সমীকরণের ভালোবাসা

সমীকরণের ভালোবাসা

আবদুল মতিন ক্লাসে ঢুকে অস্বস্তি বোধ করলেন। শরীরটা খারাপ লাগছে। ক্লাসরুমটা হঠাৎ সমুদ্রের মতো দুলে উঠলো। চেয়ারের কোনা ধরে কোনমতে নিজেকে সামলালেন। ছাত্ররা কেউ খেয়াল করেনি বোধহয়। এসব কি হচ্ছে? গত ত্রিশ বছরে তার তেমন কোনো অসুখ হয় নি। সাধারণ জ্বর-সর্দিও না। আজকে হঠাৎ এতো খারাপ লাগছে কেনো? নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি চক-ডাস্টার হাতে নিলেন। গতকাল আংশিক ভগ্নাংশ শেষ হয়েছে, আজকে ফাংশনের ক্লাস শুরু হবে।

তিনি ক্লাসের দিকে একবার তাকালেন। কোন শব্দ নেই, সবাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোন এক বিচিত্র কারণে ছাত্ররা তাকে অসম্ভব ভয় পায়। তার ক্লাসে কোন টু শব্দ হয় না। অথচ তিনি কোনদিন কাউকে ধমক দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। তিনি ফাংশন কি বোঝাতে শুরু করলেন। ডোমেন-রেঞ্জ পর্যন্ত আসতেই তার মাথা আবার ঘুরে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন বোর্ডে যেই ফাংশনটা লিখেছেন সেটার ডোমেন রেঞ্জ মনে পড়ছে না। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার! জীবনে অসংখ্য ফাংশন তিনি পড়িয়েছেন। এই সহজ ফাংশন ভুলে যাওয়ার কোন কারণ নেই। অথচ কোনভাবেই মনে আসছে না। তিনি ফাংশনটা মুছে অন্য একটা ফাংশন লিখলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার! এটার ডোমেন-রেঞ্জও মাথায় আসছে না। মাথা কাজ করছে না। আবদুল মতিন ঘামতে লাগলেন।

২ ক্লাস নাইনের ছেলেরা নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে। মতিন স্যার অংক পারছে না! একের পর এক অংক লিখছেন, কিছুক্ষণ করার চেষ্টা করে আবার মুছে দিচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের হালকা শীতেও ঘামছেন। ছেলেরা হতম্ভব হয়ে তাকিয়ে রইলো। শুধু এই এলাকায় না, পুরো জেলায় মতিন স্যারের মতো অংক কেউ পারে না। তিনি একটা অংক করতে গিয়ে আটকে গিয়েছেন এমনটা মনে হয় গত ত্রিশ বছরেও কেউ দেখেনি। এমনিতে কিছুটা পাগল টাইপের, দেখলেই ভয় লাগে। কিন্তু অসম্ভব ভালো অংক পারেন বলে এতো বয়সেও তাকে স্কুল থেকে অবসর দেওয়া হয়নি। তার কাছে গণিত শিখে কেউ গণিতে খারাপ করেছে এমন কোন রেকর্ড নেই। তিনি অংক করতে গিয়ে আটকে যাবেন এটা নিজ চোখে দেখেও কেউ বিশ্বাস করতে পারলো না।

৩ মতিন সাহেবের প্রচন্ড পানির পিপাসা পেলো। তিনি সামনের বেঞ্চের ছেলেটাকে পানি আনার জন্য পাঠালেন। ছেলেটার নাম মনে পড়ছে না। কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে আবদুল মতিন বুঝতে পারলেন নাম মনে পড়বে না। কারণ তিনি ছেলেটার নাম জানেন না। ক্লাসের কারোরই নাম জানেন না। কখনো জানার প্রয়োজন মনে করেন নি। সারি সারি মুখ আসে প্রতি বছর, রাশি রাশি নাম। প্রথম দিকে খুব উৎসাহের সাথে সবার নাম মনে রাখতেন। কয়েক বছর পর উৎসাহ চলে গেলো। এতো এতো ছাত্রের নাম জেনে কি আর হবে? পাশের ক্লাস থেকে হাসির শব্দ আসছে। তার ক্লাসে কেউ ভয়ে হাসে না। আচ্ছা তিনি কি কখনো কোন ক্লাসে হাসির কিছু বলেছেন? ছাত্রদের সাথে গল্প করেছেন? আবদুল মতিন অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। ৩ নবম শ্রেণীর ক্লাস ক্যাপ্টেন হাসিব গ্লাস ধুয়ে পানি আনতে গেলো। তার হাত একটু একটু কাঁপছে। মতিন স্যার অংক পারছেন না এটা এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। হাসিব পানি নিয়ে ক্লাসরুমের দরজার সামনে দাঁড়াতেই দেখলো মতিন স্যার ধুপ করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। হাসিব পানির গ্লাস রেখে দৌড়ে গেলো। ক্লাসে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। কয়েকজন মিলে স্যারকে চেয়ারে তুললো। দুইজন গেলো হেডস্যারকে ডেকে আনতে। বাকিরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হাসিব স্যারের কপালে হাত দিয়ে দেখলো। অনেক জ্বর। হাত পুড়ে যায় অবস্থা। মিনিট পাঁচেক পর আবদুল মতিন মোটামুটি সুস্থবোধ করলেন। জ্বর আছে কিন্তু মাথা ঘুরানোটা বন্ধ হয়ে গেছে। হেডস্যার নিজেই ঘাবড়ে গিয়েছেন।

চুপসানো মুখে বললেন,
— মতিন স্যার, আজকে আপনার ক্লাস নেওয়ার দরকার নেই। আমি কালামকে বলে দিচ্ছি, আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাক।
— না না, এটা তেমন কিছু না। আমি নিজেই যেতে পারবো। বয়স হয়েছে তো, বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। তবু হেডস্যার জোর করে দপ্তরী কালামকে সাথে দিয়ে দিলেন। আবদুল মতিন ক্লান্ত পায়ে বাসার দিকে রওনা হলেন। কিন্তু কালাম জোরাজুরি করতে থাকলো,
— স্যার ডাক্তারখানায় চলেন। এই বয়সে জ্বরাজুরি ভালা লক্ষণ না। মনে হইবো সামাইন্য জ্বর, কিন্তু দেখা যাইবো ভিত্রে আরেক রোগ। আবদুল মতিন উত্তর দিলেন না। কালাম ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকলো। ডাক্তারখানায় না গেলে কিছুতেই সে মতিন স্যারকে বাসায় যেতে দিবে না। কালামকে একটা কড়া ধমক দেওয়ার ইচ্ছে অনেক কষ্টে সামলালেন।

৪ ডাক্তারের দেওয়া জ্বরের ওষুধ খেয়ে খুব একটা কাজ হলো না। রাতে একটু কমলেও ভোররাতের দিকে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে জ্বর আসলো। আবদুল মতিন সারারাত প্রলাপ বকলেন। ঘুমের ঘোরে বারবার মনে হলো এই মুহূর্তে কেউ যদি মাথায় পানি ঢেলে দিতো! মাথায় পানি দেওয়ার কেউ নেই। আবদুল মতিন একাই থাকেন। যুবক বয়সে বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রী নাজমার সাথে বেশ মাখামাখি সম্পর্ক ছিল। একজন অন্যজনকে ছাড়া খেতে বসতেন না। যেদিন বেশী ক্লাস থাকতো, বাসায় আসতে দেরী হতো, নাজমা স্কুলে চলে যেতো। স্যাররা এটা নিয়ে যা হাসাহাসি করতো! ছুটির দিনে ঘুরতে যেতেন। বিকালে নদীর পাড়ে বসে থাকতেন দুইজনে। বিয়ের বছরখানেক পরে নাজমা পাশের বাসার ইকবালের সাথে পালিয়ে চলে যায়। তিনি অনেক ভেবেও কোনদিন এর কারণ বের করতে পারেননি।

আবদুল মতিন এরপর থেকে একাই জীবনযাপন করছেন। আর বিয়েশাদী করেন নি। হয়তো নাজমার উপর অভিমান করে কিংবা হয়তো মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন বলে। ছোট্ট এক রুমের ঘরে থাকেন। একা মানুষ, স্কুলের সামান্য বেতনেও ভালোভাবেই দিন চলে যায়। নাজমা চলে যাওয়ার পর থেকে ভালো খাওয়াদাওয়া কিংবা ঘোরাঘুরির মতো শখ আহ্লাদ আগেই মরে গিয়েছে। মানুষের সাথেও খুব একটা মিশেন না। অংকে ডুবে থাকতেই পছন্দ করেন।

৫ বালাঘাট হাই স্কুলের হেডস্যার আবুল ফজল আজ সকাল সকাল স্কুলে এসেছেন। আটটায় তার একটা ক্লাস আছে। সপ্তাহে এই একটা দিনই তার সকালে ক্লাস থাকে। এতো সকালে ক্লাস বিরক্তিকর। টিচার্স রুমে ঢুকে দেখলেন একটা মানুষ জবুথবু হয়ে বসে আছে। বিশ বছর ধরে দেখছেন তবুও চিনতে বেশ সময় লাগলো। একি অবস্থা! মতিন স্যারের বয়স যেনো একদিনেই দশ বছর বেড়ে গেছে। মুখের চামড়ায় মনে হয় আরো ভাঁজ পড়েছে, চোয়াল ঝুলে পড়েছে। একনজর তাকিয়েই মনে হচ্ছে লোকটা ভয়ংকর অসুস্থ।
হেডমাস্টার স্যার উদ্বেগের সুরে বললেন,
— এই অবস্থায় আপনাকে আসতে বলেছে কে? অসুস্থ শরীরে আসার প্রয়োজন নেই। আপনি বাসায় গিয়ে শুয়ে থাকেন। কালামকে ডেকে দিচ্ছি।
— কালকে ক্লাস নাইনের ক্লাস নিতে পারিনি। দুইদিন কামাই করা ঠিক হবে না।
— আরে দুইদিন কোন ব্যাপার না। আপনি অসুস্থ হয়ে গেলে ক্লাস নিবে কে? তখন আরো বেশী কামাই হবে। হেডস্যার অনেক চেষ্টা করেও রাজি করাতে পারলেন না। আবদুল মতিন ক্লাস নাইনে ঢুকে কোনমতে চেয়ারে বসলেন। ছাত্রছাত্রীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এক এক করে সবগুলো মুখের দিকে তাকালেন। কি আশ্চর্য সুন্দর লাগছে।
— সবাই একজন একজন করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের নাম বলবি। ছাত্রছাত্রীরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ক্লাস ক্যাপ্টেন সাহস করে উঠে দাঁড়ালো।
— আমার নাম হাসিব।
— পুরা নাম বল।
— হাসিবুর রহমান সিফাত।
— হাসিব নামে আমার একটা ছাত্র ছিল অনেক আগে। বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলো। এখন ম্যাজিস্ট্রেট। তোরা চিনিস? সবাই মাথা নাড়লো। ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবকে সবাই চিনে। এইতো কিছুদিন আগে স্ত্রীসহ স্কুলে এসেছিলেন, সবার সাথে দেখা করেছিলেন। মতিন স্যার আর হেডস্যারের পা ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন। উনার স্ত্রী আর স্কুলের ছাত্রছাত্রী অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। যাওয়ার আগে স্কুলের সবার জন্য চকলেট দিয়ে গেলো। সেই চকলেট আবার অন্যরকম, মুখে দিলেই গলে যায় কিন্তু অনেকক্ষণ মিষ্টি স্বাদটা থাকে।
— তারপরের জন, নাম বল। একে একে সবাই নাম বললো। মতিন স্যার কারো বাড়ির খোঁজখবর নিলেন। কারো বড়-ভাইবোনের কথা জিজ্ঞেস করলেন। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তার বেশ ভালো লাগছে। ছাত্রছাত্রীদের কঠিন মুখ কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে। একজন উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
— আমার নাম বাদশা সরকার।
— বাদশা আবার সরকার? রাজা, সুলতান, সম্রাট এগুলিও লাগিয়ে দে। সম্রাট সুলতান রাজা বাদশা সরকার। ক্লাসে একটা মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠলো। মতিন সাহেব তৃপ্ত চোখে হাসি দেখলেন। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা যে হাসতে পারে এটা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। নাহ! জীবনটা ভুলে ভুলে কেটে গেলো। নাজমার চলে যাওয়ার পর থেকে হাসি-তামাশা জিনিসটা জীবন থেকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে শুধু শুধু জীবনটা নষ্ট করলেন। এই চমৎকার ছাত্রছাত্রীদের সাথে মিশে চমৎকারভাবে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেতো। ইশ! সময়টা ফেরত পাওয়া যেতো যদি!

৬ ক্লাস নাইনের স্টুডেন্টদের বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। মতিন স্যার ক্লাসে এসে গল্প করছেন, হাসি-তামাশা করছেন এটা একদিন আগে কেউ বললে ঘূর্ণাক্ষরেও বিশ্বাস করতো না। স্যারকে সবসময় রাগী কিন্তু ভালোমানুষ হিসেবেই দেখে এসেছে সবাই। তিনি যে রসিকতা করতে পারেন এটা কল্পনারও বাইরে। ঘন্টা পড়ার কিছুক্ষণ আগে মতিন স্যার যখন মাথা ঘুরে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন তখন ছাত্রছাত্রীরা অধিক বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলো। সবার আগে হাসিব সম্বিৎ ফিরে পেলো। দৌড়ে গিয়ে স্যারকে ধরে চেয়ারে উঠাতে চেষ্টা করলো। খবর পেয়ে হেডস্যার দৌড়ে আসলেন। দেখে মনে হচ্ছে স্ট্রোক করেছেন। এক্ষুনি হাসপাতালে নেওয়া দরকার। হেডস্যার কালামকে ডাক দিলেন। কালাম এসে দেখলো মতিন স্যারের মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।

৭ বালাঘাট বাজারের মানুষ অবাক হয়ে বিচিত্র দৃশ্যটা দেখছে। স্কুলের দপ্তরী কালাম মতিন স্যারকে কাঁধে নিয়ে দৌড়াচ্ছে, তার পিছনে শ খানেক ছাত্রছাত্রীও দৌড়াচ্ছে। একটু পেছনে দৌড়াচ্ছেন হেডস্যার সহ অন্যান্য স্যাররা। কিছুক্ষণের মাঝে সবার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হলো। মতিন স্যার অসুস্থ, তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। বালাঘাট বাজারের মানুষরাও দৌড়াতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সবখানে রটে গেলো মতিন স্যার মৃত্যুশয্যায়। দলে দলে লোক আসতে লাগলো। ভীড়ের ঠেলায় হাসপাতাল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। বালাঘাট হাইস্কুলের ফেসবুক গ্রুপে দোয়া চেয়ে পোস্ট দেওয়া হলো। সাবেক ছাত্রছাত্রীরাও আসতে শুরু করলো। মফস্বলের ছোট হাসপাতাল নামীদামী গণ্যমান্য ব্যক্তির পদভারে প্রকম্পিত হতে লাগলো। ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবকেও দেখা গেলো এক কোণায়, চুপচাপ বসে আছেন। স্যারকে ঢাকা নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ডাক্তার বলেছেন এখনো অবস্থা ভালো না। কিছুটা সুস্থ হলে ঢাকায় নেওয়ার কথা বিবেচনা করা যাবে। ম্যাজিট্রেট হাসিব কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এসএসসি পরীক্ষার আগে অংকে সমস্যা ছিল। মতিন স্যারকে বলায় স্যার প্রতিদিন সন্ধ্যায় পড়াতে আসতেন। টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তবু লাস্ট দিন মা কিছু টাকা একত্র করে হাসিবের হাতে দিয়েছিলেন স্যারকে দেওয়ার জন্য। “আমি কি টাকা চেয়েছি?” বলে মতিন স্যার এমন ধমক দিয়েছিলেন, ভয়ে হাসিবের হাত থেকে টাকা নীচে পড়ে গিয়েছিলো। একটা কান্নার ঢেউ ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবের শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো।

৮ বালাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ সরকার ঘোষণা দিয়েছেন মতিন স্যার সুস্থ হলে তিনি হাসপাতালের তিনতলা করার খরচ দিবেন। হাসপাতালের নীচের উঠানে কালাম এখনো কাঁদছে। উপরে এতো মানুষের ভীড় ঠেলে উঠতে পারেনি। মতিন স্যারের সাথে ফেরেশতা আছে সে নিশ্চিত। গত বছরের আগের বছর বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে অনেকগুলো টাকা ঋণে পড়ে গিয়েছিলো। কথায় কথায় একদিন মতিন স্যারকে বলতেই তিনি তার বেতনের অর্ধেক কালামকে দেওয়া শুরু করলেন। প্রতি মাসে জোর করে দিয়ে দিতেন। ঋণ শোধ হয়ে গেছে বেশ আগেই কিন্তু স্যার এখনো টাকা দিয়ে যান। কালাম কয়েকবার নিষেধ করায় এমন চোখে তাকিয়েছেন যে ভয়ে আর নিষেধ করতে সাহস পায় নি। এমন মানুষের সাথে ফেরেশতা থাকবে না তো কার সাথে থাকবে? কালাম আবার কাঁদতে শুরু করলো।

৯ দুইদিন যমে মানুষে টানাটানির পর মতিন স্যারের জ্ঞান ফিরলো। চারপাশে এতো নামীদামী মানুষ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। স্কুলের সাবেক-বর্তমান সব ছাত্রছাত্রীরাই আছে। এই আসনের এমপি, পুলিশ সুপারও এসেছেন। এরা সবাই মতিন স্যারের ছাত্র ছিল। মতিন সাহেব বুঝতে পারলেন তার জীবনের সময় ফুরিয়ে আসছে। মৃত্যুর আগে নাকি প্রিয় মুখ দেখা যায়। তিনি তার প্রিয় মুখগুলো দেখতে পাচ্ছেন। শুধু একটা মুখই নেই। নাজমার মুখটা যদি দেখা যেতো! মতিন সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সারা জীবনে তিনি অনেক অংক মিলিয়েছেন। অসংখ্য জটিল জটিল সমীকরণ সমাধান করেছেন। শুধু একটা সমীকরণই মিলে নি, নাজমা কেনো ছেড়ে চলে গেলো? বহুবার এটা নিয়ে চিন্তা করেছেন, কখনো কোন সমাধানে পৌঁছাতে পারেন নি। বেলা তিনটার দিকে মতিন স্যার শেষবারের মতো নিঃশ্বাস ফেললেন। হেডস্যার চেয়ারে বিহ্বল হয়ে বসে রইলেন। কালাম মতিন স্যারের পা জড়িয়ে ধরে আছে। তার মুখ নড়ছে কিন্তু কোন শব্দ বের হচ্ছে না। ছাত্রদের অনেকেই কান্না আটকাতে গিয়ে কেঁদে ফেললো। হাসিব হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটতে লাগলেন। পেছন থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার পা কাঁপছে।

১০ ভালোবাসার তীব্র অভিমান নিয়ে একাকী জীবন কাটানো মতিন স্যার জানলেন না তার চারপাশের মানুষ তাকে কত তীব্রভাবে ভালোবাসতো।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত