কতক্ষন হবে এখানে বসে আছি? দুইঘন্টা তো হবেই। চাষাড়া শহীদ মিনারে একা একা বসে থাকাতা খুবই বিরক্তিকর। কারন এখানে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের অানাগোনা অনেক বেশি। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের পরিমান বেশি থাকে এখানে।
আমার মত নিরীহ একটা ছেলে চুপচাপ বসে বসে আশেপাশের কিউট কিউট মেয়েদের কান্ড কারখানা দেখছে। শহীদ মিনারের সিড়ির উপর কয়েকটা মেয়ে বসে আছে, কাঁধে ব্যাগ। এরা কি স্কুলের ছাত্রী নাকি কলেজের ছাত্রী তা বোঝা যাচ্ছে না।
কোণার দিকের চা দোকানে তিনজন মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর কোন একটা ব্যাপার নিয়ে তুমুল হাসাহাসি করছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তারা আমাকে নিয়েই হাসাহাসি করছে। কারন অনেক্ষন ধরেই আমি মদনের মত এক জায়গায় চুপ করে বসে আছি। এটা নিয়েই হয়তো তারা হাসাহাসি করছে।
গাছের নিচে চেয়ার পেতে দুইজন মহিলা পুলিশ বসে বসে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। কি নিয়ে তারা এত গল্প করছে কে জানে! আমি বারবার ঘড়িতে সময় দেখছি। দুইঘন্টা হয়ে গেল কিন্তু এখনো তার আসার খবর নেই। সে কি আসবে না? নাকি সে এসেছে, কিন্তু আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না? সকালবেলা তো খুব একটা ভীড় থাকে না। তবুও কি সে আমায় খুঁজে পাচ্ছে না?
আমি অপেক্ষা করছি রোদেলার জন্য। আজকেই প্রথম রোদেলার সাথে আমার দেখা হচ্ছে। রোদেলার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে। প্রায় অনেকদিন ওর সাথে কথা বলেছি। তাই বন্ধুত্বের সুবাদে আজ দেখা করার জন্য চাষাড়া এসে বসে আছি।
আমি বসে আছি শহীদ মিনারের চারপাশে দেয়া স্টীলের রেলিংয়ের উপর। এতক্ষন একাই বসেছিলাম, হঠাৎ দুইটা ছেলে এসে আমার পাশে বসলো। দুজনেরই কাঁধে ব্যাগ। বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একটা সিগারেট নিয়ে দুজনে প্রায় মারামারি বাঁধিয়ে দিচ্ছিল। আমি বুঝি না এই নিকৃষ্ট একটা জিনিস নিয়ে মারামারি করার কি দরকার আছে?
এসব কথা ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালাম। আমার সামনে দুইজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের কাঁধেও ব্যাগ। দুজনে কথা বলছে, আর আমি মনযোগ দিয়ে শুনছি।
— জানিস দোস্ত আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি।
— কি আবিষ্কার করলি আবার?
— আমি একটা জিনিস অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করেছি। সেটা হচ্ছে যেসব ছেলেরা ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত মা বাবার কড়া শাসনের মধ্যে বড় হয় সেসব ছেলেরাই বেশি বদমাইশ হয়।
— ঠিকই বলেছিস দোস্ত। এর জ্বলন্ত উদাহরন তো হচ্ছে আমাদের রফি। ইন্টার পর্যন্ত কেমন ভেজা বিড়ালের মত ছিল। আর এখন দেখ, শুধু মেয়েদের পেছন পেছন ঘোরে।
— হা হা হা তা যা বলেছিস।
এই মেয়ে দুইটার কথা শুনে ইচ্ছে করছিল এখনই শহীদ হয়ে যাই। আমাদের মত ভদ্র ছেলেদের নামে এই অপবাদ? এই মেয়েরা যেই কথা বলেছে বাস্তবে তার উল্টোটাই বেশি হয়। যারা স্কুল বা কলেজ লাইফ থেকেই লাগামছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় তারাই বেশিরভাগ মেয়েদের পেছন পেছন ঘোরে, মেয়েদের টিজ করে। কারন তাদের মনে ভয় থাকে না। তারা জানে কোথায় কি করতে হয়। কিন্তু যেসব ছেলেরা মায়ের আঁচলের নিচে অনেকটা সময় কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেয় তারা মেয়েদের সাথে হাংকি পাকিং করে না বা করার সাহস পায় না।
এই কথাগুলো এই দুইজনকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি ভদ্র ছেলে। তাই আমি নজর দিলাম অন্যদিকে। একটা জিনিস দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তা হচ্ছে এইসব স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের জুতা নিয়ে শহীদ মিনারের সিড়ির উপর বসা। এই জিনিসটা করলে শহীদদের প্রতি অসম্মান দেখানো হয় তা কি এই পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা জানে না? নাকি জেনেও না জানার ভান ধরে আছে?
হঠাৎ কোন এক আপু আউ করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। শহীদ মিনারের আশেপাশের প্রায় সবাই আপুটির দিকে তাকালো। একটা পাঁচ ছয় বছরের ছেলে মেয়েটার পা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মেয়েটা অনেক চেষ্টা করেও রক্ষা পাচ্ছে না। এই দৃশ্যটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগলো। যদিও এই দৃশ্য এখানকার নিয়মিত দৃশ্য। এমন আরো অনেক শিশু আছে যারা এভাবে মানুষদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করে। এদের মা সারাদিন ভিক্ষা করে, আর এরা সারাদিন করে ডাকাতি। যদিও এদের উপার্জনের বেশিরভাগ টাকাই চলে যায় ডেন্ডি নামক এক নেশাদ্রব্যের পেছনে।
অনেক কিছুই তো দেখা হলো, কিন্তু যার সাথে দেখা করতে আসলাম তার সাথেই দেখা হলো না। ঠিক করলাম আর দশ মিনিট অপেক্ষা করবো। আসলে আসবে নাহলে আমি চলে যাবো বাসায়।
একজন মহিলা পুলিশ এগিয়ে আসছে আমার দিকেই। নামে মহিলা পুলিশ হলেও আসলে সে একজন রূপবতী তরুণী। বয়স একুশ কি বাইস হতে পারে। এই বয়সে কি কেউ পুলিশের চাকরি পায়? এই জিনিসটা আমি জানিনা।
পুলিশ মহোদয়া আমার সামনে এসে হঠাৎ আমার শার্টের কলার চেপে ধরলেন। আমি তো পুরো টিনের চালের কাক হয়ে গেলাম। আমি কি এমন অপরাধ করলাম যে এভাবে আমাকে পাকড়াও করা হচ্ছে?
— এই তোর সমস্যা কি? সেই কতক্ষন ধরে দেখছি এখানে এসে বসে বসে মেয়েদের দিকে বাজে ভাবে তাকাচ্ছিস। নাকি বোমা হামলা করার চিন্তাভাবনা করছিস? কিরে কথা বলছিস না কেন?
আমি কথা বলবো কিভাবে? আমি তো পুরোপুরি বাকরুদ্ধ। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একই সাথে ভয় এবং লজ্জার চরম এক অনুভূতি আমায় গ্রাস করে নিল। ছোট বেলা থেকেই আমি পুলিশ ভয় পাই। যেখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের ভূতের গল্প বলে ভয় দেখানো হতো সেখানে আমাকে আমার মা ভয় দেখাতো পুলিশের গল্প বলে। আজ সেই পুলিশের হাতেই বুঝি ধরা খেয়ে গেলাম। বহু কষ্টে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলে উঠলাম,
— ম্যাডাম আমি কিছু করিনি ম্যাডাম। একজনের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। সে এখনো আসছে না। তাই বসে বসে এদিক সেদিকের কান্ড কারখানা দেখছিলাম।
— তোর কান্ডকারখানা দেখা আমি বের করছি। আয় আমার সাথে।
একথা বলেই তিনি আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। বুঝতে পারলাম আমাকে শহীদ মিনারের কোনার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে আরো একজন পুলিশ বসে আছে। আজ নিশ্চয়ই ধোলাই দিবে আমাকে। আমি তো পারি না হাউমাউ করে কাঁদি। কিন্তু এত মানুষের সামনে কাঁদতে লজ্জা লাগছে। আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসালো একটা চেয়ারে। আমার সামনে এখন দুজন মহিলা পুলিশ বসে আছে। দুজনের বয়সই মোটামুটি বাইশের আশেপাশে হবে।
যে আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে সে প্রথম বলা শুরু করলো,
— কি সমস্যা হুম? এভাবে মেয়েদের দিকে কুনজরে তাকানো হচ্ছে কেন? চোখ একেবারে গেলে দিব। এখানে কার সাথে দেখা করতে এসেছিলি? কি নাম মেয়েটার?
একটানে একাধিক প্রশ্ন করে প্রথমজন থামলো। আমার থেকে উত্তরের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না যে আমি কার সাথে দেখা করতে এসেছি। এমন ভয় পেয়েছি যে আমার ম্যামরী ফরমেট হয়ে গেছে। কিছুই মনে নেই। এখন যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে। তাই মনে মনে একটা নাম বানিয়ে নিলাম।
— ইয়ে মানে আমি মীম নামের একটা ছেলের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
— কিহ? মীম নামের ছেলে?
— ওহ সরি, ছেলে না। মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
আমার কথা শেষ করার আগেই পাশে থাকা অপর মহিলা পুলিশ চেঁচিয়ে উঠলো। যাকে বলে চিলের মত চেঁচানো।
— কি বললে তুমি? তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসো নি? তুমি মীমের সাথে দেখা করতে এসেছো?
— জ্বী এসেছি। আর আপনি কে? আপনার সাথে আমি দেখা কেন করবো?
— আমাকে চিনতে পারছো না? আমি রোদেলা, তোমার সাথে ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল।
— ধূর কি বলেন এসব? আমার তো মীমের সাথে পরিচয় হয়েছিল। রোদেলা নামের কাউকে চিনি না।
নিজেকে রোদেলা দাবি করা মেয়েটা পাশের জনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো। এবার পাশের জন হালকা একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর বলতে শুরু করলো,
— দেখো আবির অনেক মজা হয়েছে। এবার সিরিয়াস কথা বলা সময়। আসলে রোদেলা আর আমি আপন বোন, আমরা দুজনেই পুলিশে চাকরি করি। কিন্তু রোদেলা তোমাকে এই কথাটা জানায়নি। আজকে রোদেলার সাথে তোমার দেখা করার কথা ছিল। আর আজকেই আমাদের ডিউটি এখানে পড়েছে। সকাল থেকেই তোমাকে আমরা ফলো করছিলাম। রোদেলা চাইছিল সরাসরি তোমার সাথে কথা বলতে। কিন্তু আমি একটু তোমার সাথে মজা করতে চেয়েছিলাম।
— আপনারা কি বলছেন তা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তাছাড়া আমার নাম আবির না। আমার নাম আরমান।
— কিহ?
— জ্বী। এবার কি আমি যেতে পারি? শুধু শুধু আমার এত সময় নষ্ট করলেন।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তখন রোদেলা নামের মেয়েটি আমার হাত ধরলো। তারপর মোবাইলে একটা ফেসবুক আইডির প্রোফাইলে ঢুকে আমার দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিল।
— যদি তুমি আবির না হও, তাহলে এই আইডি কার?
— ছবিটা তো আমারই। কিন্তু এই আইডি আমার নয়। নিশ্চয়ই কেউ আমার ছবি দিয়ে ফেক একাউন্ট খুলেছে। আসলে আমি তো দেখতে অনেক কিউট। তাই হয়তো কেউ প্রফাইলে আমার ছবি ঝুলিয়ে দিয়ে আপনার সাথে চ্যাটিং করেছে।
একথা বলে আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালাম না। সোজা শহীদ মিনারের গন্ডীর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। রোদেলার মলিন মুখটা দেখে খুব খারাপ লাগলো। আমার সাথে মজা করতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন নিজেই মজার শিকার হলো। মনে মনে একচোট হেসে বাসে উঠে বসলাম। তারপর ফেসবুকে লগইন করেই রোদেলাকে ম্যাসেজ দিলাম।
— রোদেলা তোমার চেয়ে তোমার বোন অনেক সুন্দরী। তার কি বিয়ে হয়ে গেছে? বিয়ে না হলে আমি একটু ট্রাই করতাম আরকি।
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক