পাশের বাসার লোকজন মেহমান রেখে পালিয়েছে। মেহমান এসে উঠেছে আমাদের বাসায়। বোরখাওয়ালি মেহমান মহিলা নাকি বালিকা বুঝতে পারছিনা। এ নিয়ে মন খানিকটা খারাপ। বালিকা হলে একটু ইম্প্রেস করার ট্রাই করতাম কিন্তু বুঝতে পারছিনা তার বয়স কতো। কেননা তার মুখ পর্যন্ত ঢাকা। রিস্ক নিতে চাচ্ছিনা কেননা সেন্টু ভাই একবার ফেসবুকে এক মেয়েকে পটিয়ে ফেলেছিলেন। যেদিন দেখা করতে গেছেন গিয়ে দেখেন মহিলা তার খালার বয়সি।
তাছাড়া কাল পরীক্ষা এ নিয়ে একটু চিন্তিত। পরীক্ষার আগে আগে আমার জ্বর নাহলে পেটের গন্ডগোল দুটোর একটা হবে এটা কন্ফার্ম। এবারো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি বিকাল থেকে শরীর গরম হতে শুরু করছে সন্ধ্যা হতে হতে আকাশ পাতাল জ্বর এসে গেলো। চোখ জ্বলছে, কান গরম হয়ে গেছে, নাক দিয়ে গরম নিশ্বাস বের হচ্ছে।
আমার জ্বর হলে বাসার সবাই আতঙ্কের মধ্যে থাকে।
বংশে পাগলামি রোগ আছে। আমার এক চাচা ছিলেন কাতুকুতু পাগল। দেখতে সুদর্শন সুপুরুষ দেখে বুঝার উপায় নেই বেচারার মাথায় সমস্যা। সবার সাথে বেশ ভদ্র ভাবে কথা বলেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ কাতুকুতু দিতে শুরু করেন। এমন ও হয়েছে কাতুকুতু দিতে দিতে মানুষকে অজ্ঞান করে ফেলেছেন।
আরেকজন পাগল ছিলেন সম্পর্কে দাদা হবেন। তিনি ছিলেন ঠুয়া পাগল। মসজিদে নামাজ পড়তে যাবেন। নামাজের সময় সবাই যখন সেজদা দিবে ঠিক তখনি তিনি পেছন থেকে ঠুয়া দেন। একবার মসজিদে মোয়াজ্জেনের পাশে বসে ইমাম সাহেবের পেছনে ঠুয়া দিয়েছেন। সবাই মিলে এমন মাইর দিছে বেচারার হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। আম্মার ধারণা বংশের এই গুণটা কিছুটা আমার মাঝে আছে। এ নিয়ে আম্মা বড় টেনশনে থাকেন। আমার ধারণা জ্বর হলে নাকি আমার মাঝে পাগলামির নমুনা দেখা যায়। আমি আম্মার ধারণাকে সঠিক প্রমাণের জন্য ইচ্ছা করেই একটু পাগলামি বেশি করি।
ছোট মিয়ার গিটারটা নিয়ে আব্বাহুজুরের ঘরে ঢুকলাম। আব্বাহুজুর লেপের ভেতর শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলেন। গিটারসহ আমাকে দেখে বললেনঃ
–কিরে এসব কি?
-কিছুনা।
–ছোট মিয়ার গিটার বের করছিস ক্যান। গত সপ্তাহে নাকি তুই গিটারের তার ছিঁড়ে ফেলছিলি আজকে আবার হাতে নিছস।
আব্বারহুজুরের কথার জবাব না দিয়ে লেপের ভেতর থেকে তার পা দুটো ধরে একটানে বের করে সালাম করলাম। আব্বাহুজুর বললেনঃ
–সালাম করতেছিন ক্যান, মাথা টাথা ঠিক আছে তো?
কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। গিটারের তারে আঙ্গুল বুলিয়ে মোটা কন্ঠে জোরে জোরে গান শুরু করলামঃ
-বয়স আমার বেশি না ওরে টুকটুকির মা চুল কডা পাহি গেছে বাতাসে, আহা বাতাসে, ওহো বাতাসে, বাম চিকি বাম চিকি বাতাসে।
গান শুনে আম্মা দৌঁড়ে আসছেন। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললেনঃ
–আলিফ দরজা খুল।
-ক্যান?
–তোর মাথায় পানি ঢালবো।
-আম্মা আপনি আমারে পাগল ভাবেন? সো স্যাড।
এদিকে জ্বর বাড়ছে। একগ্লাস পানির সাথে দুটো নাপা গিলে ফেললাম। দুমিনিট পরে আব্বাহুজুর দরজা ধাক্কানো শুরু করলেনঃ
–আলিফ রাতের বেলা কি শুরু করছস এসব?
-গান গাই আব্বা।
–গান গাচ্ছিস নাকি টর্চার করতেছিস?
-আব্বা আমি মারা যাইতেছি।
–হো জ্বরে কেউ মরেনা। দরজা খুল।
-আব্বা একটা গান শুনেন। আমিতো মরে যাবো চলে যাবো রেখে যাবো সবি, আছো নাকি সঙ্গি সাথী সঙ্গে নি কেউ যাবি… তুরুরু তুরুরু…
–তুরুরু তুরুরু আবার কি?
-মিউজিক আব্বা…
–তুই দরজা খুল।
-সম্ভব না। আব্বা আপনার পকেট থেকে যতো টাকা চুরি করছি মরে গেলে সেগুলা মাফ দিয়েন। আমার পা ঠান্ডা হয়ে আসতেছে আমি মরে যাচ্ছি। ইয়া হাবিবি কেউ বাঁচাও আমাকে। ওহ্ সরি মাই মিসটেক লেপের ভেতর থেকে পা বাইর হইয়া গেছিলো সেজন্য পা ঠান্ডা হইছে। ভুল তথ্য দেয়ার জন্য সরি আব্বা।
–তুই বের হবি কি না?
-না, আমি জানি আপনি স্যান্ডেল হাতে নিয়া দাঁড়ায় আছেন। সুতরাং বের হওয়া পসিবল না। যা বলার বাহির থেকে বলেন।
–তুই বের হো মারবোনা সত্যি।
-নো… আপনি আরেকটা গান শুনেন। বেবি ডল মে সোনে দি… ও বেবি ডল মে সোনে দি……
ঘরে বসে বুঝতে পারতেছি আব্বাহুজুর স্যান্ডেল নিয়া পায়চারি করতেছেন। ভুলেও যদি দরজা খুলি তাহলে স্যান্ডেল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। মেহমানের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। তার হাসির শব্দ সুন্দর। কানের মধ্যে সুড়ের মতো বাজে। গান চলতে থাকলো। বেশ কিছুক্ষন পরে দেখি বাইরের আবহাওয়া চুপচাপ। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে গেছি আব্বাহুজুর আছে কিনা। জানালার সামনে দাঁড়াতেই আব্বা গ্রিল দিয়ে হাত ঢুকিয়ে শার্টের কলার চেপে ধরছেন। ভয়ে উলালা বলে চিৎকার দিছি।
–দরজা খুল।
-আপনি কলার ছাড়েন।
–কি পাগলামি শুরু করছিস?
-আমি কি করলাম। গান গাওয়া অন্যায়?
–গান গাচ্ছিস নাকি গানের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু করছিস? বাম চিকি বাম চিকি তুরুরু তুরুরু এসব কি?
-আব্বা কলার ছাড়েন।
–আগে ওয়াদা কর কলার ছাড়লে দরজা খুলবি।
-ওয়াদা না করলে ছাড়বেন না?
–না।
-নো প্রব্লেম শার্ট নিয়া যান।
শার্ট খুলে দিয়ে আবারো গিটার হাতে নিলাম। এক ঠ্যাং বিছানার উপরে অন্য ঠ্যাং ফ্লোরে দিয়ে গিটারে স্বজোরে আঙ্গুল বুলাতেই দুখানা তার ছিঁড়ে গেলো। খাইছে ছোট মিয়া আমারে ছাড়বোনা। ভদ্রমতো গিটার রেখে লেপ নিয়ে শুয়ে পড়লাম। জ্বর বাড়ছে।
শেষ রাতে দরজা খুলে বের হলাম। মাথা ঘুড়ছে। ঠিক মতো হাঁটতে পারছিনা। হেলুসিনেশন হচ্ছে নাকি বাস্তব সেটা বুঝতে পারছিনা তবে খুব রূপবতী এক মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি। বারান্দার দাড়িয়ে মগে করে কিছু একটা খাচ্ছে সাথে গুনগুন করছে। বাহ কি মিষ্টি কন্ঠ। আমি নিশ্বব্দে পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার উপস্থিতি সে এখনো টের পায়নি।
-আপনার গানের কন্ঠ তো বেশ ভালো।
মেয়েটি পেছন ফিরে তাকালোঃ
–ও আপনি। ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। জ্বর কমেছে আপনার?
-জ্বি না।
–অষুধ খেয়েছেন?
-দুটো নাপা একসাথে খেয়েছি। তবুও কাজ হচ্ছেনা।
–আচ্ছা আপনি তখন আঙ্কেল আন্টির সাথে অমন করলেন কেন?
-আমি পাগল মানুষ, কি করি ঠিক নাই।
–আপনি মোটেও পাগল না। আপনি ইচ্ছা করেই এমন করেছেন। যাই হোক আপনার কান্ডকীর্তি দেখে প্রচুর হেসেছি।
জ্বরের কারনে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। মেয়েটা না ধরলে হয়তো পড়ে যেতাম। মেয়েটা ধরে এনে শুইয়ে দিলো। জ্বরের ঘোরে বুঝতে পারছি কেউ একজন মাথায় পানি ঢালছে। মেয়েটা মাথার নিচে প্লাস্টিক দিয়েছে, বালতিতে করে পানি নিয়ে এসেছে। মগে করে পানি ঢালছে। বেশ ভালো লাগছে। মেয়েটার মুখটা দেখতে পাচ্ছি। কি সুন্দর কি সুন্দর। এতো সুন্দর মেয়েদের দাঁত বাঁকা থাকে। অনেকের বাঁকা দাঁত পছন্দ না। আমার বাঁকা দাঁতের হাসি কেন যেন খুব বেশি পছন্দ। ছোট থেকেই পছন্দ। মেয়েটা তোয়ালে দিয়ে বালতি নিয়ে চলে গেলো। মাথা মুছে দেখলাম টেবিলের উপরে মগে করে চা রাখা। গলাটা ব্যাথা করছে চা টা দরকার ছিলো। কিছু মেয়ে আছে যাদের মাঝে মমতাটা একটু বেশি বেশি থাকে। আমার এক বান্ধবীকে দেখেছি কলেজের পাগলটাকে রিক্সা ভাড়ার টাকাটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে।
সকাল সকাল আম্মা জোর করে ধরে অষুধ নাস্তা খাইয়ে মাথায় হুজুরের পড়া তেল চপচপ করে দিয়ে দিলেন। মেয়েটা তখনো ঘুমাচ্ছিলো তাই বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তারসাথে দেখা হয়নি।
পরীক্ষার হলে বসে আছি কিছুই পড়িনি লিখবো কি। স্যাররা দু ঘন্টার আগে খাতা জমা নিবেন না। কি আর করার বসে বসে মেয়েটার কথা ভাবছি। ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো পেছনের সিটের মেয়েটা। সারাবছর এরা আপনাকে চিনবেনা। এক ধরনের ভাব নিয়ে বেড়াবে। যেন আপনার সাথে কথা বললেই আপনি তাকে প্রপোজ করবেন এমন ভাব। কিন্তু পরীক্ষার দিন এমন আন্তরিকতা দেখাবে যেন আপনি তার চাচাতো বয়ফ্রেন্ড হন।
যেটা বলছিলাম পেছনের মেয়েটা টিশার্ট ধরে টান দিলো।
–দোস্ত এটা লিখছিস?
-কিছু লিখিনি। পড়িনাই কিছু যা পারিস লিখ। ডাকাডাকি করিসনা।
কথাটা বলে লাভ হয়নি। দুমিনিট পরপর টিশার্ট ধরে টান মারে। স্কেল দিয়ে গুঁতো দেয়। ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গলো যখন কলমের ছুঁচোলো দিক দিয়ে পেছনে গুতো দিলো। দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলাম প্যান্টের কাপড় ফুটো হয়ে গুতো লেগেছে। মেজাজটা এতো খারাপ হয়ে গেলো যে পেছন ফিরে তার মাথা ধরে বেঞ্চের সাথে ঠুয়া মারছি। এমনিতে ক্লাসটা নিশ্চুপ ঠুয়া মারার ঠক শব্দে সবাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটা রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর হাত দিয়ে কপাল ডলতেছে। স্যার এসে বললেনঃ
–এটা কি হলো?
-স্যার সে আমার পেছনে কলম দিয়ে গুঁতো দিয়েছে।
–তাই বলে তুমি একটা মেয়ের মাথা ধরে বেঞ্চে ঠুয়া মারবে।
-তখন থেকে ডিষ্টার্ব করতেছে স্যার। দেখেন টানতে টানতে টি শার্টের একটা সাইডে লম্বা করে ফেলছে।
–দেখি তোমার খাতা দেখি। কি করছো খাতায়? কার ছবি আঁকছো?
-স্যার প্রশ্ন কমন পড়েনি।
–তুমি খাতা নিয়ে ডিপার্টমেন্ট হেডের কাছে যাও। সে অনুমতি দিলে পরীক্ষা দিবে নাহলে না। যাও।
ডিপার্টমেন্ট হেড চায়ে টোস্ট ডুবিয়ে খাচ্ছেন আমি সামনে বসে আছি। আমার বাসায় ফোন দেয়া হয়েছে গার্জিয়ান আসছে। স্যারকে কতোবার বললাম স্যার আমার বয়স আঠারো পেরিয়েছে যা বলার আমাকে বলেন। কিন্তু তিনি নাছোড় বান্দা বাসায় নালিশ না দিয়ে ছাড়বেন না। দরজা দিয়ে সেই মেয়েটা আসলো। আম্মা নাকি তাকে পাঠিয়েছেন। মেয়েটা পাশের চেয়ারে বসলো। ডিপার্টমেন্ট হেড বললেনঃ
–আপনার নাম কি?
-রাত্রি।
–সে আপনার কি হয়। চেহারা দেখে তো মনে হয়না আপনারা ভাই বোন।
-জ্বি আমি ওর হবু ওয়াইফ। আসলে ওর কাল থেকে অনেক জ্বর জ্বরের ঘোরে কি না কি করেছে। তার পক্ষ থেকে আমি সরি বলছি।
–ইটস অক্কে তাকে সাবধানে রাখবেন। খাতায় আর্ট করা ছবিটা আপনার তাইনা?
জানতে পারলাম মেয়েটার নাম রাত্রি। রাত্রি ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখলো তারপর আমার দিকে তাকালো। রিক্সায় পাশাপাশি বসে বাসায় ফিরছি রাত্রি নামের মেয়েটার সাথে। কলমের গুঁতো আর মেয়েটাকে ধরে বেঞ্চে ঠুয়া মারার ঘটনা শুনে মেয়েটা তখন থেকে হাসছে। কোন ভাবেই তার হাসি থামছেনা। হাসতে হাসতে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তবুও হাসি থামছেনা। আমি তার হাসি দেখছি, বুঝতে পারলাম তার বাঁকা দাঁতের হাসির প্রেমে পড়ে গেছি।।