পাশের ফ্ল্যাটে সমবয়সী সুন্দরী মেয়ে থাকলেই সমস্যা।যেকোন সময় বিপদ ঘটতে পারে।এতদিন চুপ করে ছিলাম,আজকে খুবই বিগড়ে গিয়েছি।
নতুন বাসাটায় ওঠার অল্প কদিনের মধ্যেই আম্মু,আপু সবার সাথে পাশের ফ্ল্যাটের সকলের গভীর ভাব হয়ে যায়।আমি আবার ভাব জমাতে ওত এক্সপার্ট নয়।তাছাড়া এসব ব্যাপারে আমার ইন্টারেস্টও নেই।শুধু পাশের বাসার আন্টি আমাদের বাসায় আসলে যদি আমার চোখের সামনে পড়ে,তবেই একটা দায়সারা সালাম দিই।ব্যাস,এটুকুই।আর এ বাসা থেকে ও বাসা সবার যাতায়াত নিয়মিত থাকলেও আমার সীমানা ছিল শুধুমাত্র আমার রিডিং রুমের চার দেওয়ালের মাঝে।
বাসায় ওঠার কদিন পর পাশের আন্টি একদিন আমাদের বাসায় এসে ডেকোরেশান দেখছিলেন।আমি তখন দরজা বন্ধ করে পড়ার টেবিলে বই উল্টাচ্ছিলাম।এমন সময় আমার দরজা ঠেলে রুমে ওনার প্রবেশ।ঘাড় ঘুরিয়ে সালাম দিতে গিয়েই চোখে পড়ল মেয়েটাকে।দেখলাম সে ও আমার দিকে তাকিয়ে।অবাক হয়ে এক মুহূর্ত চেয়ে রইলাম।তারপর চোখ নিচে নামালাম টেনে।মেয়েটার রূপের বর্ণনা দেওয়ার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না,বর্ণনা দিয়েও বোঝাতে পারবো না,শুধু বলি,মেয়েটাকে একপলক দেখেই চোখ যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল,আর সেদিন ঘুমানোর জন্যও চোখ বন্ধ করতে পারিনি।
পরদিন আম্মুর কাছে বিস্তারিত জানলাম,পাশের ফ্ল্যাটের বড় মেয়ে,মেয়েটা আমার ক্লাসেই পড়ে,লেখাপড়ায়ও খুব ভাল।শুনে খুশি হলাম।তবে ঐরকম চিন্তা ভাবনা ভুলেও করিনি একবারের জন্যও।
বন্ধুত্ব করার শখ আমার নেই।মোটেও নেই।গাছের সুন্দর ফুল দেখে সকলেই অভিভুত হয়,তাই বলে যে সকলেই ফুলটাকে ছিড়তে চায়,এমনটা কিন্তু নয়।আমিও তেমনই একজন,সুন্দরের পূজারী,তবে গ্রাসী নয়।
তাকে মাঝেমাঝেই দেখি।কলেজ যাওয়ার পথে,সিঁড়িতে উঠতে নামতে,মাঝেমাঝে আমাদের বাসায় আসলেও।তবে কথা হয়না।ভুল বশত দুজনের চোখে চোখ দুএকবার পড়লেও হাই হ্যালো বিন্দুমাত্রও নেই।গম্ভীর ভাব থাকে সবসময় দুজনের।সেদিন বিকেলে কলেজ থেকে যখন ফিরছিলাম,বাসার একেবারেই কাছাকাছি,তখনই হঠাৎ কথুকে একটা হাত এসে খপ করে ধরে ফেলল আমার হাতটাকে।চমকে উঠলাম।মুখের দিকে তাকাতে না তাকাতেই সেই পাশের ফ্ল্যাটের সেই মেয়েটা জোর গলায় বলে উঠল,”সৌরভ,এসেছে এখন?কতক্ষণ অপেক্ষা করছি,চলো চলো।” কিছুই বুঝলাম না,মেয়েটা আমার হাত ধরে দ্রুত গতিতে আমাকে টানতে টানতে তিনতলায় বাসায় উঠে গেল।তারপর আমার হাতটা ঝামাড় দিয়ে নিজের ফ্লাটের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল তাড়াহুড়ো করে।আমি নির্বোধ বাচ্চাদের মতো কিছু না বুঝেই আমার
ঘরে ঢুকে গেলাম।কাউকে কিছু বললামও না।সেদিন রাতেই দেখি ম্যাসেঞ্জারে নিউ ম্যাসেজ রিকুয়েস্ট দিয়ে দিয়ে লেখা,”অনেক ধন্যবাদ।কিছু বখাটে পিছু নিয়েছিল,তাই অভিনয়টা করতে হয়েছে।প্লিজ কিছু মনে করবেন না।ইতি পাশের ফ্ল্যাটের আলপনা।” আমি অবাক হলাম।সব বুঝলামও।মনেমনে কেন জানি একটু হাসলাম।এই হচ্ছে প্রাথমিক ধাপ।এরপর আবার সব স্বাভাবিক আগের মতোই হয়ে গেল আবার,তবে দেখা হলে ভুল বশত চোখে চোখ পড়ার সংখ্যাটা আগের চেয়ে একটু বড় হলো মনে হয়েছিল।
আরেকদিন কী হলো?আন্টি আমার কাছে এসে আমার বাংলা বইটা ধার নিয়ে গেল এই বলে যে, আলপনা বইটা হারিয়ে ফেলেছে।হুম,হারা
তেই পারে।অস্বাভাবিক না।দিয়ে দিলাম বইটা।কিন্তু অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল তখন,যখন বইটা ফেরত পেয়ে তার সূচিপত্রে চোখ পড়তেই দেখলাম বড় নীল রঙের আর্ট করা লিখা,”আলপনা নামের মেয়েরা সবসময় খুব ভাল হয়।”এটা চোখে পড়ামাত্রই বিস্মিত হলাম।আমি আমার বইতে অপ্রয়োজনীয় একটা দাগও কাটিনা,আর সে এটা কী করল।রাগ হয়েছিল একটু,তবুও কাউকে কিছু বলিনি,অবাক ছিলাম অনেকক্ষণ।
এর কয়েকদিন পর ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম এমনিতেই,”আমি আমার আমিত্বে সদা বিশ্বাসী।তাই অবসর খুঁজে ফিরিনা।তবুও বলছি,যদি গল্প করতে চাও,তবে হাতে হাত রাখো;চোখে চোখ নয়।” স্ট্যাটাসটা দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ফেসবুকে চোখে পড়ল আলপনার একটা স্ট্যাটাস,”যারা চোখ বেঁধে রাখতে চায়,তাদের চোখ তুলে ফেলা উচিৎ।তবেই বুঝবে,চোখ দিয়ে না দেখলে স্পর্শ অর্থহীন।” কথাটা আমার মনকে যেন একটা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফুটো করে দিল মনে হয়েছে।প্রথমে ভেবেছি,এটা ডিরেক্টলি আমাকে অপমান।এর পরপরই কোন রিঅ্যক্ট না করে ভাবনাকে গভীরে নিয়ে দেখলাম,কথাটাতে অপমান নয়,কোন গভীর অর্থ আছে মনে হচ্ছে।কিছুক্ষণ ভেবে একটু খুশি মনেই হাসি উঠলাম আপনমতো।যাইহোক তবুও কাউকে কিছু বলিনি।
এরপর থেকে একটা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম নিজে নিজে।চোখ আর উপরে তুলব না।কখনোই না,যত হাজারবারই সে আমাদের বাসায় আসুক না কেন,যেখানেই যা হোক,চোখে চোখ রাখবই না।প্রয়োজনে আমি চোখ উপরে তুলে একপলক দেখব,তবুও দু’মুখী শুভদৃষ্টি আর করব না।এবং করলামও তাই।এরপর সে যখনই যেখানে আমার সামনে পড়ে,আমাদের বাসায় হোক,বাইরে হোক,আমার চোখ সবসময় নিচের দিকে ফিক্সড।
আমি কিন্তু চলমান বিষয়গুলো বেশ ভালোই এনজয় করছিলাম।কিন্তু সেটা বড় কথা নয়,বড় কথা হচ্ছে মেয়েটা কী ভাবছে।এমনটা যখন চিন্তা করছিলাম,সে সময়ই ফেসবুকে ঐ রূপবতী মায়াপরীর একটা লিখা সামনে আসল,”মানুষ আসলেই খুব খারাপ।কল্পনারও বাইরে।” আচমকা দেখেই আমি শিহরিত হলাম।কথাটা কি আমার জন্য ছিল?ভাবলাম একটু।আমাকে এত জঘন্য একটা কথা বললেও আমার কিন্তু বেশ ভাল লেগেছিল।আমি আমার নীতিতে আরও জোর দিলাম।চোখে চোখ রাখা তো বন্ধই,এবার আমার রুম থেকেই বিনা প্রয়োজনে বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম,যাতে আমাদের বাসায় আসলেও আমাকে আর না দেখতে পায়।তবুও মাঝেমাঝে হঠাৎ হঠাৎ কলেজ পথে,কিংবা এখানে ওখানে সামনাসামনি পড়ে যায়।তখন আরো ভাব নেওয়া শুরু করলাম।গভীর ভাব।কোন কথা না,একদম স্ট্রীক্ট।
এইভাবে দু একদিন যাওয়ার পর সে হঠাৎই একদিন আমাকে ফেসবুকে ম্যাসেজ দিলো।বলে রাখি এটা ছিল তার সেকেন্ড ম্যাসেজ।তাকে বখাটেদের হাত থেকে বাঁচানোর পর ধন্যবাদ জানিয়ে ঐ ম্যাসেজটার পর আর কোন কথা হয়নি আমাদের।ম্যাসেজটা পড়ে দেখলাম,”হাই!
কেমন আছেন?পড়াশোনা কেমন চলছে?” মানে কী বলব বুঝতে পারছি না,জানেন?ম্যাসেজটা পড়ে বারবার নিজের কাছে এটা মনে হচ্ছিল আমি যে নিজেকে এতো কন্ট্রোল করে চলাফেরা করি,এসব সে জানেও না,আমাকে নিয়ে তার কোন ভাবনাই নেই,সে আমাকে পাত্তাই দেয় না,দৃষ্টিও দেয় না।মনে হচ্ছিল সে জাস্ট স্বাভাবিকভাবেই আমার খোঁজ নিচ্ছে।আমি তো রেগে আগুন।সবই কি তাহলে আমার মনের মিথ্যা ধারণা?একটু চিন্তিত হলাম।ম্যাসেজটা seen করে ইচ্ছা করেই রিপ্লাই না দিয়ে রেখে দিলাম।
এরপরের দু একদিন আরো অফ মোডে ছিলাম।অহংকারী ভাব নিয়ে।তবে দু একবার তাকে দেখে মনে হয়েছিল তার মন ভীষণ খারাপ।খুবই খারাপ।জানিনা আমার মিথ্যা কল্পনা কিনা,সে যেন আমার থেকে কিছু একটার গভীর দাবিদার।
তবুও আমি কী করলাম?আমি ফেসবুকে আবার একটা স্ট্যাটাস দিলাম,”দূরে থাকো,ভাল থাকবে।অতি ঘনিষ্ঠ হলেই মনোমালিন্য বাড়বে।বাড়বেই,এটাই নিয়ম।Just Love YOURSELF।”
এরপর দিন।শুক্রবার সকালে।আম্মু আপু দুজনেই বাইরে গেছে কোন একটা কাজে।আমি পড়ার টেবিলে বসে বসে ভাবছি একটা কথা,আমার কী এটা ঠিক হচ্ছে?আমি কেন মেয়েটার সাথে এমন করছি?কোন অধিকারে?সত্যি কথা বলতে কী,আমি তো আসলেই মেয়েটাকে বহু আগেই ভালবেসে ফেলেছি।নইলে কেনই বা এত রিঅ্যাক্ট করছি?মেয়েটাও হয়ত সত্যিই আমাকে ভাল জেনে ফেলেছে,আর আমি এসব কী নোংরামি করছি,কেনই বা করছি!ভেবে নিজেকে ধিক্কার দিলাম,ছিঃ!গতদিনের দেওয়া স্ট্যাটাসটা ডিলিট করার জন্য ফোন হাতে নিলাম।এমনসময়ই কলিংবেল বেজে উঠল ক্রিংক্রিং শব্দে।উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।দেখলাম আলপনা দাঁড়িয়ে আছে।সম্ভবত একটা তরকারির বাটি হাতে।আমার দিকে না তাকিয়েই সোজা ঘরে ঢুকে পড়ল।আমিও পেছন পেছন হাঁটা শুরু করে বললাম,”আম্মু,আপু কেউ বাসায় নেই,বাসায় শুধু আমি।”কোন জবাব নেই।সে ভেতরের দিকেই এগুচ্ছে।আবার বললাম,”বাসায় কেউ নেই তো।শুধু আমি।” কথা শুনল না।সোজা ভিতরের দিকে আম্মুর রুমে গিয়ে দাঁড়ালো।আমিও পেছন ছুটে হাজির হলাম সেখানে।এরপর আলপনা আমার দিকে তাকালো রাগি চোখে।আমি তার অপূর্ব সুন্দর মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নিচে নামালাম।হঠাৎ আলপনা তার হাত দিয়ে আমার নিচু মুখটা তার চোখ বরাবর তুলে রাগী কণ্ঠে বলল,”এখন যদি চিৎকার দিয়ে বাঁচাও বাঁচাও করি?যদি চিৎকার দিয়ে বলি আমাকে শেষ করে দিচ্ছে,কে কোথায় আছ?”
আমি থ!পাথর হয়ে গেছি কথা শুনে।ভয়ও পেলাম একটু।ভীরু কণ্ঠে জোর দিয়ে বললাম,”মানে,কী বলছেন এইসব?” “আপনি এক্ষুণি আমার চোখে চোখ রাখবেন।তারপর দুহাত দিয়ে আমার দুগালে হাত বুলিয়ে বলবেন আমি তোমাকে ভালবাসি,চোখে চোখ রেখে বললাম।তুমি প্লিজ কাছে এসো,দূরে যেও না।” আমি তো অবাক।এটা কী বলে!বললাম,”আপনার শরীর ঠিক আছে তো?” “আপনি কথাগুলো বলবেন নাকি আমি চেঁচাবো?” গেলাম আরো ভয় পেয়ে।বিরক্ত ভীত কণ্ঠে বলালাম,”এসব কী?এসব কিন্তু ভাল না।সরুন,পথ ছাড়ুন।” “আপনি বলবেন কিনা?আমি কিন্তু সত্যিই চেঁচাবো এবার!আমি তো নার্ভাস হয়ে গেছি।তার মুখে যদিও মিটিমিটি হাসি ছিল,তবুও রাগটাও বেশি ছিল।যদি আসলেই চেঁচায়?তাহলে তো মান ইজ্জত সব শেষ।আমি কাঁপতে শুরু করলাম।উপায় নেই।বলতেই হবে।কম্পিত গলাম বলতে শুরু করলাম,”আমি আপনাকে।”
” না এভাবে না।আপনার দুহাত আমার মুখের ওপর রাখুন,চোখ আমার চোখে রাখুন।” ভীত কণ্ঠে বললাম,”এটা কিন্তু আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে!” “আপনি শুরু করবেন নাকি আমি চেঁচাবো?” আর কি!আমি অসহায়।মনেমনে ভাবলাম,”এটা বুঝি ভালবাসা?এটা তো সন্ত্রাসীর শামিল।” কিছুই করার নেই।অগত্যা আমার দুই হাত তার নরম তুলতুলে মুখে জড়িয়ে,চোখগুলো তার চোখে রেখে একদৃষ্টেতে তোতলাতে তোতলাতে বলতে লাগলাম,”আমি তো আপনাকে প্রথম দেখাতেই ভালবেসে ফেলেছিলাম।কিন্তু…আজকে আপনি আমার মতো একটা নিরীহ,বাচ্চা ছেলেকে যেভাবে ব্ল্যাকমেইলটা করলেন,এটার বিচার একমাত্র আল্লাহই করবেন।আর আপনার মুখটা এত তুলতুলে,নরম কেন?ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা।”
——সমাপ্ত——-