ফোনালাপের এক পর্যায়ে রেহানা তার বড় বোনকে বলছে, ‘আপু, মাসুদ বারবার বলছে চুল কেটে ছোট করতে। কী করবো বল।’
ওপাশ থেকে রুবি হেসে বলে, ‘আরে কেটে ফেল না। বারবার বলছে যখন ওর শখ হয়েছে হয়তো।’
‘কিন্তু আমার তো বড় চুল অনেক পছন্দ।’
‘আরে পাগলি, তোর পছন্দে তো অনেক দিন কাটালি। এখন না হয় একটু বরের মনমতো চল। চুল তো আবার বড় হবে, তাই না?’
‘হুম।’ খুব অনাগ্রহের সাথে উত্তর দেয় রেহানা।
কথা বলা শেষে রেহানা নিজেকে বুঝিয়ে মনস্থির করে চুল কাটানোর জন্য। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আজ কেটে ছোট করে ফেলবে ওর হাঁটু সমান চুলগুলো।
রেহানা বাড়িতে ফেরার ঘণ্টা খানেক পরেই মাসুদ আসে অফিস থেকে। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিজের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাতে খাবার টেবিলে মাসুদ লক্ষ করে রেহানার চুল। মুগ্ধ হয়ে বলে ওঠে, ‘ওয়াও! ইয়্যু আর লুকিং ভেরি গর্জিয়াস!’
‘প্রায় অর্ধেক চুল কাটতে হয়েছে মাসুদ। আমার অনেক খারাপ লেগেছে।’ শুকনো মুখে উত্তর দেয় রেহানা।
‘আরে এ যুগে এমন বড় চুল রাখে নাকি কেউ! কী অদ্ভুত যে লাগতো তোমায়!’ বলেই ঠোঁট দু’টো বাঁকিয়ে উপহাস করে খাবার মুখে দেয় মাসুদ।
রেহানা আর কথা বাড়ায় না। মাসুদ ওর দিকে তাকিয়ে আরেকবার বলে, ‘খুব সুন্দর লাগছে।’
রেহানা জোর করে মুখে একটু হাসির রেখা টানে।
রাতে মাসুদ ঘুমিয়ে পড়লে রেহানা উত্তরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। শীতল হাওয়া ছুটছে বাহিরে। শীতের আগমনী বার্তা জানাতে ব্যস্ত ওরা। গায়ের ওড়নাটা চাদরের মতো ছাড়িয়ে নেয় রেহানা। এতে শীত একটু কমে। হঠাৎ একটা মিষ্টি ডাকে দূরে তাকায়। ওদের বাসার সামনে দুই বাড়ি পরেই একটা বাসার কর্তা বাড়ি ফিরেছে। ‘লতা? ও লতা? দরজা খোলো? লতা? ঘুমাইছোনি?’
খুব ধীরে তবে ভরা কণ্ঠে ডাকছে লোকটি। নিশ্চুপ রাত্রি বেয়ে কাছে এসে সে শব্দ মায়া লাগায় রেহানার কানে। এরমাঝেই টিন শেডের ঘরের নড়বড়ে কাঠের দরজাটা খুলে যায়। লোকটি ঘরে প্রবেশ করে। রেহানার কাছে লতা নামের মহিলাটিকে খুব ভাগ্যবতী মনেহয়। অন্যরকম ভাগ্যবতী, যার কিছু না থেকেও সব আছে আর ওর সব থেকেও যেন শুন্য সব। তিনতলা ভবনের আরাম-আয়েশ, অর্থবিত্ত সব থেকেও যেন কোথায় এক শুন্যতা বিরাজ করে! সেটা খুঁজে হয়রান হয়ে যায় ও। হারিয়ে যায় অতীতে। ওদের বিয়ের বয়স দেড় বছর। মাসুদ একজন সরকারি কর্মকর্তা আর রেহানা একটি সরকারি কলেজের শিক্ষিকা। রেহানার চাকরীর বয়স তিন বছর। এই তিন বছরে কর্মক্ষেত্র যে ও কতো রকমের মানুষ দেখেছে! এসব দেখে দেখে এখন বিরক্ত ও। সব কিছু থেকে ছুটি নিতে ইচ্ছে করে এখন। অথচ চাকরী ছাড়ার কথা বললেই মাসুদ রেগে যায়। বলে বৌ চাকরী করা ব্যাপারটা নাকি তার কাছে সম্মানজনক। এই সম্মান সে নষ্ট হতে দিতে চায় না। রেহানা বলে তাহলে আমাকে বাসার কাজে তুমি সাহায্য করবে। তাতেও নারাজ মাসুদ। সে বারবার ওকে বোঝায়, দেখো মেয়েদের জীবনে সবসময়ই দায়িত্ব বেশি। তোমাকে এভাবেই চলতে হবে। রেহানা রেগে যায়। বলে দেয় পারবে না সে সারাদিন অফিস করে এসে আবার বাকি পুরো সময় সংসারের জন্য খাটতে। সেও তো মানুষ। তার কি একটু বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না? রাতেই সিদ্ধান্ত নেয় চাকরী ছেড়ে দেবে। কারণ তাদের তো যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে। তবুও স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে সকাল বেলাই সব কাজ সেরে আবার কলেজের জন্য রওনা দেয়। এভাবেই চলছে জীবন। ওদের বিয়ের প্রায় দেড় বছরের জীবন।
এসব কথা মনে হতেই রেহানার আবার লতা ভাবির কথা মনে হয়। ওদের বাসায় আসাতে একবার রেহানা কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আচ্ছা ভাবি, ভাই তো টেইলরিং করে। আপনি মেয়ে মানুষ, একটু সাহায্য করলেই পারেন সেলাইয়ে।’ উনি হেসে উত্তর দিয়েছিলো, ‘আমি বলি গো ভাবিজান। সে শুনে না। কয় কামের আবার মাইয়া পুরুষ আছেনি? তুমি তো বাইত কাম করোই। এডা আমার পেশা, আমিই দেখমু।’ শুনে হেসেছিলো রেহানা। দীর্ঘশ্বাসের হাসি।
এসব স্মৃতিকথা ভাবতে ভাবতেই ওর খেয়াল হয় রাত অনেক হয়েছে। এভাবে জাগা আর ঠিক হবে না। তাছাড়া শরীরটাও বেশ দুর্বল লাগছে। কাল ক্লাস নিয়ে ফেরার পথে ডাক্তারের কাছে যাবে একটু। রেহানা বিছানায় এসে মাসুদের পাশে বসে। ওর গায়ের সরে যাওয়া কাঁথাটা আরেকটু তুলে দিয়ে তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। কী নিষ্পাপ লাগে দেখতে ঘুমন্ত মানুষ। খুব ইচ্ছে করে ওর মাসুদের চুলের মাঝে একটু হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু ঘুম ভেঙে গেলে ও বিরক্ত হবে ভেবে নিজের মতো চুপচাপ শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
.
দুইদিন পরের ঘটনা। রেহানা কলেজ থেকে ফিরে খুব ফুরফুরে মনে আছে। এসেই মাসুদের প্রিয় কিছু খাবার রান্না করে। তারপর গোসল করে সুন্দর একটা শাড়ি পরে সাজে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চোখে কাজল আঁকতে নিয়ে ওর মনেহয় কতদিন পর এভাবে বসে সাজছে! আগে তো মন ভালো থাকলেই সাজতো, সেই ছোটবেলা থেকেই এমন। তাহলে কি আজকাল একটা দিনও ওর মন ভালো থাকে না? নাহ, এসব এখন আর ভাবতে চায় না ও।
মাসুদ বাসায় ফিরে ওকে দেখে একটু অবাক হয়। হেসে বলে, ‘লুকিং স্টানিং!’ রেহানাও হাসে।
বিকেলের পরে ঠিক গোধুলীর সময় চায়ের কাপের সাথে একটা খাম ধরিয়ে দেয় রেহানা মাসুদের হাতে। মাসুদ জিজ্ঞেস করে, ‘কী এটা?’
‘না খুললে কী করে বুঝবে?’ রেহানা হেসে উত্তর দেয়।
কোনো সারপ্রাইজ ভেবে মিটিমিটি হেসে খামটা হাতে নিয়ে খুলে ভেতরের কাগজটা পড়তে শুরু করে মাসুদ। কিন্তু কাগজটি পড়া শেষে ওর মুখের সব হাসি ম্লান হয়ে যায়। আকাশের রাতের আগেই অন্ধকার হয়ে আসে ওর মুখ। রেহানার ভ্রু জোড়ায় ভাজ পড়ে মাসুদের অভিব্যক্তি দেখে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাসুদ বলে, ‘এটা হতে পারে না। হলেও গ্রহণযোগ্য না।’
রেহানাও দাঁড়ায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে।
‘গ্রহণযোগ্য না বলতে কী বোঝাচ্ছো মাসুদ?’
‘মানে গ্রহণযোগ্য নয়। নট এক্সেপ্টেবল! কারণ আমাদের প্ল্যান ছিল বিয়ের আড়াই বা তিন বছর পরে একটা বেবি নেবো। এত দ্রুত নয়। এটা একটা এ্যাক্সিডেন্ট। আর এ্যাক্সিডেন্ট কখনই গ্রহনযোগ্য নয়।’
‘তুমি কী বলছো তোমার হুঁশ আছে? হতে পারে দুর্ঘটনা কিন্তু এটা আমাদের প্রথম সন্তান!’
‘এত আবেগী হলে চলে না রেহানা। ছ’মাস পরে আমার দেশের বাইরে যেতে হবে অফিসের কাজে। এখন তো ক্যারিয়ারটা গোছানোর সময়। এখন বাচ্চা নিয়ে আমি কী করবো? তাছাড়া তুমিই বা তখন কোথায় থাকবে?’
‘এভাবে বলছো কেন? শ্বশুড়বাড়ি বা বাবার বাড়ি যেকোনো এক জায়গায় আমার থাকা হয়ে যাবে। না হলে এখানেই থাকবো বুয়ার সাথে।’ ঠাণ্ডাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে রেহানা।
‘নাহ! এভাবে হয় না। আমাদের অন্যকিছু ভাবতে হবে।’
‘কী?’ অবাক ও ব্যথিত রেহানার হয়ে প্রশ্ন।
কাছে এগিয়ে এসে দু’হাতের মাঝে রেহানার মুখটা নিয়ে মাসুদ বলে, ‘এ্যাবরোশন।’
রেহানা চমকে যায়। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় মাসুদকে। আর আগুনঝরা কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘তোমার সাহস কীভাবে হয় এ কথা বলার? নিজের সন্তানকে হত্যা করতে চাও? একটুও গলা কাঁপলো না তোমার?’
‘এত আবেগী হলে চলে না রেহানা। দুনিয়াটা কঠিন। বি প্র্যাকটিক্যাল।’
‘শাট আপ এ্যান্ড ডোন্ট সে এনিথিং। এ্যাকসিডেন্ট বলবে তুমি আর তার মাশুল দেবো আমি আর একটা নিষ্পাপ প্রাণ? আর কখনও আমার সাথে কথা বলতে আসবে না তুমি।’
বেডরুমে এসে দরজা লাগিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে রেহানা। বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে হলেও মাসুদকে ও এমন পায়নি প্রথম দিকে। এতটা বদলে গেল কীভাবে সে, ভেবে পায় না রেহানা।
.
এরপরের ক’দিন দু’জনের বেশ চুপচাপ কেটে যায়। রেহানা ভাবে মাসুদ হয়তো মেনে নিচ্ছে সত্যটা ধীরে ধীরে। কিন্তু সব চিন্তা ভুল প্রমাণ করে মাসুদ শুক্রবারের দিন সকালে রেহানাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে যায়। কারণ শুনে আবার আকাশ থেকে পরে রেহানা। মাসুদ ফের বোঝাতে শুরু করে ওকে।
‘দেখ, যেহেতু সন্তানটা আমাদের তাই তাকে পৃথিবীতে আনতে সম্মতি তো আমাদের দু’জনেরই লাগবে তাই না? একজনের সম্মতিতে তার জন্ম নেওয়া কি খুব একটা ঠিক হবে?’
আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে থেকে উল্টা প্রশ্ন করে রেহানা, ‘তুমি কী বলতে চাও? তোমার সম্মতি না থাকলে এই দিন আমাকে কেন দেখতে হচ্ছে?’
তারপর আরও কথা কাটাকাটি হতে হতে এক পর্যায়ে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে রেহানার। মাসুদও বেপরোয়ার মতো বলে ওঠে, ‘আমিও দেখে নেবো কীভাবে ওকে বাঁচাও তুমি! অযথা শুধু জিদ!’
শুনে হৃদয় চুরমার হয়ে আসে রেহানার। খুব কষ্টে ও বলে, ‘তোমাকে খুনে পেয়েছে মাসুদ। রক্তের নেশায় তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ। সেই শুরু থেকেই তোমার সব কথা, ইচ্ছে মেনে চলেছি আমি। কিন্তু এত বড় পাপ হতে দিতে পারবো না। শুধু মায়েরা না, হবু মায়েরাও যে সন্তানের ঢাল হতে পারে সেটা আমি দেখিয়ে দেবো। আর এমন চিন্তাধারার কারো সাথে বিন্দু মুহূর্তও থাকার রুচি আমার নেই। আল্লাহ তোমায় হেদায়েত দিন।’
‘যা খুশি করো। যেখানে খুশি যাও। আর কিছু বলার নেই আমারও। আমার সমস্ত প্ল্যান নষ্ট হচ্ছে তোমার জন্য, শুধু তোমার একগুঁয়েমির জন্য।’ রেহানার দিকে আঙুল উঁচিয়ে কথাগুলো বলে চলে যায় মাসুদ।
রেহানা থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ও জানে না কোনো হবু মাকে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে কী না! এ সময়টায় যে মানুষটার সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট প্রয়োজন সেই সবকিছু দূরে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। তবে এটুকু স্পষ্ট বুঝতে পারে এখানে থাকা আর ওর জন্য নিরাপদ হবে না। ওর ইচ্ছেও করছে না আর থাকতে। দুপুরে মাসুদের সামনেই ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে আসে রেহানা। ড্রাইভার চাচা ওর কান্নায় ফোলা চোখ দেখেই বুঝতে পারে কিছু হয়েছে। রেহানার বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে গাড়ি ছেড়ে করিম মিয়া বলে, ‘আম্মা, আপনি ঠিক আছেন?’ ‘জ্বি চাচা।’ বলে চুপ হয়ে যায় রেহানা। বাড়ি পৌঁছে গেলে করিম মিয়া আবারও জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মা, কবে নিতে আসবো?’ রেহানা চোখের পানি লুকিয়ে অভিমানে জবাব দেয়, ‘হয়তো তার আর প্রয়োজন হবে না
চাচা।’
.
রেহানার বাড়ির সবাই অবাক হয় মেয়েকে অসময়ে পেয়ে। তবে বহুদিন পরের সাক্ষাতে ওর মা বুকে জড়িয়ে নেয় মেয়েকে। তবে শরীর, চেহারা এমন অসুস্থ লাগছে দেখে নানা রকম প্রশ্ন করে সবাই। জামাই সাথে নেই কেন সেটাও জিজ্ঞেস করে। যার কোনো উত্তর থাকে না ওর কাছে। সুখবরটা দেওয়ার মতোও মানসিকতা নেই ঐরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এসে। ‘খুব ক্লান্ত এখন। সকালে কথা হবে।’ বলে নিজের রুমে চলে আসে রেহানা।
.
অভিমান করে চলে এলেও প্রতিদিনই রেহানা মাসুদের ফোনের জন্য অপেক্ষা করে। মনের কোথায় যেন একটা দৃঢ় বিশ্বাস সব ঠিক হয়ে যাবে। মাসুদ ওর ভুল বুঝবে। ফোনের শব্দ পেলেই ছুটে আসে ফোনের কাছে, গাড়ির শব্দ পেলেই দৌড় দেয় জানালার কাছে। আবার সাবধান হয় অনাগত সন্তানের কথা ভেবে। ওর এসব আচরণে বাসার লোকজনও একটু অবাক হয়। কিছু হয়ে থাকলে খুলে বলতে বলে। কিন্তু এই কথাগুলো ওর ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়, বলবে কীভাবে? মাসুদ এসব বলেছে ওর এখনও যেন কিছু বিশ্বাস হতে চায় না। ঘোর ও দুঃস্বপ্ন লাগে। যা কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গোনে ও।
.
ঠিক পাঁচদিন পরে ফোন আসে মাসুদের নম্বর থেকে। শত অভিমান, অনুযোগ ও দুঃখ নিয়ে তা আর রিসিভ করে না রেহানা। পরেরদিন আবারও ফোন আসে। এভাবে তিনদিন পর ফোন রিসিভ করে রেহানা। ওপাশে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে একটু পরে বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দেয়। পরেরদিন আবারও ফোন। রেহানা রিসিভ করলে ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ আসে। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না ও। কয়েকবার জিজ্ঞেস করে, ‘মাসুদ? কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?’ কণ্ঠে যতোই রাগ ফুঁটিয়ে তুলতে চায় ততোই যেন উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পায়। একটা সময় ফোন কেটে যায়।
পরদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করিম চাচা আসে গাড়ি নিয়ে। একতোড়া ফুল দিয়ে যায় রেহানার কাছে। তার মাঝেই একটা চিঠি পায় রেহানা। দ্রুত চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে ও।
‘কোথা থেকে কীভাবে শুরু করবো জানি না। কিন্তু শুরু করতে হবে। বলতে হবে। চিঠি লেখার নিয়ম জানি না আমি। কখনই লেখিনি। কিন্তু কথা বলার কোনো মুখ আমার যেহেতু বাঁচেনি সেহেতু লেখা ছাড়া আর কোনো উপায় পেলাম না। মূল কথায় যাচ্ছি। তুমি চলে আসার পরদিন অফিসে যাওয়ার সময় পথে একটা জায়গায় বেশ ভিড় চোখে পড়ে। গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দেখি পাশের ডাস্টবিনে একটা ফুটফুটে বাচ্চা ত্যানায় পেঁচিয়ে ফেলে রাখা। কী নিষ্ঠুর ও বিভৎস যে সে দৃশ্য! হঠাৎ খেয়াল করলাম বাচ্চাটার হাত পা একটু নড়ছে! আমি ভিড় ঠেলে বাচ্চাটার কাছে গেলাম। মাথায় কী হয়ে গেল জানি না। কয়েকজন লোককে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে ছুটলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিলো বাচ্চাটাকে বাঁচাতেই হবে। ডাক্তাররা বাচ্চাটার ট্রিটমেন্ট শুরু করতেই কয়েকজন নিঃসন্তান দম্পতি দাঁড়িয়ে অনুরোধ শুরু করলেন বাচ্চাটা সুস্থ হলে যেন তাদের দেওয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর কী বিচার জানো? বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি। কী অদ্ভুত বিধান, নিয়তি! আমি কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়লাম। বারবার বাচ্চাটা চোখের উপর ভাসছিলো। মেনে নিতে পারছিলাম না কিছু। মিলছিলো না কোনো হিসেব। সে রাতে আমার তোমার কথা খুব মনে পড়েছে। ফোন করে কথা বলতে পারিনি। কেঁদেছি। জানো? সবাইকে আমি বাস্তববাদী হতে বলি অথচ আমিই ছিলাম সবচেয়ে বড় অবাস্তববাদী। আমি বুঝতে পেরেছি যে মানুষের কোনো ক্ষমতা নেই একটা প্রাণ বাঁচানোর তার কোনো অধিকার নেই একটা প্রাণ শেষ করার। আমার সব ভুল ভেঙেছে রেহানা। জানি যে অবিচার ও দুর্ব্যবহার তোমার সাথে করেছি তার ক্ষমা সম্ভব নয়। তবুও যদি সম্ভব হয় তো ক্ষমা করে দিও। বিয়ের রাতে তোমার হাতে যে একজোড়া সোনার বালা পরিয়ে দিয়েছিলাম তা অভিমানে লতা ভাবিকে দিয়ে এসেছো আসার সময়। আমি জানালা দিয়ে দেখেছি। ফুলের তোড়ার মাঝে আরেকজোড়া বালা রাখা আছে। যদি আমাকে ক্ষমা করতে পারো তো বালা দু’টো হাতে দিয়ে একটু বারান্দায় এসো। আমি নিচে দাঁড়িয়ে।’
~ মাসুদ
.
চিঠি পড়ে চোখ ভিজে আসে রেহানার। তারপরই মনেহয় বাইরে দাঁড়িয়ে মানে! এখন তো বৃষ্টি হচ্ছে! নভেম্বর রেইন! মাসুদ বৃষ্টির মাঝে! ভাবতে ভাবতেই তড়িঘড়ি করে বারান্দায় আসে রেহানা। দেখে অন্ধকারের মাঝে গেটের কাছে চুপচাপ বারান্দার দিকে তাকিয়ে, দাঁড়িয়ে ভিজছে মাসুদ। দু’জনের চোখাচোখি হয়। রেহানা ঘরে চলে আসে। ফুলের তোড়া থেকে তাড়াহুড়ো করে বালা দু’টো বের করে হাতে নিয়ে নিচে নামে আস্তে আস্তে। ওর পায়ের শব্দ পেয়ে মাসুদও এগিয়ে আসে। দু’জন মুখোমুখি হলে রেহানা চোখ ভরা জলে বালা দু’টো মাসুদের দিকে বাড়িয়ে বলে, ‘সে রাতের মতোই পরিয়ে দেবে?’
মাসুদ হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে বালাগুলো যত্ন করে পরিয়ে দেয় রেহানার হাতে। গালে আঙুল ছুঁইয়ে চোখের পানি মুছে দেয় প্রিয়তমার। কাঁদতে কাঁদতে রেহানা মাসুদকে জড়িয়ে ধরতে গেলে তখন থামিয়ে দেয় সে। অবাক হয় রেহানা। আবার কী মতলব তার ভেবে। তখনই মাসুদ ফিসফিস করে বলে, ‘আমার গা সম্পূর্ণ ভেজা। তুমিও ভিজে যাও তা চাই না। অন্তত আমাদের বেবির সুস্থতার জন্য।’
তারপর দু’জনেই হেসে ফেলে। ততক্ষণে থেমে গেছে নভেম্বর রেইনও। শীতল বৃষ্টিবিন্দুগুলো এখন স্তব্ধ হয়ে দেখছে আর ভাবছে কোনটা আসলে নভেম্বর রেইনের মতো? ভালোবাসা? না অভিমান?
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক