সাদা মখমলের বিছানার চাদরটাকে মাখনের মত লাগছে। তার উপর ছড়িয়ে আছে টকটকে লাল গোলাপের পাপড়ি। মাঝখানে সোনালী রঙের শাড়ি জরিয়ে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে মেয়েটি। কি যেন নাম? ও মনে পড়েছে; নয়ন তারা।
আমি খাটের কোণায় গিয়ে বসলাম। কোনো ইতস্তত না করে বললাম
-দেখেন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি। বিয়ে, সংসার- এসবের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নেই। আমি একটা মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। তাকে বিয়ে করে সুখি হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে সে এক ধনী ব্যাক্তিকে বিয়ে করে। সেই থেকে আমি মেয়েদের ঘৃণা করি। আসলে বিয়েটা বাবার জন্য মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে করতে হয়েছে। মা মারা যাওয়ার পর বাবা খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতেন। তার খুশির জন্যই আমাকে বিয়েটা করতে হয়েছে। আপনি আপনার মত থাকবেন, আমি আমার মত।
কথা গুলো এক নাগাড়ে বলে ওর মুখের দিকে তাকালাম । ভেবেছিলাম কথাগুলো শুনে মেয়েটি কান্নাকাটি করবে, বাংলা সিনেমার কিছু ডায়ালগ দেবে; কিন্তু এমন কিছু হলো না। মেয়েটির দৃষ্টি আগের মতই নিচের দিকে। আমি উঠে সোফার দিকে গেলাম। সোফার কুশনে সবে মাত্র মাথা রাখতে যাবো, এমন সময় মেয়েটির ঝাঁঝালো কণ্ঠ শোনা গেলো
– এই যে, কি হচ্ছেটা কি শুনি?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
– কি হচ্ছে মানে?
– এতক্ষণ যা যা বললেন সব আমি মেনে নিলাম। কিন্তু এটা কি হচ্ছে?
-আপনি কিসের কথা বলছেন?
– আপনি যখন আমাকে মেনে নেবেনই না, তখন এখানে ঘুমাচ্ছেন কোন সাহসে?
মেয়েটির কথা শুনে আমার চোখ ছানাবড়া!
– মানে কী? কোথায় ঘুমাবো?
– ওই তো একটা ব্যালকুনি দেখা যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে ঘুমান।
– কী? আমি ব্যালকনিতে ঘুমাবো?
– জ্বি। যে ছেলে বাবার খুশির জন্য নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে পারে, সেই ছেলে নিজের খুশির জন্য আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে….
-এতো বড় অপবাদ আপনি দিতে পারলেন?
– জ্বী পারলাম। এখন বকবক না করে দয়া করে যান। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে। আমি ঘুমাবো।
– ওখানে আমি কিসে ঘুমাবো?
মেয়েটি খাটের উপর রাখা দু’টো বালিশের একটা আমার গায়ে ছুঁড়ে মারলো
-আপাতত এটা নেন।
-দেখেন, এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।
-আপনি যাবেন? নাকি বাবাকে ডেকে সব বলবো?
আমার চোখ এবার বিস্ময়ে কুমড়ো বড়া!
-আপনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন?
-ব্ল্যাকমেইল নাকি হোয়াইটমেইল তা পরে দেখা যাবে। এখন দয়া করে আপনি রুম থেকে বের হন।
আমি রাগে গজগজ করতে করতে ব্যালকনিতে আসলাম। হায়রে কপাল! এই খোলা জায়গায় আমাকে ঘুমাতে হবে? কি আর করা! বাধ্য হয়ে মাথার নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লাম। সাথে সাথে একঝাঁক গায়ক মশা গিটার হারমোনিয়াম নিয়ে গুনগুন করতে শুরু করলো। আকাশে অর্ধেক চাঁদ ঝলমল করছে। সুন্দর চাঁদটাও আজ বুঝি চৌত্রিশটা দাঁত বের করে ব্যঙ্গ করে হাসছে। হাসো, হাসো! কপাল পোড়া থাকলে চাঁদের বুড়িও এসে পোড়া কপালে লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে যাবে।
অতি কষ্টে রাতটা পার করলাম। রুমে এসে দেখি মহারানী কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। নাহ! মহারানী বললে ভুল হবে, এ হলো দস্যুরানী। আমি সারারাত মেঝেতে ছিলাম, আর দস্যুরানী কাঁথা মুড়ি দিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। এক বুক বেদনা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। ব্রাশটা নিতে গিয়ে দেখি আমার ব্রাশের পাশে আর একটা ব্রাশ। নিশ্চয়ই দস্যুরানীর। আমাকে কষ্ট দিয়ে আবার আমার ব্রাশের পাশেই নিজের ব্রাশ রাখা? রাখাচ্ছি তোমার ব্রাশ।
আমি দস্যুরানীর ব্রাশটা মট্ করে ভেঙে ফেললাম। যাক! রাতের কষ্টের প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে ফুরফুরে মন নিয়ে বের হলাম। দস্যুরানী ঘুমাচ্ছে। ঘুমাও চান্দু, ঘুমাও। মজা টের পাবে একটু পরে।
ডাইনিং রুমে বাবা পেপার পড়ছেন।
– শুভ সকাল বাবা।
– শুভ সকাল। তুমি একা কেন? বৌমা কোথায়?
– আর বলোনা বাবা, এই যুগের মেয়েরা তো ১০ টার আগে বিছানা থেকেই ওঠেনা। তোমার বৌমা এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
– No young man. You are wrong. বৌমা অনেক সকালে উঠে নাস্তা বানিয়েছে। তুমি ঘুমাচ্ছো বলে আমরা কেউ নাস্তা করিনি।
তারমানে দস্যুরানী ঘাপটি মেরে ছিলো? বলতে না বলতে নাস্তা নিয়ে বান্দা হাজির। বাবা আনন্দিত হয়ে বললেন- বৌমা, তোমার নাস্তার ঘ্রাণে তো আর লোভ সামলাতে পারছি না। বদরুলের রান্না খেতে খেতে হাঁপিয়ে গিয়েছি
-আর বদরুল চাচার রান্না খেতে হবেনা বাবা। এখন থেকে আমিই রান্না করবো। আর বদরুল চাচার কাছে শুনলাম নাস্তায় নাকি প্রতিদিন পরোটা খাওয়া হয়। আপনার বয়স হয়েছে। এখন থেকে আপনার জন্য রুটি করবো।
-মা, এই বুড়ো মানুষটাকে তুমি দেখে রেখো।
-চিন্তা করবেন না বাবা, এখন থেকে আমি আপনার খেয়াল রাখবো, সাথে আপনার ছেলেরও। কথাটা বলেই দস্যুরানী আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। আমার বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো। নিশ্চয়ই কোন কুবুদ্ধি আছে তা এই বিশ্ব হাসিতেই বোঝা যাচ্ছে। বুদ্ধিমানের কাজ হবে চুপচাপ নাস্তা করে কেটে পড়া।
নাস্তা প্রায় শেষ, এমন সময় দস্যুরানীটা বলল
– বাবা, আপনার ছেলে বলছিলো, ওর নাকি মাঝে মাঝেই বুকে চিনচিন করে। হোটেলে খেয়ে খেয়ে হার্টের বারোটা বাজিয়েছে। এখন থেকে নাস্তার পর আমার তৈরী একটা জুস খেতে হবে। হার্ট ভালো থাকবে। কথাটা বলেই রান্নাঘর থেকে একটা গ্লাস নিয়ে হাজির। আমি ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলাম, কি এটা?
-করল্লার জুস
-কী? মাথা খারাপ? আমি এসব খেতে পারবো না।
বাবা তার আদরের বৌমাকে সাপোর্ট করে বললেন, Young man, বৌমা ঠিকই বলছে। কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নাও।
বাবা আর বাবার আদরের বৌমার চাপে পড়ে বাজে জিনিসটা খেতে হলো। এ্যা! এসব মানুষ খায়? ভুতনী! ডাইনী! এই ছিলো তোর মনে? না হয় একটা ব্রাশই ভেঙেছি। তার শাস্তি এভাবে? এর ঝাল যদি না ঝেড়েছি তবে…
রাতে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি সেখানে চাদর বিছিয়ে মশারী টাঙানো। যাক, দস্যুরানীর মনের বরফটা একটু গলেছে।
বাবার জোরাজুরিতে ভুতনীটাকে একদিন শপিং এ নিয়ে যেতে হলো। দস্যুরানীর দু’হাত ভর্তি ব্যাগ। বাসার গেটে ঢুকেই মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। দস্যুরানী আমার পিছনে। আমি লিফটে উঠেই উপরে চলে গেলাম। কেয়ারটেকারকে ফোন করে বাসায় বিদ্যুতের লাইনে সমস্যা হয়েছে বলে মেইন সুইচটা বন্ধ করে দিতে বললাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে গেলো। যাক! এবার দস্যুরানী আসো তুমি সিঁড়ি ভেঙে। আমাকে করল্লার জুস খাওয়াও? বুঝবে মজা।
বাসায় ঢুকেই কমিক্স নিয়ে বসে পড়লাম, যাতে দস্যুরানীর অবস্থা দেখে হাসিটা কমিক্সের উপর দিয়ে চালিয়ে দিতে পারি। বেশ খানিকটা সময় পার হলো। দস্যুরানী এখনও আসছে না কেন? ব্যালকনিতে গিয়ে উঁকিঝুকি দিয়ে দেখছি। নাহ! নিচেও নেই। গেলো কই? এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। মনটা একটু শান্ত হলো। দরজা খুলে দেখি দারোয়ান মাথায় বিশাল এক সব্জি ভর্তি ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়ানো, তার পিছনে দস্যুরানী। কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছে।
-হা করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঝুড়িটা রান্নাঘরে নিয়ে যান।
-আমি এই ঝুড়ি নেবো?
-হ্যাঁ নিবেন। নয়ত বাবাকে ডাকি?
আবারও ব্ল্যাকমেইল। বাধ্য হয়েই প্রকান্ড ঝুড়িটা নিজের মাথায় নিলাম। অমনি দস্যুরানীটা আমার পকেটে হাত দিয়ে কচকচে একটা পাঁচশত টাকার নোট নিয়ে দারোয়ানকে দিলো। বুঝতে আর বাকি রইলোনা, সিঁড়ি ভেঙে ওঠার শোধ নিচ্ছে। যাক, তবুও তো দস্যুরানীর ঘাম ঝরাতে পেরেছি। এতেই আনন্দিত!
কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। রাতে ল্যাপটপে অফিসের কিছু কাজ করছিলাম। এমন সময় বাবার হইচই শুনতে পেলাম। দৌড়ে গিয়ে দেখি দস্যুরানী মেঝেতে পা চেপে ধরে বসে আছে। আমাকে দেখেই বাবা কেঁকিয়ে উঠলেন
-এই যে গুণধর পুত্র, অফিসে কাজ করিস তাতে হয়না? বাসায় এসেও ওই ঘোড়ার ডিমটা নিয়ে পড়ে থাকতে হবে? বৌমার পা মচকে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।
আমি সন্দেহের চোখে তাকালাম। আসলেই পা মচকেছে নাকি কুবুদ্ধির উদয় হয়েছে? মনের কথা বুঝেই যেন ভুতনীটা মিচকি একটা হাসি দিলো। যা বোঝার বুঝে নিলাম।
-হাদার মত দাঁড়িয়ে আছো কেন? হাদারাম কমিক্স পড়ে পড়ে নিজেও একটা হাদা হয়ে গিয়েছো। বৌমাকে কোলে করে উঠাও।
ভুতনীটা ন্যাকা গলায় বললো
-বাবা, আমার মাথা ঘুরছে। লিফটে উঠলে বমি হবে
বাবাও অমনি আদেশ দিলেন
-বৌমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামাবি
-এই ৬৬ কেজি ওজনের বস্তা নিয়ে ৭ তলা সিঁড়ি দিয়ে নামবো?
ভুতনীটা বিচারের সুরে বলল,
-বাবা, আমাকে অপমান করছে
-বৌমাকে বাজে কথা বলবি না। যা বলেছি তাই কর
ভুতনী! ডায়নোচর একটা!
প্রকৃতিতে শীতের আমেজ। ৭তলা কোলে করে নামার বিনিময়ে সেদিন বিছানাটা সোফাতে দেয়া হলো।
কয়েকদিন পর শুকনো মুখে খাবার টেবিলে বসলাম বাবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।
-কি রে? তোকে এমন লাগছে কেন?
-শরীরটা একটু খারাপ লাগছে বাবা। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে ডাক্তার আঙ্কেলের কাছে গিয়েছিলাম। গ্যাষ্ট্রিক আর প্রেসারের সমস্যা মারাত্নক। ডাক্তার আঙ্কেল বললেন, দুই মাস বাটা মসলার রান্না খেতে। কিন্তু বদরুল চাচা কি প্রতিদিন মসলা বাটতে পারবে?
বাবা একটু চিন্তিত হয়ে গেলেন। বাবার সাধের বৌমা বলল
-বাবা, আমি তো আছি, চিন্তু করবেন না এই তো ঘুঘু, ফাঁদে পা দিয়েছো। এখন বুঝবে, কত গমে কত আটা।
পরদিন ফুরফুরে মন নিয়ে খাবার টেবিলে আসলাম। টেবিলে আমার জন্য আলাদা করে রান্না দেখতে পাচ্ছি। আগামী দুই মাস দস্যুরানী কষ্ট করে মসলা বাটবে, ভাবতেই আনন্দ লাগছে। কিন্তু খাবার মুখে দিতেই আমার চেহারা বাংলার পাঁচ হয়ে গেলো।
-ওয়াক থু! এটা কি? না হয়েছে লবণ, না হয়েছে ঝাল।
দস্যুরানীর বাবাকে আহ্লাদের সুরে বলল,
-বাবা, আমি ডাক্তার আঙ্কেলকে ফোন করেছিলাম। আপনার ছেলে যতটুকু বলেছে তার চেয়েও তার শরীরের অবস্থা ভয়ংকর। ডাক্তার আঙ্কেল রান্নায় সামান্য পরিমানও ঝাল দিতে নিষেধ করেছেন গ্যাস্ট্রিকের জন্য। আর প্রেসার এতোই হাই যে মাত্র তিন চিমটি লবণ দিয়ে রান্না করতে বলেছেন। এভাবে দুই এক মাস খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। ভুতনী! শকুন! দেখাচ্ছি তোকে!
সকালে বাথরুমে ঢুকে দস্যুরানীর শ্যাম্পুর বোতল দেখে পুরো শ্যাম্পু বাথরুমের মেঝেতে ঢেলে দিলাম।
অফিসে যাওয়ার দুই ঘন্টার মাথায় বাবার ফোন আসলো।
-ও খোকা, তাড়াতাড়ি তোর ডাক্তার আঙ্কেলের ক্লিনিকে চলে আয়
-কি হয়েছে বাবা?
বাবা হু হু করে কেঁদে ফেললেন
-বৌমা বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে কখন থেকে যেন বেহুশ হয়ে পড়ে ছিলো। এখনো জ্ঞান ফেরেনি।
আমার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। কোন রকম নিজেকে সামলে ছুটে চললাম।
বাবা আইসিইউ’র সামনে দাঁড়ানো। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলেন।
-বাবা, কি হয়েছে ওর?
-মাথার প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। তোর ডাক্তার আঙ্কেল তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যবস্থা করতে বলল।
জানিনা কোথায় কোথায় ছুটে গেলাম রক্তের জন্য। মাথায় একটাই চিন্তা, রক্তের ব্যবস্থা করতেই হবে।
রাত প্রায় তিনটার দিকে ওর জ্ঞান ফিরলো। আমি ওর মাথার কাছে বসে আছি। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। আমি তো এটা চাইনি। নয়ন হাত দিয়ে আমার অশ্রুস্নাত চোখ মুছে দিলো।
এক মাস পর ওর ব্যান্ডেজ খোলা হলো। ও ভীষন চুপচাপ হয়ে গেলো। আগের মত আর দুষ্টুমী করেনা। সারাদিন কি যেন ভাবে। আমারও ভীষণ একা লাগছিলো। যার দুষ্টুমীর প্রতিশোধ নিতে আমিও ব্যাস্ত থাকতাম, আজ তার নিরবতা আমাকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। কিছুদিন পরেই প্রচণ্ড জ্বর হলো ওর। আমি কপালে জলপট্টি দিতে দিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠতে গিয়ে দেখি আমার গেঞ্জির কোণা ওর হাতের মধ্যে। মনটা কেমন করে উঠলো। মেয়েটা তো আমার উপর ভরসা করেই এই বাড়িতে এসেছিলো। অথচ আমি…
ইদানিং খুব অস্থির লাগে। ওর কথা সব সময় মনে পড়ে। সেদিন অফিস থেকে বাসায় গিয়ে জানতে পারলাম ওর ভাই এসে কয়েকদিনের জন্য নিয়ে গিয়েছে। চারদিনের দিন মনকে আর কিছুতেই মানাতে পারলাম না। অনেক দ্বিধার পরে ওকে ফোন করে বললাম
-বাবার শরীরটা একটু খারাপ। পারলে একটু তাড়াতাড়ি আসবেন।
বুঝতে পারলাম না, মিথ্যা কেন বললাম? অবচেতন মন কি ওকে কাছে পেতে চাইছে?
আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। সকালে বাথরুমে ঢুকে ওর ব্রাশটা বেসিনের উপর দেখে আমার ব্রাশের পাশে রেখে দিলাম।
অফিস থেকে ফেরার সময় বেলী ফুলের মালা নিলাম। এসে দেখি নয়ন লাগেজ হাতে বসে আছে।
-আপনাকে কিছু বলার ছিলো। আমার মা অসুস্থ। তার চিকিৎসার টাকা আর আমার ভাই বোনের পড়ার খরচ চালাতে বাবা হিমশিম খায়। আপনার প্রথম দিনের কথা শুনে আমার উচিৎ ছিলো ফিরে যাওয়া। কিন্তু বাবার উপর বোঝা হতে চাইনা বলে আপনার মনের বিরুদ্ধ এখানে ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে জোর করে কোথাও জায়গা পাওয়া যায়না। আমি চলে যাচ্ছি।
নয়ন লাগেজটা হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো। আমি খপ করে ওর হাতটা ধরলাম।
-আমাকে এতোদিন অনেক কষ্ট দিয়েছো। তার শাস্তি না নিয়ে তো যেতে পারবে না।
-আপনি যা শাস্তি দেবেন তা মেনে নিয়েই আমি চলে যাবো।
-আগে লাগেজ রাখো।
লাগেজ রাখতেই আমি ওর হাত ধরে টান দিয়ে আমার বুকের কাছে এনে জড়িয়ে ধরলাম।
-কি করছেন?
-তুমি যেতে চাইলেও এখন আর তা পারবেনা। আমার বুকের ভেতর তোমাকে আটকে রাখবো। এটাই তোমার শাস্তি।
নয়ন কাঁদছে। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
রাতে নয়নের জন্য বসে অপেক্ষা করছি। ওই তো, দস্যুরানীটা; না, আমার জীবনের রানীটা চলে এসেছে।
-এই যে, কী ব্যাপার শুনি?
সেই প্রথম রাতে মতই ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল
-কী?
-এখানে শুয়ে আছেন কেন?
-কোথায় যাবো?
-কেন? এতোদিন যেখানে ঘুমাতেন সেখানে। ঐ সোফায়।
আমি বুঝলাম নয়ন দুষ্টুমী করছে।
-আজ নিজে ঘুমাবো না, কাউকে ঘুমাতেও দেবো না।
-তো?
-বউকে ছাদে নিয়ে সারারাত গল্প করবো।
আমি নয়নকে কোলে তুলে নিলাম।
-এই, ছাড়েন
-আগে তুমি করে বলো
-আচ্ছা, ছাড়ো
-না, কোলে নিয়ে ছাদে যাবো
-৬৬ কেজি বস্তা কোলে নিতে কষ্ট হবে না?
-এখন আর ৬৬ কেজি মনে হচ্ছেনা। ৬ কেজি মনে হচ্ছে
-কেন?
-এখন যে বউটাকে খুব ভালোবাসি।
-এ্যাহ! এতো কষ্ট দিয়ে এখন ভালোবাসি? বললেই হলো? এখন আর ভালোবাসতে দেবো না।
-ভালোবাসতে না দেও, শুধু তোমার ব্রাশের পাশে আমার ব্রাশটা রাখতে দিও
নয়নকে ছাদে দোলনার উপর বসিয়ে দিলাম। ঠান্ডা বাতাস বইছে। একই চাঁদর গায়ে পেঁচিয়ে দু’জন জড়োসড়ো হয়ে আছি। নিরবতা ভেঙে নয়ন বলল
-এই, ভালোবাসো?
-হু
-কতটা?
-তিন চিমটি
-মাত্র তিন চিমটি?
– তোমার তিন চিমটি লবণের রান্নাকে যতটা ভালোবাসি, ঠিক ততটাই
নয়ন খিলখিল করে হেসে বুকে মুখ লুকালো। আমি ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললম,
-তিন চিমটি লবণ সাগরে ফেললে যতটা পানিতে মিশে যাবে, তারচেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে।
আমাদের ভালোবাসার কথা শুনে চাঁদটাও যেন মৃদু হাসছে।