বামীরা যা যা করে রিফাত তার চেয়ে বরং দুই ধাপ এগিয়ে আছে। কিন্তু তবুও রিমির মন ভরে না।
আসলে সে রিফাতের চেয়ে আলাদা চিন্তাধারা সম্পন্ন। রিমি কিছুটা ভাবুক টাইপের। সে চায় শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন নয়,তার সাথে আরও কিছু। দামী কিছু নয়,ক্ষুদ্র কিন্তু প্রেমময় কিছু। যার দ্বারা ভালবাসা প্রকাশ পায়। যেমন – চাঁদনী রাতে দুইজনে পাশাপাশি ছাদে বসে থাকবে,রিমি গুণগুণ করে গান গাইবে,রিফাত শোনাবে প্রিয় কবিতার লাইন। এই না হলো প্রেম! ছুটির দিনের বিকেলে দুই জনের হাতে দুই কাপ চা, একসাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের রাস্তায় চলাচলকারী মানুষ দেখা। এই না হলো ভালবাসা! অথচ তার ভাগ্যে কী জুটেছে? প্রতিটা ছুটির দিনে রিফাত বায়না জুড়ে রিমিকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। কখনো মুভি দেখা, কখনো হয়তো শপিং করা,কখনো কোন সুন্দর জায়গায় ঘুরতে যাওয়া। রিমির মন উঠে না। যেতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে মুখের ওপর দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু পারে না।
হয়তোবা প্রেমের বিয়ে হলে পারতো। প্রেমের পর যে দাম্পত্য জীবনের যাত্রা শুরু হয় সেখানে উভয় পক্ষেরই সমান দাবি জানানোর অধিকার থাকে। রিফাত ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভালো। শান্ত,সহজ-সরল,কিছুটা বোকাসোকা। কিন্তু রিমি ঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। মা-বাবার উপর অভিমান হয়। আর কিছুদিন সময় দিতে পারতেন তারা। জানাশোনা, মেলামেশা আর একটু বেশি হলে হয়তো রিমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। চিন্তাভাবনার এত ফারাক নিয়ে দুইজন মানুষ ঘর করে কীভাবে? আর করলেও তারা সুখী হতে পারে কী? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে রিমির ভীষণ ইচ্ছে হয়। কিন্তু জানা হয় না। প্রশ্ন মনে নিয়েই দিন কাটায়। দিন পার হয়,নতুন দিন আসে। মনের প্রশ্ন মনেই ঘুরপাক খেতে খেতে মাঝেমাঝে ঘূর্ণিঝড় এর আকার নেয়। তখন অস্থির লাগে রিমির। তেমনি এক অস্থিরতার সময়ে হুট করেই নানার বাড়িতে চলে আসে রিমি। আর এখানে এসে সবার আদরে মনের ঝড় ধীরে ধীরে শান্ত মেয়ের মত ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাতের খাওয়ার পর রিমি আর নানীমা পাশাপাশি বসে পান খাচ্ছিলো। পাশের ঘরে নানাভাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। পান খেয়ে রিমির দাঁত লালচে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। সে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে নানীকে বললো,
” নানীমা আমি দাঁত মেজে আসি,তুমি বসো।”
রিমির কথায় নানী হো হো করে হেসে উঠলেন,
“দাঁত মাজলে পান খেয়ে লাভ কী? পান যে খাইছিস তার প্রমাণ রাখা লাগবো না?তুই বরং বস। তোর মাথায় ত্যাল লাগাই দেই। চুলের অবস্থা দেখে মনে হইতেছে পাখির বাসা! ত্যাল না দিয়া তোরা ক্যামন কইরা থাকোস রে? ”
নানীর কথা শুনে রিমি ফিক করে হেসে ফেললো। বাধ্য মেয়ের মত খোলা চুলে নানীর সামনে বসে পড়ে বললো,
” তুমি তবে এই কয়দিনে তেল মালিশ করে করে পাখির বাসাকে পাখির পালকের মত ফুরফুরে বানিয়ে দাও নানীমা!”
রিমির কথায় নানী মাথায় আস্তে একটু টোকা দিয়ে তেল লাগাতে লাগলেন। নানী যখন তেল মালিশ করে দিচ্ছেন রিমির তখন আরামে চোখে ঘুম চলে এসেছে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ এর চমকের মত মাথায় সেই প্রশ্ন ঝিলিক দিয়ে উঠলো। রিমি নানীকে বললো,
” আচ্ছা নানী,নানাভাই তোমায় ভালবাসে? ”
রিমির প্রশ্নে নানী অবাক গলায় বললেন,
” এ কেমন কথা! ভালোবাসবো না ক্যান? ভালো না বাসলে এতদিন সংসার করলাম কীভাবে?”
“সংসার করলেই বুঝি ভালবাসা হয়?”
“হবে না ক্যান? সংসার করতে করতেই তো মহব্বত জন্মে।”
“আচ্ছা শোন বুঝিয়ে বলি। তুমি তো নানাকে বিয়ের আগে চিনতে না। তো বিয়ের পর তাকে তোমার পছন্দ হয়েছিলো? তুমি তার সব কথা শুনতে? তোমার শখ পূরণ করতেন নানাভাই?”
” পছন্দ হইবো না ক্যান? উনি খুব ভালো মানুষ। আমি যেমন তার সব কথা শুনতাম,তিনিও আমার সব কথা শুনতেন। আর শখ পূরণ? কী যে কমু,তোর নানা আমারে বহুত মহব্বত করতো। বয়সে ছোট আছিলাম, কাম-কাইজ ঠিকমতন পারতাম না। সে তার মায়েরে মানে আমার শাশুড়িরে কইতো,আম্মা কাজ শিখায়া দিয়েন,বকাঝকা কইরেন না।”
“তুমি কীভাবে বুঝলে নানাভাই তোমায় ভালবাসে? কী দিয়ে নানা তোমার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করতো?”
” আরে বোন,ভালবাসা কি আর প্রকাশ করনের জিনিস? আমি এমনেই বুঝতাম। আর শখ পূরণের কথা যদি জিগাস তবে কইতে পারি তাও করতো। আমার শাপলা ফুল খুব পছন্দের। তোর নানাভাই বর্ষার মরসুমে প্রত্যেকটা দিন আমার লাইগা শাপলা নিয়া আসতো। বাড়ির মানুষজন ঘুমায় গেলে রাইতে যখন আমি ঘরে যাইতাম সেই ন্যাতানো ফুল চটের ব্যাগ থাইকা বাইর কইরা চুপিচুপি আমারে দিতো। সেই ফুল দিয়া কুপির আলোয় আমি মালা বানাইতাম। আহা! কীসব দিন রে আপু! মানুষটা খাইতে বসে পাতের তরকারির সব আলু সাইডে রাইখা দিতো। আমি আলু খাইতে ভালবাসি জন্য। তারপর যখন তোর মায়ের জন্ম হইলো, পুরুষ মানুষ হইয়াও রাইতে মাইয়ার কান্দনে জাইগা রইতেন,কাপড় পাল্টাই দিতেন। আমারে ডাকতেন না। এহনো উনি আমারে বহুত মহব্বত করেন। পান ফুরানোর আগেই পান নিয়ে হাজির হইবোই,ভুল নাই। আসলে কী জানিস আপু? মহব্বত জিনিসটা আলাদা কইরা দেখানো লাগে না। ছোট ছোট কাজেই তা বুঝা যায়। দুইজন মানুষ তো আলাদা হইবোই। কিন্তু নিজেদের মিইলামিইশা থাকা লাগবো। আর থাকতে থাকতে দেখবি মহব্বত চইলা আসবে। আর এইভাবে যে মহব্বত হয় তা অনেক শক্তিশালী। সহজে ভাঙ্গে না।”
নানীর কথা যখন শেষ হলো রিমির চোখে ভেসে উঠলো কিছু দৃশ্য। একসাথে খেতে বসে ভালো জিনিসটা রিমির পাতে তুলে দেয়া, জন্মদিনে রিমির পছন্দের জলপাই রঙা শাড়ি নিয়ে আসা,অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝেমাঝেই রিমির প্রিয় হাওয়াই মিঠাই কিনে আনা, শপিং এ গেলে রিমির পছন্দের চুড়ি কিনে দেয়ার বায়না করা – এসব কী ছিলো? তবে কি রিমিই ভুল বুঝেছে,ভুল ভেবেছে,ভুল করেছে? আসলেই তো তাই! ভালো না বাসলে এসব করবে কেন? রিমির মন জয় করার তাগিদ না থাকলে এসব করার হেতু কী? ঝুম বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ফেরার পথে রিমির জন্য হাত ভর্তি কদম ফুল কি এমনি এমনি নিয়ে আসে? না! রিমি অন্ধ,রিমি বোকা। রিমি দেখেও দেখতে পায়নি। ভাবালুতার মোহে প্রাপ্য স্নিগ্ধ ভালবাসাকে সে উপেক্ষা করেছে। খুব বেশি কি দেরি হয়ে গেল বুঝতে? না,এখনো সময় আছে। রিমি কালকেই বাড়ি ফিরবে।
নানীকে সিদ্ধান্ত জানালে দুষ্টু হাসি হেসে বললেন,
” নাতজামাইয়ের জন্য মন উতলা হইছে তোমার! যাও তবে,তাড়াতাড়ি যাও! আবার আইসো আমাগো কাছে তারে সাথে নিয়া।”
রাতে নানীর গলা জড়িয়ে রিমি ফিসফিসিয়ে নানীমার কানে কানে বললো,
” আমি তোমাকে ভালবাসি নানীমা!”
” জানিগো আপু। এতদিন পর আসছো তবুও আমার জন্য কালোজাম আনতে ভুলো নাই দেইখাই বুঝছি। তুমি মুখে না কইলেও বুঝছি। সব কথা বইলা বুঝানো লাগে নাগো নাতিন।”
পরের দিন রিমি যখন নিজের বাড়িতে ফিরলো,
রিফাত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললো-
“তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে বসো রিমি। এত লম্বা পথ এসেছো,আমি রান্না করে রেখেছি। তোমার প্রিয় কৈ মাছের ভাজি,ডাল আর গরম ভাত।”
টেবিলে সাজানো খাবার আর রিমির খাওয়ার চিন্তায় রিফাতের উদ্বেগমাথা মুখের দিকে তাকিয়ে রিমির মনে হলো, আসলেই ভালবাসা মুখে না বললেও এমন সব যত্ন আর স্নেহের মাধ্যমেই তা প্রকাশ পায়।