রাত ৮ টা।
লাকসাম রেলওয়ে জংশন।
মুহিন একটা ফ্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা বেনসন সিগারেট। একটু পর পর লম্বা টান দিচ্ছে সিগারেটে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বিরাট বড় বিপদে পড়েছে তাই ভিরু চোখে এদিক সেদিক সাহায্যের আশায় তাকাচ্ছে।
একটু আগে হালকা বৃষ্টি হয়েছিল। এখন বৃষ্টি নেই। আকাশে কাল মেঘ আর পূর্ণিমার চাঁদের লুকচুরি খেলা। স্টেশান থেকে একটু দূরেই বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ আর জলা ভুমি। চাঁদের আলো পড়ে কি অপরূপ সুন্দর লাগছে!
আর সব স্টেশানের মতই এই স্টেশানে অনেক কোলাহল। দুই তিনটা ট্রেন দাড়িয়ে আছে বিভিন্ন লাইনে। হকারদের কোলাহলে স্টেশান মুখরিত। স্টেশানের হলুদ আলো মুহিনের খুব ভাল লাগে। কেমন যেন একটা ঘোর অনুভব করে মুহিন। সে এদিক সেদিক চেয়ে একটা লোহার বেঞ্চির দিকে এগিয়ে যায়।
মুহিনের বয়স বেশি না। মাত্র ২৪ বছর।
সে পেশায় একজন নাবিক। সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজে চাকুরি করে। ছুটিতে সে দেশে এসেছে। সে ঠিক করেছে যে এইবার দেশে পুরো ৩ মাস ছুটি কাটাবে।
মুহিন একজন ছন্নছাড়া টাইপের ছেলে। কখন কি করে তার ঠিক নেই। আজ সকালেও সব ঠিক ছিল। বিকালের দিকে কি মনে হল তার কে জানে- হটাৎ মাকে বলল যে আজ রাতে বাসায় ফিরবে না। এক বন্ধুর বাসায় থাকবে।
তারপর বাসা থেকে সোজা স্টেশানে। সে নিজেও জানে না সে কথায় যাবে, কেন যাবে। তার আজ হটাৎ মনে হল একটু বেরিয়ে পড়া যাক। যে দিকে দুচোখ যায়। এমনি পাগল আমাদের মুহিন!
কেন সে মাঝে মাঝে এই পাগলামি করে এটা তার কাছে পরিস্কার না। হয়ত তার মনে কোন কষ্ট আছে কিংবা জমা আছে কোন ক্ষোভ যা কষ্টের চেয়েও বেশি পীড়া দেয় তাকে।
লোহার বেঞ্চিতে বসে পায়ের উপর পা দিয়ে বসল। জিন্সের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে আরেকটা সিগারেট ধরাল। তারপর উদাস দৃষ্টিতে তার চারপাশের মানুষগুলকে দেখতে লাগলো।
একটা আন্তঃনগর ট্রেন একটা লাইনের উপর থেমে আছে। একটু পরে মনে হয় ছেড়ে দিবে। যাত্রীরা আস্তে আস্তে ট্রেনে উঠছে। কেউবা দাড়িয়ে আছে দরজার পাশে। কেউ ট্রেন থেকে নেমে এই সুযোগে একটা সিগারেট খেয়ে নিচ্ছে। হকাররা ট্রেনের জানালার কাছে গিয়ে হাঁকাহাঁকি করছে- “এই কেক খান, পানি খান”!
আজকে মনে হয় মানুষ কম ট্রেনে। অবশ্য কম হবারই কথা। সপ্তাহের মাঝের একটা দিন আজ। বৃহস্পতিবার, শুক্রবার আর শনিবারে যাত্রী বেশি থাকে- সপ্তাহের অন্য দিনগুলো মানুষের ভীড় একটু কম থাকে। আজ তেমনি একটা দিন।
মুহিনের বিভিন্ন মানুষের জীবন যাত্রা দেখতে ভাল লাগে খুব। এই যে একটা ফকির তার পাশের বেঞ্ছিতে বসে এক মনে বিড়ি খেয়ে যাচ্ছে-এটা দেখতেও তার ভাল লাগছে, ঐযে একটা কিশোর ছেলে পানির গ্যালন হাতে নিয়ে পানি বিক্রি করছে এটাও ভাল লাগছে তার। মানুষের জীবন কি অদ্ভুত। সে তথাকথিত ভদ্র সমাজে থেকে ক্লান্ত হয়ে গেছে।
মুহিনের ইচ্ছে করে এই মানুষগুলোর সাথে যদি কিছুদিন কাটানো যেত! ইশ!! মুহিন মুগ্ধ চোখ তাকিয়ে দেখছে এই জীবন গুলোর জীবন প্রণালি।
হটাৎ একটা মিষ্টি সুরে চিন্তার ঘোর কাটে মুহিনের।
-ভাইয়া, একটু শুনেন।
মুহিন তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে!
হুম। শুধু মেয়ে বললে ভুল হবে মুহিনের। বলতে হবে এভাবে যে- একটা মেয়ে যার মুখে অসম্ভব রকমের মায়া আছে। ভীত হরিণীর মত কাজল দিয়ে ভরা দুটি চোখ। ভাবুক মুহিন অপলক চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। মেয়েদের দিকে এভাবে তাকানোটা মুহিনের স্বভাব বিরুদ্ধ তবুও এই অদ্ভুত পরিবেশে মেয়েটিকে যেন তার খুব মনে ধরেছে।
মেয়েটি আবার বলল-ভাইয়া, একটু শুনেন না।
-ও হ্যাঁ, দুঃখিত। কি জানতে চান বলুন। মুহিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিল।
মেয়েটি বলল-ভাইয়া, এখানে তো দুটা ট্রেন। আমার ট্রেন কোনটা বুঝতে পারছি না। আমি ট্রেন থেকে নেমে একটু হাটতে বের হয়েছিলাম।
মুহিন বলল- ও আচ্ছা। এটা তো কোন সমস্যা না। আপনার ট্রেনের নাম মনে আছে?
মেয়েটি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল- হুম। মেঘনা এক্সপ্রেস।
মুহিন হেসে বলল-আরে এত জোরে মাথা নাড়েন কেন? মাথা তো ছিঁড়ে পড়ে যাবে।
মেয়ে বলল- কি করব ভাইয়া। ভয় পেলে আমার এমন হয়।
মুহিন আবার হেসে বলল- আরে ভয় পাওয়ার কি আছে? ট্রেন তো মোটে এখানে দুটা। একটা না হলে শিউর অন্যটা। দাঁড়ান আমি দেখতেসি। আসেন আমার সাথে।
মুহিন উঠে দাঁড়াল। তারপর একটা ট্রেনের দিকে হাটা ধরল। মেয়েটিও তার পেছন পেছন আসছে। বেচারি মনে হয় একটু বেশি ভয় পেয়েছে। তাই মুহিনের পিছনে শরীর ঘেঁষে হাঁটছে।
মুহিনের কেন যেন মনে হল- মেয়েটি তার সার্টের একটা কোনা ধরে রেখেচে আলতো করে। মেয়েটি হয়ত ভাবছে যে মেয়েটি হারিয়ে যাবে। মুহিনের চেহারায় কি এমন কিছু আছে যে কারনে সবাই তাকে দেখা মাত্রই বিশ্বাস করে। যেমন এই মেয়েটি করেছে। এই জিনিসটা মুহিনের খুব খারাপ লাগে। মানুষ তাকে এত বিশ্বাস করে যে মুহিন চাইলেই কারও বিশ্বাস ভাংতে পারে না। মুহিনকে যারা বিশ্বাস করেছে কারও বিশ্বাস নষ্ট করেনি মুহিন তবুও সবাই কেন মুহিনের বিশ্বাস ভাঙ্গে?
মুহিন একটা ট্রেনের কাছে গিয়ে একটা ভদ্র লোককে জিজ্ঞাস করল-ভাই এটা কি মেঘনা এক্সপ্রেস?
লোকটি মাথা না ঘুরিয়ে বলল- হ, আপনে যাইবেন কই?
মুহিন লোকটির কথা জবাব না দিয়ে মেয়েটির দিকে ফিরে জিজ্ঞাস করল- কত নং বগি মনে আছে?
মেয়েটি অসহায় গলায় বলল- না তো। তবে মধ্য দিকের একটা বগি হবে।
মুহিনের মেজাজ খুব খারাপ হল। বলল- আজব টিকিট দেখেন নাই আপনি? কোন বগিতে উঠছেন সেটা না জেনে নামলেন কেন?
মেয়েটি ভিরু গলায় বলল- ধমক দিচ্ছেন আমাকে? আমি তো টিকিট করিনি। টিকিট করেছে আমার বান্ধবি। আমরা একসাথে বাড়ি যাচ্ছি তো। ও ট্রেনের সিটেই আছে।
মুহিন বলল- তাই বলে আপনি একটু টিকিট দেখবেন না? আচ্ছা চলেন খুঁজে দেখি আপনার বান্ধবিকে।
তারপর দুজন ট্রেনে উঠল। বাহ! বাহির থেকে মনে হচ্ছিল যে ট্রেনে বুঝি ভীড় কম। এখন দেখা যাচ্ছে যে ভিড় আছে খারাপ না।
মুহিন আর মেয়েটি সামনের দিকে একটা কামরায় উঠেছিল। তাই তারা ট্রেনের সামনে থেকে পিছনের দিকে চলল।
বাহ! মেয়েটা এইবার তার জামা ধরল না। সোজা মুহিনের হাত ধরল শক্ত করে। এই চিকন শরীরে এত শক্তি কোথা থেকে আসলো? বিপদে পড়লে বুঝি এমনি হয়!
কত দিন পরে কোন মেয়ে মুহিনের হাত ধরল? শেষ যে মেয়েটি অনেক ভালবাসা নিয়ে মুহিনের হাত ধরেছিল সে মেয়েটির কথা মনে হতেই একটা বিষণ্ণতা অনুভব করল মুহিন। সাথে একটু কষ্ট- একটু না। অনেক কষ্ট অনুভব করল মুহিন।
একটা বগিতে ঢুকেই মেয়েটি মুহিনের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে চীৎকার দিয়ে একটা মেয়ের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। মুহিন বুঝতে পারল এটা মেয়েটির বান্ধবি। বান্ধবিকে একটু বুদ্ধিমতি মনে হচ্ছে।
মুহিন সেই বান্ধবিকে বলল- আপনার বন্ধু তো আজ এখানে হারিয়ে গিয়েছিল। এত বোকা মেয়েকে ছাড়েন কেন একা একা?
বুদ্ধিমতি বান্ধবি বুঝে নিল যে মুহিনই ওর বান্ধবিকে ট্রেন খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে।
মেয়েটি হেসে বলল- হারিয়ে ভাল করেছে। তা না হলে আপনার সাথে ওর দেখা হত কই?
বাপরে! একেবারে রেডি উত্তর। মুহিন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। হারিয়ে যাওয়া মেয়েটিও বেশি অপ্রস্তুত হল। বান্ধবির পিঠে একটা কিল মেয়ে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি বলল- যাহ্! তুই সব সময় একটু বেশি বুঝিস।
বুদ্ধিমতি বান্ধবীটি বলল-আমি যা বুঝি ঠিকই বুঝি। হুম ভাইয়া। ও নিশ্চয়ই ওর নাম বলে নাই। যাই হোক ওর নাম বর্ষা আর আমি নিতু। আমরা একটা ভার্সিটিতে একসাথে পড়ি। আমাদের বাড়ি একজায়গায়। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি। এই বার ঝটপট আপনার পরিচয় দেন- তা না হলে ট্রেন ছেড়ে দিবে একটু পর।
বাপরে। মেয়েত পুরা বুলেট। মুহিন নিজের পরিচয় দিয়ে বলল- আপনারা ভাল থাকেন। আমি যাই।
মুহিন বিদায় নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে এল। চলে যাচ্ছে এমন সময় পিছন থেকে নিতু মেয়েটি জানালা থেকে ডাক দিল- ভাইয়া একটু শুনেন।
মুহিন জানালার কাছে গেল। মেয়েটি বলল- ভাইয়া, আর তো কখনো দেখা হবে না। আপনি চাইলে আমাদের ফোন নং নিতে পারেন।
মুহিন তাকিয়ে দেখল-নিতুর পেছন থেকে বর্ষা মেয়েটা উঁকি দিচ্ছে। লজ্জা পেয়ে সামনে আসতে চাইছে না।
মুহিন বলল- দরকার কি? থাকুক না। বেঁচে থাকলে অবশ্যই আবার দেখা হবে।
নিতু নিরাশ হল। বলল- ঠিক আছে ভাইয়া। আপনি ভাল থাকবেন।
মুহিন বলল- আপনারাও ভাল থাকবেন।
ট্রেনটির হুইসেল বেজে উঠল কুউ করে। মুহিনের মনটা হটাৎ বিষণ্ণতায় ভরে গেল। মেয়ে দুটো চলে যাবে এখনি। আর হয়ত আর জীবনেও তাদের সাথে দেখা হবে না তার। তবুও মেয়েটির জন্য কি অদ্ভুত টান অনুভব করছে সে! কিন্তু প্রকাশ করছে না সে।
ট্রেনটি আস্তে আস্তে চলা শুরু করল। নিতুর সাথে বর্ষাও জানালার পাসে এসে দাঁড়াল। মেয়েটির চোখেও কেমন একটা ব্যাকুলতা দেখতে পেল মুহিন।
ট্রেনটা কিছুদূর চলে গেছে। বর্ষা ট্রেনের জানালা দিয়ে মাথা বের করে মুহিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রেনটি আরও জোরে চলা শুরু করেছে। মুহিন দেখল মেয়েটি জানালা দিয়ে হাত বের করে দিয়ে হাত নাড়ছে। মুহিন ও প্রতিত্তুরে হাত নেড়ে দেখাল। মেয়েটির ট্রেন একসময় হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
তবুও মুহিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই দিকে।
মুহিন বুকের মধ্যে চিনচিন একটা বেথা অনুভব করল মেয়েটির জন্য। মুহিন আবারও ভাবল কি সুন্দর আমাদের জীবন কি অদ্ভুত সুন্দর আমাদের জীবন! ছোট ছোট কত ভালবাসায় ঘেরা আমাদের এই জীবন!
আকাশে আবার মেঘ জমেছে। কাল মেঘে আকাশের চাঁদ ঢেকে গেছে। বাতাসের প্রকৃতি দেখে অভিজ্ঞ নাবিক মুহিন বুঝল আবার বৃষ্টি হবে একটু পরে।
মুহিন ঘুরে দাঁড়াল। একটা খোলা চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা নিল। আগুন গরম ধোঁয়া উঠা গরম চা। তৃপ্তি ভরা চুমুক দেবার আগেই শুরু হল ঝুপ বৃষ্টি। আর সাথে সাথে স্টেশানের মানুষ গুলো ছুটতে শুরু করল নিরাপদ আশ্রয়ে।
খুব সাধারন একটা দৃশ্য, তবুও মুহিনের খুব ভাল লাগলো। মুহিনের গালে বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে। মুহিন তৃপ্তি নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। অসাধারন লাগলো চায়ের স্বাদ। তার মনে হল সে কল্পনার এক জগতে চলে এসেছে।
রাত ১১ টা।
কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি শেষ হয়েছে।
মুহিন দাড়িয়ে আছে। কি করবে এখনো ঠিক করে নাই সে। বাসায় ফিরতে পারে কিংবা লাইনে দাঁড়ানো একটা ট্রেনে টুপ করে উঠে যেতে পারে সে। কি করবে বুঝতে পারছে না। আজ নিজেকে মুক্ত স্বাধীন মনে হচ্ছে।
সিগারেট শেষ তার। তাই একটা দোকান থেকে এক প্যাকেট বেনসন কিনল সে।
আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে আবার চাঁদ উঠেছে। মুহিন একটা ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে হাটা ধরল। খুব সুন্দর বাতাস ভেজা বয়ে যাচ্ছে। বাতাসে তার লম্বা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। মুহিন চাঁদের মৃদু আলোয় পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কথায় যাচ্ছে সে নিজেও জানে না।
একটা ট্রেন স্তেশান থেকে ছেড়ে আসছে তার পিছন দিক থেকে। সে পেছন ফিরে তাকাল।
ছোট একটা ট্রেন, অন্ধকার হয়ে আছে, ট্রেনের গতি মন্থর। মুহিন বুঝল এটা একটা লোকাল ট্রেন।
ট্রেনটা তার পাশ দিয়ে যাবার সময় সে হটাৎ কি মনে করে ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে উঠে পড়ল।
ট্রেনের কামরায় নিকষ কাল অন্ধকার। হটাৎ করে কামরায় ঢুকে চোখে আঁধার দেখল মুহিন। একটু পরে যখন আঁধার চোখ সয়ে গেল দেখতে পেল যে কে যেন একটা মোম জ্বেলে রেখেছে। বাতাসে মোমের শিখা তিরতির করে কাঁপছে। সে মোমের আবছা আলোয় দেখল এই বগিতে যাত্রী বেশি নেই। ১০/১৫ জন হবে। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে, কেউবা সিটে লম্বা হয়ে ঘুমাচ্ছে।
মুহিন একটা খালি সিট দেখে জানালার পাশে গিয়ে বসল। জানাল দিয়ে বৃষ্টি ভেজা বাতাস আসছে হু হু করে। সে একটা হাত বাড়িয়ে দিল জানালা দিয়ে। ভেজা বাতাস তার খোলা হাত ছুয়ে যাচ্ছে, হাতের খোলা অংশে ভেজা বাতাস লাগতেই তার শরীরে কাঁটা দিয়ে গেল। আবেশে চোখ বুজে এল তার।
জানালার মধ্যে হাত রেখে হাতের উপর মাথা রেখে বাইরের দিকে তাকাল।
বাইরে কি সুন্দর দৃশ্য! দিগন্ত জোড়া ধানের ক্ষেত বাইরে। কাল মেঘের ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উকিঝুকি মারছে। সে অন্ধকার মেশানো চাঁদের আলোয় ভেসে গেছে সে দিগন্ত জোড়া ধান খেত, খাল, ঘুমন্ত বাড়ি ঘর!
পুকুর আর খালের পানিতে বৃষ্টির পানিতে সে চাঁদের আলো পড়ে হিরে মানিকের মত জ্বলজ্বল করছে। কি অসাধারন এক দৃশ্য!
হটাৎ একটা শ্লেষ মেশানো গলায় মুহিনের চিন্তার সুত্র ছিঁড়ে গেল।
-ভাইজান, আপনে কই যাইবেন?
মুহিন ঘাড় ফিরিয়ে দেখে একজন মাঝ বয়সি মানুষ। মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল।
সে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল- এই ট্রেন কোথায় যাবে?
লোকটি মুহিনের প্রশ্ন পালটা শুনে একটু অবাক হল। বলল- আপনে জানেন না এই ট্রেন কই যাইব? তাইলে উঠছেন ক্যান?
মুহিন বলল- দেখেন, আমি আজ ঘুরতে বের হইচি। কোথায় যাব ঠিক জানি না। তাই ট্রেন কই যাবে জানার আগ্রহ নাই। যেখানে ট্রেন থামবে সেখানে নেমে যাব।
লোকটি তার কথায় একটু অবাক হল মনে হয়। সে মুহিনের সামনের খালি সিটে বসে পড়ল। তারপর বলল- ও আচ্চা। বুঝতে পারছি। ভাল কাজ করছেন। আসলেই আমরা কেউ জানি না আমরা কোথায় যাচ্ছি!
মুহিন এই লোকের মুখে এত বড় দার্শনিক কথা শুনে একটু অবাক হল। সে লোকটার দিকে একটু ভাল করে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল- আপনি কই যাবেন?
লোকটি এক গাল হেসে বলল- আমিও আপনের মত কই যাই ঠিক নাই, আমার জীবন এই ঘুরে ঘুরেই কাটে। স্থায়ি কোন বসতি নাই।
একটু চুপ করে আবার বলল-ভাইজান আমার নাম আজিজ। কেউ কয় আজিজ বয়াতি, কেউ কয় আজিজ পাগলা, আমার কেউ কয় মজনু আজিজ। আমার নাম মজনু আজিজ ক্যান- ভাইজান কি জানেন?
মুহিন বিরস গলায় বলল- না জানি না। জানার ইচ্ছে হচ্ছে না।
মজনু আজিজ একটু বিষণ্ণ হল বুঝা গেল। সে আবার বলল- ভাইজান সে এক মজার হিস্টরি। তয় আমার কাছে সেটা দুক্ষের হিস্টরি। একজনের কাছে যা মজার আরেকজনের কাছে তা দুক্ষের। ঠিক বলেছিনা ভাইজান?
উফ! লোকটা বকবক করে মাথা ধরিয়া দিল। মুহিন আবার বলল- আপনি ঠিক বলেছেন। শুনেন ভাই- আমি একটু একা থাকব বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। আপনে এখন যান।
আজিজ বিরস গলায় বলল- শুনলে মজা পাইতেন। আপনে যখন শুনতে চান না তাইলে থাক। ভাইজানের কাছে কি বিড়ি আছে? থাকলে একটা দেন। কেমুন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগতাসে।
মুহিন একটা সিগারেট দিল লোকটিকে। লোকটি সিগারেট হাতে নিয়ে মোমের কাছে গিয়ে সিগারেট টা নেড়ে চেড়ে বুঝার চেষ্টা করল কোন ব্রান্ডের সিগারেট। তারপর আবার সিটে এসে বসল। তারপর সিগারেট পকেটে ঢুকিয়ে নিজের একটা বিড়ি বের করে ধরাল।
মুহিন অবাক হয়ে লোকটির কাজ দেখছে। লোকটি বলল- ভাইজান, আপনে আমারে এত দামি বিড়ি দিচেন আপনেরে আল্লা ভাল করব।
মুহিন হেসে বলল- ঠিক আছে। তবে আপনি সিগারেট না খেয়ে বিড়ি ধরালেন কেন?
লোকটি হেসে বলল- ভাল জিনিস ভাল টাইমে খাইতে হয়। দামি জিনিস পরে খামু।
মুহিন বলল- আপনার বিড়ির কড়া ধোঁয়া আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি আরেকটা সিগারেট নেন, তবুও আপনের বিড়ি ফালান। বলেই মুহিন আরেকটা সিগারেট বের করে তাকে দিল।
লোকটি হাত বাড়িয়ে আরেকটা সিগারেট নিয়ে আবার পকেটে ঢুকাল তারপর সিট ছেড়ে উঠে অন্য সিটে চলে গেল।
লোকটির আচারন দেখে মুহিন অবাক হল আবার মজাও পেল একটু।
সে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। একটা দিগন্ত বিস্তৃত জলাধার। চাঁদের আলো পড়ে কেমন চকচক করছে!
হটাৎ ট্রেনের গতি কমে এল। সামনে একটা ছোট গ্রামের স্টেশান। স্টেশানে ট্রেন থামল। এত রাতে গ্রামের স্টেশানে ট্রেন থামল কেন বুঝল লোকাল ট্রেনের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। এই ট্রেনগুলো বিনা কারনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেকোনো স্টেশানে থেমে থাকতে পারে!
মুহিন ট্রেন থেকে নামল। আরও কয়েকজনও নেমে এল ট্রেন থেকে। গ্রামের একটা সাধারন স্টেশান। স্টেশান মাস্টারের ঘরের সামনে একটা একশ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। আর পুরো স্টেশান অন্ধকার। মুহিন খেয়াল করে দেখল এই নির্জন স্টেশানে একটা আন্তঃনগর ট্রেন থেমে আছে। ঐ ট্রেনের যাত্রীরা এদিক সেদিক ঘুরা ফেরা করছে।
এত রাতে এই ছোট স্টেশানে কেন একটা আন্তঃনগর ট্রেন থামল? একটু পরে জানা গেল যে সামনে কোথায় যেন রেললাইন ভেঙ্গে গেছে। সেটা সারতে অনেক সময় লাগবে। কতক্ষণ যে লাগবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারল না।
ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন রেল কম্পনির বাপ মা তুলে গালি দিল।
মজনু আজিজ আবার মুহিনের পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর কোন প্রসংগ ছাড়াই বলল- ভাইজান, মানুষের মনে দুইটা দুনিয়া। এক দুনিয়ায় সব আছে, সুক, আনন্দ, আপন জন। আরেক দুনিয়ায় আচে সুধু দুক্ক, বেদনা, সৃতি। এই দুনিয়ায় মানুষটা একলা। আমি একলা দুনিয়ার ইস্থায়ি বাসিন্দা। আর আইজ আপনে হেই একলা দুনিয়ার টেম্পুরারি বাসিন্দা। ঠিক বলেছিনা ভাইজান?
মুহিন মুগ্ধ চোখে মানুষটার দিকে তাকাল। এত সুন্দর দার্শনিক কথা বার্তা লোকটা জানে কিভাবে?
আকাশের চাঁদ আবার হারিয়ে গেল মেঘের আড়ালে। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হল।
হটাৎ মুহিনের ঘোর লেগে গেল। সেই টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাটা শুরু করল একটা বনের দিকে।
মুহিনকে হটাৎ গভীর বনের দিকে যেতে দেখে তার পিছনে পিছনে হাটা ধরল মজনু আজিজ।
মুহিন একমনে হেঁটে যাচ্ছে। ছোট একটা জংগল। গাছের পাতা ভেদ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে না। নিকষ কাল অন্ধকার সেখানে। তবুও মুহিন ঘোর লাগা মানুষের মত হেঁটে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সে জানে না।
জংগলে হাজার হাজার জোনাকি জ্বলছে। মনে হচ্ছে একটা কাল চাদরে হাজার হাজার হিরে জ্বলছে। কি অদ্ভুত এক দৃশ্য!
ছোট জঙ্গলটা পেরিয়ে মুহিন দেখে একটা ছোট নদী। মুহিন সে নির্জন নদীর পাড়ে বসে গেল। পিছনে একটু দূরে স্টেশানটা ছাড়া আশেপাশে কোন বসতি নাই, কোন মানুষ নেই। খুব নির্জন এক নদীর পাড়।
বৃষ্টি আবার থেমে গেল। আবার আকাশে চাঁদ হাসি দিয়ে উঠল।
মুহিনের মনে আজ অনেক বিষণ্ণতা ভর করেছে। আসলেই কি মুহিন খুব একা একটা মানুষ? কি নেই তার? অনেক ভাল চাকরি করে, বাবা মা তাকে অনেক ভালবাসে। তবুও কিশের অভাব মুহিনের যে কারনে মাঝে মাঝে মুহিনের নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে- এই যেমন আজ করেছে মুহিন।
মুহিনের ঠিক পিছনে মজনু আজিজ এসে দাঁড়াল। তারপর মুহিনকে বলল- ভাই, আপনের মেচ বাত্তিটা দেন তো, একটা দামি বিড়ি ধরাই। আমার মেচ ভিজি গেছে।
মুহিন পকেট থেকে লাইটারটা নিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে লোকটিকে লাইটারটা এগিয়ে দিল। লোকটি সিগারেট ধরিয়ে মুহিনের পাশে এসে বসল।
তারপর বলল- ভাইজান, সবার দুঃখ আছে, গরিবের দুঃখ আছে, বড়লোকের দুঃখ আছে। সে দুক্ষের মাইদ্ধে পিরিতির দুঃখ বড় দুঃখ। এই দেখেন আমি এত গরিব, ঘর বাড়ি কিচ্ছু নাই তারপরেও পিরিতির দুঃখ আছে। অনেক দুঃখ ভাই।
মুহিন উদাস গলায় বলল- আপনের আবার পিরিতের কি দুঃখ?
লোকটি বলল- এক ওষুধ বেপারি স্টেশানে হাবিজাবি ওষুধ বেচত। আমি সেই মজমায় গান গাইতাম।
মুহিন বলল- তারপর?
লোকটি বলল- আমার লগে একটা মেয়েও গান গাইত। মেয়েটারে আমি অত্তধিক ভালবাসতাম। মেয়েও আমারে ভালবাসত। কি সুখের দিন ছিল গো ভাই। আহা!
মুহিন বলল- তারপর?
লোকটি একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল- তারপর আর কি? মেয়েটা দেখতে সন্দর আচিল। পরে হেই ওষুধ অলার কাছে মেয়েটা বিয়া বইচে আমারে থুইয়া। আমার কিচ্ছু নাই, আমারে মেয়ে বিয়া করব ক্যান? আমার ঘর নাই বাড়ি নাই। তারপরে আমি হেই লোকের কাম ছাইড়া দিয়া নিজেই স্টেশনে স্টেশনে গান গাই। আর বিয়া শাদি করি নাই আমি।
তারপর লোকটা খালি গলায় একটা গান ধরল-
“আশা নদীর বালুচরে বাঁধি আমি খেলা ঘর
দুচোখের দুই সরবরে-
যখন তখন ভাসেরে সেই ঘর আমার
ভাসেরে সেই ঘর। “
কি অদ্ভুত সুন্দর গলা লোকটার! গানের সুর যেন ছড়িয়ে পড়ছে এই ছোট নদীর দুই পাড়ে। মুহিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটির দিকে। চাঁদের আলোয় দেখতে পেল লোকটির দুই গাল চকচক করছে। নিঃশব্দে কাঁদছে লোকটি।
মুহিন আবার সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল। তারপরে সিগারেটের আগুনটার দিকে তাকিয়ে ফিরে গেল বেশ কিছুদিন পেছনে। তারও একটা মনের মানুষ ছিল। সময়ের স্রতে হারিয়ে গেছে সে। আজ সে বহু দূরে, অনেক দূরে। এত দূরে চলে গেছে সে মানুষটি যে সে চাইলেই নাগাল পাবে না তার। মুহিন একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে মানুষটির জন্য নিষ্ফল অপেক্ষায় একা একা কাটিয়ে দিয়েছে কত গুলো দিন। মুহিনের সব সময় মনে হত এই বুঝি সব ভুলের অবসান ঘটিয়ে সে ফিরে আসবে তার কাছে!
না। আর না। হটাৎ মুহিনের চেয়াল শক্ত হয়ে গেল। একটা মানুষের জন্য সে আর কত অর্থহীন অপেক্ষা করবে? যেখানে জানে যে মানুষটি তার জীবন থেকে চলে গেছে সে আর ফিরে আসবে না। সে মানুষটি মুহিনকে ভুলে অনেক সুখে আছে তবে মুহিন কেন বিরহের আগুনে প্রতিনিয়ত জ্বলছে? মুহিনের তো কোন দোষ ছিল না, তবে?
অনেক হয়েছে। আর না। মুহিন উঠে দাঁড়াল। হাত থেকে সিগারট নদীর জলে ছুঁড়ে মারল। মজনু আজিজের দিকে তাকাল মুহিন। এই পাগল কিচিমের মানুষটির সাথে মুহিন তার নিজের অনেক মিল খুঁজে পেল। মুহিনের মত এই লোকটিও তার ভালবাসার মানুষের জন্য অর্থহীন অপেক্ষা করে যাচ্ছে।
মুহিন বলল-শুন আজিজ, মানুষের জীবন একটা, ঠিক কিনা বল।
মজনু আজিজ মাথা দুলিয়ে বলল-হু ভাইজান।
মুহিন বলল- তুমি যে মেয়েটিকে ভালবাসছ সে মেয়েটি কি তোমাকে ভুলে সুখে ঘর সংসার করছে, করছে কিনা বল?
মজনু আজিজ বলল- হু।
“তাহলে তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছ? তোমার ভালবাসার মানুষ যেখানেই থাকুক সুখে আছে- এটা কি তোমার জন্য বিশাল পাওনা নয়? আর সে মানুষটিকে যদি তুমি বিয়ে করতে তাহলে হয়ত এতটা সুখে রাখতে পারতে না। তাই না?
মজনু আজিজ কিচ্ছু বলল না, এক দৃষ্টিতে মুহিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হল মুহিনের কথার গুঢ় অর্থ বুঝার চেষ্টা করছে।
আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুহিনের দিকে চোখ ফেরাল আজিজ, বলল-ভাইজান, আমি তো কখনো এরাম করে ভাবি নাই।
‘এবার বুঝতে পারছ তো? শুন আমিও তোমার মত একটা মেয়েকে ভালবাসতাম। মেয়েটা আমাকে ফেলে চলে যায়। এখন সে হয়ত সুখেই আছে। আমি মিছে মিছি এত দিন তার অপেক্ষায় থেকে সুধু কষ্ট পেয়েছি। বলে মুহিন উঠে দাঁড়াল- হু চল, আমাদের জীবন আরও অনেক বাকি। দেখা যাক ভালবাসার জন্য আর কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা!
বলে মুহিন স্টেশানের দিকে হাঁটা ধরল। পিছন ফিরে দেখল আজিজ বসে আছে। সে মনে হয় আসবে না। হয়ত সেই মেয়েটির জন্য সে আরও অপেক্ষা করবে। মুহিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মুহিন স্টেশানে এসে দেখে ট্রেনের লোকজন এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে। হটাৎ ৫/৬ জনের একটা জটলার ভেতর শুনতে পেল একটা মেয়ে রাগি গলায় চিল্লাচিল্লি করছে- বলেছি তো আমাদের কোন সাহায্য লাগবে না। সুধু সুধু কেন বিরক্ত করছেন?
আরে এই গলাতো মুহিন চিনে! মুহিন লোকাল ট্রেনের পাশে দাঁড়ান আন্তঃনগর ট্রেন এবং মেয়েটির গলা শুনে যা বুঝার বুঝে নিল। নির্জন স্টেশানে কোন মেয়েকে একা পেয়ে বখাটেরা উৎপাত করছে।
মুহিন জটলার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর উঁচুগলায় বলল- “কিরে নিতু, কি হইচে? এরা কি বলতেসে?
বুদ্ধিমতি নিতু যা বুঝার বুঝে নীল। বলল-দেখ না ভাইয়া, তুমি আমাদের রেখে দোকানে গেছ, আর এই লোকগুলা আমাদের সেই থেকে বিরক্ত করছে।
মুহিন আগুন গরম চোখে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল-কি চাই? এরা আমার বোন।
লোকগুলো একটু ইতস্তত করতে লাগলো। এমন সময় সেখানে হাজির মজনু আজিজ। “এই কি হইচে, কি হইচে?
তারপর বখাটে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল-ঐ তোগ এহানে কি? ভাগ কইলাম। এনারে চিনস? ইনি আমার ভাই। বেশি ফাইজলামি করলে একদম ট্রেনের চাক্কার নিচে কল্লা হান্দায়া দিমু।
লোকগুলো হয়ত আজিজকে আগ থেকেই চিনত। আজিজের পরিচিত লোক দেখে আর ঝামেলা না করে একদিকে চলে গেল।
আজিজ মুহিনের দিকে ফিরে হেসে বলল-ভাইজান, আমি আপনার কথা বুঝতে পারি নাই তখন। এখন আমার মাথায় ঢুকছে। আমি আর পাগলামি করুম না। এই শিতেই শাদি করুম ইনশাল্লাহ!
মুহিন একটু হেসে নিতুদের দিকে ফিরল। বর্ষা মেয়েটা নিতুর হাত শক্ত করে ধরে আছে। ভয় পেয়েছে মেয়েটা অসম্ভব বুঝা গেল। বর্ষার মাথাটা থেকে থেকে দুলছে। মনে হচ্ছে এখনি ঘুরে পড়ে যাবে। সাহসি মেয়ে নিতু ভয় পেলেও হাবভাবে বুঝা যাচ্ছে না।
নিতু বলল- মাই গড! ভাইয়া ভাবতেও পারিনাই এই স্টেশানে এই বিপদে আপনার সাথে আবার দেখা হয়ে যাবে! জীবনে ফেরেস্তা দেখলেও এত খুশি হতাম না আজ আপনাকে দেখে যতটা খুশি হয়েছি আমি!
তারপর কিভাবে মুহিন এ স্টেশানে আসল সব খুলে বলল মুহিন। আজিজের সাথে কিভাবে পরিচয়।
সব শুনে নিতু বলল- ভাইয়া কেন এত পাগলামি করেন বলেন তো? আমাদের জীবন কি এতই ছোট যে একটা মানুষের জন্য সব থেমে যাবে?
মুহিন বলল-হু, পাগলামি ছেড়ে দিব ভাবছি। অনেক তো হল আর কত!
এমন সময় আজিজ খবর নিয়ে এল আজ সারারাতেও লাইন ঠিক হবে না। এখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে একটা বাস স্ট্যান্ড আছে ওখানে যেতে হবে হেঁটে। এত রাতে এখানে কোন রিক্সা পাওয়া যাবে না।
সবাই ঠিক করল যে সারারাত বসে না থেকে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে চেষ্টা করাই ভাল।
গ্রামের কাঁচা রাস্তা। তিন ব্যাটারির টর্চ আর নিতু বর্ষার ব্যাগ কাধে নিয়ে আগে আগে হাঁটছে আজিজ, পেছনে মুহিন তার এক পাশে নিতু আর অন্য পাশে বর্ষা। নিতু মেয়েটা মুহিনের হাত ধরে আছে আর বর্ষা একটু দূরে দূরে হাঁটছে। এই রাতের বিপদ কিছু অপরিচিত মানুষকে বেঁধে দিয়েছে জন্মান্তরের বাঁধনে। এ বাঁধন, এ বিশ্বাস সহজে ছিঁড়ে যাবার মত নয়। মুহিন ঠিক করেছে আজিজ লোকটাকে তার বাড়িতে একটা কাজ দিয়ে দিবে। ছুটিতে দেশে আসলে প্রতি সন্ধায় আজিজের মধুর গলার গান শুনবে সে। এবার আর নিশ্চয়ই বিরহের গান গাইবে না আজিজ!
নিতু মেয়েটা কি মনে করে মুহিনের হাত ছেড়ে সামনে আজিজের পাশে চলে গেল। আজিজের সাথে কি সব গল্প শুরু করে দিল। বেচারা আজিজ! নিতুর পাল্লায় যখন পড়েছে তখন বুঝবে তার চেয়েও বড় পাগল এই দুনিয়ায় আছে!
দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে গেল। ভয়ে বর্ষা হটাৎ মুহিনের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।
মুহিন বলল- কি ভয় লাগছে? ভয়ের কিচ্ছু নেই বোকা মেয়ে। আমি আছি না!
বর্ষা বলল-তবুও আমার ভয় লাগছে। আমি আপনার হাতটা ধরি?
মুহিন উদাস গলায় বলল- অনেক বছর আগে একজন মানুষ অনেক ভালবাসা নিয়ে আমার হাত ধরেছিল। আজ সে অনেক দূরে।
বর্ষা অভিমানি গলায় বলল-যে চলে গেছে থাক না তার কথা। আমরা দুজন মিলে দোয়া করি উনি যেন সুখে থাকেন।
একথা বলে দুজনই চুপ। যেন এক মহাকালের নিস্তব্ধতা ভর করেছে দুজনের মাঝে।
কি যেন ভেবে বর্ষা বলে উঠল- আমি জানি আমি খুব বোকা একটা মেয়ে। আমি কখনো একা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। নিতুই আমাকে সবসময় সব বিষয়ে সাহায্য করে। আজ আমি একা একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাই। আমি আপনার হাতটা ধরতে চাই সারা জীবনের জন্য। আমার মত বোকা একটা মেয়ে আপনাকে সুখি করতে পারবে কিনা জানি না তবে এতটুকু কথা দিতে পারি আমি এত হাত কখনো ছাড়ব না।
মুহিন কিছু বলল না। বর্ষার মায়াবি মুখের দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তার মনে হল-এই মায়া ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে থাকা যায় অসীম দুঃখমালা, কাজল কাল চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাওয়া যায় গভীর রাতের মাঝ সমুদ্রের কাল নোনা জল।
মুহিন কিছু না বলে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। বর্ষা সেটা দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে একমনে হাটতে লাগলো।
পরিশেষ-
বর্ষার ভয়ের কারনে মাথার দুলুনি একেবারে কমে গেছে। তার পাশে এখন মুহিন আছে, আছে মুহিনের ভালোবাসা। সেজন্য ভবিষ্যতে বর্ষার এ রোগ সেরে যাবে বলে আশা করা যেতে পারে।
নিতু মজনু আজিজকে খালি খেপাচ্ছে। আজিজ এই পাগলি মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আজিজ মনে মনে বলল-হে খোদা! এই পাগলা মেয়ের হাত থিকা আমারে উদ্ধার কর!
নিতু একবার পিছনে ফিরে দেখল মুহিনের হাত ধরে তার প্রান প্রিয় বান্ধবি হেঁটে আসছে। অনেক ভাল লাগায় বুক ভরে গেল নিতুর। যাক, বোকা মেয়েটা তাহলে নিজে নিজে একটা ভাল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে!
নিতু খুশি মনে আবার পথ চলতে লাগলো।
================================
উৎসর্গ- লেখাটি লেখার সময় আমার যার কথা বারবার মনে হয়েছে সেই নিসংগ মানুষটিকে লেখাটি উৎসর্গ করালাম। মানুষটি হলেন আমার প্রিয় ব্লগার নষ্টছেলে।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়- জীবনের অনেক কিছু ওনার কাছ থেকে শিখার আছে আমার।
লিখেছেন – জাহাজী পোলা |