আমি রিন্টির দিকে হা করে তাকিয়ে আছি । হা করে তাকিয়ে থাকা বলতে আমি কিন্তু আক্ষরিক অর্থই বুঝাচ্ছি । চোখের পাতা না নাড়িয়ে মুখ অল্প খুলে রেখে আমি তাকিয়ে আছি । সৌভাগ্যের কথা হল , আমি যে ওকে এভাবে দেখছি ও সেটা খেয়াল করেনি , কারন ও এখনও আমার থেকে কয়েক ফিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে । আর এদিকে ওকে দেখতে দেখতে আমার চোখ জ্বলে যাচ্ছে , মনের কোন এক চিপায় এভারেস্ট থেকে আসা সুশীতল বাতাস আনাগোনাও করা শুরু করে দিয়েছে । আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগলাম , রিন্টিকে এত সুন্দর লাগছে কেন ? এই মেয়ের সৌন্দর্য দেখছি পুরাই মরিচের গুঁড়া টাইপ , আমার চোখ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে !
রিন্টি আমাকে দেখে আমার দিকে এগিয়ে আসল । আমি জলদি করে মুখের হা বন্ধ করে ফেললাম । আমি ওর দিকে তাকালে ওর ভাব বেড়ে যাবে , তখন আমার সাথে এমনভাবে কথা বলবে যেন আমি একটা সুইপার ,আর ওদের বাসার ল্যাট্রিন পরিষ্কারের ব্যাপারে আমি কথা বলতে এসেছি । তাই আমি চোখে মুখে যথেষ্ট সিরিয়াস ভাব নেয়ার চেষ্টা করে আশেপাশে তাকাতে থাকলাম । রিন্টি আমার পাশে এসে মধুর কন্ঠে ডাক দিল ,
” রিতুন ”
আমি নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে বললাম , ” ও আসছিস তাইলে ”
” বদমাইশ ,হারামি, বাসায় গেলিনা কেন ? ”
আমি ঢোক গিললাম , মহারানীর মুখের আসল বয়ান শুরু হয়ে গেছে । মনে মনে দাঁত খিচিয়ে বলতে লাগলাম , হ্যা রে রিন্টি, খোদা আমাকেই পেল তোর মত চিজের প্রেমে পড়ানোর জন্য এবং পোড়ানোর জন্য ??
আমি রিন্টির দিকে তাকালাম । রিন্টি আকাশী রঙের একটা শাড়ী পরেছে , ওর উদ্ধত চুলগুলো খোলা , চোখে অনেক পাওয়ারের মোটা চশমাটা , আমি বেশিক্ষন তাকানোর লাইফ রিস্ক নিলাম না , বললাম,
” আজকে কি আন্টি দাওয়াত দিছিলো ?”
” ওহ ছোটকাল থেকে আমার বাসায় এত খাইয়া আজকে তিনি আসছেন দাওয়াত খুজতে , তুই আসলে একটা কুকু , বুঝছিস ? ”
আমি মাথা নাড়লাম , হ্যা বুঝেছি , বুঝবোনা কেন , ছোট বেলা থেকে ” কুকু” গালিটাই শুনে আসছি তোর মুখ থেকে । না বুঝার কোন কারন তো দেখছিনা । আমার এই দুষ্টু পরীটা প্রায় সব গালিতেই সিদ্ধহস্ত , তবে সে ” কুত্তা ” বলার বদলে আমাকে ” কুকু ” কেন বলে বুঝিনা , তার এই ব্যাপারে এত উদারতার কারন আমি জানিনা ।
আমি বাস্তবে ফিরে আসলাম রিন্টির চেঁচানিতে ,
” কি ? কথা কানে যায়না ?”
আমি মিনমিন করে বললাম , ” গেছে । তোর এই ভয়েস যদি আমার কানে না যায় , তাইলে তো আম্মারে গিয়ে বলতে হবে আমারে যেন বয়রা হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে আসে ”
রিন্টি চোখ ছোট ছোট করে বলল , ” তাইলে বল বাসায় ঢুকলি না কেন ? ”
” আপনের আম্মার ভয়ে ”
” মানে ?”
” আমি হল থেকে পেট ভরে ভাত খেয়ে আসছি , তোর আম্মারে এইটা কইলে তিনি শুনবেন ? শুনবেন না । আমার পেট ফাটুক আর খইসা যাক , তিনি আমারে খাওয়াইতে বসাবেন । তাই ভিতরে না ঢুকে এখানে তোরে আসতে বললাম । তুই রেডি তো তাইনা ?”
রিন্টি মুখ বাকিয়ে বলল ,
” রেডি কিনা তুই দেখতেছিস না ? ”
আমি ওকে ভালমত দেখে বললাম , ” হ্যা , না ঠিক আছে ”
” আমাকে কেমন লাগতেছে ? শাড়িটা কেমন ?”
” শাড়িটা ভালই , তোদের বাসার জমিলা বুয়ার থেকে ধার করছিস বুঝি ?”
” কি ? ”
ডট ডট গুলিতে হারামি , খাচ্চর , ইতর ইত্যাদি ইত্যাদি গালি প্রয়োগ হবে ।
আমি রিন্টিকে নিয়ে রিকশায় উঠলাম । গন্তব্য টি এস সি । রিকশায় উঠে আমার আবার রিন্টিকে দেখতে ইচ্ছে হল , আড়চোখে বা ৩০ ডিগ্রি ৪০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে না , একদম হা করে দেখতে ইচ্ছে করছে , এইরকম নবাবি ইচ্ছের আসলে কোন মানে হয়না । এক ধাক্কায় নবাবি ইচ্ছেকে ফকিরি দশায় নামিয়ে দিয়ে আমি ৩০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে রিন্টির দিকে তাকিয়ে বললাম ,
” তা বান্ধবি , তোমার মনের কি এমন কথা যা কিনা টি এস সি তে ডেকে নিয়ে এসে বলতে হবে ?”
রিন্টি মুখ ঝামটা মেরে বলল , ” সেটা তুই ও জানিস , তুই তো আর বলবি না , আমিই বলব ।”
আমি হেসে ফেললাম , আমি কিছুতেই হাসি থামাতে পারলাম না , হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি চলে আসল । আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করল । ছোট থেকে জেনে এসেছি পুরুষ মানুষের নাকি চোখের পানি ফেলতে নেই , কোন বেয়াদব যে এই কথার প্রচলন ঘটিয়েছে আমি তাকে সামনে পেলে নির্ঘাত খুন করে ফেলতাম । আরে পুরুষ বলে কি আমরা মানুষ নই ?
যাই হোক , আমি টের পেলাম আমার বুকের মাঝে সাইক্লোন হচ্ছে , আমার কান্না এসে যাচ্ছে । আমি যদি এখন কাঁদি , রিন্টি কি আমার হাত ধরে বসে থাকবে ?
রিন্টি নামের এই বিচ্ছু মেয়েটাকে আমি প্রচন্ড ভালবাসি । রিন্টি আর আমি ছোটবেলার বন্ধু , ছোটবেলা বলতে আমি ” গেন্দাকাল” বুঝাচ্ছি । আমরা পাশাপাশি বাসায় থাকতাম , আমাদের আম্মুরা দুই বাসা ঘুরে আমাদের পিছে পিছে দৌড়িয়ে আমাদের ভাত খাওয়াত , আমরা একসাথে কার্টুন দেখতাম , একসাথে মারামারি করতাম ( কে মারত আর কে মার খেত তা সহজে অনুমেয় ) , একসাথে স্কুলে যেতাম । আমার এস এস সি পরে রিন্টির পরিবার ঢাকায় চলে আসল , আমি পড়ে রইলাম চিটাগাঙে ,তাও আমাদের বন্ধুত্তে একচুল চিড় ধরতে পারেনি স্কাইপি আর ফেসবুকের কল্যানে । তারপর এইচ এস সি শেষে আমি ও ঢাকায় এসে বুয়েটে ভর্তি হয়ে হলে থাকা শুরু করি । আমার হলে থাকা নিয়েও রিন্টি পরিবার ব্যাপক ঝামেলা করেছে , রিন্টির আম্মা পারলে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যান আর রিন্টির আব্বু পারলে আমার ট্রাংক নিয়ে দৌড় দেন -এই অবস্থা । আমি অবশেষে তাদের বুঝ দিয়েছি যে আমি হলেই ভাল থাকব এবং দুদিন পরপর তাদের বাসায় যাব । তারপর দেখতে দেখতে অনেকদিন কেটে গেল ,আমি গাধা আরো গাধামিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে লাগলাম আর এই বিচ্ছু মেয়েটা হয়ে গেল মহাচালাক । যার ফলশ্রুতিতে , সে আমাকে টি এস সিতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ।
আমি আর রিন্টি রিকশা থেকে নামলাম । রিন্টি আগে আগে হাঁটতে লাগল । আমি পিছে পিছে যেতে লাগলাম । তারপর বললাম ,
” এত লাফাইতেছিস কেন ?”
” তুই চুপ কর , নাইলে দূরে গিয়া মর ”
” আমি দূরে যাইয়াই মরব , ঐ দিকে তাকাও , তোমার প্রহর সাহেব চলে আসছেন । এবার আমি ভাগি ”
রিন্টি আমার দিকে তাকিয়ে বলল ,
” রিতুন ,তুই না আমার দোস্ত ? আমাকে ওর সামনে পর্যন্ত দিয়ে আয় , আমি আগে কখনও এমন সিচুয়েশানে পড়িনাই ”
” আজকে পড়বি ”
রিন্টি রাগে লাল হয়ে বলল ,
” তুই আর প্রহর তো ফ্রেন্ড , একসাথে পড়তেছিস , আমি ওরে লাভ করি সেটা তোকে বলতে বললাম , তুই বললি না , এখন সামান্য কাজটা করতে বলতেছি …”
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম , ” মাফ করেন ! চল যাইতেছি ”
প্রহর আমাকে দেখেই এগিয়ে আসল । রিন্টি তো লাজে লাল । এদের দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি ” কাবাবমে হাড্ডি ” কথাটির তাৎপর্য বুঝতে লাগলাম । আমি প্রহরের পেটে একটা ঘুসি মেরে বললাম ,
” থাক বেটা , প্রাইভেট তো পড়াইছিস , এখন প্রাইভেট আলাপ টাও সেরে ফেল । ”
প্রহর কিছু বলার আগেই আমি ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম ,
” আমার টিউশানি আছে রে একটা , দেরি হয়ে যাইতেছে, আমি যাই ”
আমি হাসার চেষ্টা করলাম , সেটা হাসি হল নাকি ভেটকি হল রিন্টি আর প্রহর ই ভাল বলতে পারবে ।
এই পর্যায়ে এসে কিছু পুরানো কাসুন্দি ঘাটতেই হবে । রিন্টি আমার দুই বছরের জুনিয়র ছিল । তাই আমি বুয়েটে আসার পর ওর আব্বু আম্মু আমাকে বিশেষভাবে বলল রিন্টিকে আমি যেন পড়াই । রিন্টি যে আমার কাছে কি কচু পড়বে সেটা আমিও যেমন জানতাম , জানত রিন্টিও । আমি চাইনি রিন্টির পড়ায় ক্ষতি হোক । তাই আংকেল আন্টিকে বুঝিয়ে আমার জিগ্রি দোস্ত প্রহরকে পাঠালাম রিন্টিকে পড়ানোর জন্য । কিউরিয়াস মাইন্ড জানতে চাইতেই পারে , এরকম গাধামি আমি কেমন করে করলাম , কিন্তু আসল কথা , আমি ভাবতেই পারিনি রিন্টি আমাকে ভালবাসেনা আর সেটাই ছিল আমার সবচাইতে বড় গাধামি ।
আমি প্রহরকে রিন্টির পড়ানোর দায়িত্ব দিয়ে বেশ খুশি হলাম । রিন্টির পড়াশুনার ব্যাপারেও ভালই প্রোগ্রেস দেখালাম । চারমাস পর , একদিন সন্ধ্যায় হলে ফিরে দেখি প্রহর চুপচাপ বসে আছে । কি হয়েছে জানতে চাইতেই ও বলল ,
” দোস্ত আমি না আজ টিউশানি টা ছেড়ে দিয়ে এসেছি । ”
” আরে হালা কত টিউশানি …” প্রহর আমাকে কথা বলতে না দিয়ে বলল ,
” আমি রিন্টির কথা বলছি ”
আমি চমকে তাকালাম , ” কেন ? তোর এই টাকাতে চলছেনা ?”
প্রহর কিছুতেই কথার উত্তর দেয়না । অনেক কাঠ খড় পুড়াবার পর ও বলল ,
” রিতুন , আমি রিন্টির প্রেমে পড়ে গেছি , এবং আমি জানি আরো আগাতে গেলে ওদের বাসায় তোর ইমেজ নষ্ট হবে,তারা তো অনেক বিশ্বাস করেন আমাদের। তাই আমি এই কাজ করেছি । আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে রিতুন ”
আমি চুপ করে বসে রইলাম , মনে মনে গর্বের সাথে বললাম , ” তুই মর । রিন্টি তোকে কখনই ভালবাসবেনা ”
আমার দর্পচূর্ণ হয়েছিল সেদিন রাতেই , রিন্টি যখন আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল ,
” রিতুন তুই প্রহর ভাইয়া কে বল না , আমাকে যেন পড়ায়, প্লিজ রিতুন প্লিজ ”
আমি গাধা হলেও মানুষ গাধা , তাই সব ই বুঝেছিলাম । গল্পের মাঝে অনেক পড়েছি , মেয়ে আর ছেলে বেস্ট ফ্রেন্ডের মাঝে যখন তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত হয় তখন তার বৈশিষ্ট্য খারাপ থাকে ,মেয়েটা ঐ তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে কষ্ট পায় , তারপর মেয়েটা একসময় ভুল বুঝতে পেরে বেস্ট ফ্রেন্ডের কাছেই ফিরে আসে । শ্রুতিমধুর গল্প বটে , কিন্তু আমার জীবনে এই কাহিনী হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই , কারন প্রহর ছেলেটা ভীষন ভাল । আর সবচেয়ে বড় কথা হল , সে আমার বিচ্ছুটাকে অনেক বেশি ভালবাসে । তাই আমার অজান্তে আমিই হয়ে গেলাম তৃতীয় ব্যক্তি ।
আমি পিছনে ফিরে তাকালাম । প্রহর মাথা নিচু করে হাসছে । ঝাপসা চোখে আমিও একটু হাসলাম । গাধাটাকে রিন্টি নিশ্চয়ই মানুষ বানাবে । রিন্টি কখনই জানবেনা , তার কাছে মানুষ হওয়ার জন্য পৃথিবীতে আরো একজন গাধা হয়ে জন্মেছিল । সেই রিতুন কখনই রিন্টির স্বপ্নের রাজপুত্র হতে পারেনি ।
থাক , আমি নাহয় তোর দুঃস্বপ্নের রাজপুত্র হয়েই থাকব ।
পরিশিষ্ট ঃ আশা করা যায় , গল্পটিতে সবাই ” হ্যাপি এন্ডিং ” ব্যাপারটাই আগে দেখবেন । কারন প্রহর এবং রিন্টি ভালবাসার টানে অবশেষে কাছে আসতে পেরেছিল । আর রিতুনের ব্যাপারটা ?
পৃথিবীতে দুটি মানুষ সুখি হলে তৃতীয় একজন কে যে কষ্ট পেতেই হবে ।