হঠাৎ-ই কপালে কারো নরম ঠোটের কোমল ছোঁয়া পেলাম।নিশ্চই রূপার! ও ছাড়া আর কে বা হবে। আমি তাকালাম না।ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম।আরেক পাবার আসায়।যদি ভুলে আরেকটা দিয়ে দেয়! সেই আসায়।ওর এমন ছোঁয়া পেতেই আমার চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেল।ঘন্টা খানেক আগেও আমি ঠিক মত চোখ মেলতে পারছিলাম না।আর এখন? কোথায় গেল সেই ঘুম! কি আশ্চর্য! রুপা দেখি আর চুমু খেল না।ওর নরম দুখানা ঠোট আমার কপালে লাগাল না আর।পাশ থেকে কারো উঠে যাওয়ার শব্দ হল।আমি আস্তে করে চোখ খুলে চাইলাম।রুপা উঠে গিয়ে আলিমারির দিকে এগুলো। আমার চোখ যখন ওর হাতের দিকে গেল ঠিক তখন আমি কিছুটা চমকে উঠলাম।ছোট্ট একটা কালো কালারের ডায়েরি। যেটাতে আমি আমার বিভিন্ন সময়ে ভালো লাগার মানুষ গুলোর কথা লিখে রাখতাম।ও আস্তে করে ডায়েরিটাকে আলিমারির একেবারে নিচের একটা ড্রয়ারে এক কোনায় লুকিয়ে রাখল।
ও যখন পিছন ফিরবে আমি ঠিক তখনই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এমন ভাব করলাম যেন আমি ঘভির ঘুমে কাতর।ও ধির পায়ে আমার দিকে এগুলো।ঠিক আমার বালিশের কাছে চলে এল।আস্তে করে কিছু সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর পূর্বের ন্যায় আবার চট করে কপালে একটা চুমু খেল। আমার থেকে কেন জানি ভালো লেগে উঠল। আমার গোপন কথা গুলো জেনে যাওয়ায় রুপা আমার উপর রেগে যায় নি এটাই অনেক।আমিতো এতক্ষন খুব ভয়েই ছিলাম।এই ঢেকে তুলে একগাদা ঝাড়ি শুনাবে বলে।ভয়টা দুর হয়ে আনন্দের শিহরন বইতে লাগল হৃদয় পল্লিতে। এই ছোট ছোট চুমু গুলো আমায় আবার নতুন করে ভালোবাসতে শিখায়।ওর প্রতিটা ছোঁয়ায় আমি অনুভব করি আমার জন্যে ভালোবাসা।একটু কমও না।বরং বেশিই বলা চলে।রুপা আর আমার পাশে থাকল না। উঠে কোথায় যেন চলে গেল।কিছু সময় পরও রুপা আসল না।আমি আস্তে করে উঠে গেলাম।পাগলিটা নিশ্চই ছাদে গিয়েছে?
আমি ছাদে যেতেই দেখলাম রুপা দোলনাটায় বসে আছে।একেবারে চাঁদের দিকে মুখ করে।যেন চাঁদ আর ও প্রেম করছে।আমার কেন জানি খুব হিংসে লাগল। আমি আস্তে গিয়ে ওর পিছনে দাঁড়ালাম। ও মৃদু স্বরে গান গাচ্ছে।আমি তা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম। ওর চিকুন স্বরের কোমল বানি গুলো আমার একেবারে হৃদয়ে লাগছে।একেবারে হৃদয়ের মধ্যখানে গিয়ে ভালো লাগা ছড়াতে লাগল। আমি শুনে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে করে ওর পাশে বসলাম। ও তখনও গান গেয়ে চলছিল। আমি শুনছিলাম।
গান শেষে আমি বললাম,
:এত রাতে ছাদে এলে যে?
ও নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
:এমনিই ভালো লাগছিল না।
:মন খারাপ?
:নাহ্!
আমি কিছু বললাম না।শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে করে উঠে দাঁড়ালাম। ঠিক চাঁদটার দিকে মুখ করে।কোন একটা ফুলের গ্রান বাতাসের সাথে ভেসে আসছে।গ্রানটা একেবারে নাকের ভিতর দিকে হৃদয়ে চালান হয়ে গেল।সেদিকে ধ্যান দিলাম না।আমি উজ্জ্বল চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়।তারপর বললাম,
:ডায়েরিটা পড়েছ তাই না?
পিছন থেকে চট করেই কোন আওয়াজ এল না।কিছু সময় পর কারো উপস্থিতি পাশে টের পেলাম।সাথে উত্তরটাও।বলল,
:পড়েছি তো বটেই।তবে কিছু রহস্য রয়ে গেল।
:কি?
:তোমার শেষ ভালোলাগার মানুষটার নামটা আমি জানতে পারি নি।কে গো সে মায়াবিনী? কি নাম তার? যাকে তুমি এত ভালোবাস।
:বলব।সব বলব তোমায়। তবে একটা শর্তে।
:বল! কি শর্ত?যেকোন শর্ত আমি মেনে নিতে রাজি।
:এত ইচ্ছা! কেন? খুব জ্বলছে?
:না জ্বলে কি আর উপায় আছে? তোমার সব স্বপ্ন তো সেই অপরিচিতাকে নিয়েই! যার অংশীদার আমি।সেই মায়াবিনী আমার অংশে ভাগ বসিয়েছে। তাহলে তুমিই বল আমার জ্বলবে না।বল! জ্বলবে না?
আমি মৃদু হাসলাম পাগলিটার কান্ড দেখে।বললাম,
:আমি কিন্তু সব টুকু লিখি নি ডায়েরিতে!
:আরো বাকি আছে?
:হুম! আজ সব খুলে বলব।
:বল না গো! আমার যে আর অপেক্ষা করতে মন চাইছে না।
:শর্ত?
:বল।কি শর্ত?
:মুখটা এমন প্যাঁচার মত করে রাখবা না।আমার খারাপ লাগে।তোমার কালো মুখখানা দেখলে কিন্তু আমি আর বলব না।
:আচ্ছা। ঠিক আছে।এই দেখ হাসলাম।
সত্যিই সত্যিই পাগলিটা হাসল।প্রানহীন হাসি যাকে বলে আরকি।
:শুন! সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল।আমি বসেছিলাম ঠিক ট্রেনের বাঁ পাশের একটা কামরায়।আমার ঠিক বিপরিতে ডানদিকের কামরাটায় বসেছিল মেয়েটা।মেয়েটা যখন বাইরে বৃষ্টি দেখায় ব্যাস্ত তখন আমি ব্যাস্ত ছিলাম মায়াবিনীকে দেখায়।জানো মেয়েটার পাগল করার মত দুচোখ আছে।যা আমার চোখের সামনে এখনও ভেসে উঠে।বার বার ওর প্রেমে ফেলতে বাধ্য করে।আমি চাইলেও চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।যেন আমার চোখ গুলো মায়াবিনীর দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যই তৈরি হয়েছে।এ যেন নিজের সম্পদ। আমাকে ওর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে।
এই বলে আমি রূপার দিকে তাকালাম।আহঃএ কি চেহারা বানিয়ে রেখেছে।একেবারে গাল ফুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে বিষন্ন মায়ায়।আমি বললাম,
:এটা কিন্তু কথা ছিল না রুপা।তুমি একদম মন খারাপ করতে পারবে না বলে দিলাম।তাহলে কিন্তু আমি আর বলব না।
:এই বারের জন্যে মাপ করে দাও। আর করব না।প্লিজ!
:আচ্ছা।শুন! আমার কাছে একটা জিনিস খুব অদ্ভুত লেগেছে।জানো রুপা!আমি ওর দিকে এতটা সময় তাকিয়েছিলাম,অথচ মেয়েটা আমার দিকে একবারওফিরে চায় নি।আমি যে ওই ট্রেনে ছিলাম সেটা হয়ত মেয়েটা উপলব্ধিই করতে পারে নি।তবুও আমি নেশা কাতুর হয়ে মেয়েটার তাকিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।সেদিন মেয়েটা ট্রেন থেকে নেমে জনসমুদ্রে হারিয়ে যায়।আমি পুরো স্টেশনটা তন্ন তন্ন করে খুঁজি।কিন্তু পাই না।মেয়েটা হারিয়ে যায় সেদিন।নিয়ে যায় আমি হৃদয়টাকে।আমার ক্লাস নাইনে থাকতে একটা মেয়েকে ভালো লাগত,ইন্টারেও একটাকে ভালো লেগেছিল।তখন আমার তাদের প্রতি এতটা ভালো লাগা অনুভূত হয় নি যতটা এই অপরিচিতার জন্যে হয়েছে।বাড়ি ফেরার পর থেকেই আমি কিছুটা উন্মাদ প্রবন হয়ে যাই।চোখ গুলো যেন আমরণ অনশন করে। যেন তাদেরকে সেই মায়াবিনীকে দেখাতেই হবে।আমি শুধু বললাম,খুঁজে বের কর তোদের মায়াবিনীকে।আমি খুঁজতে পারব না।চোখ গুলো তা মেনে নিল এবং ঠিকই তাদের মায়াবিনীকে খুঁজে নিল।
দ্বিতীয় বার দেখা হয় মেয়েটার বাড়িতে।আমি সেদিন চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে যাচ্ছিলাম।হঠাৎই দেখলাম একটা মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কি জানি বলছে।আমি একটু ভালো করে তাকালাম। দেখলাম ছোট একটা ছেলেকে।সে নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। উপর থেকে ওকে কি জানি বলছে।খুব সম্ভব কিছু একটা কিনে আনতে বলছে।চোখ গুলো যে এত তাড়াতাড়ি কাজটা করতে পারবে তা আমার বোধগম্য ছিল না। যার যেটা দরকার সে সেটা খুঁজে নিবেই।মাঝখানে লাভটা হল আমার।হৃদয়ের! আমার হৃদয়ের।সেদিন বাড়ি ফিরে আসি আনন্দে মুখরিত একটা হৃদয় নিয়ে। একটা রঙিন পৃথিবী নিয়ে। আশে পাশের সব কিছুই যেন রঙিন মনে হয়।এক অন্য রকম খুশির মধ্য বাস করতে শুরু করি। মনের ভেতরে তুমুল তোলপাড় শুরু হয়।আনন্দের তোলপাড়।
মায়াবিনীকে বার বার দেখার তোলপাড়। প্রতিদিন মায়াবিনীকে দেখতে যাব, দেখতে পাব বলে মনের ভেতর এক শিহরন সৃষ্টি হয়।বন্ধু সমাবেশে গেলে আড্ডায় মন জমে না।মায়াবিনীকে নিয়ে কল্পনায় ডুবে থাকি।বার বার সেই দু’চোখ ভেসে উঠে আমার নেশা কাতুর দু চোখের মাঝে।মাঝে মাঝে ঠোট বাঁকা করে মৃদু হাসি আনমনে। এই নিয়ে কত কথা শুনেছি বন্ধুদের কাছ থেকে তার অন্তঃ নেই।তারা কারন জানতে চায়।কি দুর্ভাগ্য আমার! আমি কারনটাও বলতে পারি না।বলতে পারি না সেই অপরিচিতার কথা।কেন? জানি না! সত্যিই আমি জানি না।প্রতিদিন মায়াবিনীকে দেখার জন্যে সব কাজ ফেলে চলে যেতাম তার সন্ধানে।তার বাড়ির ধারে।চুপি চুপি,আড়াল হয়ে তাকে দেখতাম। সামনে যাওয়ার বিন্দু মাত্র সাহস আমার তখন ছিল না।জানি না! তখন কি হয়েছিল আমার।কি অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে আমার মাঝে।আনমনে রাস্তা পার করতাম।
ফুটপাতের মাঝে হাটতাম আনমনে।বেশ কয়েকবার কয়েকটা লোকের সাথে বাড়ি খেয়েছি।কেউ পড়ে গিয়েছে।আমি হাত বাড়িয়ে তাকে উঠাতাম।কি করুন স্বরে ক্ষমা চাইতাম আমি।লোকটা আমার এমন অদ্ভুত ভঙ্গি দেখে কিছু বলত না।আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলত, “লোকটা পাগল নাকি? ” আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসতাম। খুব সুন্দর করে হাসতাম। মনে মনে বলতাম সত্যিই আমি পাগল হয়ে গেছি।সত্যিই! কি পরিবর্তনটাই না দেখা দিল আমার মাঝে।অন্য সময় হলে লোকটাকে বেশ কিছু কড়া কথা বলে দিতাম।কয়েকটা মেরেও দিতাম।কিন্তু কি হল! মারা তো দূরে থাক একটা কথাও বলতে পারলাম না।কি পরিবর্তনটাই না দেখা দিল আমার মাঝে।অদ্ভুত সেই পরিবর্তন। কোন সময় কোন ভিখারিকে দুটাকা পর্যন্ত দিতাম না।কিন্ত আজ! আজ দশটাকা দিতে গিয়ে দিয়ে দিলাম একশটাকা।আনমনে। মনের অবচেতনে।লোকটা একশ টাকার চকচকে নোটখানা দেখে তৃপ্তির হাসি দিল।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“অনেক বড় হও! বাজান! অনেক বড় হও।
আমার থেকে কেন জানি অদ্ভুত ভালো লাগল।অন্য সময় সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে দিতাম ক’টা কিল ঘুসি।কিন্তু আজ? আজ দিতে পারি নি।তার শক্ত চামড়ার হাতের স্পর্শও কেমন জানি কোমল লাগল পরম মায়ায় তা মাথা পেতে নিলাম।
কি পরিবর্তটাই না দেখা দিল।যেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি।নিজেকে আর ঠিক আগের মত কন্ট্রোল করতে পারছি না।কেউ একজন ভিতরে বসে নিজেকে কন্ট্রোল করছে।সে আমার সব নিয়ন্ত্রণ নিজের করে নিয়েছে।আমি বার বার তাকে খুঁজি। পেয়েও যাই সেই মায়াবিনীকে।যে আমার ভিতরে নিজের বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছে।কি পরিবর্ত হয়েছে আমার মাঝে।আজর ধারায় বৃষ্টি হয়।টুপটুপ শব্দ করে।আম কান পেতে শুনি। যেন মায়াবিনী আসছে।ধির পায়ে।নুপুরের ঝন ঝন আওয়াজ নিয়ে।বৃষ্টি মাখা বেলি ফুলের মাতাল করা গন্ধের হাওয়া আমার নাক দিয়ে হৃদয়ে পৌঁছে যায়।আমি তা গ্রহন করি তোমার গায়ের মিষ্টি গন্ধ মনে করে।যেন শান্তির আবরন দিয়ে যায়।আমি তা হৃদয়ের দেয়ালে মাখাই।নীলাভ বজ্রপাতের আলো আমার ঘরের দেয়ালে আছড়ে পড়ে।আমি সে আলোয় মায়াবিনী ছায়া খুঁজে বেড়াই।নিজেকে একটু সেই আলোয় ভিজিয়ে নেই।যেন মনে হয় মায়াবিনীর রূপের আলো আমার গায়ে আছড়ে পড়ছে। আমি তা পরম মায়ায় নিজের গায়ে মাখাই।জানো রুপা এই ছাদের প্রতিটা বালুকণা সাক্ষি আমি মায়াবিনীর জন্যে কত কত রাত এভাবে একা বসে কাটিয়েছি।চাঁদের আলোয় নিজের কালো ছায়াকে মায়াবিনীকে কল্পনা করতাম। যেন সে আমার খুব পাশে,একেবারে গায়ের সাথে গা এলিয়ে বসে আছে।আমার রুমের প্রতিটা আসবাবপত্র সাক্ষি। তাদের সাক্ষি রেখে লিখেছি কত আবোলতাবোল কবিতা।লিখেছি কত গল্প।সাক্ষি ছিল আমার ভাঙ্গাচোরা সেই মোবাইল। এই বুড়ো দু আঙুলও।দু’চোখ সাক্ষি ছিল।সাক্ষি ছিল ফেবুর প্রতিটা বন্ধু।যারা উন্মাদ হয়ে থাকত কখন গল্প দিব।কখন তারা আমার সেই আবোলতাবোল কথা গুলো গিলবে।জানো রুপা! রুপা!
আমি পিছন ফিরে চাইলাম।দেখলাম আমার মায়াবিনী দোলনায় বসে দু’চোখ ভাসাচ্ছে।কিন্তু সে জানেনা শেষে তার জন্যে কি অপেক্ষা করছে।আমি দু’পা ফেলে ওর সামনে গেলাম তড়িৎবেগে।ওর পাশে বসে বললাম,
:অ্যাই! রুপা অ্যাই! তুমি কাঁদছ কেন? তোমাকে না বললাম কাঁদবে না।একদম না!আমার কষ্ট হয় জানো না?
ও দু’চোখ মুছে বলল,
:তুমি আমাকে এত ভালোবেসেছ যে কোনদিন কল্পনাই করতে পারি নি যে তোমারও এমন রঙিন একটা অতিত আছে।কিভাবে পারলে তুমি দুজন মানুষকে ভিন্ন রকমে ভালোবাসাতে?
:আমি মোটেও ভিন্ন দুজন মানুষকে ভিন্নভাবে ভালোবাসি নি। আমি একজনকেই ভালোবাসেছি আমার মত করে।যেমন করে মায়াবিনীকে ভালোবেসেছি।জিবনে একজনকেই মন প্রান দিয়ে ভালোবেসেছি।
:মানে?
:আমার কোলে মাথা রাখ।আর একদম কান্না করবা না।আমি যা বলছি মনযোগ দিয়ে শুন।
:আচ্ছা।
এই বলে ও আমার কোলে মাথা রাখল।
আম আবার কল্পনায়য় ডুব দিয়ে ফিরে গেলাম অতিতে।ঠিক যেখানে এসে থামলাম সেখান থেকে শুরু করলাম।
একদিন কি করেছি জানো? মায়াবিনীর চোখ দিয়ে হুট করেই কোন ট্রাফিক সিগন্যাল না মেনে লুকিয় লুকিয়ে ঢুকে পড়লাম মায়াবিনীর হৃদয় গহ্বরে।একেবারে হারিয়ে গেলাম।কিন্তু জানো! আমাকে না খুব হতাস হতে হল।মায়াবিনীর মনের কোঠরের একটা দরজাও আমার জন্যে খোলা ছিল না।একটাও না।আমি পাগলের মত খুঁজলাম। কিন্তু একটা দরজাও খোলা পেলাম না।প্রতিটা দরজায় উপর লিখা, “আমার আগন্তুক স্বামি ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিশেধ।” একটু হতাস হলাম।চারপাশ ঘুরা শেষে যখন একেবারে শেষ দরজাটার সামনে এলাম তখন আমাকে খুব অবাক হতে হল।সেখানে তার স্বামির কথা লিখা নেই। অন্য কেউ একজনের কথা লিখা।যেখানে তার স্বামিও ঢুকতে পারবে না।জানো কে সে? একজন লেখক। যে আবেগের বসে গল্প লিখত তার মায়াবিনীকে নিয়ে।আর আমার মায়াবিনী ছিল তার ক্ষুদে পাঠক।যার জন্যে আমার মায়াবিনী অনেক কেঁদেছে।নিজের অব্যক্ত কথা গুলো সেই আবেগি লেখককে বলতে না পারায় খুব কেঁদেছে আমার মায়াবিনী। আমার খুব খারাপ লাগল। কারন মায়াবিনীর হৃদয়ে আমার জন্যে বিন্দু মাত্র জায়গাও নেই।অনেক খুঁজেছিলাম সেই লেখক কে।কিন্তু পাই নি তখন।পেয়েছি তো বটেই।একটু দেরিতে।আমি বিমর্ষ হৃদয় নিয়ে ফিরে এলাম মায়াবিনী হৃদয় গহ্বর থেকে।যেন সারা বেলা ভিখা করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসা এক ক্লান্ত ভিখুক।
ক্ষুদার্ত কাক যেমন গৌধুলি লগ্নে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে ঠিক সেভাবে আমি ফিরে এলাম মায়াবিনীর হৃদয় থেকে।ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য যেহেতু করেছি সেহেতু শাস্তি পেতেই হবে।আমার ঠিক তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি এতক্ষণ মায়াবিনীর দিকে এক রোখা হয়ে তাকিয়েছিলাম।পাশ থেকে আমার বন্ধুর মৃদু ধাক্কায় আমি বাস্তবে ফিরে আসি।ঘোর কাটাতেই দেখলাম মায়াবিনী সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাগত চেহারা নিয়ে। আমার থেকে কেন জানি সেটা খুব ভালো লাগল।আমি মৃদু হাসলাম।আমার হাসি দেখে মায়াবিনীর রাগটা আরেকটু ছড়ে গেল।ঠাসস ঠাসস করে দিল কয়েকটা চড়।আম তা পরম মায়ায় মাথা পেতে নিলাম।যেন কোমল কিছুর স্পর্শ পেলাম।আমাকে মেরেই মায়াবিনী চলে গেল হন হন করে।রেস্টুরেন্ট এর প্রতিটা মানুষ আমাকে দেখছে। যেন আমি কোন নতুন পশু যাকে সদ্য আনা হয়েছে চিড়িয়াখানায়।মানুষ ভীর করে আমাকে দেখছে।আমি আমার বন্ধুর দিকে তাকাতেই দেখলাম সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।একটা কথাও বলতে পারছে না।আমি আস্তে করে উঠে গেলাম।মায়াবিনী যে টেবিলে বসেছে সেখানে গেলাম।নীল কালারের ডায়েরিটাকে আস্তে করে সবার চোখ কে ফাঁকি দিয়ে নিয়ে এলাম।কেউ টেরও পায় নি।
রুপা হুট করেই আমার কোল থেকে মাথা তুলল।আমার দিকে প্রশ্নবাণ হয়ে তাকিয়ে থাকল। আমি থামলাম না।বললাম,
:সেদিন আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।খুব খুশি। কারন মায়াবিনীর হৃদয় কোঠরে যে লেখকের নাম লেখা ছিল সেই লেখক আমি নিজেই।আমার আবোলতাবোল লেখা গুলো মায়াবিনি পড়ত।নিজেকে আমার গল্পের মায়াবিনী চরিত্র কল্পনা করত।রাত দিন আমাকে নিয়ে ভাবত।নিজের অব্যক্ত কথা গুলো না বলতে পারায় লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত।কেন আমি লেখা গুলো পড়ে আমার চোখ ভিজে এল।এই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে বলে।বেশ কয়েকটা চিঠি পেয়েছিলাম ডায়েরিটার ভিতরে। সব গুলোই ছিল আমাকে নিয়ে।আমাকে নিয়ে মায়াবিনীর স্বপ্ন গুলোর কথা।আমি এক এক করে প্রতিটা চিঠি পড়লাম। পড়ে নিজের অজান্তেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আমার দুজন দুজনকেই ভালোবাসি।একই ভালোবাসা। শুধু পথটা ভিন্ন।দুজনের রাস্তাটা ভিন্ন।আমি প্রচন্ড অবাক হই যখন জানতে পারি আমার মায়াবিনি আমাকে না দেখেই ভালোবেসেছে।পবিত্র ভাবে।কোন গর্ত ছাড়াই।মসৃণ ভাবে ভালোবেসেছে।আমি এত স্বল্প ভালোবাসায় তৃপ্ত ছিলাম না।মায়াবিনিকে নিজের করে পাওয়ার অদম্য নেশ ছড়ে বসল মাথায়।যেন মায়াবিনীকে আমার পেতেই হবে।যে একজন অচেনা মানুষকে রেখে এতটা ভালোবাসতে পারে সে নিশ্চই নিজের স্বামিকে আরো বহু গুনে ভালোবাসবে।ও আমাকে একটা হৃদয়ের ঘর দিয়ে ভালোবেসেছে।এতটা ভালোবেসেছিল যা আমি কল্পনাই করতে পারি নি।।বাকি সব গুলো ঘর রেখে দিয়েছে নিজের স্বামির জন্যে। আমি যদি মায়াবিনীর স্বামি হই তাহলে আমি কত ভালোবাসা পাব সেটা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে।
তারপর একদিন মাকে বলে হুট করেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দেই মায়াবিনীরর বাড়িতে।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো? মায়াবিনী তখনও আমাকে ঠিক চিনতে পারে নি।এমনকি আমাকে যে সেদিন চড় মেরেছিল সেটাও মায়াবিনী ভুলে গিয়েছে।কি অদ্ভুত তাই না? জানো আমি আজোও মায়াবিনীর চোখ দেখে কিছু বলে দিতে পারি নি।কারন ওর চোখের দিকে তাকাতেই দেখা মিলে অজস্র ভালোবাসার।আমার জন্যে।শুধু আমার জন্যে ভালোবাসা।আমি শুধু ওর মুখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারি সে কি চাচ্ছে। মায়াবিনী এখনও জানে না যে যে লেখকে সে ভালোবেসেছে সে লেখক আমিই।জানলে যে কতটা খুশি হবে তা ঠিক আমি ঠাউরে উঠতে পারছি না।
এই বলে আমি রুপার দিকে চাইলাম।দেখলাম সে আমার দিকে চেয়ে আছে।দাঁড়িয়ে আছে দোলনার সামনে।অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে।হুট করেই বলে ফেলল,
:মায়াবিনীর নামটা কি যেন?
আমি কিছু সময় ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।মৃদু স্বরে বললাম,
:রুপা!
রূপা হুট করে বসে পড়ল দোলনায়। দোলনাটা কেঁচ কেঁচ শব্দ করে উঠল। আমি কিছু বললাম না।দ্রুতু হেঁটে গিয়ে লুকিয়ে রাখা নিলাভ ডায়েরিটা নিয়ে এলাম।রুপা সামনে তা মেলে ধরলাম। রুপা তা দেখেই চট করে আমার থেকে সেটা কেড়ে নিল।একজন মা যেমন তার হারিয়ে পাওয়া সন্তান কে ফিরে পেলে যেভাবে আঁকড়ে ধরে রুপা ঠিক সেভাবেই ডায়েরিটাকে আঁকড়ে ধরল।কান্না ভাসিয়ে দিল নিজের দুচোখ কে।আমি বললাম,
:আমিই সেই যাকে তুমি প্রথম দেখায় চড় মেরেছিল।তুমিই সেই যে আমার গল্পের মায়াবিনী। যে মায়াবিনীর মাঝে তুমি নিজেকে কল্পনা করতে।কিন্তু তুমি জানতে না যে তুমিই সেই মায়াবিনী। তুমিই সেই অপরিচিতা। তোমার স্বপ্নের কেউ ভাগ বসায় নি রুপা।তোমার স্বামির উপর কেউ ভাগ বসায় নি।যে বসিয়েছে সে স্বয়ং তুমি নিজেই।তোমার স্বপ্ন তোমারই আছে, থাকবে আজিবন ।
ও আস্তে করে ডায়েরিটা নিজের পাশে রাখল।উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।সেদিনের সেই রাগত চেহারা নিয়ে এগিয়ে এল।এই চড় মারবে বলে।আমি কিছু বললাম না।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।রুপা ভেজা কন্ঠে বলল,
:কিভাবে পারলে তুমি এটা? কেন আমাকে আগে বলনি যে তুমিই আমার প্রথম ভালোবাসা।তুমিই আমার ভালোবাসার লেখক। বিয়ের পরে বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত।জানো আমি আজও একতরপা সেই লেখকেই ভালোবেসে এসেছি।কেন বলনি বল? বল কেন বলনি?
:এমনিই।কেন জানি আনন্দ পাচ্ছিলাম।তুমি আমাকে দুভাবে ভালোবাস এটা ভাবতেই আমার কেমন জানি আনন্দ লাগে।আর তাছাড়া আমি তোমার ডায়েরি পড়েছি লুকিয়ে লুকিয়ে। এখন যদি তুমি আমার ডায়েরি না পড় তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখায়।তাই এতদিন অপেক্ষা করছিলাম কোন দিন তুমি আমার ডায়েরিটা পড়বে।সেদিনের অপেক্ষায় ছিলাম।কখন আসবে সে দিন।আসলেই চট করে সব বলে দিতাম।
এই বসে আমি আস্তে করে মাথা তুললাম।দেখলাম রুপা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন পড়ছে।এই আমাকে গিলে খাবে বলে।আমি চট করেই চোখ নামিয়ে নিলাম। ওর এমন রাগত চোখ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না।আমি চুপ করে থাকলাম।রুপাও।কিছু সময় পর রুপা বলল,
:সেদিন তো খুব বলেছিলে আমার রাগত দুই চোখ নাকি তোমার ভালো লাগে।ওটা কি মিথ্যা ছিল?
আমি চট করেই ওর দিকে তাকালাম।ওর চেহারার তুমুল পরিবর্তন হয়েছে।রাগ সেখানে ঠাই পাচ্ছে না।মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আসছে।ভালোবাসা ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।বললাম,
:সত্যিই বলছি আজো তোমার সেই দুচোখ আমার খুব ভালো লাগে।খুব ভালো।ঘোর লাগানো ভালো লাগা কাজ করে।
ও একটু অভিমানি স্বরে বলল,
:তাহলে এখন তাকিয়ে থাকছ না কেন? পুরোন হয়ে গেছি তাই না?
:এই না! একদম না।তোমাকে আমি প্রতিদিন নতুন করে ভালোবাসি। নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ি।তোমার ওই মিষ্টি মাখা দুঠোট যখনই আমার কপাল স্পর্শ করে তখনই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। অন্য রকম ভালোবাসাও।
:তাহলে? এখন কি হল? তাকিয়ে থাকছ না কেন?
:এই যে তাকিয়ে থাকলাম।
তারপর? তারপর আমি হুট করেই ওর দুচোখের ভেতর দিয়ে হৃদয়ে পথে রওনা হই।কি অদ্ভুত! এই তো সেদিন এলাম।তখন এমন ছিল না। এখন যেমন দেখাচ্ছে।আজকে আর ট্রাফিক বাধা দিচ্ছে না।আস্তে আস্তে চুরে করে ঢুকতে হচ্ছে না।লালবাগিছা বিছানো আছে।আমি সেখানে পাঁ রাখতেই সবাই আমার দিকে চাইল।তারপর সাদরে আমাকে গ্রহন করল।আমি যেদিকে তাকাই সেদিকেই নিজেকে দেখতে পাই।নিজের ছবি প্রতিটা দেয়ালে টাঙানো। প্রতিটা দরজার খোলা।সবাই আমাকে ঢাকছে।”এখান দিয়ে আসেন জনাব।”এখানে দিয়ে আসেন।” আমি ঘুরে ঘুরে সবটা দেখলাম। আস্তে করে টুপ করে বেরিয়ে গেলাম।বের হতেই দেখা মিলল সেই মায়াবিনীর দু চোখের।মধু মাখা মুখটা কেমন উচ্ছ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।বলল,
:কি দেখলে গো? :আমাকে দেখলাম। আচ্ছা এত ভালোবাস কিভাবে বলত?
:তুমি মনে হয় কম ভাসো।তুমি এত ভালোবাস কেন হুম।কেন?
:আমি ঠিক জানি না।তুমি জানো?
:না! আমিও জানি না।তবে একটা জিনিস জানি।
:কি?
:আমি তোমাকে ভালোবাসি।ভিশন ভালোবাসি।
:আমিও।
:কি আমিও?
:ভালোবাসি!
:কাকে?
:মায়াবিনী কে?
রুপা একটু লজ্জা পেল।মৃদু হেসে একে বারে বুকের উপর আছড়ে পড়ল।কি পাজি মেয়েটা।এতক্ষণ কেঁদেছে।এখন আবার হাসে।সত্যিই মেয়ে জাতি কে বুঝা বড় দায়।বড় বেশিই দায়।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে আছি।আর ও আমাকে।দুজনেই ভেসি আছি ভালোবাসার অতল গহ্বরে।আমি আবার সেই গ্রান পেলাম।একটা ফুলের গ্রান বার বার ভেসে আসছে।আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।ছাতিম ফুলের গ্রান এত মধুর হয় এ আমার পুর্বে জানা ছিল না।আমি গ্রানটা নিজের মাঝে নিলাম।সত্যিই অসাধারণ। আমরা যেন ফুলের গ্রানের মধ্য খানে দাঁড়িয়ে আছি।আর সেই গ্রানেরা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে আছে। মিষ্টি চাঁদের আলো ছাদের উপর পড়ছে।আমরা সে আলো ভিজছি।গায়ে একেবারে মাখিয়ে নিচ্ছি।ভাবতেই অবাক লাগে।এই চাঁদের আলোয় আমি একদিন এই পাগলি টাকে খুঁজেছি।তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।