এরা কারা? এলিয়েনও তো নয়? পৃথিবীর দুর্গমতম এক পাহাড়ি জঙ্গলে এরকম স্মার্ট, ইংরেজি-বলা মানুষদের বসবাস? বেশ-বাসে নগ্ন, অর্ধনগ্ন, ময়লা ও মলিন, কিন্তু অবয়ব ও দেহসংগঠনে জংলি মনে হচ্ছে না কিছুতেই। ধারণা করা হচ্ছে, এরা ইউরোপয়েড ও কঙ্গোয়েড নৃগোষ্ঠীর সংকর। এই কালে আদি জংলিরা যেখানে ‘সভ্য’ জগতে এসে মিশে গেছে, কিংবা ‘সভ্যতা’ যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গভীর জঙ্গল পর্যন্ত, সেখানে নতুন করে কারা আবার কারা জংলি হতে চাইছে?
কথাবার্তা ও আচরণে বোঝা গেল, এদের পূর্বপুরুষেরা ছিল জ্ঞানে-গুণে এক উন্নত জাতির সদস্য। সভ্য জগতের সঙ্গে সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে স্বেচ্ছায় জঙ্গল বেছে নিয়েছিল এক সময়। বহুকাল আগে। তারপর পার হয়ে গেছে তাদের বেশ কয়েকটি প্রজন্ম। সভ্যতার ভাষায় যাকে বলে ‘অধঃপতিত সম্প্রদায়’, এখন তারা তা-ই।
কিন্তু কথা হলো, দুর্গম পাহাড়ি অরণ্যের এই দুর্গমতম জায়গাটা এরা বেছে নিয়েছিল কেন? এসেছিলই-বা কীভাবে! রাজা হবার পর যেমন কারো কারো সন্ন্যাসী হবার সাধ জাগে, সেরকম ঘটেছে কি? বানপ্রস্থের জন্যও তো উপযোগী নয় জায়গাটা। তাহলে? নাকি ভয়ঙ্কর কোনো সংঘবদ্ধ চক্র প্রাণ বাঁচাতে মরুৎযানে করে উড়ে এসে নেমেছিল এখানে, পরে আর ফেরা সম্ভব হয় নি যাদের? নাকি বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর মানুষদের জোর করে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল এখানে? নাকি একশো-দেড়শো বছর আগে সেই যে প্রায়ই শোনা যেত বিমানের নিখোঁজসংবাদ, সেগুলির কোনো একটা কি বিধ্বস্ত হয়েছিল এই দুরধিগম্য জঙ্গলে? বেঁচে-যাওয়া, অকহতব্য সংগ্রাম করে টিকে-যাওয়া যাত্রীদের বংশধর এরা? কিন্তু এরকম চরম প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা, বংশ বাড়িয়ে চলা…এসবই-বা সম্ভব হলো কিভাবে? গবেষকদের মনে এরকম হাজারও প্রশ্ন।
গোত্রের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলার সুবিধা এই যে এরা ইংরেজি জানে, বস্তুত এরা কথাই বলে ইংরেজিতে, যদিও ইংরেজিটা পুরনো আমলের। এদের রয়েছে নানা সংস্কার-সংস্কৃতি। রয়েছে বিচিত্র সব প্রবাদ-প্রবচন-পুরাণকথা। এদের প্রচলিত প্রধান মিথটা সংক্ষেপে এরকম—গড হাঁপিয়ে উঠেছিলেন প্যারাডাইসে, যদিও তাঁর আশেপাশেই থাকত হুকুম-তামিলে-তৎপর অ্যানজেলবৃন্দ। একদিন এই মাটির পৃথিবী থেকে মাটি আনিয়ে তা দিয়ে গড বানালেন এক মানুষ। নাম রাখলেন অ্যাডাম। তারপর ভাবলেন নিঃসঙ্গ সেই মানুষের একজন সঙ্গিনী দরকার। তাই তারই বাঁ-পাঁজরের হাড় থেকে বানালেন এক মানুষী। নাম রাখলেন ইভ। অ্যাডাম আর ইভ আনন্দে ঘুরে বেড়ায় ইডেন গার্ডেনে… ইত্যাদি ইত্যাদি।
মিথের শেষটা এরকম—‘অতঃপর অ্যাডাম আর ইভকে কোনো এক আকাশযানে করে গড পাঠিয়ে দিলেন এই এখানে। পৃথিবীর মাটি দিয়ে তৈরি মানুষকে পৃথিবীতেই পাঠালেন গড। আমরা দুজন হলাম সেই অ্যাডাম আর ইভ, সরাসরি প্যারাডাইস থেকে নেমে-আসা’ —সন্তানদের কাছে এরকম কাহিনিই নাকি বলেছে গোত্রের আদি নরনারী দুজন, যা ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আশ্চর্য! এই মিথ আর মূল ভূখণ্ডে প্রচলিত উদ্ভবতত্ত্ব তো হুবহু এক! পার্থক্য কেবল ওই আকাশযানের প্রসঙ্গটুকু। আর ওইটুকুই হয়ে উঠল গবেষকদের জন্য এক মহামূল্যবান ক্লু।
শুরু হলো পুরাণকথিত সেই বায়ুযানের খোঁজ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক খাড়া পাহাড়ের গোড়ায় পাওয়া গেল এক আকাশযানের জং-ধরা হাড়গোড়। গবেষণা শুরু করা দরকার। আকাশযান নিয়ে তো গবেষণা করতেই হবে, পাশাপাশি এই নব্য আদম-হাওয়ার আওলাদ-বুনিয়াদদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা, ডিএনএ টেস্টিং, নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এসবও তো করতে হবে। সেজন্য তাদের নিয়ে আসতে চাওয়া হলো শহরে। কিন্তু তারা কোত্থাও যেতে রাজি না। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো পোর্টেবল গবেষণাগার এনে স্থাপন করা হবে এখানে, এই গহিন জঙ্গলে। যে-কথা সেই কাজ। উড়িয়ে নিয়ে আসা হলো এক সুসজ্জিত গবেষণাগার, বসল ক্যাম্প, এল গবেষক-প্যানেল। সংগ্রহ করা হলো জংলিদের রক্ত, লালা, মলমূত্র, মাথার চুল থেকে শুরু করে নানা প্রত্যঙ্গের কোষ। চলল ডিএনএ টেস্টিং, হরকিসিমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পাশাপাশি চলতে থাকল আকাশযানেরও ডিএনএ পরীক্ষা। নানারকম আইসোটোপ পদ্ধতি ব্যবহার করে, মাইক্রোস্কোপ ন্যানোস্কোপ সবকিছু কাজে লাগিয়ে নির্ণয় করবার চেষ্টা করা হলো আকাশযানের বয়স।
ঘটনার রহস্যভেদ করতে নানা দিক থেকে তৎপর সবাই। কিন্তু আশ্চর্য! সুরাহা তো হচ্ছে না কিছুতেই। এক টেস্টে এক রেজাল্ট তো আরেকটায় অন্য। বিভ্রান্তিকর সব ফলাফল। কারা ছিল তাহলে সেই নব্য ‘আদম-হাওয়া’? এই ধরিত্রীর কেউ? যারা নিজেদের প্রকৃত পরিচয় মুছে ফেলে ছড়িয়ে দিয়েছে এই কাহিনি? নাকি তারা ভিনগ্রহের? শতবর্ষ আগে মঙ্গলে পাঠানো অভিবাসীদের ভেতর থেকে এক ‘লাভ-বার্ড’ জুটি পালিয়ে এসেছিল পৃথিবীতে, মঙ্গল-কলোনিতে সার সার পার্ক করে রাখা মহাকাশযানের একটাতে চড়ে। তারাও তো ছিল একজন ইউরোপীয়, আরেকজন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। ওরাই কি তবে ঠাঁই নিয়েছিল এখানটায় নব্য অ্যাডাম-ইভ সেজে? নাকি মাঝে-মধ্যেই যে উড়ন্ত মানুষ দেখা যায় আকাশে—একা-একা কিংবা ঝাঁকে-ঝাঁকে তাদের কেউ কেউ কি?
সেই যুগে এক জোড়া দুর্ধর্ষ মাফিয়ার কথা শোনা যেত ঘন ঘন। মাফিয়া তো অনেক, কিন্ত ওই দুই জন ছিল জাঁহাবাজ মাফিয়া। একজন নারী, আরেকজন পুরুষ। তাদেরও একজন ইউরোপিয়ান, আরেকজন আফ্রিকান। সারা দুনিয়ার টনক নাড়িয়ে দেওয়া যতগুলি ক্রাইম ও কেলেঙ্কারির খবর পাওয়া যেত সেসময়, তার প্রায় সবগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকত ওরা দুজন। মহা মহা সব জোচ্চরি, জালিয়াতি, চোরাচালানি, মাদক ও অস্ত্রব্যবসা, ব্যাংকডাকাতি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসকৃত্য, সেক্স অ্যান্ড ক্রাইম ইন্ডাস্ট্রির ওপর নিয়ন্ত্রণ…সব, সব। এমনকি বিশ্বের বাঘা-বাঘা সব চোরডাকাতদের ওপর বাটপাড়ি, জাঁদরেল জোচ্চরদের ওপর জোচ্চরি, বাহাদুর সব মাফিয়াদের ওপর পাল্টা মাফিয়াগিরিতে ওস্তাদ ছিল তারা। সেসবেই নাকি তারা আনন্দ পেত বেশি।
তাদের ধরতে পারে এমন শক্তি বা দক্ষতা কোনোটাই ছিল না কোনো রাষ্ট্রের। অবস্থা একসময় উঠল চরমে। তখন দুনিয়ার বড় বড় সব চোর-বাটপার-মাফিয়ারা একাত্ম হয়ে মাফিয়া রাষ্ট্রগুলির সহায়তায় জারি করল রেড, ব্ল্যাক, আল্ট্রা ভায়োলেট… সবরকমের অ্যালার্ট। আকাশ-পাতাল-পাহাড়-সমুদ্র সব মন্থন করে চলল চিরুনিতল্লাশি। কিন্তু ধরা সম্ভব হলো না তাদের—না জীবিত, না মৃত। কোথায় যে পালাল তারা, আজ পর্যন্ত কূলকিনারা হয় নি কোনো। এখন তারা জগৎ জুড়ে বিচরণ করে এক অপরূপ রূপকথা হয়ে। এখনো দুনিয়ার অনেক জায়গায় দস্যি শিশুদের ঘুম পাড়ানো হয় তাদের গল্প শুনিয়ে।
রূপকথা আরো আছে। ওই ঘটনারও আগে ঘটেছিল আরো এক দুনিয়াকাঁপানো রহস্যঘটনা। তখন সমগ্র দুনিয়া দাপিয়ে ফিরত একটি দেশ। প্রায় সব দেশ ও জাতির ওপর—এমনকি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ওপরও—জারি রাখত তার জবরদস্ত খবরদারি, অবৈধ মাস্তানি আর মাতব্বরি। সেই রাষ্ট্রের যিনি প্রধান, তাঁর ক্ষমতা ঐশ্বরিক-প্রায়। কোনো কোনো দেশ তাঁকে বলত ‘ছোটা-ঈশ্বর’, কোনো কোনো দেশ আবার সুভাষিত বচনে বেশ তাজিমের সঙ্গে বলত ‘ঊনেশ্বর’। তো একদিন শেষরাতের দিকে বলা-নেই-কওয়া-নেই হঠাৎ লাপাত্তা সেই মহাপরাক্রান্ত রাষ্ট্রপ্রধান। দেশ পরদেশ মহাদেশ মহাসাগর, উচ্চভোল্টের সমরনীতি, জঙ্গিসমীকরণ, হঠযোগ, হম্বি ও জম্বি-তন্ত্র, প্রজাহিতৈষা, সহিংস জিঘাংসার অহিংস ব্র্যান্ডিং, কালাজাদু, সম্মোহন, অভিভাবন, মশালবহন, সাপ হয়ে দংশন ওঝা হয়ে ঝাড়ফুঁকন, বিপন্ন দ্বীপদেশ, খয়রাতি উপদেশ, উপদংশ, ইনসাফ, ইনসানিয়াৎ, চাণক্যচাল, নিত্যলীলা, জুগুপ্সা, অঙ্গারশুল্ক, নিগূঢ় এষণা, দখলবাসনা, অবাধ আকাশ, অনুকূল বাণিজ্যবাতাস, তালুক-মুলুক, আর্টিকেল টু সেকশন ওয়ান… সবকিছু অরক্ষিত ফেলে রেখে অন্তর্হিত হলেন সেই অমিত শক্তিধর ছোটা-ঈশ্বর। উধাও তাঁর ‘পাওয়ার ওয়ান’ বহরের সেই অত্যাশ্চর্য স্কাইশিপটাও।
তামাম দুনিয়ায় রাষ্ট্র হয়ে গেল রাষ্ট্রপ্রধানের অন্তর্ধানের খবর। অচেনা বিস্ময়ে বিস্মিত সমগ্র পৃথিবী। কোনো কোনো দেশ ও উপমহাদেশে তুমুল হাসাহাসি, ফোঁড়ন ও টিপ্পনী। এদিকে সাগর উত্তাল, মরুভূমি অস্থির, স্টক একচেঞ্জ বিপর্যস্ত, খনিতে টগবগ ফুটছে জীবাশ্ম জ্বালানি। কেঁপে কেঁপে উঠছে পারদস্তম্ভ, পঞ্চভুজা-ভবনের বিপুল ব্যারোমিটারে; পারদ এখনই উর্ধ্বমুখী তো ফের এখনই অধোগামী। আর ধবল হাবেলি-র যে বিশাল তাপমানযন্ত্র, তার ভেতরকার যে খাঁড়া গুরুগম্ভীর তরলরেখা, ধাঁ করে তা উঠে যাচ্ছে যন্ত্রের চূড়াস্য চূড়ায়, এবং উঠতে উঠতে উদ্বায়ী। উন্মত্ত ফারেনহাইট, দিশাহারা থার্মাল ইউনিট, উন্মাতাল জ্বরাঙ্ক ও প্রেষাঙ্ক। তাপমানযন্ত্রের মাথা ফেটে বেরিয়ে আসছে ফুটন্তঘন বহ্নিতরল।
স্বাধীনতা-স্তম্ভের চূড়ায় নতুন বসানো হাওয়ামোরগটা ঘুরেই চলেছে চড়কির মতো, ক্ষণেই ডানে তো ক্ষণেই বামে, পূর্বাভাসরহিত। বেদম টলতে টলতে ঢুকে পড়ছে ইলেকট্রিক ট্রেন পাতাল-গুহায়। সাগরতলে অজ্ঞাত আক্রোশে নিজে নিজেই ছিঁড়ে যাচ্ছে মেগামেরিন কেবলের টানটান আলোকতন্তু। যত্রতত্র লুটোপুটি খাচ্ছে, দিগ্বিদিক দিশাহারা হয়ে ছুটছে যত গজ ফুট মাইল, পাউন্ড পিএসআই, গ্যালন ব্যারেল, ফারেনহাইট বিটিইউ, টি-ওয়ান টি-টু, র্যাম্বো জাম্বো অ্যাপল অ্যাপাচে…সব, সবকিছু। চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে যত ডলার ডাইম ও গোল্ডেনের দম্ভ।
ওদিকে তামাম দুনিয়া তছনছ করে হন্যে হয়ে ছুটছে উগ্র গ্রে-হাউন্ডের দল, ধেয়ে যাচ্ছে অনুগত হাঙর ঈগল ও বাজ-বাহিনী। তাদের বৈদ্যুতিক চোখ তন্ন-তন্ন করে স্ক্যান করে চলেছে ভূমণ্ডলের প্রতিটি রোম ও রোমকূপ। চারদিকে মার-মার কাট-কাট, পাগলা ষাঁড়ের মতো তর্জন-গর্জন, ফোঁসফাঁস, ঢুঁশঢাঁশ, সুপ্রিম রেড অ্যালার্ট, হুঙ্কার, হুইসেল, পাগলা ঘন্টি, সুপার-হাংরি অ্যালার্ম, লক্ষ ডেসিবলের উচ্চনিনাদ। আর আচমকা ব্রাশফায়ার। থেকে-থেকে বিস্ফোরণ। এ কী! এ আবার কোন কেয়ামত! এ কোন ভূকম্প খকম্প সুনামি শুরু হয়ে গেল জলে স্থলে অন্তরীক্ষে!
এক দেশ বলছে, “বেশি-বেশি করে ফেলছে এরা!”
“করবে না? গোধন হারালে গৃহস্থের মাথা কি ঠিক থাকে? থাকে না। তখন শালি-কে বলে বউ আর বউকে বলে মা। হি হি হি…”, উত্তর করছে আরেক দেশ।
অন্য এক দেশ বলে ওঠে, “সস্ত্রাসীরা হাইজ্যাক করেছে ছোটা-ঈশ্বরকে। শিওর। দ্য গড জুনিয়র ইজ হাইজ্যাকড। যাহ্, একদম খাল্লাস! ডান।”
আরেক দেশ আবার ফোঁড়ন কাটে, “ছোটা-ঈশ্বর অলরেডি চলে গেছে বড়া-ঈশ্বরের কাছে।”
খবর পাঠানো হলো মঙ্গলে, ছোটা-ঈশ্বর সেখানে গেছে কিনা তা জানতে। বার্তা এল, না সেখানেও নেই। ডবল চেকিংয়ের জন্য উড়ল স্ট্যান্ড-বাই ‘পাওয়ার ওয়ান’। গন্তব্য: প্রথমে চাঁদ, পরে মঙ্গলের অপর পিঠ। আহা! সারা জাহানকে অনাথ করে দিয়ে কোথায় যে অন্তর্হিত হলেন জাঁদার জগন্নাথ!
অপেক্ষাকৃত তরুণ ওই রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন স্বভাবে ভাবুক, চরিত্রে প্রেমিক। আসলে কোনো হাইজ্যাক-টাইজ্যাক নয়, সবার অলক্ষে সেদিন তিনি একা-একা আকাশযানে বেরিয়ে পড়েন আফ্রিকা-অভিমুখে, কোনোপ্রকার প্রটোকল প্রটেকশন ছাড়াই। কেন, কে জানে?
সেই যুগে আফ্রিকা ছিল এক অন্ধকার মহাদেশ। সেই মহাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিল এক আদিম ক্যানিবাল-গোত্রের বাস। জঙ্গলের ভেতর বিরাট এক কড়াই চাপানো থাকত বিশাল এক উনুনের ওপর। রাতদিন আগুন জ্বলত সেই চুলায়। অগ্নি-অনির্বাণ। আর গোত্রের লোকজন যখন যেখানে যা-কিছু দেখতে পেত চলন্ত ছুটন্ত বা উড়ন্ত, দল বেঁধে জানপ্রাণ দিয়ে ধরে ফেলার চেষ্টা করত তা-ই—ফাঁদ পেতে, ঢিল মেরে, তীর-বল্লম ছুড়ে, ধাওয়া দিয়ে, ঘেরাও ক’রে। হোক তা পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ, কিংবা মানুষ। ধরে ফেলার পর জ্যান্ত সেই আমিষপিণ্ডকে কোনোপ্রকার ড্রেসিং প্রসেসিং ছাড়াই চড়িয়ে দিত সেই অতিকায় কড়াইয়ে। তারা এমনই আমিষপ্রিয় জাতি যে, পারে-তো আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া বিরল প্রজাতির ধাতব খেচরকেও গুলতি মেরে ধরে এনে ভাজাভাজা করে খায়।
কোন কুক্ষণে কী মনে করে যে ছোটা-ঈশ্বর উড়ে এসেছিলেন এই কুস্থানে! সম্ভবত সভ্যতার চূড়ায় চড়ে-থাকা এই বিশ্বে কোথাও কোনো অসভ্য মানুষ আছে কিনা, মানুষ এখনো অন্ধকারে আছে কিনা তা সরেজমিনে দেখতে চান তিনি। থাকলে সেখানেও তো আলো জ্বালাতে হবে, নাকি? বিশ্ববাজেটে ‘আলো-জ্বালানি’ প্রকল্পের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তার অর্ধেকও তো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। একইসঙ্গে তিনি এও দেখবেন, সেসব জায়গায় কোনো ধনদৌলত, বিশেষ করে তেল-গ্যাস পাবার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা। সারা দুনিয়া তো চষে ফেলা হয়েছে তেল-গ্যাসের অবশিষ্ট উৎসের খোঁজে। কোত্থাও নাকি আর নেই। নিঃশেষ বিশ্বভাণ্ডার। জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক সভ্যতা তাহলে টিকবে কীভাবে? মিডিয়া আর বিশেষজ্ঞদের কথার বিশ্বাস নেই, তারা সাদাকে কালো বানিয়ে দেখায়, সবুজকে হলুদ। তাই স্বচক্ষে দেখতে বের হয়েছেন বিশ্বপ্রধান। তবে সবচেয়ে বড় কারণ—এত ব্যস্ততা, এত বক্তৃতা, এত জনসঙ্গ, এত নজরদারি খবরদারি… ভাল্লাগে না আর। একটু তো নিঃসঙ্গতা চাই, অন্তত এক দিনের জন্য।
নাকি কারণ এসবের কোনোটাই নয়? কোনো কোনো চন্দ্রাহত মানুষ আছে, চাঁদনি রাতে একা-একা বেরিয়ে পড়ে অজানা উদ্দেশে, ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো। আমরা বলি নিশিপাগলা, বলি চাঁদে-পাওয়া মানুষ। ছোটা-ঈশ্বরের স্বভাবে সেরকম কিছু একটা আছে বলে জানিয়েছে কাছের কেউ কেউ। এখন তো কত কথাই বলবে পাত্রমিত্রসভাসদ! কেউ কেউ বলে, ছোটা-ঈশ্বর জাতিস্মরও। পূর্বজন্মের অনেক কথাই বলতে পারতেন। তিনি নাকি প্রায়ই বলতেন—সে-এক জায়গা আছে যেখানে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে এক সমতল চারণভূমি। চতুর্দিক জঙ্গলে ঘেরা। সমতলের সিঁথি হয়ে বয়ে গেছে চিকন এক নদী। চারণভূমিতে চরে বেড়ায় রাঘববিড়াল, কেশরশোভন, সারা গায়ে টিপ-পরা মনুষ্যমোহন, দীর্ঘগ্রীব, কৃষ্ণসার, ডোরাকাটা ঘোড়া…। নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে হঠাৎ গুচ্ছ গুচ্ছ ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের আড়ালে একটি টিলা, তার ওপর আচমকা এক বিশাল পাথুরে প্রতিমা, জোলোঙ্গা দেবতার। নদী অরণ্য ও চারণভূমির দেবতা।
স্কাইশিপটা চারণভূমিতে ল্যান্ড করে হাঁটছেন ছোটা-ঈশ্বর। আরে! এই তো সেই জায়গা! ওই তো রাঘববিড়াল, ওই তো কেশরশোভন, ওই যে ডোরাকাটা ঘোড়া… চরে বেড়াচ্ছে সব! ওই তো সেই নদী, নদীর বাঁক, গুচ্ছ গুচ্ছ জঙ্গল। ভীষণ চেনা চেনা লাগছে সব। হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ছেন ছোটা-ঈশ্বর। মনে মনে ভাবছেন এর পরেই দেখতে পাব এক টিলা আর টিলার ওপরে জোলোঙ্গা-দেবের বিশাল মূর্তি। আরে! একদম তো তা-ই! নিজে নিজেই বিস্মিত হতে থাকেন বাবা বিশ্বনাথ।
এদিকে ঝোপঝাড়ের আড়ালে যূথচারী আমিষাশীর দলে গুঞ্জন ওঠে, “ওই দ্যাখ দ্যাখ, আমিষ যায়, আমিষ। আস্ত এক চলন্ত আমিষ—ফর্সা, মোটাতাজা। ধর… ধর… আটকা ওইটারে আটকা…”
যেই বলা, আর যায় কোথায়! মুহূর্তের মধ্যে চারদিক থেকে ঘনিয়ে এসে, ধাওয়া দিয়ে পাকড়ে ফেলে নধরকান্ত ছুটন্ত আমিষকে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে উত্তপ্ত কড়াইয়ের দিকে।
“সেইভ! সেইভ! ফর ইওর গড’স সেক, প্লিজ ডোন্ট কিল মি!” বলে চিৎকার করছেন ছোটা-ঈশ্বর আর করুণ চোখে তাকাচ্ছেন গোত্রনেত্রী তরুণীটির দিকে। ধরিত্রীর সবচেয়ে নিষ্করুণ নিঃসহায় চাহনি আজ ধরিত্রীপতির। আর সেই সর্বস্বান্ত চাহনি গিয়ে যেই মিলে গেল গোত্রনেত্রীর ধারাল, হাইচার্জ দৃষ্টির সাথে, সঙ্গে-সঙ্গে খেলে গেল এক উচ্চভোল্টের বিজলিচমক। জগতের কোনো তত্ত্বে, কোনো সূত্রে ব্যাখ্যা নেই সেই চমকের। দুজনে কেউ কারুর ভাষার বিন্দুবিসর্গটুকু জানে না—না বাচিক, না ইশারাভাষা, অথচ মুহূর্তের মধ্যে এক অপার্থিব ভাষায় অনুদিত হয়ে গেল পরস্পরের চোখের পরিভাষা। সে-ভাষা দৈবিক, সে-ভাষা দুর্জ্ঞেয়তম, সে-ভাষা অতীত সমস্ত বোধবুদ্ধির—বিশ্বের সবচেয়ে চৌকশ ভাষামেশিনের, তুখোড়তম তাত্ত্বিকের, টীকাভাষ্যকারের। এই কি সেই প্রেমের পরমা ভাষা, যা বাগিন্দ্রিয়ে না সম্ভবে! আর এই কি সেই প্রথম-দেখায়-প্রেম, যা জংলি-সভ্য অ-অতিমানব-ঊনমানব নির্বিশেষে সবাইকে নামিয়ে আনে একই সমতলে!
গোত্রনেত্রী স্যাঙ্গাৎদের আদেশ করলেন অচেনা ভাষায়, “যাও কুড়িয়ে নিয়ে এস আরো ঝরাপাতা, আরো মরা ডাল।”
সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটল জঙ্গলের মধ্যে। অবশ্য ইতোমধ্যে ছোটা-ঈশ্বরকে চড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তপ্ত কড়াইয়ে। পুড়ছেন বাবা বিশ্বনাথ আমিষপিণ্ড হয়ে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড! মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে তুলে কড়াই থেকে নামিয়ে আনল জ্যান্ত, চিৎকাররত আমিষপিণ্ডকে। এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিয়ে কয়েক দফা গড়াগড়ি খাওয়াল তাঁকে গেরুয়া ধুলার ভেতর। বাবা বিশ্বনাথের সারা গায়ে চন্দনচূর্ণের মতো গৈরিক ধূলি-পাউডার। তারপর বাবাজির ধূলিধূসর মুখের ভূমণ্ডল দুই হাতের তালুর মাঝখানে স্থাপন করে ঝুঁকে পড়ে চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল মেয়েটি। বিদ্যুৎবেগে ঘটে গেল যোগাযোগ আবার, পরস্পরের শিরায় শোণিতে, মাথা ও হৃদয়ের কোষে কোষে। যেন তাঁরা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন এখন একে অপরের গোধূলিভাষা।
তিলমাত্র সময় নষ্ট না করে দুজনে ছুটতে থাকলেন ফাঁকা চারণভূমির মধ্য দিয়ে—রাঘববিড়াল, কেশরশোভন, কৃষ্ণসার আর দীর্ঘগ্রীবদের পাশ কেটে কেটে। দূরে কালচে রঙের বিশাল ঢিবির মতো কী যেন একটা পড়ে আছে। ছোটা-ঈশ্বরকে একরকম টানতে টানতে নিয়ে চলল মেয়েটি, তাঁকে লুকিয়ে রাখবে ওই ঢিবির খোঁড়লে। পেছন পেছন খা-রে-রে-রে করে ছুটে আসছে ক্যানিবালের দল। ঢিবি নয়, ওটা তো বাবা বিশ্বনাথের স্কাইশিপ। চোখের ইশারায় দুজনে কী যেন বলাবলি করলেন আর সঙ্গে-সঙ্গে লাফিয়ে উঠে পড়লেন সেই আকাশযানে। তারপর কোথায় যে উড়ে গেলেন তারা, তা হয়তো কেবল বড়-ঈশ্বরই জানেন।
এত যে ঘটনা ঘটল, কোনোটারই তো কূলকিনারা হলো না। শতাব্দী গেল, সমাধান হলো না কোনো প্রহেলিকার। এমনকি এই যে এখন এত গবেষণা চলছে এই জঙ্গলে, অকুস্থলে,তারও তো স্পষ্ট কোনো ফলোদয় হলো না। হুলুস্থুল হলো, ফল হলো না। তাহলে!? পৃথিবীর দুর্গমতম, গা-শিউরানো এই পাহাড়ি অরণ্যে এরা কারা, কী, কেন, কবে, কিভাবে, এবং কোথা থেকে!? বেশ কয়েকটি আলোড়ন-তোলা ঘটনা ঘটেছিল পরপর, সেগুলির মধ্যে কোনটার ফলাফল তবে আজকের এই আজব অরণ্যকাণ্ড?
শোনা যায়, ওইসব সিরিজ ঘটনার পর থেকে ওদিকে আবার সারা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অন্তর্ধান, অজ্ঞাতবাস আর বানপ্রস্থের অসুখ।