রোববার রোববার ওরা বাপ-ছেলেতে সকালের চা’টা একসঙ্গে খায়। অর্ণব এই সময় শুভ’র গোটা সপ্তাহের সব গল্প মন দিয়ে শোনে। ওর অফিসের খবর, নতুন অ্যাসাইনমেন্টের হাল-হকিকত, তিন্নির সর্বশেষ আবদারের কাহিনি। তিন্নি মেয়েটা বেশ ভালো। ডাক্তারি পাস করে এখন এমডির জন্য পড়ছে। মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে চলে আসে, সুমিত্রার সঙ্গেও বেশ হইহই করে আড্ডা দেয়। হবু শাশুড়ি-বউ এখন থেকেই বেশ মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। সামনের মাঘে মনে মনে একটা তারিখও ভেবে রেখেছে অর্ণব।
আজ কিন্তু শুভ কেমন যেন কিন্তু কিন্তু করছিল। অর্ণব শেষে বলেই ফেলল, কী বলবি বলেই ফ্যাল না!
: বলছি। কিন্তু প্রমিস করো পেটাবে না।
: তোকে শেষ পিটিয়েছি বোধহয় যখন তুই সেভেনে পড়তিস। নিচের সেনবাবুর গাড়ির সাইলেন্সারে আলু ঢুকিয়ে রেখেছিলি। তা, সেরকম কিছু করেছিস নাকি, আবার?
: উঁহু।
: তবে?
: আমি আর তিন্নি ঠিক করেছি যে আমরা কিছুদিন এখন লিভ-ইন করব।
: মানে!
: মানে এখনই বিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না কারণ ওর কম করে আরও দেড়বছর লাগবে সেটল ডাউন করতে। এর মধ্যে ও বিয়ে করতে চায় না।
: কেন? বিয়ে করলে অসুবিধেটা কোথায়?
: ও তুমি বুঝবে না।
: বোঝাবার চেষ্টা কর। বুঝব না আগে থেকেই ধরে নিচ্ছিস কেন?
: আরে, বিয়ের পর হাজার ঝামেলা বাবা! প্রথমেই তো একমাস ধরে বারোভূতের নেত্য। তারপর নেমন্তন্নের হিড়িক, সব জায়গায় জোড়ে যেতে হবে। তার ওপর দুই বাড়ির আশা দুরাশা হতাশা ভাবাবেগের চাপ। ও পড়বেটা কখন? জাস্ট ইমপসিবল।
: পয়েন্ট টেকেন। তাহলে বিয়ে করিস না, অপেক্ষা কর!
: অতদিন আমি পারব না।
“কী নিঘিন্নি ছেলে রে বাবা! বাবার সামনে এইসব কথা কোনো ছেলে বলতে পারে! দ্যাখো, লাই দিয়ে দিয়ে কোথায় তুলেছ ছেলেকে!” সুমিত্রা যে কখন এসে আড়াল থেকে ওদের কথা শুনছিল, কে জানে। এখন আর থাকতে না পেরে একেবারে ফেটে পড়ল। “আর শুভ, লজ্জার মাথা খেয়ে তুই তোর বাবাকে এই কথাগুলো বলতে পারলি?”
: বেশ করেছে বলেছে। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যে কেনো বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলবে এটাই তো স্বাভাবিক। সব ব্যাপারে বাবা ছেলের সম্পর্ক টেনে আনবে না তো!
: বেশ করব আনবো! অ্যাহ! কী ছিরির বাবা ছেলের সম্পর্ক! জম্মে কোথাও দেখিনি! হ্যাঁ রে, ওর বাড়িতে সবাই মেনে নিয়েছে? কিছু বলেনি?
: ওর বাবা বলেছেন, আগে রেজিস্ট্রিটা করে তারপর যা খুশি করোগে যাও।
: মানে! রেজিস্ট্রি করার দেড়বছর পর বিয়ে করবি? এসব কী ইয়ার্কি হচ্ছে? যাক গে, সব এখন লায়েক হয়েছ, নিজেরা যা পারো করো, আমি এসবের মধ্যে নেই!
: আরে, যাচ্ছ কোথায়? বসো বসো। শুভ, যা, তুই আরেকটা চেয়ার নিয়ে এসে বস এখানে। শোনো সুমিত্রা, ওদের কথাটাও ভেবে দ্যাখো। ওরাই বা এই দেড়বছর মিছিমিছি নষ্ট করবে কেন? লুকোছাপা করে করাটার মধ্যে কি কোনো গৌরব আছে? ওবাড়িতে সম্ভব নয়, এখানেও একই ব্যাপার, কোন উল্টোপাল্টা জায়গায় হোটেল-ফোটেল বুক করে ঝামেলায় পড়বে; তার চেয়ে এই বরং ভালো না?
: তোমার মুখে কিছুই আটকায় না, না?
: দ্যাখো, বেশি চোখ রাঙিও না, বুঝেছ? দেবো ছেলের সামনে হাটে হাঁড়ি ভেঙে, ভালো হবে?
: চুপ! খবর্দার বলছি!
: হুঁ, পথে এস! তোমার সেই বান্ধবী নন্দিনীর শোয়ার ঘরটা মনে আছে তো? সবার কি আর তোমার মতো বন্ধু ভাগ্য হয়?
: ইস্! চুপ করো প্লিজ! শুভ আসছে!
: আয়, বোস। এবার বল তোদের প্ল্যানটা কী? রেজিস্ট্রি করে নিবি?
: না করলে তোমরা ছাড়বে? আমরা পরস্পরে নিজেদের বিশ্বাস করি কিন্তু তোমরা তা’ করো না।
: বাই ‘তোমরা’ ইউ মিন দু’ সেট মা-বাবা?
: ইয়েস!
: অবিশ্বাস করি কথাটা বোধহয় ঠিক না। বিয়েটা একটা এগ্রিমেন্ট, সেটা খাতায় কলমে না হলেও চলে। বিশ্বাসটাই আসল।
: তাহলে অযথা রেজিস্ট্রির জন্য চাপ দিচ্ছ কেন?
: আমি তিন্নির কথা ভেবে বললাম। ওর মা-বাবার কথাটা ভাব, কিছু হলে তুই সামলে নিবি কিন্তু সমাজ ওকে সহজভাবে বাঁচতে দেবে না রে।
: তোমরাই তো সমাজ।
: হ্যাঁ, দোষটা আমাদেরই। কিন্তু দ্যাখ চেষ্টা তো করছি নিজেদের পাল্টানোর। আমি আমার মত জানালাম। যাক গে, তারপর নেক্সট এজেন্ডা?
: ভাবছি একটা ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট ভাড়া নেব। ওর হাসপাতালের কাছাকাছি কোথাও।
: আমি উঠলাম! তোমাদের মতো দু’কানকাটা বাপ-ব্যাটা আমি জীবনেও দেখিনি! চালিয়ে যাও! ছি!
সুমিত্রা রাগ দেখিয়ে ধমধম করে বেরিয়ে গেল। যদিও পেছন পেছন ভেসে আসা অর্ণবের গা জ্বালানো হাসিটা সবার অজান্তে এই বয়েসেও ওর গালদুটোয় ফাগের আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
রান্নাঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল সুমিত্রা। তারপর কী যেন ভেবে তিন্নির নম্বরটা ডায়াল করে ও ধরতেই বলে উঠল, অসভ্য মেয়ে! তলে তলে এই বুদ্ধি! আমার ঘরেও জুটেছে সব সেইরকম! তুই আয় এবার তারপর দেখিস তোকে আমি কী করি!
: রাগ করেছ?
: হ্যাঁ, খুব!
: এদিকে মা দু’দিন থেকে কথা বলছে না।
: বলা উচিতও নয়। আমি হলেও বলতাম না।
: তুমি একটু বোঝাও না, প্লিজ!
: ও! তোর মা’কে বোঝানোর দায়িত্বও আমার! বেশ, বোঝাবো। তবে রেজিস্ট্রি করাটা কিন্তু মাস্ট।
: কেন?
: সে তোর ছেলেপুলে হলে বুঝবি!
: তোমরা সব বাবা-মা একরকম। একই ধাতু দিয়ে গড়া।
: হ্যাঁ, সে জন্যই তো বললাম এখন বুঝবি না।
: অলরাইট, মেনে নিলাম। আমি কিন্তু সিঁদুর-টিঁদুর পরবো না।
: পরিস না। আমার নিজেরই পরতে ভালো লাগে না। কিন্তু এতদিনের অভ্যেস, ছাড়তেও পারি না।
: কবে আসছ?
: দ্যাখ, আমি ছেলের মা। আমার একটা আত্মসম্মান বলে কথা আছে তো!
: প্লিজ!
: আজ বিকেলে গেলে চলবে?
: দৌড়বে!
: কী খাওয়াবি?
: ম্যাগি?
: ধরে পেটাবো! ভালো কিছু রান্না করে খাওয়াবি। নাহলে, সব ক্যানসেল! বুঝেছিস?
: যো হুকুম শাশুমা! বাট অন ওয়ান কন্ডিশন …
: কী?
: ভাড়ার ফ্ল্যাটটা কিন্তু তোমায় এসে গুছিয়ে দিতে হবে। ওক্কে? বাই!
সুমিত্রা হাসতে হাসতে মোবাইলটা রেখে আলু ছাড়াতে বসল। রোববার সকাল মানেই যে সেই লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। মনে মনে ও এ ক’দিন ভেবেছিল, হোক না ডাক্তার মেয়ে, একটু তো হাতে হাতে এগিয়ে দেবে। তাহলেই হলো।
যাক গে! ভালো থাকুক ওরা।